ব্রীজ ভেঙে পড়লে : মৃদুল শ্রীমানী

ব্রীজ ভেঙে পড়লে : মৃদুল শ্রীমানী
ব্রীজ ভেঙে পড়লে : মৃদুল শ্রীমানী

একটা পা , মহিলার একখানা কাটা পা, উঁচু হয়ে থাকে। ব্রীজ ভেঙে পড়েছিল শহরের। ব্যস্ত এলাকায়। মহীনের মা গিয়েছিল ঠাকুর প্রণাম করতে। যেমন প্রতি সন্ধ্যায় যায়। অভ্যাস। ফেরার পথে ব্রীজ ভেঙে ঘাড়ে পড়েছিল। সাথে সাথে মৃত্যু। শুধু একখানা পা হাঁটুর নিচ থেকে ছিল না। মহীন ছোটো বেলায় বাবাকে হারিয়েছে। পাতি কেরানি মানুষটার ব্লাড ক্যানসার হয়েছিল। মহীনের মা অনেক দেবতার কাছে কেঁদেছিল। উপবাস করেছিল। তাগা তাবিজ। হত্যে দিয়েছিল। দণ্ডী খেটেছিল। কিছুতেই কিছু হয় নি। কিছুতেই কিছু হয় না। সেটা মহীন জানত। মায়ের অতো আকুতি সত্ত্বেও দেবতা সাড়া দেন না। দিতে জানেন না। ছোটবেলায় বিধবা মাকে বার ব্রত তিথি উপোস করতে দেখে মহীন রাগ করত। তাকে রাগ করতে দেখে মা চোখের জল ফেলতেন। কিন্তু ধর্ম বিশ্বাস ছাড়তেন না। মায়ের চোখের জল দেখে মহীন চুপ করে যেত। মা চুপ করতেন না। নিয়ম করে দুবেলা শহরের ব্যস্ত এলাকার মন্দিরে মাথা ঠুকতেন। মাথা ঠোকো কেন মা? মাথা ঠুকলে কি হয়? মা কোনো উত্তর করতেন না। শেষের দিকে মহীনের আর কিছু বলতে ইচ্ছে হত না। 

ব্রীজ ভেঙে পড়ে যখন চারদিক সমালোচনায় উত্তাল, কার দোষে, কার অবহেলায় নির্মীয়মাণ ব্রীজ এভাবে ভেঙে পড়ে, তখনো মা সন্ধ্যা গড়ালে নির্দিষ্ট দেবস্থানে প্রণামান্তে ঘরে ফিরে আসে নি দেখে বুক তার ছাঁৎ করে উঠেছিল। এক একাই মাকে খুঁজতে বেরিয়েছিল মহীন। চারদিকে ভিড়। জটলা। কুতূহলী মানুষকে নিয়ে জেরবার প্রশাসন। সকলের সব কিছু তখুনি তখুনি জানা চাই। সকলেই সবজান্তা। মহীনের মাথায় কোনো সমালোচনা আসছিল না। সে শুধু বুড়ো মা টাকে দেখতে পেলে হিড় হিড় করে টানতে টানতে ঘরে এনে ঢোকাবে। উদ্বেগে সে শ্রান্তি বোধ করতে করতেও  এলাকার প্রতিটি মন্দির আর তার প্রতিটি অন্ধকার কোণ অনেকবার করে খুঁজে ফেলল। গোটা এলাকাটা বার বার পায়ে হেঁটে আঁতি পাঁতি করে খুঁজে ফেলল। এ রকম অনেকবার। মা নেই। কোথাও নেই। গ্যাস কাটার দিয়ে কাটা হচ্ছে ভেঙে পড়া ব্রীজের লোহার কাঠামো। জেসিবি পে লোডার দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হবে কংক্রিটের ভারী জঞ্জাল। আত্মীয় স্বজন নিয়ে নিজের হারানো লোক খুঁজতে বেরিয়েছে অনেকে। মহীনের গলির লোকেরা মহীনকেও খুঁজতে বেরিয়েছে। তাদের একজনের হাত ধরে ছেলে মানুষের মত কেঁদে উঠল মহীন। মাকে কোথাও পাচ্ছি না।
অনেক রাতে পাওয়া গেল। মা নয়। মায়ের শরীর। একটা পা হাঁটুর নিচ থেকে ছিল না। মায়ের শরীর টেনে বের করে থানায় জানিয়ে অন্ত্যেষ্টি করে এল তারা। তখন খবর এল একখানা কাটা পা পাওয়া গিয়েছে। মহীন তখনই ছুটল অকুস্থলে। পাড়ার লোকেরা তর্ক তুলল এই বার পা খানা নিয়ে কি করা যায়। মহীন হাঁপাচ্ছে। এই পা খানা এত ক্ষণ কোথায় গিয়েছিল? মরা মা কে ফেলে কাটা পা খানা কি তল্লাশ নিচ্ছিল আর কে কে চাপা পড়ে রইল ধ্বংসস্তুপের ভিতর? না কি সবার চোখের অগোচরে কাছের মন্দিরে গিয়ে দেবতার কৈফিয়ত দাবি করছিল?

সরকারি অফিসার এসে মহীনের পিঠে হাত রাখতে সে ধীরে ধীরে তাঁর হাত সরিয়ে দিল। সরকারি কর্তা মাথা নিচু করে সরে গেলেন। মাথাটা একটু টলে যেতেই তাকে আঁকড়ে নিল পাড়ার লোকেরা। তার পর কি কি হয়েছিল, চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে কি কি কৃত্য তাকে দিয়ে করানো হয়েছিল, সে সব কিছুই আর মহীনের মনে নেই।

শুধু কাছে দূরে কোথাও ব্রীজ ভেঙে পড়লে একটা কাটা পা তার অবচেতনায় উঠে আসে। কাকে যেন লাথি দেখাতে থাকে।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.