প্যামেলা : ঈদারুল ইসলাম

প্যামেলা : ঈদারুল ইসলাম
প্যামেলা : ঈদারুল ইসলাম

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে, সবে মাত্র দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী প্যামেলা রোজাস অনেক স্বপ্ন নিয়ে তার পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। খুব মেধাবী শিক্ষার্থীদের আওতায় আনা না গেলেও ছাত্রী হিসেবে নেহাৎ মন্দ ছিল না প্যামেলা । রূপে-গুণে অপরূপা প্যামেলার চোখে-মুখে তখন একটাই প্রশ্ন কি করে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় ? এই লক্ষ্যে সে পড়াশুনোর সাথে সাথে সেলাই শেখা থেকে শুরু করে বিভিন্ন হাতের কাজ, গান, নাচ, আবৃত্তি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শিতার সাথে শিক্ষালাভ করে এবং পড়াশুনোর পাশাপাশি হাতের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী ও খাতা, কলম, পেন্সিল ইত্যাদি বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে নিজের মতো করে স্বাবলম্বী হয়ে চলার পথে ব্রতী হয়। বাড়ির আর্থিক অবস্থা খুব একটা খারাপ ছিল না; দু-ভাইয়ের মাঝে একমাত্র আদুরে মেয়ে সে। বেশ ভালোই চলে যাচ্ছিল সব কিছুই; এমন সময় হঠাৎ করে একদিন প্যামেলার একটা প্রোগ্রামে পারফরম্যান্স দেখে ছেলে পক্ষের তরফে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান হয়। প্রথমটায় বাড়ির বড়রা রাজি না হলেও ছেলে কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মী এবং ভালো মাইনেও পায় তার উপরে একমাত্র ছেলে হওয়ায় মানা করতে পারে না। এদিকে প্যামেলা কিছুতেই এই বয়সে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিল না; তার চোখে তখন একটাই স্বপ্ন ক্যারিয়ার গড়তে হবে।

কিন্তু শেষ রক্ষে আর হল না ! বাড়ির চাপে এবং বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্যামেলা অনেকটা বাধ্য হয়েই জাবেদ মাহমুদ-এর সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে তার জন্য ঠিক কি অপেক্ষা করছে তা স্বপ্নেও কল্পনা করে নি সে। বিয়ের প্রথম রাত থেকেই শাশুড়ির মানসিক নির্যাতন শুরু হয়; শুভদৃষ্টি হলেও ছেলেকে বৌমার কাছে কিছুতেই ছাড়তে চান নি জাবেদের মা ! রাত্রে সবার অলক্ষ্যে ছেলেকে যে নিজের ঘরে নিয়ে যান তা কাক পক্ষীতেও টের পায় নি ! প্যামেলা কিছু বুঝে উঠবে তার আগেই জাবেদকে ক'দিনেই কর্মসূত্রে বাইরে চলে যেতে হয়।

এদিকে ক্রমশঃ শ্বশুর বাড়িতে মানসিক নির্যাতন শারীরিক রূপ নেয় ! কথায় কথায় গায়ে হাত দেয়া থেকে শুরু করে সারাদিন অভুক্ত রেখে রাত্রে যৎসামান্য খেতে দেয়া হতো। বাড়ির সাথে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়; ক'দিনেই জাবেদ বাড়ি ফিরে এলে প্যামেলা সব খুলে বলবার জন্য বহুবার চেষ্টা করার পরেও শাশুড়ির কড়া নজরদারিতে ব্যর্থ হয়। দুজনে মিলে যাতে একটু প্রাণ খুলে কথা বলতে না পারে তার জন্য সব ধরনের কৌশলই অবলম্বন করা হয়। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে দুটি প্রাণ কখন যে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় তা কেউই বুঝতে পারে নি; এমন কি জাবেদের মাও না !
প্যামেলা সব মেনে নিয়ে রঙিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে এমন সময় হঠাৎ করে সকালে একটু বমি সহ ঘুম থেকে উঠতে আলস্য দেখা দেয়। জাবেদের মা সব বুঝতে পেরে ছেলের কাছে খবর পাঠায় যে,

-- তোর বউ ভ্রষ্টচরিত্র নারী; কোথাকার পাপ যে পেটে পালছে কে জানে ?
-- বল লম্পট,  কার পাপ পেটে পালছিস ?
কার কার সাথে যে মুখ কালা করে বেরিয়েছে কে জানে ?
-- এই সন্তান যে আপনার বংশের প্রদীপ মা ! এ যে আমার আর জাবেদের ভালোবাসার নিশান।
--- হতেই পারে না ! আমি বিশ্বাস করি না ! তোমরা তো কোনোদিনই মিলিত হও নি; তবে এই সন্তান জাবেদের হবে কোত্থেকে ?
-- আপনি জানেন না মা, এইবার যখন আপনার ছেলে বাড়ি এসেছিল; তখন আমরা মিলিত হয়েছিলাম।

জাবেদের মা কিছুতেই মানতে নারাজ । সারারাত জেগে প্যামেলার উপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয় ; কিন্তু প্যামেলার উত্তর একটাই ছিল।

পরের দিনই জাবেদ বাড়ি এলে সেও একই প্রশ্ন করে যে,
--- এই সন্তানের জনক কে ? তুমি এতটা নীচে নামতে পার স্বপ্নেও ভাবি নি !
--  অন্ততঃ তুমি তো আমায় বিশ্বাস কর। আমি তোমাকে মিথ্যে বলছি না; এই সন্তান তোমার আর আমার ভালোবাসার উপহার। একে অস্বীকার কোরো না, প্লিজ?
-- আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না, চরিত্রহীনা নারীর কোনো কথাই আমি বিশ্বাস করতে চাই না । তুমি এক্ষুণি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও।
-- প্লিজ,জাবেদ এতটা নিষ্ঠুর হয়ো না !  আমাদের সন্তানের কথা একবার ভেবে দেখ। সে কোন পরিচয়ে বাঁচবে ?
-- আমি অতশত বুঝি না ! এই পাপের কোনো দায়িত্ব পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। প্লিজ,তুমি চলে যাও।

প্যামেলা বাড়ি ছাড়ার সময় হাতে পায়ে ধরে অনেক কেঁদেছে; কিন্তু ওই রাতের অন্ধকারেই তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হয়।
প্যামেলার বাড়ির লোকজন বিষয়টা আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নেয়ার বহুবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও শেষ অবধি মামলা কোর্টে পৌঁছায়।
সেই সময় ডিএনএ টেস্টের প্রচলন না থাকায় বিচারকের পক্ষে রায় দিতে কষ্ট হচ্ছিল।

ততদিনে প্যামেলাএক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির সকলের সামনে প্যামেলার প্রতি একটাই প্রশ্ন করেন যে,

--- সন্তানের পিতা কে সেটা কেবলমাত্র জন্মদাত্রী মা ই বলতে পারবেন। এক্ষেত্রে আপনার কিছু বলার আছে ?
প্যামেলার অশ্রুর বাঁধ ভেঙে যায়; সে চিৎকার করে বলে ওঠে যে,
--- এই দেখুন জাজ সাহেব, মেয়ে কার মত দেখতে হয়েছে ? যদি এটা জাবেদের সন্তান না হয় তবে হুবহু জাবেদের মত দেখতে হল কি করে ?

জাবেদ এই প্রথমবারের মতো মেয়ের মুখ দেখে বিস্মিত হয়ে যায় !
--- আমি এ কি করেছি, নিজের সন্তানের অস্তিত্ব আমি কি করে অস্বীকার করতে পারলাম ! প্যামেলা তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও। মেয়েকে নিয়ে ফিরে এসো; আমরা আবার নতুন করে সব শুরু করি।
--- জাজ সাহেব, আপনি অর্ডার দিন । আমরা ডিভোর্স চাই না। আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিন।

কিন্তু ততো দিনে বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে। প্যামেলা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে অনেকটাই শক্ত অবস্থানে পৌঁছে গেছে; যেখানে দাঁড়িয়ে আর কাউকে ক্ষমা করা সম্ভব নয়। এই দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর যাবৎ মেয়েকে নিয়ে যে জীবন সংগ্রাম সে চালিয়েছে তার হিসেব কেউ রাখে নি। ততদিনে সে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে সেই সাথে খাতা, পেন ও পেনসিলের ব্যবসাটাও একটা জায়গায় দাঁড় করিয়েছে।
ম্যাজিস্ট্রেট তার রায়ে পরিষ্কার করে বলে দেন যে,
--- এই সন্তানের পিতা যে জাবেদ তা বলার অবকাশ রাখে না। সেই সাথে কোর্ট এটাও বলে যে দুজনকেই কিছুদিন সময় দেয়া হল; যদি ক্ষমা করে প্যামেলা ফিরে যেতে চায় যেতে পারে। অন্যথায় মা-মেয়ের ভরণপোষণ বাবদ অর্থ চাইলে জাবেদ সেটা দিতে বাধ্য থাকবে।
কিন্তু প্যামেলা আর ওই নরকে ফিরে যেতে রাজি হয় নি এবং কোনো আর্থিক সাহায্যও  প্রত্যাখ্যান করে।

অনেক কষ্টে স্বাস্থ্য দপ্তরে একটা চাকুরী হয় সেই সাথে ব্যবসাটাও ভালো চলছে। ততদিনে মেয়ে এঞ্জেলিনা ও ভালো রেজাল্ট করে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে।  মা-মেয়েতে বেশ শান্তিতেই আছে; হঠাৎ এতদিন পর ফেসবুকের মাধ্যমে মেয়ের ছবি দেখে জাবেদের পিতৃস্নেহ জেগে ওঠে ! সে এঞ্জেলিনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করায় মেয়ে বাবাকে পরিষ্কার অস্বীকার করে এই বলে যে,
-- আপনি তো আমার বাবা হতে পারেন না ! যে পিতা একদিন অন্যের কথায় আমার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমার মায়ের ভালোবাসার অপমান করতে পেরেছে, সে কখনো আমার বাবা হতে পারে না ! আমি ক্ষমাপ্রার্থী, মি.জাবেদ ।।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.