বিনয় মজুমদার আমার প্রিয় কবি। প্রিয় `কবি মানুষ' বললে ঠিক বলা হয়। কেন না, বিনয়দার কবিতা নয়, কবি জীবন আমাকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল। বিনয়দা ১১ ডিসেম্বর মারা যান। তার আগে আমি কোনোদিন বিনয়দার কবিতা পড়েছিলাম কি না, তা আমার স্মরণে নেই। আমি তাঁকে খুঁজে পাই ২০০৬ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। আনন্দ বাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় আমার সঙ্গে বিনয়দার যোগসূত্র তৈরী করে দেন। তখন তিনি মৃত। ভাবুন, তাঁর মৃত্যুর পর একটি দৈনিক কাগজে তাঁকে নিয়ে লেখা আর্টিকেল থেকে আমি কবিকে চিনি। সে বছর আমার প্রথম কাব্য পুস্তিকা `লেনিনের ভাস্কর্য' প্রকাশিত হয়। আমি পেশাদার লেখক নই। তখন আমি জীবিকার পাশাপাশি কবিতার জগতে ইতিউঁতি উঁকি মারছি। চিত্তরঞ্জন রেলইঞ্জিন কারখানার শিল্পাঞ্চলের পরিবেশে সাহিত্য চর্চাও তখন আমার কাছে এক অতীব বিড়ম্বনার। সে আলোচনাও আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। তবে তা অন্যত্র কখনো করবো।
যাইহোক, শত ব্যস্ততার ভিতরেও বিনয় মজুমদারের জীবনের সঙ্গে আমার জীবনকে মিলিয়ে ফেলছিলাম বেশি করে। ছোটবেলা থেকে ভাবতাম কবিতা লিখে জীবন কাটিয়ে দেব। তখন তো জীবনের এতো প্যাঁচ বুঝতাম না। শুধু জানতাম, লিখলেই সম্মান, সমাদর। লেখাতে এতো দলবাজি, এতো পার্টিতে বিভক্ত জানতে জানতে সময় পেরিয়ে কখন জীবনের কঠিন বাস্তবতায় চলে এলাম, বুঝতেই পারলাম না। তখন অবশ্য না বুঝেই শুরু করলাম বিনয় মজুমদারের নামাঙ্কিত একটি পুরস্কার `বিনয়পদক'। ২০০৭ সাল থেকে একসঙ্গে দুটি কাজ শুরু করলাম। `মুকুর' নাম একটি কবিতা সংকলন সম্পাদনা এবং `বিনয়পদক'।
এখানে `মুকুর' নিয়ে আলোচনা করবো না। শুধু `বিনয়পদক' নিয়ে আলোচনা করবো। এবং বিনয় মজুমদার নিয়ে আলোচনা করবো। ২০০৭ সালে কোন কবিকে সাহিত্য সম্মান প্রদান করা হবে, তা নির্ণয় করার দায়িত্ব নিলেন বাংলাসাহিত্যের অন্যতম কবি, আমাদের সকলের নমস্য প্রয়াত কবি মনীন্দ্র গুপ্ত। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের ভূমিকায় আমি আর সভাপতি মাননীয় মনীন্দ্র গুপ্ত। সুতরাং আমাকে নিতে হবে অনেক দায়িত্ব। টাকা জোগাড় করা, অনুষ্ঠানের আয়োজন করা, এবং সবকিছু মানসম্মত ভাবে সম্পাদনা করা। কেন না, এই কাজটির সঙ্গে বিনয় মজুমদারের নাম জড়িয়ে আছে। এবং সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন মণীন্দ্র গুপ্ত।
সাধারণ কথায় কাজগুলোকেও সাধারণ মনে হতে পারে। কিন্তু যাদের কাজের অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা নিশ্চয় জানেন, অলাভজনক কোনো কাজের ক্ষেত্রে কি পরিমান পরিশ্রান্ত হতে হয়। আজকের সমাজে মিডিয়া ডেকে দেন করার পক্ষে সবাই। আমার মিডিয়া ছিল না, তাই ডোনেশন তোলার ক্ষমতাও ছিল না। নিজের তহবিল থেকে সেবার আমাকে ব্যয় করতে হলো খরচের সব টাকা। তবু কোথাও একটা চরম আনন্দের অনুভূতি হতে লাগল। ত্রিপুরা থেকে কবি শুভ্রশংকর এলেন। ডাকসাইটে সব বড়ো বড়ো কবিরা এলেন অনুষ্ঠানে। কিন্তু মিডিয়া এলেন না।
অনুষ্ঠান শেষ হয়ে সপ্তাখানেক অতিবাহিত হয়ে যেতে কিছু আলোচনা সমালোচনা কানে আসতে লাগলো। কেউ দরাজ গলায় বাহবা দিলেন, কেউ ঈর্ষায় মুষড়ে গেলেন। তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেঁচে ছিলেন। ফোনে করে বিস্তারিত বললাম। খুশি হলেন। বললেন, জয় একসময় বিনয়ের সঙ্গে খুব যোগাযোগ রাখতো। তুমি ওর সঙ্গে কথা বলো, ও তোমাকে আরো পরামর্শ দিতে পারবে। আমি জয় গোস্বামীর সঙ্গে পরের দিন কথা বলি। জয়দা, খুবই খুশি হলেন। এবং আমাকে উনার পত্রিকা অফিসে দেখা করতে বললেন। তারপর থেকে মনে একটা সাহস তৈরী হলো।
যার ওপর কাজ করছি, তাকেও একটু একটু করে জানছি। বিনয়দার সম্পর্কে জানতে দুজন মানুষ প্রাথমিক ভাবে সাহায্য করেছিল। একজনের নাম আপাতত বলছি না। অন্যজন সুকৃতি শিকদার। সুকৃতি যা তথ্য দিয়েছে, তার ভিত্তিতে আমার অনেক উপকার হয়েছিল পরবর্তী সময়ে। এখনো সুকৃতি আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন। ওর কবিতা লেখার শক্তি আমাকে অবাক করে বৈকি। আমার বিশ্বাস ও একদিন বিনয়দাকে হারিয়ে দেবে কবিতার লড়াইয়ে। এ আমি কথার কথা বলছি না। কেন না, আমি উপলব্ধি করেছি। অসাধারণ লেখনী, বিষয় নির্বাচন ও প্রকাশ ভঙ্গি যে কাউকে মোহিত করবে।
যাইহোক, আমি ও কবি পার্থ শীল একদিন বিকেলে জয়দার কাছে গেলাম পত্রিকা অফিসে। অনেকক্ষন আলোচনা শেষে চায়ের আসরে আমি আর জয়দা। কিছু গুরুমন্ত্রের মতো পরামর্শ, আজ প্রতিমুহূর্তে আমার জীবনে সুখ বয়ে আনে। জয়দা ভালোবাসতে জানে। যখনতখন ফোন করেছি, রিসিভ করে কথা বলেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাসাহিত্যে ভালো উঁচুমানের কবি লেখকের অভাব নেই। তবে, জয় গোস্বামীর মতো ভালো মানুষের অভাব আছে। বিনয়দা সম্পর্কে এতো অনুরাগ, এতো শ্রদ্ধা, এতকিছু জানেন, আমি কল্পনাও করিনি। অনুশীলন আর অধ্যয়নের যোগগুরু হল জয়দা। বিংশ শতককের গৌরব, বাংলাসাহিত্যের অহংকার তিনি।
আমি তখন ২৪ পরগনার সংহতিতে বসবাস করি। তখন কলকাতা বইমেলা চলছিল। জয়দাকে ফোনে পেলাম। উছ্বাসের সঙ্গে বই মেলায় ডাকলেন। গেলাম। কত ভক্ত আছে জয়দার, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না কেউ। তাঁর সঙ্গে বইমেলার গেট দিয়ে ঢুকছি, মনে হচ্ছিলো আমি যেন কোনো নেতার সঙ্গে জনারণ্যে ভেসে বেড়াচ্ছি। তরুণ তরুণীরা কি অনায়াসে মাথা ঝুঁকে জয়দার পা ছুঁয়ে প্রণাম করছে। এ সবকিছু জয়দার আন্তরিকতার ফল। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, জয় গোস্বামী কাউকে প্রমোট করেন না। আমি একমত তাদের সঙ্গে। কিন্তু তারা হয়তো জানেন না, কেন জয়দা কাউকে প্রমোট করেন না।জয়দা, নিজের যোগ্যতায় নিজেকে বড়ো করার নীতিতে বিশ্বাসী। তার এই ব্যাক্তিত্বময়তাই আমাকে মুগ্ধ করেছে বারবার।
বিনয়পদক একটি সংগঠন হলেও বেশিরভাগ সাহিত্যিকেরা আমাকে ব্যক্তিগত রূপ দিতে চাইতো। ভালো কি মন্দ জানি না, তবে আমি এটাকে সংগঠন হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করেছি। ২০০৯ সালের কথা। তখন উৎপল ঝাঁ বাংলা অকাদেমির সেক্রেটারি ছিলেন। তাঁর ঘরে সৌজন্য আলাপচারিতা চলছিল। তিনি অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। এতো সৌজন্যবোধ আর আন্তরিকতা এ সময়ে খুব কম সাহিত্যিকের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। আমাদের কথা চলছিল, এমন সময় স্যামলকান্তি দাশ উপস্থিত হলেন। আমাকে সকলের সামনে বিনয়পদকের রুদ্রসাগর বলে অভিবাদন জানালো। পরে আমি ব্যক্তিগত ভাবে শ্যামলদাকে আপত্তি জানিয়েছিলাম। কেন না, আমি কবি। কবি পরিচয়ের পর বাকি সব। কিন্তু আমার আপত্তি টিকলো না। ক্রমান্বয়ে আমি বিনয়মজুমদারের গবেষক ও বিনয়পদকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই পরিচিতি পেতে লাগলাম। ২০১৯ এর দুর্গাপুজো সংখ্যার জন্য আসানসোলের আমলদা আমার কাছে বিনয় মজুমদার সম্পর্কে লেখা চাইলেন। সুতরাং আমার কাছে এটা পরিষ্কার, আমার আর কবি হওয়া হলো না।
This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন