![]() |
কর্ণধর মন্ডল |
কোলকাতা নিবাসী প্রিয়তোষ মুখোপাধ্যায়।তিনি একজন স্বৎ ও নিষ্ঠাবান প্রতিভাবান ব্যক্তি।স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে প্রিয়তোষ বাবুর সুখের সংসার। প্রিয়তোষ বাবুর স্ত্রী প্রিয়তমা দেবী একটা প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষিকা।দুই সন্তান ঋতম ও ঋষিতা পড়াশুনা করেন।ঋতম সপ্তম শ্রেনীতে এবং ঋষিতা চতুর্থ শ্রেনীতে।প্রিয়তোষ বাবু নিজে একজন স্বাধীনচেতা মানুষ।বর্তমানে একটি সরকারী উচ্চতর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।বাড়ীতে দেখাশুনা করার জন্য দুজন কাজের লোক রয়েছেন,সত্যকাকা ও মিনতী(মিনু)।সত্যকাকা প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে প্রিয়তোষ বাবুর বাড়ীতে রয়েছেন।সত্যকাকাকে ওনার বাড়ীর একজন সদস্য বললে,খুব একটা কম বা ভুল বলা হবে না।সত্যকাকা প্রিয়তোষ বাবুকে খুব ভালোবাসতেন ও শ্রদ্ধা করতেন।
প্রিয়তোষ বাবু বাবা-মায়ের মুখে শুনেছেন চাকরি নিয়ে যখন সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকতেন,তখন ওই সত্যকাকা প্রিয়তোষ বাবুকে পুত্র স্নেহে দেখাশুনা করেছেন ও লালন পালন করেছেন।সে কথা স্মরণ রেখে কোন দিনের জন্য সত্যকাকাকে কাজের হিসাবে ভাবতে দেননি।এখন সত্যকাকার কাজ হলো প্রিয়তোষ বাবুর ছেলে মেয়েদের নিয়ে রুপকথার গল্প,রহস্যময় গল্প ও অলৌকিক গল্প শুণিয়ে নিজের বার্ধক্যের একাকীত্ব জীবনটা অনায়াসে অতিবাহিত করা।আর বাড়ীতে রান্না ও সংসারের যাবতীয় কাজ করার জন্য রয়েছে মিনতী,যাকে ডাকাতেন সবাই মিনু বলে।প্রিয়তোষ বাবু ও প্রিয়তমা দেবী দুজনেই চাকরি নিয়ে ব্যস্ত।এদিকে বাবা-মায়ের অবর্তমানে ছোট্ট ঋতম ও ঋষিতার মনে দিন দিন এক ঘেঁয়েমি ও একাকীত্ব বাঁসা বাঁধতে থাকে।
দেখতে দেখতে প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও পুজাতে প্রায় কুড়ি দিনের মতো ছুটি পড়েছে।ঋতমের ইচ্ছে ছিল পুজার সময় বাবা-মা'কে বলবে পুজাতে মামার বাড়ীতে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।হঠাৎ কোন কিছু না জানিয়ে প্রিয়তোষ বাবুর বাড়ীতে এসে উপস্থিত অজিত বাবু।সম্পর্কে প্রিয়তোষ বাবুর শালক ও প্রিয়তমা দেবীর বড়ো দাদা।এক ঘেঁয়েমী ও একাকীত্ব কাটানোর জন্য অজিত বাবু অফিসের কাজে ছুটি পেয়ে ,সপ্তাহ খানেকের জন্য ভাগ্না-ভাগ্নী ও বোন-ভগিনীপতিদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য চলে এলেন সুদুর পাটনা থেকে কোলকাতায়।বেশ সাড়ম্বরে কেটে গেল এবৎসর পুজার দিনগুলি। অজিত বাবুর বয়স প্রায় দেখতে দেখতে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই।নিজের কোন সংসার ধর্ম নেই।কারন-উনি পরাধীনতার জীবন কাটাবেন না বলে বিয়ে করেননি।তাই এখন দেখতে দেখতে বয়স বাড়ছে।ঠিক তেমন কাজের ফাঁকে একাকীত্ব ও বাড়ছে।যাই হোক পুজা কটাদিন সবাই হৈহুল্লোড় করে কেটে গেল।
আবার সেই একাকীত্ব ও একঘেঁয়েমীর দিন কাটানোর সময় এগিয়ে আসছে।কারন-অজিত বাবুর বাড়ীতে রওনা দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিয়েছে।ঋতম চাইলো মামা সঙ্গে কয়েক দিনের জন্য যেতে।একথা শুনে অজিত বাবু বেশ খুশীও হলো।বোন প্রিয়তমা দেবী ও প্রিয়তোষ বাবুকে রাজি করিয়ে ভাগ্না ঋতমকে নিয়ে নিজের বাড়ী পাটনার অভিমুখে রওনা দিলেন।ট্রেনে উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে শিশু হৃদয় মুগ্ধ হয়ে গেল।এদিকে ট্রেন এসে নির্দিষ্ট স্টেশনে দাঁড়ালো,মামার হাত ধরে আস্তে আস্তে ঋতম নেমে পড়লেন।তারপর রিক্সায় চাপলেন,প্রায় দু'মাইল পথ অতিক্রান্তের পর অজিত বাবু ঋতমকে নিয়ে নিজের বাড়ীর সন্মুখে উপস্থিত।দু-তিন বার কলিং বেল বাজার পর প্রায় পঁষট্টি কি সত্তর বছরের এক বৃদ্ধ এসে দরজা খুললেন।দু'জনে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করলেন।ঋতম স্ব-ঞ্জানে এই প্রথম মামার বাড়ীতে এলেন।ছোট্ট ঋতম অজিত বাবুকে জিঞ্জাসা করলেন....
মামা এই বৃদ্ধ লোকটি কে ?
সদুত্তরে জানালেন,
........ইনি হলেন সতীশ বাবু।
ছোট্ট বেলায় যখন একটা দুর্ঘটনায় আমার বাবা-মা মারা যান,তখন থেকে ইনিই,আমাকে মানুষ করেন ও দেখাশুনা করে বড়ো করেছেন।আমার সমস্ত কিছু দেখাশুনার ভার এই সতীশ বাবুর উপর।তোমার যখন যা কিছু প্রয়োজন এই সতীশ দাদুকে বলবে।
বেশ কয়েক ঘন্টা পর,বৃদ্ধ সতীশ বাবুর সঙ্গে ঋতমের আলাপ চারিতা হয়।দু'দিন যাওয়ার পর বৃদ্ধ সতীশ বাবুর সঙ্গে ভাব জমে ওঠে ও বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।ঋতম সতীশ বাবুকে দাদু বলে ডাকতেন।ছোট্ট ঋতমকে পেয়ে বৃদ্ধ বয়সের একাকীত্বের অভাবটা, কিছুটা হলেও দুর হয়।সতীশ দাদুর কাছ থেকে প্রতিদিন রুপকথার গল্প,অলৌকিক ভুতের গল্পও রহস্যময় গল্প শুনতো।যতই সতীশ দাদুর মুখে গল্প শোনে ,ততই ছোট্ট ঋতমের মনে কৌতুহল জন্মাতে থাকে।
একদিন ঋতম সতীশ দাদুর সঙ্গে মাইল খানেক দুরে,পাহাড়ের পাদ দেশে একটা লেকের পাশে ঘুরতে গেলেন।বেশ মনোরম জায়গা।
ঋতম দাদুকে বললেন দাদু তুমি আমাকে প্রতিদিন এখানে ঘরতে নিয়ে আসবে।এখানে আমার খুব ভালো লাগছে।এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করতে করতে হঠাৎ খানিকটা দুরে গাছ-গাছালী ঘেরা একটা বাংলোবাড়ী দেখতে পেলো।দেখে যেন মনে হলো বেশ পুরানো।কোন অলৌকিক রহস্যময় জায়গা।সামনে যেন একটা বড়ো জলাশয়ও রয়েছে।চারিদিকে পাকা সান বাঁধানো।এগুলো দেখার পর ছোট্ট ঋতমের মনে কৌতুহল জন্মাতে থাকে।এই ভাবে দু'তিন দিন ঘুরতে আসার পর,ঋতম সতীশ বাবুকে বললো চলো দাদু আজকে ওই বাংলোবাড়ীতে ঘুরতে যাবো।একথা শোনার পর সতীশ বাবু হঠাৎ চমকে উঠলেন।এবং ভয়েতে গায়ের সমস্ত লোম কুপ কাঁটা দিয়ে শিহরিয়া উঠিল।
কারন-সতীশ বাবুতো জানেন,যে এটা একটা অলৌকিক ভুত বাংলো!রহস্যময় বাড়ী।
ওই বাড়ীতে নাট্য-শিল্পী অমৃত বাবু একটা রহস্যময় গল্পে,একটি মুখ্য'ভুমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে প্রাণ হারান।অমৃত বাবুর তিনকুলে কেউ ছিলনা।তাই সেখান থেকে এই বাংলোতে আর কেউ আসেননি।ধীরে ধীরে এই স্থানটি রহস্যময় ভুত বাংলোতে পরিনত হয়।ছোট্ট ঋতমের এমন প্রশ্নের কারনে সতীশ বাবু এই পাহাড় তলীর লেকে ঘুরতে আসা বন্ধ করে দেয়।সেজন্য ঋতমের মনে আরো কৌতুহলী আবেগ আরো বেড়ে যায়।কয়েক দিন যাওয়ার পর,ছোট্ট ঋতমের মনে একটা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসতে থাকে।ওই বাংলোবাড়ীর কথা জিঞ্জাসার পর সতীশ দাদু কেন এমন চমকে উঠেছিল ? একদিন দুপুর বেলা মধ্যাহ্ন ভোজের খাবার খাওয়ার পর,সবাই যে যার ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
কিন্তু,ছোট্ট ঋতম দুটি চোখের পাতা এক করতে পারলো না।চোখ মেললে শুধু ঘুরে ফিরে ওই ''রহস্যময় বাংলোবাড়ীর কথা'' বার বার ছোট্ট কৌতুহলী মনের দরজায় কড়া নাড়তে থাকে।চুপিচুপি কাহুকে না জানিয়ে ওই বাংলোবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।প্রায় দেড় মাইল পথ হেঁটে ওই রহস্যময় স্থানে উপস্থিত হলেন।
কারন-ছোট্ট ঋতম তো জানতো না।কেন,এই স্থানটি রহস্যময় ও কৌতুহলের কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠেছেন।চারিদিকে ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলো।তারপর কিছুক্ষণ জলাশয়ের সান বাঁধানো রকের উপর বসলো।হঠাৎ নজরে পড়লো বাংলোবাড়ীর সদর দরজা খুলে কে যেন একজন ভিতরে প্রবেশ করলেন।সঙ্গে সঙ্গে ঋতম উঠে হাঁটতে হাঁটতে ওই সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায়।এবং তারপর আস্তে আস্তে
দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন।বাংলোবাড়ীর ভিতরে চাকচিক্যময় কারুকার্য দেখে ছোট্ট ঋতমের চোখ ধাঁধিয়ে যায়।মাঝখানে বড়ো মাঠ,চারিদিকে রং-বাহারী ও রং-বেরঙের ফুলের গাছ সারিবদ্ধ ভাবে লাগানো,ঠিক মাঝখান বরাবর একটা জলের ফোয়ারা বসানো রয়েছে।
মাঠের চারিদিকে সারি সারি ঘর গুলো দন্ডায়মান।বাইরে থেকে দরজা লাগানো।ঠিক সন্মুখে বিল্ডিংয়ের উপর সদর দোতলায় একটা রুমে মিটিমিটি তরে আলো জ্বলছে।সামনে বড়ো ব্যালকুনি রেলিং দিয়ে আটকানো।চারিদিকে সারি সারি কাঠের চেয়ার সাজানো এবং মাঝ বরাবর একটা বড়ো ডাইনিং টেবিল পাতা রয়েছে।ওখানে বসে কাজের অবসরে দখিনা বাতাস গায়ে মাখতেন অমৃত বাবু ও তাঁর সঙ্গীরা।
ছোট্ট ঋতম আস্তে আস্তে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে চারিদিকে ঘুরতে লাগলো।যে ঘরটাতে আলো জ্বলছিলো,সেই ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
মনে হলো যেন,
কে ভিতর থেকে কথা বলছে।প্রথমে একটু বিষ্মিত হয়েছিল।কিন্তু পরে ছোট্ট ঋতমের মনে কৌতুহল আরো বেড়ে যায়।
কি আছে ?
এই আছে,এই বাংলোবাড়ীর অন্তঃনির্হিত রহস্য ?
দরজার সামনে গিয়ে ঠক ঠক করলো,ভিতর থেকে কোন সদুত্তর পেলো না।অবশেষে তিন-চার বার সজোরে ধাক্কা মারার পর ধড়াস করে দরজা খুলে গেল।কিন্তু ভিতরে গিয়ে কাহুকে দেখতে পেলো না।পাশের ঘর খুলে দেখলো ঘুটঘুটে অন্ধকার কেউ নেই।পাশে আরেকটা ঘরে দরজা খুলে প্রবেশ করে দেখলেন,মৃদু আলোর আভায় একজন আনমনে আবেগ প্রবন হয়ে,জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছে।আস্তে আস্তে টিপিটিপি পা ফেলে সেই ব্যক্তির দিকে এগিয়ে গেল এবং ভীত সন্ত্রস্ত মৃদু স্বরে ঋতম অচেনা ব্যক্তিকে জিঞ্জাসা করলো!
কাকু!
তুমি এখানে কি করছো ?
সঙ্গে সঙ্গে লোকটি অবাক হয়ে গেল।এতটুকু ছোট্ট বালক এখানে কিভাবে এলো।যেখানে বিগত দীর্ঘ কুড়ি বছর কোন মানুষ়ের ছায়া পর্যন্ত এই বাংলোর মাটিতে পড়েনি।লোকটি এগিয়ে এসে,বালকটিকে জিঞ্জাসা করলো-
তুমি কে ?
কি করতে এসেছো ?
কার সঙ্গে এসেছো ?
ছোটেট বালকটি বলে উঠলো.....
আমি ঋতম!এখানে ঘুরতে এসেছি।
জানো কাকু !!
আমি যখন ঘুমাই,কে যেন আমাকে ডাকে।আয় যাবি না ওই ওখানে ঘুরতে।আমি ঘুমের মধ্যে বলতাম- হ্যাঁ।
আমি প্রতিদিন ঘুরতে যাব।
তখন লোকটি মনে মনে মুচকি হাসলেন।আর বললেন,তোমার মতো নিষ্পাপ শিশুর সংস্পর্শে আমার অপ্রত্যাশিত আত্মার মুক্তি ঘটবে প্রকৃতির বাতাসে বাতাসে।তাই তো!আমি তোমাকে স্মরণ করতাম।
ছোট্ট ঋতম লোকটিকে জিঞ্জাসা করলো.....
কাকু!তুমি কে ?
তুমি কি করো ?
তোম্র আর কে আছে ?
সঙ্গে সঙ্গে লোকটির দু'চোখ দিয়ে অবিরত অনর্গল অশ্রু ঝরতে লাগলো।
আমি একা !
আমার কেউ নেই।
ছোট্ট ঋতম শুনে খুব কষ্ট পেল এবং শিশু হৃদয় ব্যথায় ভরে গেল।
তুমি কেঁদো না কাকু !
আমি প্রতিদিন আসবো তোমার সাথে গল্প করতে।
শুনে খুব আনন্দিত হলেন এবং বললেন আজ থেকে আমি ছোট্ট একটা বন্ধু পেলাম।আর তুমি জানতে চেয়েছিলে,আমি কে.....
আমি হলাম এই বাংলোবাড়ীর মালিক অমৃত মুখোপাধ্যায়।একজন নাট্যকার ও নাট্যপ্রেমী।
তুমি এখানে রোজ আসবে তোমাকে গল্প শোনাবো,নাটকের অভিনয় দেখাবো ।তোমাকে নিয়ে মজা করবো।শুনে তো ঋতম আরো খুশি হলো।এই ভাবে বেশ কয়েক দিন আসা যাওয়া করতে থাকে।কিন্তু ঋতমের মামার বাড়ীর কেউ ভ্রুনাক্ষরে টের পেলেন নাা।অমৃত বাবুর মুখে গল্প শুনতে শুনতে মোহিত হয়ে যায়।একটা শিশু মনে যা হয়।যেখানে ভালোবাসা পাবে সেখানে বার বার মন যেতে চাইবে।
এই ভাবে কয়েক দিন যাওয়ার পর ,অমৃত বাবু ছোট্ট ঋতমকে বললেন,আমি তোমাকে আমার অতীত জীবনের একটা গল্প শোনাবে তুমি ভয় পাবে না তো ?
ঋতম বললেন....
কেন ?
আমি ভয় পাবো কেন ?
তুমি তো আমার কাছে আছো !
শুনে অমৃত বাবু হাসলেন।এইটুকু অচেনা ছোট্ট একটা বালক,আমাকে এতটাই ভালোবাসেন আর ভরসাও করেন।আমি কিভাবে বোঝাবো ওকে,যে আমি মৃত ব্যক্তির অশরীরী আত্মা।কিছুতেই অমৃত বাবু ভেবে উঠতেই পারছেননা।কিভাবে ছোট্ট একটা নিষ্পাপ শিশুর হৃদয়ে আঘাত দেবেন।
কিন্তু,শিশুর মনের কৌতুহল!
অবশেষে অমৃত বাবু ,তাঁর বিগত দিনের সমস্ত ইতিহাস ঋতমকে শোনালেন।শুনে ঋতমের দু'চোখ দিয়ে দুঃখে বিরহের অশ্রু'ঝরতে লাগলো।তারপর অমৃত বাবু বললেন,আমি যে এজগতে মৃত ব্যক্তি।তুমি যাঁর সাথে কথা বলছো,সেটা আমার অতৃপ্ত-আত্মা।
ছোট্ট ঋতম চমকে উঠলেন।সে কি !আমি বিশ্বাস করি না।তুমি আমার সাথে মজা করছো বন্ধু ?
সঙ্গে সঙ্গে অমৃত বাবুর আত্মা বলে উঠলেন এটা বাস্তব ।আমি একা একা অনুভব করেছি একাকীত্ব থাকার যন্ত্রণা।
কিন্তু,আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে ;আমি বাড়ী ছেড়ে চলে আসি।একটা ব্যক্তিগত কারনে।আর সেই একাকীত্ব জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে ভোলার জন্য এই অভিনয়ের পথ বেছে নিয়েছিলাম।একমাত্র অভিনয়ের মাধ্যমে নিজের দুঃখকে তুলে ধরা অথচ অপরকে বুঝতে না দিয়ে।প্রায় কুড়ি বছর আগে একটা মৃত্যুঞ্জয়ী বীর-বিপ্লবীর ভুমিকায় ফাঁসীর মঞ্চে অভিনয় করতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয়।একথা বলতে বলতে ঋতমকে সেই রেওয়াজ কক্ষে নিয়ে গেলেন।
ওই যে দেখছো ?
এই অভিশপ্ত ফাঁস লাগালো দড়িতে আটকে আমি মারা যাই।কিন্তু আমি কাহুকে কোন দিন ক্ষতি করিনি।সবাইকে শুধু আনন্দ দিতে চেয়েছিলাম।তাই আজো আমার অতৃপ্ত-আত্মা সবাই ডেকে বলতে চায়।
হে বন্ধু........
আমার জীবনে অসমাপ্ত নাটকের শেষ অভিনয়টা দেখাতে চাই।তাই তোমার মতো বন্ধু পেয়ে আমি আপ্লুত ও গর্বিত।
তুমি গ্রামে গিয়ে সবাই কে বলো বন্ধু!একবারের জন্য আমার অসমাপ্ত অশরীরী আত্মার শেষ ইচ্ছেটা পুরণ করেন।তাহলে আমার অতৃপ্ত আত্মা মুক্তির উল্লাসে,দীর্ঘঃশ্বাসে চির-বিদায় নিতে পারবে।
একথা শুনে ছোট্ট ঋতম আনন্দে ছুটতে ছুটতে বাড়ী ফিরে সব ঘটনা সতীশ দাদুকে খুলে বললেন।প্রথমে সতীশ বাবু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলেন না।ঋতমের অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর,গ্রাম থেকে বেশ কয়েক জন সাহসী লাঠিয়াল জোয়ানদের নিয়ে ওই রহস্যময় বাংলোর সামনে উপস্থিত হলেন।তারপর ধীরে ধীরে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই চমকে উঠলো।হঠাৎ শুনতে পেলেন বাদ্যযন্ত্রের বাজনার সুর ভিতর দিয়ে ভেসে আসছে।সবাই ভয়ে ভয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকলো।ছোট্ট ঋতম সবাইকে নিয়ে অমৃত বাবুর রেওয়াজ কক্ষের দিকে এগিয়ে চললেন।কারন-ঋতম আগে বার বার এসে সবকিছু জানা হয়ে গিয়েছে।কোথায়, কোন ঘরে কি আছে। ঘরে ঢুকতেই সবাই তমকে উঠলো।নাটকের আসরের মতো বাদ্য-যন্ত্র ও সাজ-সরঞ্জাম চারিদিকে সাজানো গোছানো।পাশের ঘর থেকে অমৃত বাবু এগিয়ে এসে সবাইকে নমস্কার জানালেন।সবাই কে দেখে খুবই খুশীও হলেন।আনন্দিত হয়ে বললেন,আজ আমি সার্থক।নাট্যকার হতে পেরে।আজ আমি অভিনেতা হতে পেরে।
সবাই তো হতবাক হয়ে গেলেন অমৃত বাবুকে দেখে।কি ভাবে হতে পারে ?সেই ব্যক্তি,যে কিনা কুড়ি বছর আগে মারা গেয়েছেন।একই রকম বা দুই ব্যক্তি কিভাবে হতে পারে।এই নিয়ে সবার মধ্যেই আলোচনা করতে শুরু করলেন।
অমৃত বাবু সবাই কে বললেন,আপনাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ।আমার এই স্বপ্নের বাড়ীটাকে আর পরিত্যাক্ত হতে দেবেননা।সাধের স্বপ্ন-মহলটা আমার ছোট্ট বন্ঘু ঋতমকে উপহার দিয়ে গেলাম।পারলে তোমরা এই বাংলোবাড়ীর বুকে প্রতি বছর এমন দিনে নাট্য'নুষ্ঠানের আসর বসাবেন।তাহলে আমার আত্মা চির শান্তি পাবে।এখানেই আমার জীবনে নাটকের অঙ্কের প্রথম দৃশ্যের পরিসমাপ্তি করলাম।একথা বলতে বলতে অমৃত বাবু সবার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট ঋতমের দু'চোখে বেদনার অশ্রু বাক মানলো না।কারন-অমৃত বাবুর জীবনে সবচেয়ে প্রিয় ও আপন ছিলেন ঋতম।হয়তো ও না হলে অমৃত বাবুর পরিত্যাক্ত অসমাপ্ত আত্মার মুক্তি হতোই না।
কিছুক্ষণ পর,একটা দমকা বাতাস বয়ে গেল, আর যেন সবার কানে কানে বলে গেল!অামি চির দিনের জন্য দুনিয়া থেকে বিদায় নিলাম।কিন্তু,সবার স্মৃতির পাতায়!হৃদয় খাতায় রয়ে গেলাম।
আর এই বাংলোবাড়ীর অভিশপ্ত বন্ধন চির-দিনের জন্য মুক্ত করে দিয়ে গেলাম।এরপর থেকে গ্রামের মানুষ সেখানে রোজ বেড়াতে আসেন।কারো মনে সেই অলৌকিক ভয়ের উদ্বেগ আর নেই।ছোট্ট ঋতম এখন জীবনে প্রতিষ্ঠিত।সেই বাংলোবাড়ীর সদরে অমৃত বাবুর মৃত্যু দিবসে,মহা সাড়ম্বড়ে অমৃত বাবুর মুর্তি স্থাপন করে দিয়েছেন এবং মুর্তির পাদদেশে স্বেত পাথরে খদাযিত রয়েছেন ।নাট্যকার ঁঅমৃত মুখোপাধ্যায়ের নাম।
এই ছোট্ট ঋতমের মনের আবেগী কৌতুহলের দ্বারা....
"পরিত্যাক্ত বাংলোবাড়ীর রহস্য"-উদঘাটন হয়।
সেখানে এখন প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের ঢল।বিরহ ব্যথিত মানুষের মনের একাকীত্ব ও মনের দুঃখ ভোলার জন্য এবং দীর্ঘঃ পরিশ্রমের পর স্বস্তির একমাত্র বিনোদনের জায়গা হলো-ঁঅমৃত বাবুর বাংলোবাড়ী।এই ভাবে যুগ যুগ ধরে প্রতিটি মানুষের কাছে,
আনন্দ নিকেতনের একমাত্র স্বপ্নের ঠিকানা............
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন