তৈমুর খানের তিনটি অণুগল্প

তৈমুর খান

তৈমুর খানের তিনটি অণুগল্প 

 

১সন্দেহ
____________

বড় দিঘিতে একটা লাশ ভেসে উঠেছে।
সকাল সকাল খবরটা একেবারে চমকে দিল। সমস্ত গ্রামের মানুষ সেদিকেই ভেঙে পড়েছে। সন্দেহটা আরও মারাত্মক আশরাফ সিদ্দিকীর ছোট মেয়েকে গতকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। পাঁচ বছর বয়স। নার্সারিতে পড়ে। বিকেলে খেলতে বেরিয়ে আর ফিরে আসেনি। তাহলে কি….. সবার মনে একটাই প্রশ্ন।
     চারিদিকে হইচই গন্ডগোল তার মাঝেই কান্নার রোল শোনা যাচ্ছে। দিঘিতে নেমেও পড়েছে দু-তিনজন। ইতিমধ্যে পুলিশের গাড়ি। সবাই চেঁচিয়ে বলছে : থামুন! লাশে হাত দেবেন না! আগে পুলিশের কথা শুনুন!
        আশরাফ সিদ্দিকী নেই। মেয়েকে খুঁজতে সকাল সকাল বেরিয়ে গেছেন। তার বউ বুক চাপড়ে কাঁদছে। খবর ভালো নয় সবাই জানে। বিশেষ করে বাচ্চা মেয়েদের নিয়ে মেয়ের বাবা-মায়ের মনে সর্বদা এক উদ্বেগ।
        পুলিশের বড়বাবু আদেশ করলেন : তুলে আনুন লাশ!
        
        গ্রামের দুই যুবকের চেষ্টায় লাশটি তুলে আনা হল। কিন্তু এ কী! এযে সোনু ডাকাতের লাশ! বেশ কিছুদিন তাকে এলাকায় দেখা যায়নি। আজই হঠাৎ লাশ হয়ে দিঘিতে ভেসে উঠেছে। কারণ কী? সবারই মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আশরাফ সিদ্দিকীর মেয়ে হারানোর সঙ্গে কি সোনু ডাকাতের কোনও সম্পর্ক আছে?
       পুলিশ লাশটি গাড়িতে তুলতেই আশরাফ সিদ্দিকীর বউয়ের কান্না আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল।


২কর্তব্য
______________

হুড়মুড় করে একদল লোক ট্রেনে উঠল। সবারই মাথায় লাল ফেট্টি বাঁধা। উঠে উঠেই তারা জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিতে লাগল।
   আমি সিট পাইনি। কোনও রকমে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশেই অচেনা যুবতীটি একটি ছেলে কোলে কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। এই কালো কাপড় আসলে বোরখা। এদেশে বোরখা কেন? মনে মনে প্রশ্নটি উঁকি দিলেও প্রকাশ হল না।
    জয় শ্রীরাম ধ্বনির দল এগিয়ে এসে বলল : বোল জয় শ্রীরাম!
    যুবতীটি তেমনই চুপচাপ ।
    এবার ওরা মুখের কাপড়টি ধরে জোর টান মারতেই সে দুই হাত দিয়ে প্রতিরোধ করতে গেল আর অমনি তার কোলের ছেলেটি পড়ে গেল নিচে। প্রচণ্ড আঘাতে কেঁদে উঠল ছেলেটি। আমি আর থাকতে পারলাম না, রুখে দাঁড়ালাম।
—একটা অসহায় নারীর সঙ্গে এরকম অসভ্যতা কেন? এটাই কি রামের মাহাত্ম্য?
এক মুহূর্তেই ওরা গেল ক্ষেপে। সব ছেড়ে দিয়ে ধরল আমাকে। শুরু করল তুই তুকারি।
—এটাই কি তোর স্ত্রী?
—কেন? স্ত্রী না হলে রক্ষা করব না?
—তুই রক্ষা করার কে?
—আমি এই দেশের নাগরিক। আমার কর্তব্য আছে ।
—বড় বড় কথা কম নয়। শালা পাকিস্তানী মনে হচ্ছে। দে এদের ট্রেন থেকে ফেলে দে!

নিজেই কোমর বেঁধে দাঁড়ালাম : আয় এবার কে ফেলবি! পাশের যাত্রীরাও রেগে গেলেন তাদের উপর। পালাতে আর দিশা পেল না।
  পরের স্টেশনেই নেমে গেলাম। ছেলেটি আমার কোলে। মেয়েটি আমার পেছনে। কিন্তু যাব কোথায়? এখনও ওর পরিচয় জানা হয়নি। আমার অফিস আছে। অফিস সেরে বউকে নিয়ে একটা অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতে হবে। ভাবতে ভাবতে মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। চোখে আর কিছুই দেখতে পেলাম না।


তফাত
______________

—এদেশ শুধু আমাদের।
—তা কী করে হয়? আমরা তো সাতপুরুষ ধরে এখানেই বসবাস করছি।
—জানিস না! তোরা তো দেশ ভাগ করে নিয়েছিস! পাকিস্তান তোদের দেশ। ভারত শুধু আমাদের।
—তা আমি মানি না। এখানেই জন্মেছি, এখানেই বড় হয়েছি। আমার সাতপুরুষের নাম পর্যন্ত বলে দিতে পারি। আমার পূর্ব পুরুষ ব্রাহ্মণ ছিলেন। নবাবের আমলেই ধর্মান্তরিত হন।
—কিন্তু আমরা চাই এটা হিন্দুরাষ্ট্র হবে। অন্যকোনও সম্প্রদায়কে এখানে থাকতে দেবো না।
—আমি কিন্তু পাকিস্তান যাব না। আমাকে মেরে ফেললেও না।
—আগামী মাসের দশ তারিখ আমাদের রাষ্ট্রীয় যুবদলের কর্মসূচি ঘোষণা হবে। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তোদের জন্য কী ব্যবস্থা হবে।

    মহম্মদ শফি ভাবতে পারে না, তারই বাল্যকালের বন্ধু শ্রীসঞ্জীব দাস তাকে এরকম কথা বলবে। কতদিন সুখদুখে, বিপদে-আপদে একসঙ্গে কাজ করেছে। কলেজ পর্যন্ত একসঙ্গে পড়াশোনাও। যে কোনও কাজেই উভয়ে আগে পরামর্শ করে নিত ওরা। কিন্তু আজ কী এমন হল যে, জাত-ধর্ম নিয়ে উভয়ে আলাদা হয়ে গেল? অথচ উভয়েই তেমনভাবে ধর্মে বিশ্বাস রাখে সেটাও কোনওদিন স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। বরং মানুষকে ভালবাসাই তাদের কাছে একমাত্র ধর্ম ছিল। তাহলে ধর্মান্ধ ছদ্মবেশী রাজনৈতিক দলেরই কোনও প্রভাব?
     শফি ভাবতে ভাবতে ব্যাকুল হয়ে উঠল। বাড়ি ফিরে বেশ কয়েকটি প্ল্যাকার্ড তৈরি করল। প্রতিটি প্ল্যাকার্ডে হাতের শিরা পেঁচিয়ে রক্ত দিয়ে লিখল “আমি ভারত সন্তান । ভারত আমার গৌরব।" কোনওটাতে লিখল “আমাকে মেরে ফেললেও দেশ ছাড়ব না।" প্ল্যাকার্ডগুলি মঞ্চের চারিপাশে দেবে আগামী মাসের দশ তারিখ। সেদিন সঞ্জীবকে সে একটা কথাই বলেছিল : সঞ্জীব, আমিও মানুষ। আমি শুধু মুসলমান নই, হিন্দুও। তোর সঙ্গে আমার কোনও তফাত নেই।

    সঞ্জীব হা হা করে হেসেছিল। বলেছিল : অনেক তফাত আছে। সেদিন দেখিয়ে দেবো।





________________________________________



তৈমুর খান, জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট সংলগ্ন পানিসাইল গ্রামে । পিতা ও মাতার নাম :জিকির খান ও নওরাতুন । শিক্ষা : বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি। পেশা : উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহশিক্ষক । উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ :বৃত্তের ভেতরে জল, জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা, নির্বাচিত কবিতা, উন্মাদ বিকেলের জংশন, স্তব্ধতার ভেতর এক নিরুত্তর হাসি, নির্ঘুমের হ্রস্ব ধ্বনি, কাহার অদৃশ্য হাতে, ইচ্ছারা সব সহমরণে যায়, আকাঙ্ক্ষার ঘরের জানালা ইত্যাদি ।পুরস্কার : কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার, দৌড় সাহিত্য সম্মান এবং নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি । ঠিকানা :রামরামপুর (শান্তিপাড়া), ডাকঘর :রামপুরহাট, জেলা বীরভূম, পিন কোড ৭৩১২২৪, পশ্চিমবঙ্গ ।ফোন নম্বর ৯৩৩২৯৯১২৫০, ভারত।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.