অজ্ঞাত রহস্য - স্বপন কুমার মজুমদার

অজ্ঞাত রহস্য - স্বপন কুমার মজুমদার

অজ্ঞাত রহস্য - স্বপন কুমার মজুমদার

(ছোট গল্প )


নিদাঘ উত্তাপে ঘরের পিছনে যখন একটি আধবুড়ো তেঁতুল গাছ হাত পাখার মত তার শাখা-প্রশাখা দিয়ে হালকা বাতাস টানছিল তখনই সেই গাছের ডালে বসে গ্রীষ্মের এই দুপুরে একটি ঘুঘু পাখি যেন বুক কাঁপানো বেদনার ডাকছিল।

 এমনটাই যেন মনে করছিল বশির মিয়া অনেকবারই তিনি ঘুঘু পাখির ডাক শুনেছে কিন্তু আজ যেন তার মনটাকে ভাবিয়ে তুলছে । তার মেয়ে আহমা খাতুন পিসির বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। আজকে সকাল বেলা তার ফিরে আসবার কথা কিন্তু কই সকাল বেরিয়ে দুপুর গড়িয়ে যায় যায় এখনো তো তার খবর নেই। গতকাল সে ফোনে জানিয়েছিল , আব্বা আমি সকালেই বাড়িতে আসবো কিন্তু এলো না তো !পৌঁছালো না তো বাড়িত। বুকটা দুরু দুরু কাঁপতে থাকে বসির মিয়ার । সে যেন আর স্থির থাকতে পারছেনা ।সে আসমার পিসি বাড়িতে ভরাট গলায় কম্পিত কন্ঠে ফোন করে।

  পিসির ছেলে আনিস ফোনটা রিসিভ করে এবং জানিয়ে দেয় যে আসমা তো সকাল বেলাতেই বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গিয়েছে। এখানে তো সে আর নেই ।কেন কি হয়েছে আসমা কি এখনো বাড়িতে পৌঁছায়নি? দেখো একটু খোঁজ নিয়ে দেখো ! কথাটা শুনেই বিস্ময় প্রকাশ করে বসির মিয়া । বাড়ির দিকে রওনা হয়ে এসেছে মানে তাহলে গেল কোথায়! এক ঘন্টার পথ না কিন্তু কয়েক ঘন্টা কেটে গেলো । খবর নেই তো খবর নেই! এবার যেন বেশি করে ভাবতে লাগল । এমন সময় পাশে এসে দাড়ালো আসমার আম্মা আলেহা বিবি।

  --হ্যা গো কি হয়েছে গো ! চিন্তিত দেখে স্বামীর উদ্বিগ্নের কারণ জিজ্ঞাসা করল ।বসির মিয়া জবাব দিলো আর কি বলি বলতো আসমা এখনো তো বাড়ী ফিরল না  ওর পিসির ছেলে মনিরুল জানিয়ে দিল , আজ সকাল বেলা সে তো বাড়ির দিকে রওনা হয়ে এসেছে । বল দেখি মেয়েটা গেল কোথায় ! এখনো আসে না যে ।তাকে নিয়েই বেশি করে ভাবতে হচ্ছে আমার। কি করি । আমি যে আর স্থির থাকতে পারছি না বল দেখি মেয়েটা গেল কোথায় এখনো আসে না কেন?

   আলহা বিবি কিছুটা বিরক্তি স্বরে বলে, আরে তুমি তো মেয়েকে নিয়ে বড্ড বেশি ভাবো । এত ভাবার কি আছে বল দেখি । সে কি এখন আর সেই ছোট্ট খুকি। সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখ ।আসবে নাতো যাবে কোথায় । তুমি এই গরমে ঘরে গিয়ে একটু পাখার তলায় বসো। বিশ্রাম করো ।এত ভাবতে হবে না তোমায়।
যাও ঘরে যাও।

  বশির মিয়া ধীরে ধীরে বারান্দা থেকে ঘরে গিয়ে বসলো বটে তবে অন্তরে স্বস্তি পাচ্ছে না । শুধু ভাবছে লেখাপড়া জানা মেয়ে হারিয়ে যাবার তো কথা নয় ।বন্ধু-বান্ধবতার অনেক আছে ,তা কোথাও গেলে যেতেও পারে। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফিরবে ধরে নিয়ে একটু নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করলো মাত্র । কিন্তু সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো । আসমা ঘরে ফিরে এলো না। এবার স্বামী-স্ত্রী পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করা শুরু করল । আলেহাবিবি কে বলল বশির মিয়া , আমি না তোমায় মানা করেছিলাম তুমি ওকে পিসির বাড়ি পাঠিয়ে দিও না । দিনকাল ভালো নয় । চারিদিকে মস্তানি-ভন্ডামি কিনা হচ্ছে বলো ! তুমি শুনলে কি আমার সে কথা ।বললে, বললে তো খুব উঁচু গলায় কেন কি হয়েছে দিনকালে ! সেকি যায় না কখনো ।এর আগেও কি সে যায় নি তার পিসি বাড়ি । সে কি এখন কচি খুকি আছে । লেখাপড়া করতে তাকে কি স্কুল-কলেজে যেতে হয়নি । যেতে হয় না বাজার ঘাটে , কত কি যুক্তি খাটিয়ে পাঠিয়ে দিলে । আমাকে সে থোড়াই কেয়ার করে আর করবেই বা কেন তুমি যে তাকে মাথায় তুলে রেখেছে।

   আলেহা বিবি বলে তোমার কথা শুনতে গেলে তো তার পড়াশোনাই হতো না। তুমি তো চাও নি সে কলেজ পড়ুক ,টাইপ শিখুক । তাকে একটু মেলায় পর্যন্ত ঘোরা মানা করে রেখেছো। ঘরে তার পছন্দমত একটা ছবি পর্যন্ত লাগাতে দাও না , এদের মনে কি কোন খুশির জায়গা থাকতে নেই । আমাকে তুমি পর্দার আড়ালে রেখে দিয়েছো । বাইরে কোনদিন যেতে দাও নি ।শুধুই বোলেছো এটা ঠিক নয় ওটা ঠিক নয়। ওটা আমাদের কোরানে নেই ধর্ম নেই । আমি তো তোমার কথা শুনে শুনে ঘরের দম বন্ধ করে বসে আছি আর মেয়েটা পড়াশোনা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে আর তুমি সেটা চাওনা । আমি তাকে একটু স্বাধীনতা দিতে চেয়েছি বলেই যত দোষ আমার হলো! আলেহার কন্ঠ যেন ভারাক্রান্ত হয়ে আসে।

    বশির মিয়া বলে বেশ তো স্বাধীনতা দিয়েছো এখন বোঝো ঠেলা । সন্ধ্যা গড়িয়ে এলো তার এখনও দেখা নেই । আল্লাহ না করুক তার কোনো বিপদ হয় আর যদি কিছু হয় তখন বুঝবে স্বাধীনতা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। আলেহা বিবির চোখ দুটো ছল ছল করে ওঠে। তার আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ফোন করে তারা কিন্তু কোথাও আসমার উপস্থিতির খবর নেই ।কোথাও সে আশ্রয় নেয়নি ।চিন্তামগ্ন কান্নারত আলহা বিবি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে সে আল্লাহ যেন আমার মেয়ের কোনো ক্ষতি না হয় ।প্রভু ভালোভাবে সে যেন বাড়িতে ফিরে আসে কিন্তু আসমা আর বাড়িতে ফিরে এলোনা। স্বামী স্ত্রী উভয়ই বড় ক্লান্ত হয়ে পড়ল ।তারা যেন কান্নায় ভেঙে পড়ল আর কি করার আছে তাদের । এক সপ্তাহ কেটে গেল আসমা বাড়ি ফিরল না । আত্মীয়-স্বজন বাড়ি এমনকি আসমার বন্ধু-বান্ধবীদের বাড়িতেও আসমা নেই, তবে সে গেলো কথায়! ভাবনার অন্ত নেই স্বামী স্ত্রীর। চোখে ঘুম নেই ,মুখে অন্ন ওঠে না শুধু চোখ দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। পাড়া-প্রতিবেশীরা এখন টিপ্পনী কাটা শুরু করে দিয়েছে পিসি বাড়ির নাম করে মেয়েটা কারো সাথে পালিয়ে গিয়েছে  তা ছাড়া আর কি বা হবে। সেয়ানা মেয়ে, লেখাপড়া জানা মেয়ে এমনিতেই সে হারিয়ে যায় নাকি । কানাফুসি এমনি শুনতে হয় এখন ওদের।

   পড়শিদের কানা- ফুঁসি কানে আসে তবে কিছু বলার থাকে না ওদের । কে ঝামেলায় জড়াতে চায় ।বশির মিয়া নীরব থাকবে। নীরব থাকে আলেহা। ভাবে এবার আসমার নিখোঁজ হবার একটা ডায়েরি করা উচিত। কাছের লোকদের কাছে পরামর্শ নেয় । তার কেউ কেউ বলে আরে বাবা , লোক জানাজানি হবে যে, তোমাদেরও মুখ পুড়বে আর মেয়ের ভবিষ্যত হবে অন্ধকার  না হয় আরো কিছুদিন দেখো। কারো সাথে গিয়ে থাকলে ফিরে আসবে বৈকি কিন্তু কত আর অপেক্ষা করা যায় । পনের দিন তো কেটেই গেল। বশির মিয়া স্ত্রীকে সাথে নিয়ে নিজেদের থানায় ডায়েরি লেখাতে গেল কিন্তু বড়বাবু জানিয়ে দিলেন যেহেতু নিখোঁজ হওয়া অন্য এলাকায় সুতরাং এই এলাকার থানায় ডায়েরী নেওয়া যাবে না ,সেই এলাকার থানাই করাতে হবে যেখানে থেকে নিখোঁজ হোয়েছে। নিরুপায় হোয়ে পিসির বাড়ি এলাকায় গিয়ে থানায় অভিযোগ  করলো বশির ।বড় বাবু সব শুনে ধমক দিয়ে বললেন, নিখোঁজ হয়েছে পনের দিন। এখন অভিযোগ লেখাতে এলে । আপনাদের মতো লোকেদের জন্য আমরা সময়মতো কাজ উদ্ধার করতে পারিনে ।বড়বাবু অত্যন্ত বিশ্বাসের সঙ্গে জানালেন , আপনার মেয়েকে হয়ত অপহরণ করা হয়েছে নয় সে নিজের ইচ্ছায় কারো সাথে আত্মগোপন করে আছে।

   বড়বাবু একটা ডাইরি লিখে নিলেন জানালেন অনেকটা সময় অতি বই অতিবাহিত হয়েছে ক্রিমিনালদের হাতে পড়লে তা তো সময় বিদেশে পাচার হয়ে যেতেই পারে আর তা যদি না হয় তবে আপনার মেয়েটা আমরা খুঁজে বের করবো তবে কোন ফোন এলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করবেন
    অশ্রু সজল চোখে বশির মিয়া তার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। কি করবে আর তারা । কিবা করার আছে আর। দিনের-পর-দিন চিন্তা ভাবনায় বশির মিয়া আলহা বিবি অসুস্থ হয়ে পরলো । তাদের একটি মাত্র মেয়ে বড় আদরের মেয়েটি ।আলেহা বসে বসে ভাবে , কবে  সে তার মেয়ে কে কি কষ্ট দিয়েছে , কতটা বকুনি দিয়েছে । তার আবদার কতটা পূরণ করেনি । এমনি কত কি মনে পড়ে । মেয়েকে কখনো কোনো কষ্ট দিয়েছে কিনা ।  তবে আসমা কেন মায়ের বুক এমনি করে দুঃখ বেদনায় জর্জরিত করে রেখে গেল । তার আব্বা হয়ত তাকে মাঝে মধ্যে কিছু বকুনি দিত বটে কিন্তু সে তো তার ভালোর জন্যেই , ধর্মের মর্যাদা রক্ষা করার জন্যে । আজকাল যেসব মেলা উৎসব হয় বিচিত্রা অনুষ্ঠান হয় সেখানে  তাকে যেতে নিষেধ করে সে তো মেয়ের খারাপের জন্যে নয় । মেয়ে বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে, পরিবেশ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান হয়েছে তার । যে কোন মুহূর্তে এইসব উৎসব থেকে কোন হাঙ্গামার সূত্র পাত না হয় , যাতে না হতে হয় হেনেস্থা , এই জন্যই তো তার আব্বা মানা করে রাখে । তাতে যে আসমা তার আব্বার প্রতি কোনো ক্ষোভ তা তো আসমার কোনো ব্যবহারে আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি । তবে এমন কেন হলো।

   
  সেই কবে আমার সঙ্গে একটা ছেলে বাড়িতে এসেছিল তারা একসাথে কলেজে পড়ে তারপর অনেক বন্ধু বান্ধবীরা এসে বেরিয়ে যায় কোনদিন তোকে এমন টি বুঝা যায়নি যে আসো না কাউকে ভালোবাসে বা কারো সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রাখে তবে এমন কেন হলো বুঝতে পারে না আবার প্রতি অসন্তুষ্ট অনুরাগ এমনটি করতে পারে সেটাও ভাবা যায় না বুঝে উঠতে পারে না তার ভুল কোথায় তবে এটাও হতে পারে যে পিসির বাড়ি থেকে ফেরার পথে কেউ তাকে অপহরণ করলে করতেও পারে এ সন্দেহটা বশির মিয়ার ধারণায় মাঝেমধ্যে আসছে আর তা না ভাবতে গিয়ে তার গা ছমছম করে ওঠে সেভাবে মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে কলেজে যায় সে এতটা লাজুক প্রকৃতিরও নয় কথা যে বলতে জানে না এমনও নয় তো সকলের সাথে সহজে মিশে যেতে পারে সকলের সাথে সহজে মিশে যাওয়া টা কেউ কেউ বলে এটা মেয়ের গুন তবে বেশ গুণ এখন মনে হচ্ছে নিখোঁজের পিছনে হয়তো এই কাজ করেছে কোন কিছু আলাপ আলোচনায় দেশে গেলেও যেতে পারে এমন ও ভাবছে বশির আল হাবিবি এখনও নীরব হয়ে গিয়েছে শুধু তারা চোখের জল ঝরতে থাকে প্রথমে পাড়ার অনেকে সহানুভূতি দেখিয়েছে তো এখন আর পাশে কেউ আসে না তাকেও আর কোন কথার জবাব দিতে হয় না পারায় আলোচনার শেষ নেই নানা মুনির নানা ভাষা নানা মত আল হাবিবি পথের দিকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে থাকে ভবিষ্যতে চিন্তা করে লোকেদের কিছু আলাপ করতে দেখলেই আল হাবিবির মনে হয় জনতার উদ্দেশ্যে সব কথা বলাবলি করছে মেয়েকে কলেজে পাঠাবার বোঝো ঠেলা।

   আজ বশির মিয়া আবার সেই ঘুঘু পাখির ডাক শুনতে পেল। সেই তেঁতুল গাছের ডালে বসে বড় মিষ্টি স্বরে ডাকছে । মনে কোরছে বশির মিয়া, বুঝি কোন সংবাদ দিতে এলো ঐ পাখিটা । সে পাখিটাকে দেখতে যখন ঘরের বাইরে এলো তখনই হাতের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। সাথে সাথে বশির মিয়া উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চাইলো , হ্যালো কে বলছো ? উত্তর এলো আব্বা , ' আমি তোমার আসমা বলছি ।' বুকটা যেন ধড়ফড় করে উঠলো বশিরের। আসমা বলছো !আসমা ! হ্যা বাবা, 'আমি বলছি । ' মাগো তুমি কোথা থেকে বলছো ? আব্বা আমি ঠিক বলতে পারছি না, আমাকে একটা অন্ধকার ঘরে রাখা হয়েছে ।আমাকে একজন মহিলা দেখাশোনা কোরছেন। ঘরের বাইরে যাবার কোনো উপায় নেই। পাহারাদারের কড়া ব্যবস্থা রয়েছে। বেশি কিছু বলতে পারবো না আব্বা । বেঁচে আছি এই টুকু জানিয়ে দিলাম । ওই মহিলার হাতে পায়ে ধোরে ফোন করবার সুযোগটুকু পেয়েছি মাত্র ‌। আমি রাখছি ।ফোনটা কেটে দিল। ছ্যাত কোরে উঠল বশিরের বুক । কিন্তু একি মেয়ের কন্ঠে যে আতঙ্কের কোন আভাস বুঝতে পারলো না বশির ! কেন বুঝতে পারলো না ! এমন বিপদের মধ্যে যে মেয়েটি আছে তাকে উদ্ধার করে নেওয়া হোক এমন বিনয় আবেদনও করল না কেন । বশির  ভাবলো, হয়তো এভাবে ইঙ্গিত দিলে তার আরও বেশি বিপদ ঘটতে পারে কিন্তু বশির মিয়ার মুখখানা নিমিষে শুকিয়ে গেল। আসমাকে অন্ধকার ঘরে পাহারায় রাখা হয়েছে । নিশ্চয়ই দুষ্কৃতীদের কাজ হবে, হয়তো বিদেশে পাচার করার অভিসন্ধি থাকতেও পারে ।বশির মিয়া সত্তর থানায় গিয়ে যোগাযোগ করে ফোন নাম্বারটা দিলো। জানা গেল ফোন নম্বরটা দিল্লির । দিল্লি থেকেই ফোন এসেছে। পুলিশ ভরসা দিলেন, আসমা যখন দিল্লি আছে এবং দেশের বাইরে যেতে পারেননি , দেশের বাইরে তাকে পাচার করা হয়নি , তবে উদ্ধার করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ।এই মুহূর্তে আমাদের দিল্লি রওনা দিতে হবে । দেরি হলে মেয়ে পাচার হয়ে যেতে পারে । বশির মিয়া এক দুস্থ গরিব পরিবারের মানুষ ।সে অনেক কষ্টে মেয়ের বিয়ের জন্যে  কিছু গহনা তৈরি করে রেখেছিল , কিছু নগদ অর্থ ছিল সব মিলিয়ে হাজার ত্রিশ টাকা হবে। এই টাকার ব্যবস্থা করলে পুলিশের সঙ্গে দিল্লি পৌঁছানো যাবে। একদিকে পুলিশের রথ দেখাও হবে কলা বেচাও হবে । কিন্তু যদি মেয়ের খবর হয় তাহলে সব খরচা সে মেনে নিতে পারবে। তৎক্ষণাৎ পুলিশের কথামতো টাকা যোগাড় করে বশির মিয়া দিল্লি গেলো ।

   কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না আসমার কোনো খবর হলো না। যে ঠিকানার কথা পুলিশ ভাবছিলো সে ঠিকানায় আসমা নেই । ঠিকানাও সঠিক না। আর কি করবে , হতাস আর নিরাশায় ঘেরা রশিদ মিয়া পুলিশের সঙ্গে আবার বাড়ি ফিরে এলো। কিন্তু তার হঠাৎ মনে মনে পড়লো  তাই তো দিল্লিতে তাদের একটা পরিচিত ছেলে থাকে। সে নাকি শাড়ির দোকানে কাজ করে । একবার আসমার সাথে তাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল । ছেলেটা হিন্দু ছেলে   
। তবে সে খুব ভালো ছেলে । তার ব্যবহার আচার আচারণ খুব ভাল । আসমার সাথে নাকি এক সময়ে পড়াশুনা করত । এখন যদি সেই ছেলেটার খবর পাওয়া যায় , হতে পারে সে কিছু সহযোগিতা করে । সে একদিকে যেমন বন্ধু ভাবে তেমনি তাকে বোন বলেও ডাকে। তার ব্যবহারে বশির মিয়া বা তার স্ত্রী খুব খুশি ছিল । আজ তার কথা হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় দিল্লিতে সেই ছেলেটার সঙ্গে যোগাযোগ করল বশির । মনের মধ্যে একটু আশার আলো জেগে উঠল টিমটিম করে ।ওই ছেলেটার ফোন নাম্বার জোগাড় করে তাকে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে বললো, দেখো বাবা তোমার বোন আসমা দিল্লিতে কোথায় যেন থাকে। তাকে আমরা খোঁজ করতে গিয়েছিলাম কিন্তু দিল্লীতে পাইনি। সে কোথায় কোন ঠিকানায় রয়েছে  জানতে পারিনি । তবে তার একটা ফোন নাম্বার আমাদের কাছে আছে ।তুমি এই ফোন নাম্বারটা নিয়ে দেখো, যদি কোনো খবর পাও আমাদের জানিয়ে দিও । তুমি তো আসমাকে খুব আপন বোনের মত ভাবতে । আমরাও তোমাকে আপন ভাবতাম । আমরা এখন বড় বিপদে পড়েছি তুমি আমাদের এই কাজটা উদ্ধার করে দাও বাবা। আমি তোমার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকব । ঐ হিন্দু ছেলেটার নাম দীননাথ । সে বলল, কাকু ,আপনি চিন্তা করবেন না ।আমি যখন দিল্লিতে থাকি তখন কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি আসমার খোঁজ- খবর নেবার চেষ্টা করবো। যদি আমি  খবর পাই তাহলে আপনাদের জানিয়ে দেবো । কিছুটা আশার আলো দেখতে পেলো বশির মিয়া । তবু স্থির থাকতে পারছে না ।তার মনের মধ্যে সব সময় একটা অস্থিরতা কাজ করছে। কে যেন এসে আবার খবর দিয়ে গেল দিল্লিতে কেউ খোঁজ নিতে আছে নিতে থাকুক কিন্তু তুমি একটু দরবেশের কাছে যাও। শুনেছি দরবেশরা ইচ্ছা করলে অনেকটা খোঁজ খবর দিতে পারেন ।তুমি একটু দেখো কোনো দিকে কোথায় কোনো দরবেশদের খবর পাও কিনা । এই ব্যাপারে দরবেশরা ভাল পরামর্শ দিতে পারে । লোকটির কথা শুনে বশির মিয়া খবর নিতে থাকল এবং এক দরবেশের খবরও পেয়ে গেলো । তিনি বল্লেন, আসমাকে খুঁজে পাবার পথ প্রশস্ত আছে ।পীর বাবা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে জানালেন, তুমি বাড়িতে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকো ভাই আর ছোটাছুটি করো না। সময় মতো  তোমার মেয়ে বাড়িতে পৌঁছে যাবে ।তবে আমাকে টাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে আমি সব বন্দোবস্ত করে দেব কি আর করবে বশির মিয়া পীর বাবার প্রতি অনেকের বিশ্বাস আছে ।সেও বিশ্বাস করল ।নগদ তিন হাজার টাকা গুনে দিয়ে পীর বাবাকে বলল , আপনার পরে আমার ভরসা আছে। আমার মেয়ে যদি বাড়ি এসে যায় বাকি টাকা আপনাকে আমরা দিয়ে দেব ।আপনি তো জানেন যাদের সন্তান হারিয়েছে তারা কি কষ্ট দুঃখ ব্যথা  উপলব্ধি করতে পারে।  মেয়েকে যদি খুঁজে পাওয়া যায় যদি সে ফিরে আসে কেন আপনাকে টাকা দেব না ।  মেয়ে ফিরে না এলে আসমার মা আর বাঁচবে না হয়ত ।বশিরের অবস্থাও হবে না বাঁচার সামিল ।অগত্যা পীর বাবাকে টাকা দিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে দিন গুনতে শুরু করল বশির আর তার স্ত্রী ।দেখি কবে ফিরে আসবে তাদের  মেয়ে আসমা ।


    হঠাৎ দিল্লী থেকে একটা ফোন এলো বশির মিয়ার কাছে । ফোন কোরেছে দিল্লী থেকে দীননাথ । বোলছে , কাকু আমি আসমার খবর পেয়েগিয়েছি । কিন্তু অপহরণকারীদের চক্রান্ত থেকে মুক্তি কোরে আনা খুবই কঠিন। তাকে একটি ঘরে আটকে রাখা  হয়েছে ,আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। কয়েকজন পাহারাদারের দখলে রয়েছে আসমা । সে ঘরে আরো অনেক মেয়েরা আছে । শুনেছি ওদের বিদেশে পাঠিয়ে দেবে । বাস্তবতার গভীরে প্রবেশ করতে পারে না বশির ।কথা কতটা সঠিক ।তার মনে সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করে ।এমন তো নয় ওই দিননাথের চক্রান্তে বা তার ভালোবাসার জালে জড়িয়ে আসমাকে দিল্লিতে নিয়ে গিয়েছে এবং সেখানে বসবাস করছে তারা । যদি দিননাথের বাসায় গিয়ে খোঁজ নেওয়া যেত তবে হয়তো আসমাকে পাওয়া যেতে পারতো এমন ধারণা মনের ভিতর জাগতে থাকে বশিরের। এতো সহজেই সে আসমার খোঁজ দিতে পারছে। যেখানে দিল্লিতে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করতে পারেনি তার খোঁজ পাইনি এই কয়েকদিনের মধ্যেই ছেলেটা খবর পাঠিয়ে দিচ্ছে। দেখি দীননাথ কি বলতে চায় । দীননাথ আবার বলল, কাকু শুনছি খুব তাড়াতাড়ি ওদের পাচার করে দেবে । তবে তো ওকে উদ্ধার করা যাবে না। ওদের সাথে কথা হোয়েছ , দশ হাজার টাকা দিলে  আসমাকে ওরা ছেড়ে দেবে বোলেছে ।

   বশির মোল্লার মাথায় যেন বাজ পড়লো। ইতিমধ্যে সে পুলিশের সঙ্গে দিল্লিতে গিয়ে বিশ হাজার টাকা খরচ করে এসেছে । এখন মাঠে দশ শতক জমি ছাড়া হাতে নগদ টাকা একদমই নেই। এমত অবস্থায় আসমাকে ফিরিয়ে পেতে তাকে আবার যদি দশ হাজার টাকা জোগাড় করতে হয়, তবে মাঠের ঐ জমিটুকু বিক্রি করা ছাড়া আর উপায় থাকবে না । বশির মনে মনে ভাবে, মেয়ের আধুনিক চিন্তা ধারা, খামখেয়ালি মনোভাব আজ তাকে পথে বসিয়ে ছাড়ছে । তার জীবন বিপন্ন করে তুলছে। সমাজে যেন আর মুখ দেখাবার মতো রইল না । কিন্তু যদি সে ফিরে আসে তবে এলাকার মানুষের সামনেও মুখ দেখাতে পারবে না বশির ।কি ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তাকে । তাই বশির মিয়া ভাবে, মেয়ে যদি দীননাথের কাছে থেকেই থাকে তবে থাকুক । এখন আর আপত্তি করেই বা কি লাভ । ছেলেটা দেখতে খুব একটা খারাপ নয়। রং ও ফর্সা । পড়াশোনাও কম জানেনা । তবে তুলনামূলকভাবে বয়সটা একটু বেশি । কিন্তু সমস্যাটা হলো সে যে একটা হিন্দু ঘরের ছেলে ।হিন্দু ঘরে মেয়েকে যদি হিন্দু ঘরে ছেড়ে দেয় তবে সমাজে তার ঠাঁই হবে কোথায় ! বশির কে এ সমাজ এক ঘরে রাখবে । না হলে তাকে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে কোথাও ।  তবু ভাবে এক মাত্র মেয়ে তার । সে যে তার মা আলেহা বিবির প্রান । দিনানাথ  অনেক ভেবে বলল, দেখ বাবা , যদি আসমাকে এনে দিতে পারো তবে আমি তোমাকে টাকার ব্যবস্থা কোরে দেবো। আগে তুমি আসমাকে বাড়ি নিয়ে আস। নইলে যে আসমার মা আর বাঁচবে না । আমার কথা না হয় ছেড়ে দিলাম । তুমিও তো কোনো বাবা মায়ের ছেলে । তোমাদের কালী মায়ের আমিও একজন ভক্ত । তাঁকে আমিও মানি ।  সেই মাকে আমি তোমাদের পূজার সময় অঞ্জলী দেব । প্রসাদ দেব ।  দিনোনাথ আর দেরী করেনি সঙ্গে সঙ্গে আসমাকে নিয়ে তার বাবা বশির মিয়ার কাছে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু  দেখা গেলো যে কোনো অশান্তির মধ্যে মেয়েটি যে এতদিন  ছিল তার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলো না বরঞ্চ মেয়েটির কথাবার্তা চালচলন আগের থেকেও ভালো, শরীর স্বাস্থ্যও ভালো হয়েছিল । তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো ঘটনাগুলো কি ছিল তুই আমাদের বল । কোথা থেকে কী ভাবে দিল্লী গেলি আমাদের একটু জানা । তবে মেয়েটিকে কেউ মানসিক চাপ সৃষ্টি করেনি । গ্রামের মানুষও মেয়েকে  কোনো  প্রকার উত্যক্ত করেনি । তার উপর চাপ সৃষ্টি করেনি কেউ । হতে পারে পাছে যদি  দুর্ঘটনা কিছু গুটিয়ে বসে কিন্তু পাড়ার লোকে হিন্দু ছেলেটার সাথে এইভাবে তিন- চারটে মাস কাটিয়ে আসা কেউ ভাল নজরে নেয় নি । তবে হিন্দু ছেলেটি আসমাকে ওদের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছে আমি ওকে বোনের মতই ভালবাসি। সুতরাং তার সাথে কোন প্রকার দুর্ঘটনা ঘটেনি। কারা ওকে নিয়ে এসে ছিল সে বিষয়ে আসমা কিছু বলেও নি । তবে আমি আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি এটাই আমার খুশি । বোনের মত ভেবেছিলাম বোনের মতোই দায়িত্ব নিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম। তবে টাকাপয়সা কিছু লাগেনি । কিছুদিন ধরে আমার মনে হচ্ছিল কে বা কারা যেন আমার উপর খুব একটা মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে । আমি যেন খুব তাড়াতাড়ি  আসমাকে উদ্ধার কোরে আপনাদের কাছে পৌঁছে দেই । আমি কি যেন একটা অশান্তির মধ্যে ছিলাম। যদি আমি তাকে উদ্ধার কোরে না আনতাম  আসমাকে বাড়িতে পৌঁছে না দিতাম হয়তো আমার জীবন নিয়ে সংশয় হোয়ে যেত । কেন জানি একটা অদৃশ্য শক্তি আমাকে বারবার কষ্ট দিতে চেষ্টা চালিয়েছিল । রাত্রে আমি ঘুমাতে পারতাম না ।দিনে আমি স্বস্তি পেতাম না । মনে হোতো কি একটা শক্তি   আমার পিছে কাজ করছিল সুতরাং আমি আমার ঘরের থেকে দশ হাজার টাকা তাদের হাতে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরে তারা সে টাকাও নেয় নি । শুধু বোলেছে তাড়াতাড়ি তোমার বোনকে সরিয়ে নিয়ে যাও । তারাও নাকি আমার মত অশান্তি বোধ কোরছিলো।  আমি আপনাদের মেয়ে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি  মনে হচ্ছে আমি যেন সব দিক থেকে চাপ মুক্ত হয়ে আছি । বশির মিয়া ভাবছিল হয়ত দরবেশ বাবার কারনে সহজেই আমরা আসমাকে বাড়িতে ফিরে পেলাম।  আসমা কিন্তু কোনো ঘটনা যা এই পর্যন্ত ঘটেছে কাউকে কিছুই বলেনি । তবে এইটুকুই বোলেছিল , পিসি বাড়ি থেকে ফিরবার পথে কখন যে সে অজ্ঞান হয়ে যায় , এর পর থেকে সে আর কিছু জানে না। অনেক মানুষের অনেক কথাই যেন অজ্ঞাত থেকে যায়।
 

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.