অপোজিট সেক্সের বন্ধুত্ব ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : মৃদুল শ্রীমানী

অপোজিট সেক্সের বন্ধুত্ব ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : মৃদুল শ্রীমানী

অপোজিট সেক্সের বন্ধুত্ব ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
মৃদুল শ্রীমানী


একজন পুরুষের সঙ্গে একজন নারী একান্তে কথা বলবেন, সহজ স্বাভাবিক বন্ধুত্ব গড়ে তুলবেন, এটা বাঙালি সমাজে এখনো সহজ নয়। কো এড কলেজে ছেলে মেয়েরা একসাথে পড়ে ঠিকই। কিন্তু এখনো বহু অভিভাবক ওই কারণেই নিজের কন‍্যাসন্তানকে সহশিক্ষার পরিবেশে পাঠাতে চান না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে এই বছর পঞ্চাশ আগেও মেয়েরা অধ‍্যাপক মহাশয়ের পিছন পিছন ক্লাসে ঢুকত। আর ক্লাস শেষ হলে অধ‍্যাপকের সাথেই বেরিয়ে আসত। কাজী নজরুল ইসলাম না কি একজন ছাত্রীর সাথে গিয়ে আলাপ করার উপক্রম করেছিলেন বলে, তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। এ ধরনের ঘটনা ঘটালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, এটা জানার পরেও কাজী এই কাজটি করেন। সদর দপ্তরে কামান দাগার আগ্রহ কাজীর ছিল।
 
 মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'চার অধ‍্যায়' উপন‍্যাসের কথা। সেখানে কলেজের পরিবেশে এলালতা দাশগুপ্তের ফরসা ছোটোখাটো চেহারা দেখে ছেলেরা দূর থেকে ছোটো এলাচ বলে ডেকে পালিয়ে যেত। অন‍্য একটা মেয়েকে তারা বলত বড় এলাচ। রবীন্দ্রনাথ  লিখেছেন সেই মেয়েটির আড়ে বহরে চেহারা ও গাত্রবর্ণের সাথে বড় এলাচের মিল পেত তারা।
 তারপর রবীন্দ্রনাথ এলার জবানিতে লিখেছেন, ছেলেদের সাথে ব‍্যবহার করা খুবই সহজ, যদি তাদের মানুষ হিসেবে ভাবা যায়। 'চতুরঙ্গ' উপন‍্যাসে লীলানন্দস্বামী চরিত্রটি খুব সাবধানে এঁকেছেন তিনি। যেটুকু বলেছেন, আভাসে ইঙ্গিতে বলার ব‍্যাপারটা মাথায় রেখেছেন। অবশ‍্য বুদ্ধিমান লোকের জন্য ইশারাই যথেষ্ট।
 
 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন কালে তো ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারী, রজনীশ, মহেশ যোগী ও সত‍্য সাইবাবাদের ব‍্যবসা সাম্রাজ‍্য পত্তন হয় নি, আর  অবাধ যৌনতার খেলাও শুরু হয় নি। তাহলে চতুরঙ্গ উপন‍্যাসের লীলানন্দস্বামী চরিত্রটি কি রবীন্দ্রনাথের তরফে পুরোপুরি কপোলকল্পিত?
 জীবনানন্দ দাশের কবিতা মনে পড়ে। মানুষ কাউকে চায়, তার সেই নিহত উজ্জ্বল, ঈশ্বরের পরিবর্তে অন‍্য কোনো সাধনার ফল। বলেন, 'আরো আলো, মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়'। আর রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'রমণীর মন, সহস্র বরষের সখা সাধনার ধন'।
 
 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সদ‍্যোতারুণ‍্যে লেখা 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' কবিতাটা অনেকের মুখস্থ। আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান, না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ... রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৈশোরের প্রেমের কথা মনে পড়লে অবাক লাগে। দেবেন ঠাকুরের ছোটছেলেকে বিলেতে পাঠিয়ে ব‍্যারিস্টার করে আনা হবে। তার আগে বিলিতি কায়দাকেতায় রপ্ত হ‌ওয়া চাই। সহজ শোভনভাবে মেয়েদের সাথে ব‍্যবহার করতে শেখা চাই। ঠাকুর পরিবারের বাইরে বাঙালি সমাজে তখন সহজভাবে মেলামেশার মেয়ে ক‌ই? বিবাহিত মেয়েরাই তখন দিনের বেলা নিজস্ব পুরুষের সান্নিধ্যে আসতে মনের ভিতর বাধা পায়। মেয়েদের পাঁচজনের সামনে বেরোনোর পোশাক তখনো জবড়জং। এমন সময় বোম্বের ডাক্তার আত্মারাম পাণ্ডুরঙের মেয়ে আনা তড়খড়ের সাথে আলাপ করিয়ে দেওয়া হল রবির। ভাবতে ভারি অবাক লাগে।  মিষ্টিও লাগে। আনা বোধ হয় রবির থেকে বয়সে সামান্য একটু বড়। আর রবি চেহারায় একটু বড়সড়। 
 
 
আনার খুব পছন্দ হয়েছিল রবিকে। হাতমোজার গল্পটা মনে পড়ে শ‍্যামলীর। আশ্চর্যের ব‍্যাপার এমন আধুনিক মন মেজাজের লোক হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন নিজের সব কয়টা মেয়ের বাল‍্যবিবাহ দিলেন? তাঁর মেয়েরা কি বাড়ির কোনো পুরুষের হাতে সমস্যায় জর্জরিত হতে পারে এই আতঙ্কে ভুগতেন কবি? তাই কি ঝামেলা চুকিয়ে দিতে বিয়ে? এই রবীন্দ্রনাথ যখন চার অধ‍্যায়ে বিয়ে জিনিসটাকে পাঁশতলা বা আস্তাকুঁড়ের সামিল করে বলেন, তখন ভাবনা হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেন, পিঠ চুলকে দেবার একটা লোকের জন‍্য মানুষ বিয়ে করে, তখন তার ভিতরকার কঠিন ব‍্যঙ্গটা টের পাওয়া যায়।
 
 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সদ‍্যোতরুণী রাণু অধিকারীর সম্পর্ক লোকেরা সহজভাবে নিতে পারে নি। রাণুর বাবা মা পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থেকে বয়সে ছোটো। কবির সঙ্গে রাণুর বয়সের এতটা ফারাক, তবুও কত কথা উঠেছিল। রাণুর বিয়েতে দামি মরক্কো চামড়ায় বাঁধাই করে নিজের সব কয়টা ব‌ই উপহার দিয়েছিলেন তিনি। তবু স্বয়ং গিয়ে বিবাহ বাসরে দাঁড়াতে পারেননি। পরিস্থিতি খুব স্বাভাবিক ছিল না।
 
 
বন্ধুত্ব যদি অপোজিট সেক্সের মানুষের মধ‍্যে হল তো বাঙালির সমাজ সেটাকে সহজ করে দেখতে পারে না। সম্পর্ককে শান্ত দাস‍্য সখ্য বাৎসল‍্য মধুর এই পাঁচ রকমে চিনিয়েছে ভারতীয় রসশাস্ত্র। অনসূয়া প্রিয়ংবদার সাথে তপোবনের দিনগুলো দারুণ এঁকেছেন কালিদাস। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন "ক‌ইত কথা শৌরসেনী হলা পিয় সহি.."... আর অর্জুনের সঙ্গে কৃষ্ণের সখ‍্যতা। উদ্ধবের সাথে মাধবের সখ‍্যতা। 'আওয়ে উধো বেগর মধো..'. বন্ধুত্বের অধিকারে ভগবানের ঘাড়ে চাপছে ভক্ত। ভক্তের বোঝা ভগবান বয়।  কিন্তু অপোজিট সেক্সের মধ‍্যে "বন্ধুত্ব" রামায়ণ মহাভারতে ক‌ই? অনেক খুঁজে পেতে যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীর সঙ্গে নন্দপুরচন্দ্রের একটি সম্পর্ক খুঁজে পাই। সেই কোপনস্বভাব দুর্বাসা আর উগ্রবাদী দশহাজার শিষ‍্য অতিথি হবেন বনবাসী পাণ্ডবদের কাছে। তখন দ্রৌপদীর কাতর প্রার্থনায় কৃষ্ণ তাঁর তাম্রস্থলীর কানায় লেগে থাকা শাকান্ন ভক্ষণ করে দারুণ একটা ম‍্যাজিক দেখালেন যে হ‍্যারি হুডিনিও ডাহা ফেল মেরে যাবেন। কিন্তু, সে জিনিস কি ঠিক অপোজিট সেক্সের মধ‍্যে বন্ধুত্ব হল? এটা কি আদতে ঐশ্বরিক কৃপাকণা নয়?
 
 
গোরা উপন্যাসে সুশিক্ষিত যুবক বিনয় ব্রাহ্ম ভদ্রলোক পরেশবাবুর মেয়েদের  সাথে সহজ স্বাভাবিক বন্ধুত্ব চাইছে, সেটাও তার সহপাঠী বন্ধু জাঁদরেল হিন্দু হয়ে উঠতে চাওয়া গোরা খারাপ ভাবে নিচ্ছেন। চিঠি লেখা, একান্তে গল্প করা, দেখা করা, এগুলো গোরার চোখে বেলেল্লাপনা মাত্র। ললিতা, বড়ো হয়ে উঠতে থাকা ঋজু সবল চরিত্রের মেয়েটি স্বাদেশিক ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ম‍্যাজিস্ট্রেটের আতিথ‍্য পায়ে ঠেলে বিনয়ের সাথে এক জাহাজে রাত্রি কাটিয়ে কলকাতা চলে এসেছিল। একটি সমর্থ নারী পুরুষ কাছাকাছি অবস্থান করলে, তাদের মধ‍্যে যৌনসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছে, এভাবেই ধরে নেওয়া হয়।  সামাজিক জ‍্যাঠামশায়রা ভাবেন বাঙালির মেয়ের রজোদর্শন হলেই অরক্ষণীয়া হয়ে গেল। গোরাকে শান্ত করতে বিনয় গোরার ভাইঝি শশিমুখীর পাণিগ্রহণ করে অপরাধ স্খালন করতে চায়। বিনয়ের হীনমন্যতা কাটান গোরার মা আনন্দ ময়ী। পুত্র তুল‍্য বিনয়কে বোঝান, বিয়ে জিনিসটা অত হেলাফেলার নয়। কমপ‍্যাটিবিলিটির প্রশ্ন তুলে দেন আনন্দময়ী।

 
মেয়ের বিয়ের জন‍্য ন‍্যূনতম একটা বয়স লাগে, ব‍্যক্তিত্ব বিকাশের প্রয়োজন হয়, বাঙালি সমাজে এই ভাবনা গড়ে ওঠা এখনো বাকি। সরকারি কর্মীকে এখনো এ নিয়ে ঢ‍্যাঁড়া পিটতে হয়। সে যুগের অগ্রণী বুদ্ধিজীবীরা এমনকি খোদ রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত নিজের কন‍্যাদের ক্ষেত্রে এই চক্কর থেকে বের হতে পারেন নি। বিদ‍্যাসাগর পেরেছেন? বঙ্কিমচন্দ্র? কেশব সেন তো সাংঘাতিক দ্বিচারিতা করে বসে ‌র‌ইলেন। ব্রাহ্ম সমাজের নেতা হয়ে, বড় বড় কথা বলতে বলতেই যেই কুচবিহারের রাজাকে পাত্র পেলেন অমনি আদর্শ টাদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে সুনীতি দেবীর বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। 'একরাত্রি' গল্পের সুরঞ্জনা পেশাদার আইনজীবীর বৌ। কেমন বৌ? স্ত্রীর হাতে  যেদিন রান্না ভাল হয়, সেদিন উকিলবাবু গহনা গড়াতে দেন। যেদিন দুধে ধোঁওয়ার গন্ধ হয়, সেদিন বৌয়ের চোখের জল ফেলান। সেই সুরঞ্জনা বন‍্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিনে বাড়ি থেকে একাকিনী বেরিয়ে এসেও কৈশোরের বন্ধুর হাতটি ধরতে পারল না। সামাজিক জ‍্যাঠামশায়রা মানুষের মনকে কতটা কোণঠাসা করে দিয়েছেন!
 
 
মাখন বড়াল লেনে মৃণালের মানুষ হিসেবে বাঁচার ইচ্ছেগুলি ঘরের চার দেয়ালে কেবলি ঠোকর খাচ্ছিল। মনুষ্যত্বের দায়ে, নিজস্ব তাকে বাঁচানোর তাগিদে তার চরণতলাশ্রয়চ্ছিন্না না হয়ে কোনো উপায় র‌ইল না। চার অধ‍্যায়ে এক‌ই অভিন্ন সংগঠনের রাজনৈতিক কর্মী মেয়ে পুরুষের মধ্যে হৃদ‍য়ের সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেখলে দলনেতা ইন্দ্রনাথ তাতে বিঘ্ন ঘটাতে তৎপর হয়ে ওঠেন। কি করে প্রেমের জুড়ি ভাঙতে হয়, তাতে তিনি সিদ্ধহস্ত। চতুরঙ্গে প্রথাগত বিবাহরীতি পালন না করেই হৃদয়ের টানে একত্রবাস করতে থাকে শিবতোষের বিধবা দামিনী আর শ্রীবিলাস। খবরের কাগজে তাদের মুণ্ডপাত করা হতে থাকে।
 
  
যে দেশের মানুষ কোনো একসময় দৈব ব্রাহ্ম প্রাজাপত‍্য গান্ধর্ব, অতোরকম বিবাহপদ্ধতি ভাবতে পেরেছিল, আজ তারা এতখানি একমাত্রিক হয়ে গেল কেন?
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.