একটি মৃত্যু, ইয়েলো জার্নালিজম এবং ভোট ব্যাংক--দেবব্রত মন্ডল

একটি মৃত্যু, ইয়েলো জার্নালিজম এবং ভোট ব্যাংক--দেবব্রত মন্ডল

একটি মৃত্যু, ইয়েলো জার্নালিজম এবং ভোট ব্যাংক


দেবব্রত মন্ডল

 

সুশান্ত সিং রাজপুত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই বলিউড তারকার নামই নিঃসন্দেহে সবথেকে বেশি আলোচিত হয়ে চলেছে। ১৪ জুন এই অকাল প্রতিভার মৃত্যুর পরের এই কয়েকমাস এই চিত্রতারকা প্রতিটি প্রথম সারির দৈনিকের ফ্রন্ট পেজ দখল করছেন অবলীলায়।অবশ্য শুধু তার মৃত্যুর খবরেই আটকে থাকেনি তারা সেই সঙ্গে চলেছে মৃত্যুর কারণ নিয়ে কাটাছেঁড়া এমনকি অভিনেতার ব্যক্তিগত জীবনেও অনধিকার প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনরকম দ্বিধাবোধ করছে না তারা।সুশান্ত কি খেতেন কি পরতেন এমনকি মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে সুশান্তের আচরণের খুঁটিনাটি জানিয়ে যাচ্ছে মিডিয়া।

একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে শুধুমাত্র সুশান্তের মৃত্যুর ক্ষেত্রেই নয়।বিগত কয়েক বছরের মধ্যে বারংবার বিভিন্ন চটকের আড়ালে চলে গেছে দেশ এবং সাধারণ মানুষের প্রকৃত সমস্যাগুলি তা সে অর্থনীতির বেহাল দশা হোক চাকরি সংকট বা সাম্প্রদায়িকতা।সমস্যাটি এতটাই সংক্রামক যে পি সাইনাথের মতো ব্যক্তি বলতে বাধ্য হচ্ছেন - দেশের মূল সমস্যাগুলি থেকে বারংবার দূরে সরে যাচ্ছে মেন স্ট্রিম মিডিয়াগুলি।দেশের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলো যে ভাবে টি আর পির পেছনে দৌড়তে গিয়ে প্রতিমুহূর্তে প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে অবতীর্ণ হচ্ছে এমনকি তা যে অচিরেই বুদ্ধিজীবী মহলের কপালে ভাঁজ ফেলবে তা বলাই বাহুল্য।না এখানেই শেষ নয় সুশান্তের মৃত্যুর পর প্রায় প্রতিটি নিউজ চ্যানেল যেভাবে আলোচনার নামে চায়ের কাপে তুফান তুলেছে এবং তার মধ্যে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম যে ধরনের মধ্যযুগীয় আলোচনার অংশীদার হয়ে উঠেছে তা ' ইয়েলো জার্নালিজম ' - এর মতো বিবেকবর্জিত কাজের গতিকে যে আরও ত্বরান্বিত করবে সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়ায় যায়।

এরপর আসা যাক রিয়া চক্রবর্তীর প্রসঙ্গে।সুশান্তের মৃত্যুর পর সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছেন পুরুলিয়ার আদি বাসিন্দা এই বঙ্গতনয়া।সম্পর্কে তিনি ছিলেন সুশান্তের বান্ধবী।সুশান্তের আত্মহত্যা ( অথবা খুন ) - এর পর আঙ্গুল উঠেছে রিয়ার দিকেই।তিনিই নাকি আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়েছেন অথবা ঠান্ডা মাথায় খুন করেছেন সুশান্তকে মনে করা হচ্ছে এমনই।এই পরিস্থিতিতেই রিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি নাকি সুশান্তের উপর কালা জাদু বা ব্ল্যাক ম্যাজিকের প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন।আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই অভিযোগ শুনলে স্বাভাবিকভাবেই আঁতকে উঠতে হয় এবং তারই সূত্র ধরে অতি সহজে প্রায় সমস্ত বাঙালি মেয়েদের একঘরে করা হলো এই বলে যে তারা নাকি কালা জাদু প্রয়োগে বিশেষভাবে পারদর্শী!অভিযোগেই সীমাবদ্ধ নয় এই ঘটনা বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে ধীরে ধীরে রীতিমতো মুখরোচক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠলো এই কালাজাদু - হ্যাঁ আজকের এই আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়েও। অভিযোগ তো হলো এরপর আসা যাক অভিযোগের সতত্যা বিষয়ে - রিয়া চক্রবর্তীর অন্যতম অপরাধ হলো মহেশ ভাটের সঙ্গে তার কিছু ছবি থাকা - এই ঘটনাকে নিয়েও যে ভাবে তাকে দোষারোপ করা হচ্ছে তা যৌক্তিকতা কতটা সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।সেই সঙ্গে আসে সোশ্যাল মিডিয়ায় ' জাস্টিস ফর সুশান্ত ' ট্যাগলাইনে দেদার প্রচার। ন্যায় বিচার অবশ্যই সকলের প্রাপ্য কিন্তু অভিযোগ প্রমাণ হবার আগেই যেভাবে একজনকে অপরাধী সাজানো হচ্ছে তা যথেষ্ট দুর্ভাগ্যজনক।আমাদের মনে রাখতে হবে অভিযুক্ত এবং অপরাধী এই দুইয়ের মধ্যে অবশ্যই কিছুটা সূক্ষ্ম পার্থক্য বর্তমান।

এতো গেলো মিডিয়ার টি আর পি বৃদ্ধির ইঁদুর দৌড়ের কথা।এরপর আসা যাক রাজনীতির প্রসঙ্গে।অবশ্য একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে রাজনীতি এবং মিডিয়ার টি আর পি এক্ষেত্রে কোথাও গিয়ে বারংবার এক হয়ে পড়ছে।একটু বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে সুশান্তের মৃত্যুকে রাজনৈতিক দলগুলি কি ভাবে নিজেদের ভোট ব্যাংক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে চলেছে।একটি পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট হবে সামগ্রিক চিত্রটি - বিহারে বিজেপি ইতিমধ্যে সুশান্তের নামে প্রায় ত্রিশ হাজার ফেস্টুন ছাপিয়ে ফেলেছে।এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য এই অতিদরদী ভাবের পিছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধি নেই তো?

সেন্টার ফর মনিটরিং ইকোনমির রিপোর্ট মোতাবেক  দেশে বেকারত্বের হার ২৭.১১ শতাংশ।শহরাঞ্চলে এর হার ২৯.৪৫ শতাংশ সুতরাং দুরবস্থা সহজেই অনুমেয়।মার্চ মাসে দেশে বেকারত্বের হার যেখানে ৮.৭৪ শতাংশ এপ্রিলে তা দাঁড়িয়েছে ২৩.৫২ শতাংশে সেই সঙ্গে আছে রেলের মতো প্রতিষ্ঠানের বেসরকারিকরণ অথবা স্টেট ব্যাংকের প্রায় তিরিশ হাজার কর্মীর অবসরকালীন সিদ্ধান্ত এমনকি এর সঙ্গেই যোগ হয় জিও এবং রিলায়েন্সের মতো পুঁজিবাদী সংস্থার আধিপত্য বা বি এস এন এলের মতো সংস্থার ধীরে ধীরে খাদের কিনারায় পৌঁছে যাওয়া।এমনকি সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির মতো প্রতিষ্ঠানের মতে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাঁটাই হয়েছেন প্রায় বারো কোটির বেশি মানুষ। লকডাউন এর অন্যতম কারণ অবশ্যই কিন্তু তার দোহায় দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কি তার দায় এড়িয়ে যেতে পারে?এরই সঙ্গে যোগ হয়েছে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার মতো স্পর্শকাতর ইস্যু।

এই পরিস্থিতিতে দেশের মেন স্ট্রিম মিডিয়াগুলি কি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করতে পারছে?নাকি সুশান্তের মৃত্যু আর টি আর পি বাড়ানোর খেলায় আড়ালেই রয়ে যাবে সে সব প্রসঙ্গ?নাকি সুশান্তের মৃত্যুর উপর সমস্ত স্পট লাইট পড়ার কারণ তিনি সেলিব্রিটি?প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে।একইসঙ্গে এই প্রশ্ন উঠবে সুশান্ত ইস্যুতে কেন্দ্রের এই অতি সক্রিয়তা কি বিজেপির ভোট ব্যাংক বাড়ানোর কৌশল?জল্পনা চলতেই থাকবে।যে জল্পনার আগুন আরও উসকে দিয়েছে কঙ্গনা রানাওয়াতের বিজেপিতে যোগদানের খবর।বর্তমানে সুশান্ত রিয়ার পরে হয়তো নেপোটিসিজম নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সবথেকে বেশি উঠে এসেছে এই অভিনেত্রীর নাম।সবশেষে একটাই কথা বলা চলে - সুশান্ত মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই।

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.