বিবিসির 'রিয়েলিটি চেক' অনুসন্ধানের রায়:
ভালোবাসার তাজমহল
মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার প্রেমকে অমর করে রাখতে যে কীর্তি স্থাপন করেছেন তা যে সত্যিই কালোত্তীর্ণ এ কথা নতুন করে বলার নেই। সেই অনন্য কীর্তি তাজমহল আজও বিশ্ববাসীর কাছে এক অপার বিস্ময়ের নাম। যদিও তাজমহল তৈরির খরুচে বিলাসিতা, নির্মাণ শ্রমিকদের ভাগ্য আর মমতাজের চৌদ্দতম সন্তান ধারণ শাহজাহানের ভালোবাসাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এরপরও তাজমহলের নির্মাণশৈলী মানুষকে মুগ্ধ করে।আজও মানুষ অবাক বিস্ময়ে জানতে চায় এর পেছনের লুকনো সত্য।
এই দাবির পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য কোন প্রমাণ নেই। বরঞ্চ ইতিহাসবিদদের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ,এমনকি ভারত সরকার পর্যন্ত মনে করেন, এই সৌধ ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের এক চমৎকার নিদর্শন।ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রা শহরের ঐতিহাসিক তাজমহল কখনো শিবমন্দির ছিল না বলে আদালতে হলফনামা পেশ করেছে দেশটির প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ (এসএসআই)। বেশ কিছুদিন আগে তাজমহল নিয়ে একটা বিতর্ক শুরু হয়। একটি মহল দাবি করে, তাজমহল গড়া হয়েছে একটি শিবমন্দিরের ওপর। শিবমন্দিরটি চাপা পড়ে আছে তাজমহলের নিচে। এই দাবিতে আগ্রার বেশ কয়েকজন আইনজীবী মামলাও দায়ের করেন। সেই মামলায় ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আইনজীবী অঞ্জনী শর্মা অ্যাফিডেভিটের মাধ্যমে আদালতকে জানিয়ে দেন, তাজমহল কোনো দিন শিবমন্দির ছিল না। এটি মুঘল সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের স্মৃতির উদ্দেশে গড়া সৌধ।
অঞ্জনী শর্মা বলেন, তাজমহলকে শিবমন্দির প্রমাণ করার জন্য যেসব তথ্য-প্রমাণ আদালতে পেশ করা হয়েছে, তার অধিকাংশই কল্পনাপ্রসূত। এর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। আর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তাজমহলের যে অংশটি বন্ধ রাখা হয়েছে, সেই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনার প্রয়োজন নেই।
এসএসআই দাবি করেছে, ঐতিহাসিক পি এন ওকের লেখা একটি বই নিয়ে প্রথম তাজমহল বিষয়ক বিতর্ক শুরু হয়। ওই বইয়ে পি এন ওক দাবি করেন, তাজমহলের তলায় শিবমন্দির চাপা দেওয়া হয়েছে। ওই শিবমন্দিরের নাম ছিল ‘তেজো মহালয়’। বইয়ের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আগ্রার আইনজীবীরা মামলা করেন। এতে তাজমহলকে শিবমন্দির হিসেবে মানার দাবি তোলা হয়। তাজমহলের নাম ‘তেজো মহালয়’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার আবেদন জানানো হয়।
হরিশঙ্কর জৈনসহ অন্য আইনজীবীদের দাবি, “আগ্রায় ভগবান অগ্রেশ্বর মহাদেব নগ্নাথেশ্বর বাস করতেন। এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাই ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’র হাত থেকে তাদের হাতে দিতে হবে।”আদালতে ওই আইনজীবীদের দাবি, “তাজমহল চত্বর থেকে সমস্ত কবরকে সরিয়ে ফেলতে হবে এবং এখানে মুসলমানদের ইবাদত করাও বন্ধ করতে হবে। এর পরিবর্তে সেখানে হিন্দুদের ভগবান শিবের পুজো করার অনুমতি দিতে হবে।”
আইনজীবীদের দাবি, “যেখানে এখন তাজমহল রয়েছে, সেখানে প্রাচীনকাল থেকে ভগবান অগ্রেশ্বর মহাদেব নগ্নাথেশ্বরের মন্দির ছিল। এ জন্য তাজমহলের সমস্ত সম্পত্তি এই মন্দিরের।”

ভারতের সরকারীভাবে সংরক্ষিত ইতিহাস অনুযায়ী, মোগল সম্রাট শাহ জাহান তাজমহল তৈরি করেছিলেন তাঁর মৃত স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মরণে।ভারতের মোগল শাসকরা এসেছিল মধ্য এশিয়া থেকে। ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে তারা ভারত শাসন করে।মোগল শাসনামলে দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে ইসলামী শিল্পকলা এবং সংস্কৃতির প্রসার ঘটে।শিল্পকলা ও স্থাপত্যের ব্যাপারে মোগলদের যে অনুরাগ, তার সবচেয়ে বড় নিদর্শন বলে গণ্য করা হয় তাজমহলকে।
ভারতের প্রত্নতত্ত্ব জরিপ বিভাগ তাজমহলকে বর্ণনা করেছে 'মোগল স্থাপত্যকলার চূড়ান্ত নিদর্শন' হিসেবে।আর তাজমহল নিয়ে ভারত সরকারের যে ওয়েবসাইট আছে, তাতে বলা হচ্ছে, "ইসলামী স্থাপত্যকলার সঙ্গে ভারতের স্থানীয় স্থাপত্যকলার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা সেসময়ের স্থাপত্য রীতির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহারণ এটি।"
এতে আরও বলা হয়, মোগলরা যখন তাজমহলের নির্মাণ কাজ শেষ করে, তখনও তারা তাদের পারস্য এবং তুর্কী-মোঙ্গল শেকড় নিয়ে গর্ব অনুভব করেছিলো। কিন্তু ততদিনে তারা একই সঙ্গে নিজেদের ভারতীয় বলেও ভাবতে শুরু করেছিলো।ইতিহাসবিদ রানা সাফভি বিবিসিকে বলেন, "তাজমহলের ইতিহাস নতুন করে লেখার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। সেখানে যে কখনো কোন মন্দির ছিল তার কোন প্রমাণ নেই।"
"তাজমহল তৈরি হওয়ার আগে সেখানে হিন্দু শাসক জয় সিং এর একটি 'হাভেলি' (প্রাসাদোপম বাড়ি) ছিল।""শাহজাহান এই হিন্দু শাসক জয় সিং এর কাছ থেকে হাভেলিটি কিনে নেন। এ নিয়ে একটি 'ফরমান' জারি করা হয়েছিল। সেটা এখনো আছে। এই ফরমানে দেখা যাচ্ছে মোগলরা তাদের বিভিন্ন চুক্তি এবং ইতিহাস রক্ষায় বেশ সচেতন ছিল।"
রানা সাফভি বলেন, "ডাব্লিউ ই বেগলি এবং জেড এ ডেসাহাসের লেখা একটি বইতে এসব দলিল সংকলন করা আছে।এসব বই পড়ে আমি উপলব্ধি করি, এসব ভবন এবং সৌধের ইতিহাস কত ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই বই পড়েই আমি যুক্তি দিতে পারি যে তাজমহল তৈরি হয়েছে রাজা জয় সিং এর বাড়ির জমির ওপর, এবং সেখানে কোন ধর্মীয় ভবন থাকার কোন উল্লেখ কোথাও নেই।"
আরেকজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হারবনস মুখিয়াও রানা সাফভির সঙ্গে একমত।'শাহজাহান যে তাঁর স্ত্রীর স্মরণে তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন এ নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।"ভারতের স্কুল পাঠ্য বই এবং বিভিন্ন সরকারী সাইটেও তাজমহলকে ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।প্রফেসর পিএন অক ‘তাজমহল : দ্য ট্রু স্টোরি’ তে শাহজাহান ও মমতাজের প্রেমকাহিনীর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি দাবি করেন শাহজাহানের ভালোবাসার গল্প মূলত লোকমুখে সৃষ্ট। তিনি দাবি করেন তাজমহল শাহজাহানের সময়ের চেয়েও ৩০০ বছরের পুরনো স্থাপত্য। পরে অবশ্য তার এসব দাবি ধোপে টেকেনি।
সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের প্রেম কাহিনীতে দেখা যায় শাহজাহান মমতাজকে বাজারে দেখতে পান এবং প্রথম দেখাতেই মমতাজকে পছন্দ করে ফেলেন। কিন্তু এও শোনা যায় শাহজাহানের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগেও মমতাজের বিয়ে হয়েছিল এবং সম্রাট শাহজাহান মমতাজের সেই স্বামীকে হত্যা করে তারপর মমতাজকে বিয়ে করেছিলেন। শুধু তাই নয় মমতাজের আগেও সম্রাট শাহজাহানের আরও তিনজন স্ত্রী ছিলেন এবং মমতাজকে বিয়ে করার পরও সম্রাট শাহজাহান আরও তিনটি বিয়ে করেন। এমনকি মমতাজ মারা যাওয়ার পর শাহজাহান মমতাজের আপন ছোট বোনকে বিয়ে করেন। তাজমহলের ডিজাইনারের নাম ছিল ঈশা মোহাম্মদ। তিনি তার স্ত্রীকে উপহার দেওয়ার জন্য একটি ভাস্কর্য বানিয়েছিলেন। পরে সম্রাট শাহজাহানের পছন্দ হওয়ায় সেই ডিজাইনের আদলে বানানো হয় তাজমহল। সেই ব্যক্তির চোখ নষ্ট করে দেওয়া হয় যাতে তিনি নতুন করে আর এই ডিজাইন তৈরি করতে না পারেন। শুধু তাই নয়, যে বিশ হাজার শ্রমিক দিনরাত খেটে এই মহলটি তৈরি করেছিলেন তাদের হাতও কেটে দিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান।
অনেকেই হয়তো জানেন না, তাজমহলের জমিটি এখন যতটা উঁচু দেখা যাচ্ছে আসলে আগে এটি এমন ছিল না। তাজমহল যে জমির ওপর দাঁড়িয়ে সেই জমি ছিল খুবই নিচু। জায়গাটি এই বিশেষ সৌধ নির্মাণের উপযুক্ত করতে প্রচুর মাটি ফেলা হয়। সেই নিচু জমিকে যমুনা নদীর তীরের উচ্চতা থেকে প্রায় ৫০ মিটার বা প্রায় ১৬০ ফুট উঁচু করা হয়। এজন্য সেখানে অনেকগুলো পাতকুয়া খোঁড়া হয়। ভাবতে অবাক লাগে এই কৌশল এখনো ক্ষেত্র বিশেষে আধুনিক স্থাপত্য নির্মাণেও ব্যবহার করা হয়। তবে এই কুয়োগুলো অবশ্য প্রয়োজনীয় কাজ শেষে পাথর, বালি ও মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়।
প্রাথমিক কাজেই লাগে ১৭ বছর
তাজমহল নির্মাণের মূল নকশা তৈরি করেন ওস্তাদ আহমেদ লাহাউরী। সে সময় বেশিরভাগ মুঘল দালানই তৈরি হতো লাল বালু, পাথর দিয়ে। তেমন কিছু নমুনা এখনো দেখতে পাওয়া যায়। যেমন হুমায়ুনের স্মৃতিসৌধ, জামা মসজিদ, তৈমুরের স্মৃতিসৌধ। সে দৃষ্টিকোণ থেকে তাজমহলের একটি বিশেষ দিক রয়েছে। তাজমহল নির্মাণে শাহজাহান প্রথম শ্বেতপাথর ব্যবহার করেন। শ্বেতপাথরের সৌধ হিসেবে তাজমহলের গুরুত্ব যে কাউকে আকৃষ্ট করে। এটি শুধু এখনই নয় সে সময়েও গোটা ভারতবর্ষের মানুষ কৌতূহলী হন। ১৬৪৮ সালে এই স্মৃতিসৌধের প্রাথমিক নির্মাণকাজ শেষ হয়। সে হিসাবে প্রাথমিক কাজেই লাগে ১৭ বছর। নির্মাণকাজ শেষ হলেও এর সৌন্দর্যবর্ধন চলতে থাকে। আশপাশের বাকি কাজুবাগান, তিন দিকের তিনটি প্রবেশদ্বার পুরোপুরি শেষ হতে আরও পাঁচবছর সময় লাগে। তাজমহলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের দেখা মিললেও এই সৌধ নির্মাণে বিভিন্ন ধর্মের স্থাপত্যের ছোঁয়া দেখা যায়। যেমন তাজের মাথার ত্রিশূলটি হিন্দুদের শিবমন্দিরের অনুকরণে, মুসলমানদের মসজিদের মতো করা হয় তাজমহলের চারটি মিনার ও মাথার গম্বুজ।
নান্দনিক ভাস্কর্য-
তাজমহলের প্রতিটি ভাস্কর্য এবং তার নকশা একেবারে সমান মাপের। অথচ তখন সব কাজই করা হতো হাতে। এমনকি ছাঁচের ব্যবহারও ছিল না। তাও সব নকশাই সমান। এ ছাড়া তাজমহলের চারদিকে অনেকগুলো আর্চিংয়ের কাজ করা খিলান রয়েছে। যাকে বলা হয় ইয়ান। এই ইয়ানের চারপাশে পবিত্র কোরআন ও ধর্ম প্রচারের নানা বাণী খোদাই করা আছে। সাধারণভাবে আমরা কাছের জিনিস আমরা বড় দেখি আর দূরের জিনিস ছোট। কিন্তু তাজমহলের ইয়ানের একেবারে মাথার ওপরের শিলালেখ যা ছোট হওয়া স্বাভাবিক ছিল তাও কিন্তু সমান আকারে নজরে পড়ে। এর কারণ তলার হরফের তুলনায় উপরের হরফ বেশ বড়। সেগুলো এমনভাবেই ক্রমাগত নিচ থেকে উপরে বড় করা হয়েছে যে তলায় দাঁড়িয়েও সব কটি হরফ এক মাপের বলে মনে হয়।
তাজমহলের সৌন্দর্য বর্ধনে এই শিলালিপিতে ব্যবহূত হয় পবিত্র কোরআন থেকে উদ্ধৃত বাণী। এই শিলালিপি কিন্তু রং দিয়ে লেখা নয়। প্রথমে শ্বেতপাথরের ওপর হরফাকৃতি খোদাই করা। তারপর সেই খোদাই করা জায়গায় সমান মাপের কালো পাথর কেটে বসিয়ে সেই বাণী লেখা।তাজমহলের অন্তর্সজ্জাও দারুণ।পাথরের পলিশ এতই উঁচুমানের যে, তার থেকে আলো প্রতিফলিত হয়। সমাধির ঠিক উপরের তলায় একটি কৃত্রিম সমাধি আছে। লোকে সেই সমাধিই দেখে।
স্থাপত্যশৈলী-
পুরো তাজমহল ১৮০ ফুট উঁচু যার প্রধান গম্বুজটি ২১৩ ফুট উঁচু এবং ৬০ ফুট চওড়া এবং এর চারপাশে চারটি মিনার আছে যার প্রতিটির উচ্চতা ১৬২.৫ ফুট। পুরো কমপ্লেক্সটির আকার ১৯০২ বাই ১০০২ ফুট। শুধু তাজমহলটি ১৮৬ বাই ১৮৬ ফুট মার্বেল পাথরের ওপর নির্মিত। এর প্রধান প্রবেশদ্বার ১৫১ বাই ১১৭ ফুট চওড়া এবং ১০০ ফুট উঁচু।
তাজমহল ছিল প্রকাণ্ড এক নির্মাণযজ্ঞ। এটির বিশেষত্ব ও গুরুত্ব দেখা যায় তাজমহলের নির্মাণ সামগ্রী আয়োজনে। তাজমহলের শ্বেত পাথর আনা হয়েছিল সুদূর রাজস্থানের মাকরানা থেকে। পান্না আসে পাঞ্জাব থেকে, চীন থেকে স্ফটিক, তিব্বত, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে আসে নানা ধরনের নীলকান্তমণি। মোট ২৮ ধরনের দুষ্প্রাপ্য দামি পাথর পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে আনানো হয় শ্বেতপাথরের গায়ে বসানোর জন্য। তাজমহলের এই অসাধারণ কীর্তি শুধু ভারতীয় বিশেষজ্ঞ দ্বারাই নির্মিত হয়। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিশেষজ্ঞদেরও আনা হয়েছিল নানা কাজের জন্য। ভাস্কররা আসেন বুখারা থেকে, হস্তাক্ষর শিল্পীরা আসেন সিরিয়া এবং পারস্য থেকে, রত্নশিল্পীরা আসেন উত্তর ভারত থেকে, মণিকারেরা আসেন বালুচিস্তান থেকে।
সত্যিই কি কালো মার্বেলের আরেকটি তাজমহল বানাতে চেয়েছিলেন শাহজাহান?
তাজমহলকে ঘিরে মিথের কোনো শেষ নেই। এর মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় মিথ হচ্ছে অসমাপ্ত দ্বিতীয় তাজমহলের গল্প। মুঘল সম্রাট শাহজাহান নাকি যমুনার অন্য পাড়ে কালো মার্বেল পাথরে আরেকটি তাজমহল তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেন?
প্রথম এই গল্পের বীজ বোনেন ফরাসি পর্যটক জ্যঁ ব্যাপটিস্ট টাভারনিয়ার। ১৬৪০ ও ১৬৫৫ সালে মুঘল রাজধানী আগ্রায় ভ্রমণ করেছিলেন টাভারনিয়ার। তার ভ্রমণ কাহিনীতে তিনি লিখেন, সম্রাট শাহজাহান যমুনার অপর পাড়ে নিজের সমাধিক্ষেত্রের নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু নিজের ছেলেদের সঙ্গে লড়াই শুরু হওয়ায় তিনি তা শেষ করতে পারেননি। স্থানীয় লোককথায় এর কিছুটা প্রমাণ মেলে। শাহজাহান নাকি যমুনার ওপর একটি সেতু বানিয়ে নদীর দুই পাড়ে নিজের ও স্ত্রীর সমাধিকে সংযুক্তও করতে চেয়েছিলেন। কালো তাজমহলের মিথ আরও ঘনীভূত হয় ১৯ শতকে এসিএল কারলেইলি নামের এক ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ যমুনার পাড়ে একটি পুকুরে কালো মার্বেল খুঁজে পাওয়ার দাবি করার পর। পরে অবশ্য দেখা যায় এটি আসলে সাদা মার্বেলই ছিল। পুরনো হয়ে যাওয়ায় কালো হয়ে গেছে।গবেষকদের মতে,শাহজাহান তার প্রপিতামহ সম্রাট বাবরের তৈরি মাহতাব বাগকে সংস্কার করে তাজমহল কমপ্লেক্সের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে স্থপতিদের অনুরোধ করেছিলেন। এটাই নাকি পরিকল্পিত দ্বিতীয় বা কালো তাজমহল নির্মাণের স্থান।
তাজমহলের মধ্যে শাহজাহানের সমাধিটির অবস্থান বিবেচনা করলেও এটা বোঝা যায় যে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে একই সমাধিতে সমাহিত হতে চাননি। কেননা, পুরো তাজমহলের নকশায় চূড়ান্ত রকমের প্রতিসাম্য থাকলেও শাহজাহানের সমাধিটি সমাধিঘরের পশ্চিম দিকের দেয়ালের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীনভাবে বানানো। কিন্তু মমতাজ মহলের সমাধি ওই ঘরের ঠিক মাঝখানে।এসব তথ্য-উপাত্ত আর বর্ণনায় মনে হতেই পারে যে শাহজাহান আরেকটি কালো তাজমহল বানাতে চেয়েছিলেন নিজের সমাধির জন্য। কিন্তু ইতিহাসবিদেরা সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। কেননা, কেবল ফরাসি পর্যটক টাভারনিয়ারের লেখা ছাড়া আর কোথাও এমন দাবির পক্ষে প্রমাণ মেলেনি।
কিন্তু ইতিহাস যা-ই বলুক না কেন, কালো তাজমহলের ধারণাটি অনেক শিল্পীকেই অনুপ্রাণিত করেছে। অনেক শিল্পীই কালো তাজমহলের ছোট্ট অনুকৃতিও বানিয়েছেন এই গল্পের অনুপ্রেরণা থেকেই।
তাহলে তাজমহল যে মন্দির ছিল সেই কাহিনী কোত্থেকে আসলো?
তাজমহলের ইতিহাস নতুন করে লেখার দাবি ভিনয় কাটিয়ারই যে প্রথম জানিয়েছেন তা নয়।এর আগে ডানপন্থী ইতিহাসবিদ পিএন ওক ১৯৮৯ সালে প্রকাশ করা 'তাজমহল: দ্য ট্রু স্টোরি' বইতে এই সৌধকে 'তেজো মহল' বলে দাবি করেন।বইতে তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে এটি ছিল আদতে একটি হিন্দু মন্দির এবং একজন রাজপুত শাসক এটি তৈরি করেন।মিস্টার ওক মনে করেন, সম্রাট শাহজাহান এটি দখল করে সেটিকে পরে তাজমহল নাম দিয়েছেন।লেখক সচ্চিনানন্দ শেভডে ইতিহাসবিদ পিএন ওকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। তিনি বিবিসির মারাঠী সার্ভিসকে বলেন, সরকারের উচিত 'প্রকৃত সত্য' উন্মোচনের জন্য একটি দল নিয়োগ করা।"তাজমহল কোন মুসলিম স্থাপত্য নয়। এটি আসলে একটি হিন্দু স্থাপত্য", দাবি করছেন তিনি।কিন্তু সরকারের তাজমহল ওয়েসবাইটে দাবি করা হচ্ছে, এই স্থাপত্য পারস্য, ভারতীয় এবং ইসলামী স্থাপত্যকলার সংমিশ্রন।
স্থাপত্য রীতি:
মিস্টার কাটিয়ার এবং মিস্টার শেভডে, উভয়েই যুক্তি দেন যে, তাজমহলের স্থাপত্যে অনেক হিন্দু স্থাপত্যের ছাপ রয়েছে।
"তাজমহলের শীর্ষে একটি অর্ধাকৃতি চাঁদ আছে। ইসলামিক স্থাপত্যে এই চাঁদটি সাধারণত বাঁকা থাকে। কিন্তু তাজমহলের চাঁদ বাঁকা নয়। এই চাঁদ আসলে হিন্দু দেবতা শিবের সঙ্গে সম্পর্কিত।""এছাড়া এই সৌধ চূড়ায় একটি কলসও আছে। সেখানে আমের পাতা এবং উল্টে রাখা নারকেলও আছে। এগুলো হিন্দু প্রতীক। ইসলামী সংস্কৃতিতে ফুল, পশুর প্রতিকৃতি নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও তাজমহলে এসব ব্যবহার করা হয়েছে।মিস্টার মুখিয়া অবশ্য এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
"স্থাপত্য রীতি সব সময় বদলায় এবং সেখানে বহু সংস্কৃতির প্রভাব পড়ে। মোগল স্থাপত্যকলাও এর ব্যতিক্রম নয়। কলস হিন্দু স্থাপত্যরীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু অনেক মোগল স্থাপত্যেও এটি দেখা যায়, তাজমহলেও। মোগলদের তৈরি আরও অনেক স্থাপত্যে কলস এবং পাতা দেখা যাবে।"
কিন্তু এই জানা এবং সর্বজন বিদিত তাজমহলের ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন প্রফেসর পি.এন. অক (Professor P.N. Oak– Taj Mahal: The True Story বই এর লেখক) তার একটি গবেষণাধর্মী বইতে ।
এতদিন যাবত আমরা তাজমহল সম্পর্কে যা জেনে এসেছি তা অনেক বড় ভূল বলে তিনি দেখিয়েছেন। তিনি তাজমহলে নামকরন নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তার মতে তাজমহল কোন ভাবেই মমতাজের নাম থেকে আসেনি । নামটি এসেছে “তেজ মহলয়” থেকে । তিনি দাবী করেন যে তাজমহল বেগম মমতাজ মহলের সম্মানে নির্মিত প্রেমের সমাধিস্থল নয়; বরং এটা প্রাচীন দেবতা শিব (যাকে আগে বলা হত “তেজ মহালয়”) এর মন্দির যেখানে আগ্রার রাতপুতরা পূজা অর্চনা করতেন। পরে মোঘল সম্রাট আকবরের দৌহিত্র সম্রাট শাহজাহান একে তাঁর মৃত স্ত্রীর স্মরণে স্মৃতিশালা হিসেবে গড়ে তোলেন।
রাজপরিবারের অধীনে থাকায় সাধারন মানুষের কাছে এ মন্দিরটি ছিল অচেনা। পরবর্তীতে মমতাজ মারা গেলে তাকে এখানে সমাহিত করা হয় এবং সাধারনের সামনে চলে আসে মন্দিরটি । আর তখনই মানুষের মুখে মুখে মমতাজ শাজাহানের প্রেম কাহিনী প্রচারিত হয় ।
ইতিহাস অনুসন্ধানে তিনি দেখতে পান যে শিব মন্দিরটি সম্রাট শাহজাহান অন্যায়ভাবে জয়পুরের মহারাজার (জয় সিং) কাছ থেকে দখল করেন । সম্রাট শাহজাহান নিজেই তাঁর নিজস্ব দিনপঞ্জীতেও (বাদশাহনামা) উল্লেখ করে গেছেন যে, জয় সিং এর কাছ থেকে আগ্রার এক চমৎকার প্রাসাদোপম ভবন মমতাজ মহলের সমাধিস্থলের জন্য বেছে নেয়া হয় এবং এর জন্য জয় সিংকে অনত্র জমিও দেয়া হয় সম্রাট শাহজাহানের পক্ষ থেকে ।
“তাজমহল” নাম নিয়েও প্রফেসর অক সংশয় প্রকাশ করেন । তিনি বলেন, মোগল আমল এমনকি খোদ সম্রাট শাহজাহানের আমলেও দলিলাদি ও কোর্টের নথিপত্রে কোথাও “তাজমহল” নাম উল্লেখ নাই । আর তাছাড়া সে সময়ে কোন মুসলিম দেশে মুসলিম শাসনামলে কোন প্রাসাদ বা ভবনের নাম “মহল” রাখার প্রচলন ছিল না ।এছাড়া “তাজমহল” নামটি এসেছে ‘মমতাজ মহল’ থেকে এ বিষয়টি তাঁর কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি । তিনি এর পেছনে দুটি কারণ উল্লেখ করেন ।
☞ প্রথমতঃ তাঁর প্রকৃত নাম কখনোই ‘মমতাজ মহল’ ছিল না বরং তাঁর নাম আরজুমান্দ বানু বেগম ৷
☞ দ্বিতীয়তঃ সাইকোলজিক্যাললি কেউ কারও নামে কোন প্রাসাদের নামকরন করতে চাইলে তার নামের প্রথম দুই অক্ষর বাদ দিয়ে (অর্থাৎ মমতাজ থেকে “মম” বাদ দিয়ে তাজ) নাম রাখবেন– এটাও সহজে মেনে নেয়া যায়না । এটা মানব স্বভাবের মধ্যে পড়ে না ।
প্রফেসর পিএন অক দেখিয়েছেন যে এ রকম প্রেম কাহিনী সে সময়ের কোথাও লিপিবদ্ধ নেই তাই এ কাহিনী লোকমুখে প্রচারিত (ধারণা প্রসূত মাত্র)। তিনি আরো বলেন, মমতাজ আর শাহজাহানের ভালবাসার গল্প মুলতঃ রূপকথা যা ওই সময়ের লোকদের মুখ থেকে সৃষ্ট; কারন ওই সময়কার কোন সরকারী নথিপত্রে বা গ্রন্থে মমতাজ-শাহজাহানের প্রেমের কথা উল্লেখ নেই।
পাশাপশি প্রফেসর অক কিছু ডকুমেন্টরি উপস্থাপন করেন যা প্রমাণ করে তাজমহল কখনোই সম্রাট শাহজাহান শাসনামলের নয় ।সেগুলো হল-
১। নিউ ইয়র্কের আর্কিওলজিস্ট মারভিন মিলার (Marvin Miller) যমুনা নদীর তীর সংলগ্ন তাজমহলের দেয়ালের নমুনা পরীক্ষা করেন ।তিনি এর কার্বন টেস্ট করে যে তথ্য পান, তাতে যে কার্বন পাওয়া যায় তা সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলের চেয়েও ৩০০ বছরের বেশি পুরনো !
২। এছাড়া আরেকটি ব্যাপার হল এক ইউরোপিয়ান পর্যটক যিনি ১৬৩৮ সালে আগ্রা ভ্রমন করেন । সময়টি শাহজাহান স্ত্রী মমতাজের মারা যাওয়ার মাত্র ৭ বছর পর । কিন্তু তিনি তার লিখিত ভারতবর্ষ ভ্রমণ গ্রন্থে তাজমহল নামক প্রাসাদের কোন কথাই উল্লেখ করেননি ।
প্রফেসর অক তাজমহলের স্থাপত্য শৈলীর কিছু অসামঞ্জস্যতার কথা উল্লেখ করে বলেন যে তাজমহল মুলতঃ হিন্দু শিব মন্দির ছাড়া আর কিছুই নয় ।তিনি আরও যুক্তি দেখান, তাজমহলের অনেক কামরাই সম্রাট শাহজাহানের আমল থেকেই তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে যা এখনও জনসাধারণের অজানা রয়ে গেছে । তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেন যে ওই সব কামরাগুলোর একটাতেই আছে দেবতা শিবের মস্তকবিহীন মূর্তি অর্থাৎ শিব লিঙ্গ যা হিন্দুদের শিব মন্দিরে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় ।
বিখ্যাত তাজমহল নিয়ে প্রফেসর অকের এ উল্টো বক্তব্য ও ইতিহাস তিনি তার যে বইতে লিখেছিলেন তৎকালীন ভারতের ইন্দিরা গান্ধী সরকার বইটি ব্যান্ড করে দেয় ও সবগুলো কপি বাজার হতে উঠিয়ে নেয় এবং ভারতে এর দ্বিতীয় কোন কপি প্রকাশ করাও বন্ধ করে দেয় ।
সেখানে কারণ দেখানো হয়, যদি এ বই প্রকাশ করা হয় তাহলে ভারতে হিন্দু ও মুসলিমদের মাঝে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক সংঘাত বা রায়োট বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ।পরে প্রফেসর অকের প্রচলিত ইতিহাস বিরোধী বক্তব্য এবং তার বই বিশ্লেষণে গবেষকরা এতটুকু মত দিতে পেরেছেন, তাজমহলের মার্বেল পাথর, ইসলামিক সংস্কৃতি,আল কোরানের আয়াত ক্যালিওগ্রাফি এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত গম্বুজের কারুকাজ এসব কিছুই সম্রাট শাহজাহানের সময়ে হয়ে থাকলেও তাজমহলের প্রাথমিক স্থাপনা শাহজাহান কর্তৃক না হয়েও থাকতে পারে ।
তবে তাজমহল তৈরির আসল ইতিহাস যতই বিতর্কিত হয়ে থাকুক, তবু তাজমহল মুঘল মুসলিম স্থাপত্য কীর্তিগুলোর মধ্যে গৌরবান্বিত অলঙ্কার, একটি অনন্য কীর্তি । সপ্তাশ্চর্যের এক আশ্চর্য ।
BJP's Vinay Katiyar now calls Taj Mahal a Hindu temple - a 'bee in bonnet' theory that Supreme Court once rejected India Today
Giles Tillotson (2008). Taj Mahal.Harvard University Press. pp. 112–114.ISBN 9780674031869.
Muslim Digest, July to Oct. 1986 pages 23–24;Purushottam Nagesh Oak, Indian Kshatriyas Once Ruled from Bali to Baltic & Korea to Kaba(1966)
"Hindu Vishva", Volume 27, Issues 4-11, pp. 16.
Rabbi Simon Altaf, 2011, World War III - Unmasking the End-Times Beast: Unmasking End Time Beast, African-Israel International Union of Israelite Qahalim, ISBN 1599160528.
Aravamudan, Srinivas (27 June 2011). Guru English: South Asian Religion in a Cosmopolitan Language. Princeton University Press. p. 34. ISBN 9781400826858.
Bryant, Edwin (20 September 2001)."Aryan Origins and Modern Nationalist Discourse". The Quest for the Origins of Vedic Culture. Oxford University Press. pp. 267–297.doi:10.1093/0195137779.003.0014.ISBN 9780195137774.
Bryant, Edwin (20 September 2001)."Introduction". The Quest for the Origins of Vedic Culture. Oxford University Press. pp. 3–12.doi:10.1093/0195137779.003.0001.ISBN 9780195137774.
Peter Parker (13 September 2008)."Review: Taj Mahal by Giles Tillotson".The Daily Telegraph.
Giles, Tillotson (12 November 2012).Taj Mahal. Harvard University Press. pp. 112–115, 163. ISBN 9780674063655.
Brown, Rebecca M. (8 July 2004). "Lagaan: Once Upon a Time in India (review)". Film & History: An Interdisciplinary Journal of Film and Television Studies. 34 (1): 78–80.doi:10.1353/flm.2004.0008.ISSN 1548-9922.
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন