মেধা ও মননের সমন্বয়ে : পিনাকী চৌধুরী

মেধা ও মননের সমন্বয়ে : পিনাকী চৌধুরী  
মেধা ও মননের সমন্বয়ে সত্যজিৎ রায় : পিনাকী চৌধুরী        

একজন মানুষের শিল্প বা সাহিত্য ব্যাপারটা ভেতর থেকে আসে। আমাদের দেশের অনেক প্রতিভাবান মানুষ আছেন , যাঁদের হয়তো সেই অর্থে প্রথাগত শিক্ষা নেই, কিন্তু তাঁদের সহজাত প্রতিভার দ্বারা ক্রমে ক্রমে বিখ্যাত হয়েছেন । যেমন ধরুন সত্যজিৎ রায় , একদা বালিগঞ্জ গভর্মেন্ট স্কুলের মেধাবী ছাত্রটি । অতীতে সত্যজিৎ রায় প্রথাগত শিক্ষার দিকে ঝুঁকেছিলেন ঠিকই,  কিন্তু শান্তিনিকেতনে কলাভবনে ফাইন আর্ট চর্চা করলেন টানা দু'বছর, তারপর আর সেখানে তাঁর মন টিকলোনা, শিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই তিনি আবার কলকাতায় ফিরে এলেন!  

বাস্তবে সেইসময় সত্যজিৎ রায় কমার্শিয়াল আর্টের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন ।  ক্রমে ক্রমে তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটতে লাগলো এই জগতে ! আসলে সৃষ্টিশীল মানুষ মাত্রই এইরকম হন , প্রতিনিয়ত পরীক্ষা- নিরিক্ষা, নতুন কিছু সৃষ্টির তাড়নায় তাঁরা যেন নিবেদিত প্রাণ হয়ে যান । সত্যজিত রায় যেন শুধুমাত্র একটি নামতো নয় , বাস্তবে তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান ! গ্রাফিস্ক শিল্প থেকে চলচ্চিত্র নির্মান - সবেতেই ছিলো তাঁর অনায়াস বিচরণ !বস্তুত চলচ্চিত্রের সাথে গ্রাফিক্স শিল্পের একটি সুন্দর যোগসূত্র তিনি স্থাপন করেছিলেন , ঘটিয়েছিলেন এই দু'য়ের মেলবন্ধন ! 

তাঁর অনন্যসাধারণ সৃষ্টি পথের পাঁচালীর সংস্করনের জন্য এই মহান শিল্পী সাদা- কালোয় নির্মাণ করলেন অসাধারন লিনোকাট ! দর্শক এবং পাঠকমহলে তা সমাদৃত হল। এখানে বলে রাখা ভালো যে, সত্যজিৎ রায় কিন্তু পূর্ণ চিত্র থেকেও বেশী গুরুত্ব দিতেন ড্রয়িংকে । নিজস্ব কল্পনায় কখোনো তিনি একটি রেখাকে অন্য রেখায় মিলিয়ে দিতেন , কখোনোবা আবার বিস্ফোরণ ঘটাতেন ! তৈরি করতেন  অন্য জগৎ । সেই সঙ্গে চলতে থাকলো গ্রাফিক্স শিল্পের বা চলচ্চিত্রের নতুন নতুন আঙ্গিকে তাঁর নিরন্তর পরীক্ষা -নিরীক্ষা , তখন যেন সত্যিই সত্যজিৎ রায়ের শিল্পচেতনা আকাশে ডানা মেলতে থাকলো!  এমন একটা সময় ছিলো, যখন পাশ্চাত্য শিল্প , সঙ্গীত বা সাহিত্য তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো , কিন্তু সেটা সাময়িক , শান্তিনিকেতনের কলাভবনের মনোরম পরিবেশ , সাথে নন্দলালের দুর্লভ সান্নিধ্য তাঁর জীবনের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিলো ! হ্যাঁ, সত্যজিৎ রায়ের শিল্পধর্মের শিকড় পোঁতা ছিলো কিন্তু এই গ্রামবাঙলার মাটিতেই , গ্রামের মেঠো পথ, কিংবা বাউল গান - এসবই তাঁকে আকৃষ্ট করতে থাকলো। 

শুধু কি তাই ? সাহিত্য এবং বই প্রকাশনার জগতেও ছিলো তাঁর অনায়াস বিচরণ ! অতীতে এমন একটা সময় ছিলো, যখন দিলীপকুমার গুপ্ত এবং সত্যজিৎ রায়ের যুগলবন্দী বাঙলা বই প্রকাশনাকে আধুনিক করে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন ! তারপর থেকেই যেন বাঙলা বই প্রকাশনা কিছুটা হলেও সাবালক হল ! বাস্তবে শিল্প ব্যাপারটা ছিলো সত্যজিৎ রায়ের মজ্জাগত, তীব্র প্যাশনও বলা চলে ! তিনে রঙিন ডিজাইনের থেকেও বেশী গুরুত্ব দিতেন সাদা কালোয় মনোক্রম মাধ্যমকে। কভার ডিজাইনেও তিনি এক নতুন ধারার প্রবর্তন করলেন ! নতুন নতুন সৃষ্টির নেশা যেন তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো ! পুরানো পুঁথির হরফমালা থেকে কালীঘাটের পটের মোটিফ , অভিনবত্ব এবং বৈচিত্র্যে যাকিনা সবাইকে চমকে দিয়েছিলো ! হ্যাঁ , এভাবেই তখন এই বরেণ্য মানুষটি মধ্যগগনে দীপ্যমান সূর্যের মতোন সবাইকে আলোকিত করেছিলো ! 

দেশকালের সীমানা অতিক্রম করে সত্যজিৎ রায়, এই নামটি আজও সর্বজনগ্রাহ্য ! মৃত্যুর এত বছর পর, আজও তাঁর সৃষ্টিগুলো দর্শক এবং পাঠকমহলে সমাদৃত ! আজও তাই পথের পাঁচালীর সেইসব সহজ, সরল, অনাড়ম্বর দৃশ্য দর্শকদের হৃদয়ে অনুরণণ তোলো !
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.