![]() |
শিব বা ভোলানাথ নিয়ে নানারকম : মৃদুল শ্ৰীমানী |
ত্রিশূল ও কনডোম সম্পর্কে আমি যা ভাবছি
আমি মহাদেবের খুব ভক্ত । সেই যে পরিহাসপ্রিয় অসম্ভব সুন্দর চেহারার দেবতাটি । সাধে কিশোরী মেয়েরা আমার ছোটবেলায় শিবের মতো বর পাব বলে পুণ্যি পুকুর ব্রত করতো। সেই শিব ভোলানাথ , যার টানে উমা পার্বতী তপস্যা করতে করতে অপর্ণা হয়ে ওঠে। ভোলানাথের দারুণ সব ব্যাপার স্যাপার ! ক্লাস ফোরে পড়তে পড়তেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এর বইয়ে অন্নদা মঙ্গল চোখে পড়ে। কালকেতু ফুল্লরার উপাখ্যান , মনসার জন্ম কথাও পড়ে ফেলি। আমাদের রায়গুণাকর কবি শিবের সম্পর্কে পরমেশ্বরীকে দিয়ে ঈশ্বরী পাটনীর কাছে কি বলিয়েছেন, তাও । “ কুকথায় পঞ্চমুখ , কণ্ঠ ভরা বিষ , কেবল আমার সাথে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ “ ! পরে পরে জেনে গেলাম বাংলার সাধারণ ঘরের স্বামী স্ত্রীর নিত্য নৈমিত্তিক দ্বন্দ্বকে এক অনুপম ছবিতে পেশ করেছেন ভারতচন্দ্র। আর তার মাঝে বুনে দিয়েছেন ফাইন লাইন । ভেতরে ভেতরে অন্য কথা বলতে পারার অলঙ্কার । ওপরে যা দেখছো, ভেতরে তার পুরো উলটো কথা।
তো এই আমার শিব। শিব একটু কেমন যেন । প্র্যাকটিক্যাল টাইপের । মানে গোস্বামী বাবাজিদের পরম পুরুষ কৃষ্ণ নয়, বড়ু চণ্ডীদাসের কাহ্ন টাইপের । রক্ত মাংসের প্রাকৃত মানুষ । তার যৌনতা তার খুব বড়ো পরিচয়। সাধে অন্নপূর্ণা বলেন “ গঙ্গা নামে সতা তার তরঙ্গ এমনি “ ! এমন কি চণ্ডী শিবকে ছলনা করে প্যাঁচে ফেলে দেন। মেছুনি সেজে চণ্ডী মাছ ধরতে থাকেন । মেছুনির কাপড় ভদ্র সমাজের মাপে নয়। কন্যা তুমি হও গহীন গাঙ টাইপের কাপড় চোপড় পরে চণ্ডী মাছ ধরতে থাকেন । আর তাকে পরস্ত্রী ভেবে ভোলানাথের রেতঃপাত হয়। সেই বীর্য বাসুকি গ্রহণ করে মনসার জন্ম দেন। সাধে চণ্ডী মনসাকে দু চোখে দেখতে পারতেন না? চণ্ডী এমন কি মনসার একটা চোখ নষ্ট করে দেন। সেই থেকে মনসা “কানি” বা ‘চ্যাং মুড়ি কানি’ । তো শিবের কনডোম পরার সুবিধে থাকলে সাধু চন্দ্রধরের গল্পটা মাঠে মারা যেত । কেননা মনসার জন্মই হতো না। শিব তো সন্তান হিসেবে মনসাকে প্রার্থনা করেন নি। লঘু চপল স্বভাবের কারণে রেতঃপাত হয়ে গিয়েছে। মনসা নেহাতই শিবের অনাকাঙ্ক্ষিত কন্যা সন্তান ।
বাঙালির কবি শিবকে ঘর সংসারী করতে চাইলেন। ওই বাঘছাল পরা লোকটাকে আর ভাঙ খেয়ে নেশা করে ভোম হয়ে শ্মশানে মশানে ঘুরতে দেওয়া যাবে না। সভ্য হতে হবে। তো শিবের ত্রিশূল ভেঙ্গে হলকর্ষণের লাঙল বানানো হল। দেখেছেন, ত্রিশূল নয়, লাঙল । ত্রিশূলের দফারফা হয়ে গেছে বাঙালি কবির হাতে সে আজ বহুদিন হল । ছিল ত্রিশূল, হয়ে গেল লাঙল । এগ্রিকালচার। হরধনু ভঙ্গ করে দিলেন দূর্বাদল শ্যাম রাম। রাম মানে আরাম । সবুজের জয়গান। ছিল যুদ্ধাস্ত্র , হয়ে গেল সৃষ্টি সুখের উল্লাস।
শিবের কথা ভেবে বাঙালির মেয়ে লিঙ্গেশ্বরের মাথায় জল ঢালে । লিঙ্গ পূজা্র এক গভীর ঐতিহ্য আছে ভারতে। রাম যখন বনবাসে চলেছেন , শিব তখন তাঁকে দেখা দেন। নৃত্যরত শিবের মুখের ভিতর লিঙ্গ । রাম বুঝলেন চোদ্দো বছর বনবাসে থাকতে নিজ লিঙ্গটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বনের মধ্যে সন্তান প্রসব করা মহা ঝকমারি। জনকনন্দিনী ওই হ্যাপা সামলাবেন কি করে। অতএব , লিঙ্গটি নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার। শিব কি রামকে ওরাল সেক্সের পরামর্শ দিয়েছিলেন? হবে হয় তো। খাজুরাহো ও কোণার্ক দেখা বাঙালি জানে যৌনতাকে উৎসব করে তুলতে ভারতীয়দের দক্ষতার অভাব ছিল না। ওরাল সেক্সকে ট্যাবু ভাবা হতো না। ধীমান আর বিটপালের বন্ধুরা কঠিন পাথরে রক্ত মাংসের মহাকাব্য লিখে গিয়েছেন খাজুরাহো ও কোণার্ক -এ । আজকের দিন হলে রামকে বন্ধু বান্ধবেরা শৌখিন কনডোম উপহার দিতে পারতেন। বন্ধুরা ওসব পারে। বাঙালি সমাজে এখন এগুলো অ্যাকসেপটেড প্র্যাকটিশ ।
ভালো না বাসলে যৌনতার উৎসব হয় না। রসোদগার হয় না। অনেক পুরুষ নিজের তৃপ্তির বেশি কিছু ভাবতে চান না। যৌন সঙ্গীটি কিসে তৃপ্তি পাবেন সে খেয়াল রাখেন না তিনি। কিন্তু সে জিনিস রতিক্রীড়া হয়ে ওঠে না। শিব কিন্তু পার্বতীর সুখের কথাই বেশি ভেবেছেন । কাহ্নের রাধিকাও । রাধিকার মুখে কবি বলেছেন ”চির চন্দন উরে হার না দেলা।“ বুকের স্পর্শ যাতে সবটুকু পাও, তাই বুকে না মেখেছি চন্দন, না পরেছি হার, এমন কি আঁচল টুকুও দিই নি । ... সঙ্গীর সুখের জন্যে সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেন পারাবতী প্রেমিকা। আমাদের শিব হয়ে উঠেছেন অর্ধনারীশ্বর । সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সামগ্রিক সুখের কথা ভেবে যে যৌনতা, তা কাম হতে প্রেমে উত্তীর্ণ হয়েছে।
শিবের ত্রিশূল তো লাঙল হলো। কিন্তু চাষ বাসের সাথে যে যৌনতার সুগভীর সম্পর্ক । ভূমি হল সহযোগে কর্ষিত হয়। নারী অঙ্গও পুরুষাঙ্গ দ্বারা কর্ষিত হয়। দুইয়ের মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েছে কর্ষণজীবী সমাজ। তাই ভূমিকে শস্যশ্যামলা করতে তরুণ তরুণী চাষের ক্ষেতে ভালবাসার উৎসব করে। সে জিনিস শহুরে ভ্যালেনটাইনস ডে নয়। কাহ্ন রাধার ভালবাসা, “তিঅড্ড চাপি” কোল দেওয়া শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের ভালোবাসা। লাঙল আর যৌবনের মদ মহোৎসব মিলে মিশে যায় । সেখানে কনডোম থাকুক। অবাঞ্ছিত সন্তান এসে যাবার ভয় প্রেমিক যুগলকে গ্রাস না করুক। কবির জয় হোক । প্রেমের উৎসবের জয় হোক।
গঙ্গা রহস্য
২
শিবের কথা আরো মনে এলো। শিবের মাথার উপর গঙ্গা । তাই শিবের আরো একটি নাম গঙ্গাধর। যতোটুকু মনে পড়ছে, নারদ বীণা বাজিয়ে বিষ্ণুকে গান শোনাচ্ছিলেন । সেই গান শোনার সুখে নারায়ণের পা গলে জল হয়ে গেল। সেই জলই না কি গঙ্গা । তো গঙ্গা তো মর্ত্যে আসবেন। কেননা ভগীরথ তপস্যা করেছেন তার পূর্ব পুরুষদের শাপ মুক্তির জন্যে । সগর রাজার ষাট হাজার ছেলে যে অভিশপ্ত হয়ে আছেন , তাদের মুক্তির পথ হল গঙ্গাপ্রাপ্তি । তো গঙ্গা ঝাঁপিয়ে পড়বেন সেই বিষ্ণুলোক থেকে । অনেক উঁচু জায়গা। মোমেন্টাম হবে সাংঘাতিক ! কে ঐ জলের তোড় সামলে নিতে পারবে ? যে সে রামা শ্যামার কাজ নয়। একাজের জন্যে বাছা হল শিব মহেশ্বরকে । তিনিই পারেন গঙ্গাকে ধারণ করতে।
তবে শিবকে যতোটা আলাভোলা মনে করে থাকে অনেকে, ততোটা আলাভোলা তিনি নন। একটু রহস্য করতে ইচ্ছে যায় ভোলানাথেরও । তিনি নিজের জটার মাঝে লুকিয়ে ফেলেন গঙ্গাকে। বের হবার পথ পান না গঙ্গা । শেষে ভগীরথের কাকুতি মিনতিতে আর্দ্র হল শঙ্কর ব্যোমকেশের হৃদয় । গঙ্গার মর্ত্যে অবতরণ হল ।
কবি যদি জানতে চান নদীর কাছে " নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছো ?"
কবির কানে কানে কুলু কুলু নাদিনী উত্তর দেন " মহাদেবের জটার শিখর হইতে ।"
৩
শিব আর গঙ্গার কথায় আরো কিছু কথা মনে উঁকি মারলো। শিব যে নিজের মাথার উপর গঙ্গাকে স্থান দিয়েছিলেন সেই নিয়ে কি শিবজায়ার খেদ ছিল? সাধে কবি বলেন " গঙ্গা নামে সতা তার তরঙ্গ এমনি ...।"
গঙ্গা ছিলেন অসাধারণ রূপবতী । দেবসভায় একবার দাঁড়িয়ে আছেন গঙ্গা । পরিধানে ভারি স্বচ্ছ পোশাক । বায়ু করলেন কি সেই পোশাককেও উড়িয়ে দিলেন । ফ্যাশন দুনিয়ার সেরা মডেলের মতোই চোখের পাতাটুকু না কাঁপিয়ে দেবসভায় জন্মদিনের পোশাকে দাঁড়িয়ে রইলেন গঙ্গা ।
সভ্যভব্য দেবতারা লজ্জা পেয়ে চোখ নিচু করলেন। ওটাই সভ্য দুনিয়ার দস্তুর। কেবল একজন গঙ্গার ওই অসামান্য নগ্নকান্তি চোখভরে দেখে গেলেন।
দেবতাদের সমবেত অভিশাপে সেই রূপদর্শীকে মানুষ হয়ে জন্মাতে হল।
রাজা প্রতীপ গঙ্গাতীরে বেড়াতে এসে চমৎকার পরিবেশ দেখে বসেছেন । অমনি গঙ্গা উঠে এসে তাঁর কোলে বসলেন। মেয়েদের আবার কোলে বসানোর নিয়ম টিয়ম আছে। কোনো কোলটা বধূর জন্য । অন্যটি কন্যা স্থানীয়া দের জন্য । রাজা প্রতীপ তার পুত্র শান্তনুর জন্য গঙ্গাকে পাত্রী হিসেবে মনোনীত করলেন। এরপর গঙ্গা গর্ভে অষ্ট বসু জন্মাবেন, আর প্রতি ক্ষেত্রেই গঙ্গা তাদের ভাসিয়ে দেবেন জলে । কেননা অষ্টবসুর সাথে গঙ্গার সে রকমই কন্ট্রাক্ট ছিল। গঙ্গা জানতেন এসবই তিনি করবেন। কিন্তু সাধারণ মানব রাজা শান্তনু সে সব জানতেন না । বিয়ের সময়েই শান্তনুর থেকে কথা আদায় করে রেখেছিলেন গঙ্গা , যে কোনোভাবে বধুর মনস্তুষ্টির বিপরীতে গেলেই গঙ্গা আর স্বামী গৃহে থাকবেন না ।
কথা দেওয়া সত্বেও অষ্টম গর্ভের সন্তান বিসর্জনের সময় শান্তনু বেঁকে বসলেন। ব্যস , চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে গঙ্গা ত্যাগ করে গেলেন শান্তনুকে । সেই শিশু সন্তান দেবব্রত ভীষ্ম হয়ে উঠলেন । দেবব্রত এমন করিৎকর্মা লোক ছিলেন যে নিজের বাবার বিয়ের আয়োজন করেছিলেন। সে আরেক গল্প ।
৪
বাঘছাল গন্ধের মেয়ে
কবিতার বই হাতে পেলে নানা ভাবে উলটে ও পালটে দেখবো - এতে আমি অভ্যস্ত
কবিতা পড়তে ভালোবাসি আর কবিতার বই কিনে সংগ্রহ করতে আরো ভালোবাসি
বিয়ের পর আমার সংগ্রহের সাথে মিলেছে আমার সহধর্মিণীর বিবাহ পূর্বজীবনের কবিতার বইয়ের ঝাঁপি
জীবনের বাঁকে বাঁকে তাই কবিতারা এসে উঁকি মারে
বাঘছাল গন্ধের মেয়ে পেয়েই মনে হল রায়গুণাকর কবির কথা
রায়গুণাকর কেন? কেন না ভারতচন্দ্রের কবিতায় বাঘছাল পরা শিবের যে মূর্তি দেখেছিলাম , রহস্য আলাপী সেই শিব কে খুব মনে আছে
বেশ মনে আছে কীর্তিবাস কবি কৃত্তিবাস ওঝাকে
কৃত্তি মানে যে বাঘছাল আর কৃত্তিবাস হলেন বাঘছাল পরিহিত মানুষ
বাঘছাল পরে সেই যে বিবাহসভায় দাঁড়িয়েছেন কৃত্তিবাস শিব
তাঁর দিগম্বরতা দেখে পুরনারী গণ লাজে চোখ বুজেছেন
শিবের শরীরে অসাধারণ সৌন্দর্য
আর দিগম্বরতা তাঁকে করেছে দারুণ সেক্সি
শিবের দুচোখে নেশা
কিন্তু শুভ বোধে শিব অনন্য
নেশার আমেজ শিবকে আরো সেক্সি করে দিয়েছে
এই সব মনে হতো রায়গুণাকর কবির কথা
বাঘছাল গন্ধের মেয়ে আমার এক লহমায়
বাঘছাল পরা শিব ও শক্তির অনুপম ছবি স্মরণে এনে দিল
বাঘছাল গন্ধের মেয়ে
আমাদের চেতনায় অজস্র রহস্য মেখে উঁকি দেয় বাঘ
বাঘকে কেবা বশ মানায়
তাই বাঘছাল
সেই যে বিবাহসভায় পুরাঙ্গনা দের মধ্যে কৃত্তিবাস শিব
আর সকলের দৃষ্টির সামনে দিগবসন হতে চিন্তা না করা শিব
ভারতচন্দ্রের কবিতা থেকে
সেই সব সহসা মনের মধ্য থেকে উঠে এলো
উঠে এলো সেই ছবি যেখানে ভোলা মহেশ্বর কে ভালোবেসে
রাজনন্দিনী এলো গায়ে বাঘছাল তুলে নিয়েছেন
আমার মনের মধ্যে ছিল
বাঘছাল পরা গৌরী
অপর্ণা যতো না ঢেকেছেন নিজেকে বাঘছালে
তার বেশি নিজেকে মেলে দিয়েছেন
শিবের প্রেমই গিরি নন্দিনীর বসন
যজ্ঞ সভায় শিব নিন্দা শুনে বাঁচতে চান না সতী
মৃত্যু বেছে নেয় মেয়ে মুহূর্তে
তার পর রুদ্র নৃত্য শুরু হল
কত কিছু মনে এনে দিল
বাঘছাল গন্ধের মেয়ে
বাঘছাল গন্ধের মেয়ে
পড়তে পড়তে
পরতে পরতে
যৌনতা, জীবন আর মৃত্যু
অবসাদ, অন্তর্বাস আর মৈথুন
শব্দগুলি ছটফট করে
মনে হচ্ছিল
কবি বাঘছাল উড়িয়ে দিয়ে
হেঁটে যাবেন অবহেলায়
মিলে গেল
হেঁটে এগিয়ে গেলেন
নিরাভরণা
বাঘছাল টুকুও উড়িয়ে দিয়ে
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন