![]() |
নতুন প্রেমের কবিতা'র নিবিড় পাঠ : মাধবী দাস |
শাড়ি, তুকারাম, মণিপুরের মা ,রামবাবু ,ঘুষ, ছাত্রকে লেখা চিঠি ,রুপমকে একটা চাকরি দিন এমন বহু কবিতার মাধ্যমে কবি সুবোধ সরকার বাংলা ভাষায় আজ অত্যন্ত পরিচিত একটি নাম হলেও অনেকেই জানেন না প্রায় ৪০ বছরের কাব্য জীবনে কুড়িটারও বেশি কাব্যগ্রন্থে কয়েক হাজার কবিতা তিনি লিখেছেন এবং এখনও লিখেই চলছেন। 'ঋক্ষ মেষ কথা', 'একা নরকগামী' ,'চন্দ্র দোষ ওষুধে সারে না', 'রাজনীতি করবেন না ','সব রাস্তা রোমে যায় না', 'জেরুজালেম থেকে মেদিনীপুর', 'ছিঃ', 'ভালো জায়গাটা কোথায়',' মণিপুরের মা', 'যা উপনিষদ তাই কোরান' প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য।'বৈশাখী ও বব ডিলান'-এর পর আমরা পেলাম কাব্যগ্রন্থ 'নতুন প্রেমের কবিতা'।
কবি সুবোধ সরকার কবিতার গায়ের থেকে সব আভরণ খুলে ফেলতে চেয়েছিলেন ।তিনি চেয়েছিলেন -কবিতা ঝলসে উঠুক রাগ প্রতিবাদের আগুনে। প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ,অন্যায়ের বিরুদ্ধে বারেবারে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে তাঁর কলম। কখনও গুজরাত তো কখনও কামদুনি , কখনও বানতলা তো কখনও মনিপুর, কখনও ইরাক তো কখনও সাব -সাহারান আফ্রিকা যেখানেই যখন ধুলো জমেছে তখনই তিনি কলমকে বানিয়েছেন ধুমকেতু পুচ্ছ। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি-"মধুর সুরে কিছু বালখিল্য অন্তমিল দিয়ে (ওই চোরাবালিতে আমিও নেমেছি) কবিতা লেখার জন্য আমি জন্মাইনি" (কবিতা সমগ্র প্রথম খণ্ড ) ।তিনি মনে করেন সত্য কখনো গয়না পরে না। সমাজ ও রাজনীতি সচেতনতার কালি দিয়ে কবিতা লিখতে তাই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেছেন বলে তার কবিতা হয়ে উঠেছে নিরাভরণ সরল অথচ ভাবগম্ভীর। প্রেমকে স্বীকৃতি দিতে ন্যায়-অন্যায় সমাজের বাধা-নিষেধ মানতে তিনি রাজী নন ।
![]() |
মাধবী দাস |
কবি সুবোধ সরকারের কবিতার অন্যতম তিনটি বৈশিষ্ট্য বরাবর পাঠককে আকৃষ্ট করে প্রথমত সহজবোধ্য ভাষা ,দ্বিতীয়তঃ কবিতার থিম আর তৃতীয়তঃ কিছু পাঞ্চ লাইন।সব কাব্যগ্রন্থে আমরা দেখি কবিতার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ,বক্তব্য, চিত্র ,অদৃশ্য নির্মাণকৌশল যথাযথভাবে বজায় রেখে কবিতার বৈশ্বিক এবং সময়গত কাঠামো সুন্দরভাবে স্পর্শ করে গেছেন। এই 'নতুন প্রেমের কবিতা' কাব্যগ্রন্থেও দেখি প্রেমের কবিতা গুলোকে ভঙ্গি দিয়ে ভোলাতে চাননি তিনি ।সংযম ও বাগ্মিতার সঙ্গে আত্মমর্যাদাবোধ তাঁর নির্লিপ্ত ছোট ছোটকবিতাগুলোকে দুর্লভ নির্মলতা দান করেছে।
বাসনা যতটা কমে বেড়ে চলে ততই কামনা।/ ধুলো ওড়ে। ধুলোময় এ জগৎ পুরোটাই সোনা।(সোনা)
সংসার, জুঁই ,জাগ্রত ,দাগ ,কান্না এমন চার পঙক্তির কবিতাগুলোতে বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন করিয়ে প্রাত্যহিক জীবনের অনিবার্য সত্যগুলোকে, দর্শন গুলোকে তুলে ধরেছেন প্রেমের কবিতার নাম দিয়ে। এর জন্যই বারেবারে কবিতার ভাবের সঙ্গে কবিতা পাঠকের একটা সংযোগ ঘটে। অদ্ভুত আচ্ছন্ন করে, ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে ,এবং অন্ত্যমিলের দোলা দিয়ে পাঠক ও শ্রোতাদের কবির মনোভূমিতে টেনে নিয়ে যান।
আবার 'আমার ভালোবাসার কোন তারিখ নেই' অংশে যে কবিতা গুলো রয়েছে সেগুলো পড়তে পড়তে কেবলই মনে হয়েছে অধরা মাধুরী কে ছুঁতে চাওয়ার প্রবল বাসনা কবির মধ্যে থাকলেও বাইরের কোলাহলকে তিনি দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি ।দৈনন্দিন জীবন জিজ্ঞাসাকে সঙ্গী করে রোমান্টিকতার সঙ্গে বাস্তবতার অপূর্ব সমন্বয়ে এক নতুন জগৎ যেন গড়ে তুলেছেন ।এই জগত যেমন রহস্যময় তেমনি আবার দ্বিধাদ্বন্দ্ব যন্ত্রণা অসহায়ত্বে ভরা। তাই এই পর্বের 'আমার আছে', 'আমরা দুজনে', 'মাছরাঙা', 'ছোট বউ', 'পলা' প্রভৃতি ছোট ছোট কবিতা গুলো হয়ে উঠেছে খন্ড খন্ড জীবনের মধ্যে অসীম জীবনের হাতছানি ।ফলে এসব কবিতার পাঠক যে কেবল সাহিত্যরসিক শিক্ষিত সমাজের সংখ্যালঘু মানুষ না হয়ে;হয়ে উঠবে সাধারণ মানুষ তা কয়েকটি পঙক্তি তুলে দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে--১) মাছরাঙা শাড়িতেই তোমাকে মানায় /বিন্দু যেমন এসে বিসর্গ দাঁড়ায় (মাছরাঙা)
২)বাইরে আমি ভদ্রলোক, জ্যাকেট পরি,বুট পরি /দিঘির জলে কেউ জানে না তোমাকে আমি লুট করি। (ছোট বউ)
৩) আল্লা, আমি মেঘ চাই না, হে ভগবান পানি চাই না /নতুন কোন জামা চাই না ঈদে/ চাইছি আমি লিবিডো থেকে /নিভিয়ে দাও নিভিয়ে দাও খিদে। (আল্লা)
৪) আমরা যতনে ভাসি ইমনে বেহাগে/ তারচেয়েবেশি ভাসি অভাগার ভাগে। (পালটা বিরহ)
এই কাব্যগ্রন্থের সারাংশ রয়েছে 'যেটুকু দুধ চলকে পড়ে সেটাই ভালোবাসা 'নামক কবিতার ঋতম পরমার কথোপকথনের পরতে পরতে ।কবি ঋতমের জবানিতে লিখেছেন--'তোমার কাছে আসতে চাই আলো আসার আগে /ধরো আঙুল বেহাগ থেকে বেহাগে।' কিংবা-'ভালোবাসার অনেকগুলো দরজা/ খুলতে নেই সবগুলোকে/ পায়ের নিচে মাড়াতে নেই ধুলোকে।' আবার পরমার উক্তিতে কবি লিখলেন-ঘোড়ার পিঠে উঠেছ তুমি/হরিণ তাকে সয় না।/তিমির অবগাহন করা মোটেও অপচয় না/ 'ভালবাসার ভাল খারাপ হয় না' ।
আগের বিশ -একুশটি কাব্যগ্রন্থের সমস্ত কবিতাকে পাশে রেখে এই কাব্যগ্রন্থে এক অন্য কবিকে যেন পাই আমরা ।এভাবেই প্রকৃত কবি নিজের সৃষ্টির প্রতি অসন্তোষে মাথাচাড়া দেয় বলেই এমন পঙক্তি বেরিয়ে আসে--'ভালোবাসার জন্ম হয় ভোরে /ভালোবাসার মৃত্যু হয় পতন আলো ধরে /আগুন আহা আগুন ওগো আগুন /আমাকে ছেড়ে যেও না /এই আগুন ,ওই আগুন, আগুনে পোড়ে আশা /যেটুকু দুধ চলকে পরে সেটাই ভালোবাসা।' বলা যায় এই কাব্যগ্রন্থে প্রতিবাদ ও প্রেমকে একই কবিতায় একই পঙক্তিতে শৈল্পিক রূপ দিয়ে কাম ও বিদ্রোহ, আলিঙ্গন ও প্রতিবাদ ,ভালোবাসা ও মেকি অনুভূতিকে কবি ধ্বনিত করে তুলেছেন নিজস্ব বৈশিষ্ট্যেই। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে সদ্য প্রয়াত কবি পৌলোমী সেনগুপ্তকে। সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত বইটির নিপুণ অলংকরণ করেছেন শ্রী তারকনাথ মুখোপাধ্যায়।
মূল্য ২৫০ টাকা।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন