![]() |
আমার সময়, আমার রবীন্দ্রনাথ : মৃদুল শ্রীমানী |
তিনি যখন বলেন, 'কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সঙ্গীতহারা, অমাবস্যার কারা, লুপ্ত করেছে আমার ভুবন..'; তখন বেশ টের পাই, ভিতরের কথাটা কি! একটা দেশ, পরাধীন দেশ, তার মর্মজ্বালা আসলে বইতে হয় গরিবকে, অশিক্ষিত কে, পশ্চাৎপদকে। সে যেন দেশে আছে অথচ নেই। তিনি বলছেন, 'সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান।' চোখের সামনে মুসলমান মালবাহক কুলিটির মুখের উপর চাবুক চালায় গাড়ি ওয়ালা। মুহূর্তে কুলিটির মাথার উপর ঝুড়ি থেকে মাখন ফল ডিম সব পড়ে নষ্ট। ব্যাকুল কুলি গাড়ি ওয়ালার চাবুকের আঘাতের ক্ষত হতে রক্তপাত অগ্রাহ্য করে আর্থিক দুর্গতির হিসাব করে। গোরা, গৌরমোহন তার কাছে গিয়ে রাস্তায় দলে যাওয়া খাদ্য সামগ্রী ঝুড়িতে তুলে দিতে চায়। এক দীপ্ত বেদনাবোধ থেকে বলে, তুমি প্রতিবাদ না করে ঠিক করলে না। মুসলমান কুলি বলে, আল্লা উপর থেকে সব দেখছেন। তার কথা শুনে গৌরমোহন প্রতিবাদ করে। বলে অন্যায়ের প্রতিকারের ভার ভগবানের হাতে ছেড়ে দেওয়া মানে নিবীর্যতা।
তিনি বলেন, "আমারে তুমি করিবে ত্রাণ, এ নহে মোর প্রার্থনা। বহিতে পারি, শকতি যেন হয়।" বলেন, প্রতিকার করতে হবে 'তোমার বিচারাসনে লয়ে তব স্থান' আর এভাবেই বুঝিয়ে দেন পার্থিব মানবিক জীবনে আমাদের কর্তব্য কত বহুধা বিস্তৃত।
গৌরমোহন লক্ষ্য করে বাংলা ভূমির একটি সজীব স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ছেলে , যে খেলাধূলায় অগ্রণী, সে কিভাবে সামান্য রক্তপাত হতে ধনুষ্টঙ্কার হয়ে নিজের মা বাবার চরম অজ্ঞতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্নতার শিকার হয়ে মরতে বাধ্য হয়। আর কিভাবে দেশের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির লোকজন শাসকের পদলেহন করতে আগ্রহ বোধ করে। হারাণ ওরফে পানুবাবুকে মনে করি। শাসকের বিরুদ্ধে কখনো কখনো একটু আধটু কথা বলে মহিম, গোরার বৈমাত্রেয় অগ্রজ। তবে সে একান্ত ভাবেই নিজের স্বার্থ হানি হলে। নচেৎ সে শাসকের তাঁবেদার। কত ভাল ভাল বাছাই ইংরেজি শব্দের সজ্জায় শাসকের তোষামোদ করা যায় সেই লক্ষ্য মহিমের। ওই যে একদিন বড় ধিক্কারবোধ থেকে বলেছিলেন, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি, সেই অমানুষদের দেখাতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ, গোরার চোখ দিয়ে।
হিন্দুত্ব নয়, ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতে গোরা নিজেকে মুক্ত মানুষ হিসেবে দেখবে। ধর্মমোহের বিরুদ্ধে বলেন কবি। অনির্দেশ্য ভাগ্যের হাতে নয়, নিজের হাতে দুনিয়া বদলানোর শলা দিতে আমার ভিতরে বার বার নড়ে বসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন