 |
হে দামিনী : মৃদুল শ্রীমানী |
হে দামিনী : মৃদুল শ্রীমানী
(আজ নির্ভয়া দামিনী দিবসে রবীন্দ্র সাহিত্যের দামিনী কে নিয়ে আমার কথা।)
প্রাপ্তমনস্ক নর নারীর শাস্ত্র বিরহিত আকর্ষণের কথা চমৎকার করে লেখেন রবীন্দ্রনাথ। চতুরঙ্গ উপন্যাসের দামিনীর কথা মনে করি। শচীশ ও শ্রীবিলাস এই দুই প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলারের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে বিধবা দামিনী। লীলানন্দ স্বামী, বিধবার প্রয়াত স্বামীর ধর্মগুরু বেশ গাপ করেছিলেন বিধবার স্বামীর সম্পত্তি। শিবতোষ, দামিনীর স্বামী নিজের উদ্ভিন্নযৌবনা স্ত্রীকেও বিশেষ ভাবে গুরুর হাতে দান করে গিয়েছিলেন। দামিনী ছিল নাছোড়। কিছুতেই সে গুরুজীর যৌনদাসী হতে রাজি নয়। লীলানন্দ এগোচ্ছিলেন গুঁড়ি মেরে, সাবধানে। দামিনীকে প্যাঁচে ফেলে কব্জা করতে চাইছিলেন। মেয়ে ক্রমেই পিছলে যাচ্ছিল।
এর মধ্যে এসে পড়ল শচীশ আর তার কিছু পরে শ্রীবিলাস। কলকাতার ছেলে দুটি। তাদের দিকে তাকালো বিধবা দামিনী। তার পর? সম্পর্কের এক অভাবনীয় বিন্যাস তৈরী করেন রবীন্দ্রনাথ। নর নারী সম্পর্কের এক নতুন মাত্রা এনে দেন বাংলা সাহিত্যে।
আর একটি অসাধারণ মেয়ে দামিনী। শিবতোষ নিজের যথা সর্বস্ব এর সাথে স্ত্রী দামিনীকেও বিশেষ ভাবে গুরুর কাছে সমর্পণ করে মারা যায়। গুয়রু লীলানন্দ স্বামী ধীরে ধীরে দামিনীকে পরিপাক করার দিকে এগোচ্ছিলেন। বাদ সাধছিল মেয়েটির প্রখর ব্যক্তি সচেতনতা। মেধাবী মেয়েটি কিছুতেই গ্লানিকর যৌন সংযোগ মেনে নিতে চায় নি। হিন্দু সমাজের ভিতরে গুরুগিরির নামে বিধবা শিষ্য পত্নীকে ভোগ করার কার্যকর বাধা ছিল না। গুরুদের এই দাপট আজও কমে নি। গুরু তো বটেই, শ্বশুর ভাসুর ইত্যাদি গুরুজনেরাও বাড়ির বিধবা মেয়েকে যৌন সম্ভোগ করতে অন্তরে বাধা পান নি।
চতুরঙ্গের দামিনী দেখিয়ে দিল যুবতী বউটা স্বামীর কাছে নেহাতই একটা সম্পত্তি। দর দালান খাট আলমারির সাথে একটা রক্ত মাংসের বউকেও লীলানন্দ স্বামীর মতো গুরুর ভোগের জন্য উৎসর্গ করে দিয়ে ছিল নিষ্ঠাবান হিন্দু শিবতোষ।
শরৎচন্দ্র এসে দেখিয়ে দিলেন পরিবারের ভিতরে থেকে শুধু ভাত কাপড়ের কষ্টে ভুগত না একটা তরুণী বিধবা। দিনের বেলা যে মেয়েটিকে থান পরিয়ে উপবাসী রেখে বার ব্রত করিয়ে দেবী বানাত সনাতনী হিন্দু সমাজ, রাতে তাকেই শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে পেতে চাইত পরিবারের সমর্থ পুরুষেরা।
মেয়েদের শরীর যে ভোগের বস্তু , সনাতনী হিন্দু পুরুষ তা মুখে স্বীকার না করলেও ঘরের ঘেরাটোপে তা করে দেখাতে অভ্যস্ত ছিল। সেই যৌনমিলনে বাড়ির সমর্থ বিধবা গর্ভবতী হয়ে পড়লে গর্ভপাতের ব্যবস্থা করতে হত। লুকিয়ে চুরিয়ে অশিক্ষিত দাইয়ের হাতে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে গর্ভপাত করাতে গিয়ে মারা পড়ত অনেক হিন্দু বিধবা। অথবা ভয়াবহ সংক্রমণ হয়ে সারা জীবন কষ্ট পেত।
শিবতোষের মৃত্যুর পর দামিনী বিধবা। শিবতোষের সন্তান হয় নি। অন্যান্য জ্ঞাতি কুটুম্ব আত্মীয়ের সাথেও যোগাযোগ না থাকার মতো। এই অবস্থায় ঘর দুয়োর আসবাব সমেত সে নিজের তরুণী স্ত্রীকে উৎসর্গ করে যায় লীলানন্দ স্বামীর কাছে। লীলানন্দ স্বামী ধর্মব্যবসায়ী। ব্রিটিশ শাসনে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অনেক যুবক নিজের মনের ভেতর নানা প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে নানা পথে নিজের উচ্ছ্বাসকে অপচয় করেছে। এ দেশে ধর্মের নানা আড়ম্বর সর্বদাই গুরুত্ব পেয়েছে। যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমুখী চিন্তাচেতনা এদেশে শিকড় ছড়াতে পারে নি। পুরোনো ধাঁচের ধর্মীয় সংগঠন নবীন যৌবনকে আশ্রয় না দিতে পারলে, অতি সামান্য সময়ের জন্যে হয়তো বাঙালি যুবক যুক্তি ও জ্ঞান বিজ্ঞানের মুখোমুখি হতে চেয়েছে। কিন্তু সে সামান্য সময়। বেশিরভাগ যুবক ধর্মের চোলাইতে মেতে গিয়েছেন। শচীশ তেমন একজন। পড়াশোনায় দিগগজ হবার পরেও, জ্যাঠামশাই এর মতো যুক্তিবাদী মানুষের সঙ্গ পাবার পরেও লীলানন্দ কি করে শচীশকে নিজের দলে ভিড়িয়ে নিতে পারেন, সে এক আশ্চর্য প্রহেলিকা। শচীশের ছায়াসঙ্গী শ্রীবিলাস। পড়াশুনায় মজবুত হয়েও সে শচীশের টানে লীলানন্দ বৃত্তে। কিন্তু বৃত্তের পরিধিতে না থেকে দুই বন্ধুই ক্রমশঃ সে সংগঠনের কেন্দ্রে। তাদের উন্নত মেধা মগজ তাদের ওই ধর্মীয় সংগঠনের কেন্দ্রে এনে দেয়। দামিনী নামে তরুণী বিধবাটিও মেধাপূর্ণ যৌবনের দিকে তাকায় আগ্রহে। শচীশের প্রেমের পূর্ব ইতিহাস ছিল। তার দাদা পুরন্দর ননিবালা নামে এক বিধবার ধর্মনষ্ট করে। পুরন্দর এ কাজ করেও নিজের পিতা হরিমোহনের কাছে ভর্ৎসনা পায় নি। শচীশের যুক্তিবাদী মানবতাবাদী জ্যাঠামশাই ননিবালাকে কন্যাজ্ঞানে পিতৃস্নেহে আশ্রয় দিতে চেয়েছিলেন। শচীশ তার জ্যাঠামশাই এর প্রতি আনুগত্যে ননিবালার গর্ভস্থ সন্তানের পিতৃপরিচয় এর দায়িত্ব নিতে চায়। কিন্তু ননিবালা আত্মহত্যা করে। এর পর জ্যাঠামশাই বেশিদিন বাঁচেন নি। সে যাই হোক, শচীশ বুঝতে পারতো বিধবা দামিনী তাকে বিশেষ পছন্দ করে। কিন্তু সে সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি কি হবে সে নিয়ে শচীশ প্রবল দোলাচলে থাকতো। শচীশ আর দামিনীর ফাঁকের জায়গাটাতে দামিনী টেনে আনত শ্রীবিলাসকে। শ্রীবিলাসও পড়াশুনা করা সুদেহী পুরুষ। তরুণী দামিনীর প্রতি তারও এক রকম টান ছিলই। এই তিনটে মানুষের পরস্পরের টানের গল্প গড়ে উঠেছে দামিনীর চারপাশে।
আহা রে দামিনী মেয়েটি। লীলানন্দ বৃত্তের মানসিক অত্যাচার থেকে যে প্রতিদিন নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলতো। লীলানন্দ এই দামিনী মেয়েটির স্বামী শিবতোষের ফেলে যাওয়া বাড়ি ঘরদোর আসবাবসহ স্থাবর অস্থাবর সব কিছুই দখল করেছিলেন। শুধু পারছিলেন না দামিনীকে হজম করে ফেলতে। না, হিন্দু সাধুজী ও গুরু মহারাজদের নারীলিপ্সা কোনোকালেই খুব কম ছিল না। এমন কি শিশুদের উপরেও যৌন নির্যাতনে তাদের ক্লান্তি নেই। দামিনীর সঙ্গে তার স্বামীর গুরু লীলানন্দের বাঘবন্দী খেলা চলছিল। বাড়ির মধ্যে থেকেও তারস্বরে হতে থাকা সংকীর্তনে দামিনী যোগ দিত না। প্রয়াত স্বামীর গুরুকে উপেক্ষা করবে বলেই তার এই চেষ্টা। শচীশ ও শ্রীবিলাস এই দুই উচ্চ শিক্ষিত যুবককে দেখে দামিনীর উপোসী নারীত্ব উচ্ছল হয়ে ওঠে। নারীহৃদয়ের কোন নিগূঢ় ইঙ্গিতে সে নানাতর খেলায় মেতে উঠে এই দুই যুবকের নৈকট্য পেতে চায়। দামিনী ভালো করে জানে, হিন্দু বিধবার পক্ষে পুরুষসঙ্গ অমার্জনীয় অপরাধ। কিন্তু দামিনীর অঙ্ক বলে যে, শচীশ ও শ্রীবিলাসের সাথে মন দেওয়া নেওয়ার খেলায় মেতে উঠলে লীলানন্দ ঠিক কোনো কিছু বলে উঠতে পারবেন না। শ্রীবিলাস বেশ সহজেই রসিকা রমণীর নানা শখ পূরণে এক পায়ে খাড়া। আর শচীশ এসে মাঝে মাঝে শুকনো মুখে দেখে যেতে চাইত - কি চলছে কাণ্ডটা !
শচীশকেই চেয়েছিল দামিনী। চেয়েছিল তার সমস্ত নারীসত্তা দিয়ে। পায় নি। দামিনী পাশে পেল শ্রীবিলাসকে। শ্রীবিলাস কি তার সাথে দাম্পত্যে বৃত হল?
এক নতুন ধরণের সম্পর্কের মাত্রা উন্মোচন করেন রবীন্দ্রনাথ। বাঁধা ধরা সম্পর্কের চেয়ে অনেক অন্য ধরণের সম্পর্ক।
খবরের কাগজে ঢি ঢি পড়েছিল। এক ছাদের নিচে এক অন্নে একটি সমর্থ পুরুষ আর একটি রূপসী বিধবা, গসিপ ছাপার সুযোগ ছাড়বে কেন থার্ড পেজ?
শচীশও মাঝে মাঝে শ্রীবিলাস ও দামিনীর কাছে আসতো। নোটবই লিখে সংসার চালানোর বন্দোবস্ত করেছিল শ্রীবিলাস - এক কালের প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলার। এক বিধবা কি করে জীবন খুঁজে পায় মরমিয়া ভাষায় সে গল্প করতে থাকেন রবীন্দ্র ঠাকুর।
This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন