রাজা রামমোহন রায় (২২ মে ১৭৭২--২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৩৩) : রুদ্রসাগর কুন্ডু

রাজা রামমোহন রায় 
রাজা রামমোহন রায়  (২২ মে ১৭৭২--২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৩৩) 
রুদ্রসাগর কুন্ডু 


রামমোহন রায়কে জানার আগে, তাঁর জন্মকাল যদি পর্যালোচনা করি, তাহলে সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে পরিষ্কার একটি ধারণার জন্ম হতে পারে। এবং সেই ধারণা, তাঁকে ভালো করে জানতে সাহায্য করবে। এখন ইংরেজি ২০১৯ সাল।  আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর আগে তিনি বর্তমান হুগলি জেলায় শ্রীরামপুরে মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার বাড়ি, হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে ছিল। তখনকার সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার মতো ছিল না। তখন শিক্ষার অর্জনের জন্য গুরু ধরে টোল-এর মাধ্যমে শিক্ষা অর্জন করতে হতো। প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তখন একজন করে বিশেষ পন্ডিত থাকতেন। সেইরূপভাবে তখনকার সময়ের বিদগ্ধ পন্ডিত নন্দকুমার বিদ্যালংকারের কাছে তিনি সংস্কৃত শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে হরিহরানন্দ তীর্থস্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ হলে তাঁর কাছে রাজা রামমোহন রায়, বেদান্ত শিক্ষা ও ব্রাহ্ম উপাসনালয় প্রতিষ্ঠায় সাহায্য পেয়েছিলেন। বলে রাখি,  ব্রাহ্ম উপাসনালয় রামমোহনের জীবনে একটি বড়ো কাজের পর্ব। যাইহোক, পরবর্তীতে তিনি পাটনা থেকে আরবি ও ফার্সি ভাষা শিক্ষা লাভ করেন।

 ১৭৯৬ সালে, ২৪ বছর বয়সে, রামমোহন অর্থ উপার্জন শুরু করেন। এই সময় তিনি মহাজনির কাজ করতেন। এরপর ১৮০৩ সালে, অর্থাৎ ৩১ বছর বয়সে ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে কাজে যোগদান করেন, এবং এই কাজে তিনি ছিলেন ১৮১৪ সাল পর্যন্ত। এই কাজের সুবাদে কলকাতায় ক্রমাগত আসা যাওয়ার ফলে কোম্পানির তরুণ ও নবাগত কর্মচারীদের সঙ্গে রামমোহনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।  এই সুযোগে রামমোহন তাঁদের কাছে ভালো করে ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন, ও পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ভুটান সীমান্তে বাণিজ্যিক দৌত্যকার্যে অফিসার ডিগবীর সঙ্গে যাতায়াতের ফলে রামমোহনের ব্যাপক বাণিজ্যিক ধারণার তৈরী হয়। এবং সে কারণে রামমোহন ১৮১৫ সালে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। 

৪৩ বছর বয়সে কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হলেন রামমোহন। আর এখানথেকেই সমাজ সংস্কারের প্রচেষ্টা শুরু করেন।  বেদান্তের আলোকে ঈশ্বরের রূপ নিয়ে অর্থাৎ একেশ্বরবাদ নিয়ে রামমোহন লেখেন প্রথম গ্রন্থ ''তুহফাতুল মুহাহহিদীন'', যা ছিল ফার্সি ভাষায় লেখা।  আর এ বইয়ের ভূমিকা লেখা ছিল আরবি ভাষায়।  একবার ভেবে দেখুন বিষয়টি।  তিনি বাঙালি হয়েও অন্যভাষার প্রতি তার ছুৎমার্গ  ছিল না। তিনি সময় ও স্থানভেদে শিক্ষা গ্রহণ ও প্রচার বিবেচনা করে ভাষার ব্যবহার করেছেন।  ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত রামমোহন নিজেকে তৈরী করেছেন, তারপর তিনি তাঁর আসল কাজটিকে শুরু করেছেন। প্রাথমিক অবস্থায় রামমোহনের উদ্দেশ্য ছিল একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা করা।  ধর্মীয় কুসংস্কার তাকে খুব ব্যথিত করতো।  তাঁর উচ্চশিক্ষা-চেতনা, মানবিক মূল্যবোধ, সংস্কারপন্থী মনোভাব এক বিশেষ ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠা করেছিল। যা থেকে মূলত ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের প্রথম উন্মেষ ঘটে। 
রুদ্রসাগর কুন্ডু

বাঙালি জাতির ইতিহাসকে যে ৩ জন মণীষী বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাঁদের  মধ্যে রামমোহন রায়  অন্যতম। বাকি ২ জন হলেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, এবং লালন ফকির। যদিও এই নির্ণয় ব্যাপক অর্থে ধরা চলে না। তবু আপাতত আমি এই তিনজন মণীষীর উল্লেখ মূলত সময় ধারাবাহিকতার জন্য ধরে নিলাম।  কেননা, এঁরা মূলত ধর্মীয় সংস্কার মূলক আন্দোলনের পুরোধা। বাঙালি জাতির অন্যান্য মণীষীদের আলোচনা বা প্রসঙ্গ এখানে আমার আলোচ্য নয়। রামমোহনের সমাজ সংস্কার এবং ধর্মীয় নীতিমালার সংস্কারকে প্রাধান্য দিয়ে মূলত এই আলোচনার সূত্রপাত। এবং এই ধারাবাহিকতায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, এবং লালন ফকির একান্তই প্রাসঙ্গিক। যদিও,  প্রেক্ষাপটও ভিন্ন ভিন্ন। 

আমাদের বর্তমান প্রজন্ম রাজা রামমোহন সম্পর্কে কতটা জানেন, তা আজ নির্ণয় করা মুশকিল। সতীদাহ প্রথা সম্পর্কেও আজকের প্রজন্ম হয়তো তেমনভাবে চর্চা করেন না।  বাঙালি জাতির ইতিহাসকে, ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার শিক্ষানীতি, কৌশলে বিলুপ্ত করার যে মিশন চালাচ্ছে, তাই মূলত প্রধান কারণ, এই চর্চাহীন নব্য বাঙালির, তথাকথিত সুশীল সভ্য সমাজের বাবুয়ানা। হাতে একটি স্মার্ট মোবাইল রেখে নব্য এই বাঙালি জাতি আখেরে আত্মমর্যাদাহীন একটি নপুংসক জাতিতে পরিণত হচ্ছে।  আর এখানেই রাজা রামোহনের দর্শন আরো বেশি প্রাসঙ্গিক ও প্রখর হয়ে ওঠে।  রামমোহন সনাতন ধর্মের সংস্কার নিয়ে কেন এতো চিন্তিত ছিলেন ? কেননা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এই হিন্দু জাতির আজকের অবস্থা তিনি বহুকাল আগেই উপলব্ধি করেছিলেন, আর সেই জন্যই তিনি সমাজ ও ধর্মীয় সংস্কারের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। 

আজকের বাঙালি হিন্দু সমাজ যে অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে, তার একটু পর্যালোচনা দরকার। এই যে বাঙালি হিন্দু সমাজ, একদিকে আধুনিক বাস্তুতন্ত্রের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ডিজিটাল ব্যবস্থার দিকে হাত বাড়িয়েছে। তার অন্য হাতটি বাঁধা রয়েছে কুসংস্কার আর বহু-ঈশ্বরবাদের দর্শনে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ভুলে, ভারতীয় বহুমুখী বঞ্চনাকে মুখ বুজে সহ্য করছে। না সাহিত্যে অগ্রগতি, না রাজনীতিতে অগ্রগামী, না ব্যবসা-বাণিজ্যে ! ধর্মীয় আধিপত্যের এক সস্তা রাজনীতিতে গা ভাসিয়ে চলছে বাঙালির নতুন প্রজন্ম।  মাস্টারদা সূর্যসেন ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে ভুলতে বসেছে আজকের বাঙালি সম্প্রদায়। ২০ বছর আগেও বাঙালির ঘরে ঘরে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হওয়া নেতাজিকে চোখে পড়তো। প্রতিটি শিক্ষিত ব্যক্তির কাছে সংগ্রহীত থাকতো সূর্যসেনের জীবনী গ্রন্থ। আজ তা বিলুপ্ত ইতিহাসের মতো বাঙালির মস্তিস্ক থেকে ধূসর হয়ে যাচ্ছে।

এই ধূসর হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি আসে মূলত প্রগতিশীল সংস্কার আর সুষ্ঠুধারার শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিকূল পরিবেশের কারণে।  বাঙালি হিন্দুদের ক্ষেত্রে এটা ঘটার আশঙ্কায় বিচলিত ছিলেন রামমোহন রায়। হিন্দু সমাজের অন্দরে প্রচলিত অমানবিক নিয়মবিধি রামমোহনকে বিচলিত করছিলো ক্রমশ। আর যে বিষয়টি সবচে বেশি ভাবিয়ে তুলেছিল, তা হলো, ''সতীদাহ প্রথা''। আজ থেকে মাত্র আড়াইশো বছর আগে হিন্দুসমাজে বা ধর্মে ''সতীদাহ'' প্রথা চালু ছিল। যা বন্ধ করার জন্য রামমোহন আন্দোলন শুরু করেন, এবং তা ব্রিটিশ আইনের দ্বারা চিরস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করানো হয়। ''সতীদাহ প্রথা'' আজকের দিনে একটি সামান্য ঐতিহাসিক আলোচনার প্রসঙ্গমাত্র হলেও, এটি ছিল ভীষণই অমানবিক একটি প্রচলিত হিন্দু ধর্মীয় কুসংস্কার নীতি। যা মূলত, বহু-ঈস্বরবাদের একটি বিশাল বিষ-বৃক্ষ ছিল।

''সতীদাহ প্রথা'' সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। এই প্রথা অনুসারে, স্বামী মারা গেলে, তার বিধবা স্ত্রীকে জোর করে হাত-পা বেঁধে স্বামীর চিতায় একসঙ্গে পুড়িয়ে মারা হতো। এই সময় বিধবা স্ত্রীকে ``সতী'' নাম দেওয়া হতো। এমন অমানবিক মৃত্যুর প্রতিবাদে ``সতী''-র চিৎকার ঢাকার জন্য শ্মশানঘাটে হিন্দুদের আনন্দ-উল্লাসে চিৎকার করা এবং ঢাক-ঢোল বাজানো হতো। একটু কল্পনা শক্তিদ্বারা অনুভব করলে অবশ্যই বোঝা যাবে, কতটা অমানবিক ছিল হিন্দুধর্মের এই রীতিনীতি। এমন একটি প্রচলিত ভয়ঙ্কর রীতিনীতিকে মানতে পারেননি দরদী রাজা রামমোহন রায়। তাই তিনি এমন মানবতা-বিরোধী ধর্মীয় নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন।  বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে অতিবাহিত করেন এই আন্দোলনের সময়। 

''সতীদাহ প্রথা'' গুপ্ত সাম্রাজ্যের পূর্ব হতে চালু ছিল। অর্থাৎ প্রায় ২৫০০ বছর আগে থেকে। এর শুরু বা ভিত্তি হিসেবে জানতে পারি মহাভারতের কাহিনীতে। মহাভারত অনুসারে পান্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী সহমরণে যান। এভাবেই প্রচলিত আরেকটি ভিত্তি, রাজপুতানায় ``জোহর-ব্রত'' অনুসারে রাজ্যদখলের পূর্বেই সে রাজ্যের নারীরা অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু বোরন করতেন। আচার ও রীতির বহুসময় ধরে ব্যবহার হয়ে এইসব কাহিনীই একসময় ''সতীদাহ প্রথা'' হিসেবে চালু হয়ে যায়। সহ-মরণকে হিন্দুরা পূর্ণ্য হিসেবে পালন করতো। হিন্দুদের পালিত এই রীতিনীতির নির্দেশ বেদে পাওয়া যায়নি। বেদে  ''সতীদাহ প্রথা''র উল্লেখ নেই।

যাইহোক, হিন্দু ধর্ম কেন, পৃথিবীর সব ধর্মেই এমন মানবতা বিরোধী বহু রীতিনীতির বৈভব দেখা যায়।  রাজা রাম মোহনের আন্দোলনের ভিত্তিতে ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল ঘোষণা করা হয়। এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তৎকালীন হিন্দুপন্থী কুলাঙ্গারেরা লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে মামলা করেন। দীর্ঘ্য ৩ বছর শুনানি শেষে ১৮৩২ সালে প্রথম রায়কেই বহাল রাখা হয়। লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে রাজা রাম মোহন প্রমান করে দেন, সনাতন ধর্মের কোথাও সতীদাহ বলে কিছু নেই।


সরকারিভাবে সতীদাহ রদ করা হলেও সমাজের অন্দরে গোপনে গোপনে কোথাও বেপরোয়া সাহসিকতার সঙ্গে জঙ্গি হিন্দুরা সতীদাহকে বহাল রাখলো। নবাবী আমল এমনকি সম্রাট শাহজাহানের আমল পর্যন্ত সতীদাহ চলতো বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।  এর পরের সময়ে বাঙালির মহামহিম, শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারক-বাহক, মানব দরদী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সতী বা বিধবা বিবাহের প্রচলন করেন। যার ফলে সমাজে এক নবযুগের ছোঁয়া লাগে। লাখো বছরের ইতিহাস-বিধৃত বাঙালির হাত ধরে এগিয়ে চলে মহাভারতের জনতা। সেই মহামহিমের আলোচনা আরেক পর্বে করা যাবে। আপাতত হৃদয়ে মথিত হোক বাঙালির প্রাণের রাজা, বাঙালির শ্রেষ্ঠ পুরুষ রাজা রাম মোহন রায়। যিনি ১৮৩১ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের দূত হিসেবে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করেন। এই সময় তিনি ফ্রান্সও ভ্রমণ করেন। ১৮৩৩ সালে মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ব্রিস্টলের কাছে স্টেপলনে অর্থাৎ বিদেশের মাটিতে মৃত্যু বরন করেন।
Share on Google Plus

About SAGAR KUNDU

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.