![]() |
সত্যেন : সুকান্ত পাল |
সকাল থেকেই মেঘটা ঘোলা ঘোলা, শরতের প্রথম আলো তখনও ফোটেনি , থেকে থেকে মোরগগুলো চিৎকার করে উঠছে। রাস্তায় দু’একটি কুকুর অভ্যাস মত মাঝেমাঝে ঘেউ ঘেউ করে উঠছে। একটি মোষের গাড়ি কঁচকঁচ কঁচাকচ শব্দে এগিয়ে চলেছে। রাস্তার দিকের বারান্দায় খাড়া হয়ে বসে সত্যেন আকাশ -পাতাল ভেবে চলেছে।
দীর্ঘ চব্বিশটা বসন্ত পার করে চলে এসেছে সে। একসময় মার্কস-লেলিনের স্বপ্নে বিভোর ছিল সত্যেন। বাবার কিছু জমিজমা ছিল, তাতে তাদের চলে যায় কোনোরকমে।
তিন ভাইবোনের মধ্যে সুজাতাই বড়ো আর সুমিতা ছোটো । হঠাৎ সুজাতার বিয়ের সম্বন্ধ হয়ে গেল। ভালো ছেলে, রেলে চাকরি করে। বয়সে ও মানাবে ভালো। সুখবিলাসি, সত্যেনের মা একটু আপত্তি করছিল। চারলাখ টাকা নগদ, আটভরি সোনা, বাইক, খাট -ফার্নিচার —এত দাবি! সুবিনয় কোনোমতেই এ ছেলে হাতছাড়া করতে চায় নি। তাই সব জমিজমা বেচে বিয়েটা হল বটে কিন্তু সোনার দোকানে মোটাটাকা ধার থেকে গেল। ভেবেছিল —সত্যেনের বেতনের টাকাটা জমিয়ে ধারটা শোধ করে দেবে। কিন্তু সুবিনয় হিসেব করে দেখেনি যে ঐ চল্লিশ হাজার টাকা জমাতে কুড়ি মাস সময় লেগেযাবে। সত্যেন —করে তো প্যারাটিচারি- আর মাসে পায় দুহাজার টাকা মাত্র। অতিরিক্ত পরিশ্রম পঞ্চাশোর্ধ শরীর বইতে পারল না।
দীর্ঘ রোগভোগের পর আজ সুবিনয়ের উপর নিশ্বাস বইতে লাগল। ওই গুমোট সকালে মায়ের বুকভাঙা কান্না সত্যেনকে আর এতটুকু বিচলিত করে নি। যেমনভাবে দাওয়ায় বসেছিল , তেমনি বসে রইল—শুধু একজোড়া বিস্ফারিত চোখ আকাশের দিকে চেয়ে রইল — যেন হাজার যুগের অপেক্ষা । সুমিতার ডাকে ঘোর কাটে তার।
দাদা , বাবা আর—
এ বেলাটা বোধহয় যাবে না সুমি। নারে?
দিদি তো বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু—
এখনই চলে আসবে। তুই বরং বড় কাকাকে একটু খবর দে।
বলছিলাম দাদা, একবার মনোজ ডাক্তারকে ডাকলে হয় না?
ডাক্তার ? পয়সা কই ডাকব? পয়সার অভাবে চোখটাও অপারেশন করাতে পারলাম না। হাসপাতালে ই কি কম গেলাম—
আমার মন বলছে দাদা, মনোজ ডাক্তার —
মাসের শেষ। ঘর কুড়ালে দুশো টাকাও পুজবে না। ভিজিট চারশো। তার উপর আবার ওষুধ—
তাই বলে বাবা বিনাচিকিৎসায় চলে যাবে ? দাদা—
সুমির কথা শেষ হওয়ার আগেই সত্যেন ঝাঁকিয়ে ওঠেঃ ‘ ডাক্তার ? তুই জানিস না, ঘরের অবস্থা, তার উপর এত টাকা দেনা?ক টাকা পাই তুই জানিস না?- - - - - - -’’এমনি আরও যা কিছু সত্যেন বলছিল তা এখানে গোপন থাকাই ভালো। সুমি কোনো কথা না বলে চোখ মুছতে মুছতে মায়ের কাছে গিয়ে বসল।
সত্যেন , এক জীবন্ত লাশ,এক অর্ধ বেকার । গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের প্যারাটিচার। রসায়নের স্নাতক। পয়সার অভাব আর সংসারের বোঝা বইতে গিয়ে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া সত্যেনের পড়াশোনা করা হয়ে ওঠে নি। মাসে দুহাজার টাকা সান্মানিক ,তাও তিন মাস জোটে নি। খাতা কলমে চারদিন ডিউটি , আর ষোলোটা ক্লাস হলে হবে কি—সপ্তাহে ছ’দিনই যেতে হয়। সমান ক্লাস ও নিতে হয়। একজন দিদিমণি আর সত্যেন এই নিয়ে স্কুল। একশ বাইশ জন ছাত্র। পাঁচটা ক্লাস । তার উপর বিলো ফাইভ ননস্কুল। মিড ডে মিলের বাজার,খাতাপত্র সারা, অডিটের কাগজপত্র সারা, চাইল্ড ট্র্যাকিং, চাইল্ড রেজিস্ট্রার ,বি এল ও -এর কাজ — কত কাজই না করতে হয়। তবু ও দিদিমণি আর সত্যেনের মাঝে আমরা ওরার ব্যবধান । এরই মাঝে টিউশানি কিছু পড়িয়ে সংসারের হাল ফেরাতে গিয়েও পারে না সত্যেন। বিশ-তিরিশটা ছাত্র পড়ালেও সবাই তো আর মাসে মাসে টাকা দিতে পারে না।
সুবিনয় আজ চারমাস শয্যাশায়ী । কি হয়েছে কেউ জানে না। গ্রামের হাসপাতালের ডাক্তারবাবু সবদিন হাসপাতালে আসেন না। তবে মাঝে মাঝে এলে রোগী দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যায়। সুবিনয় দুবার ডাক্তারবাবুর কাছে গিয়েছিল। প্রথমবার রক্তপরীক্ষা,আর ছবি তুলতে বলেছিল। গ্রামের হাসপাতালে এসব কিছু হয় না। শহরের হাসপাতাল থেকে ফ্রি তে রক্তপরীক্ষা হয়েছিল কিন্তু ছবি তোলার তারিখ তিনমাস পরে দিয়েছিল। রক্তপরীক্ষার কাগজ নিয়ে হাসপাতালে গেলে ডাক্তারবাবু শহরের পলিক্লিনিক থেকে ছবি তুলে আনার পরামর্শ দেন। একটা ঠিকানা ও লিখেদেয়। কিন্ত ছবিতোলার হাজার টাকা কোথায় পাবে সুবিনয়? ছেলেকেও কিছু বলে নি। শুধু বাড়ি ফেরার পথে রক্ত পরীক্ষার কাগজগুলো হাসপাতালের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে এসেছে। সেই অবধি বিছানা থেকে সুবিনয় ওঠে নি।
সারাদিন সুবিনয় চিন্তায় ডুবে থাকে। ঠিকমত খায় না। কোনো কোনো দিন মাঝ রাতে উঠে বসে থাকে। সুখবিলাসী কি হয়েছে জানতে চাইলে শুধু বলে —ঘুম আসছে না সুখি।
হ্যাগো, আমাদের সুমি বাইশে পা দিল—
হুম।
ওর বিয়ের ব্যবস্থাএকটা—
বিয়ে কি করে দেব?কে নেবে বিনে পয়সায়?
থাকা বলতে তে আমার চুরি জোড়া আর কানের—
বসত বাড়িটা বেচা ছাড়া আর উপায় কি?
তাহলে যে সতুকে নিয়ে গাছতলায় দাঁড়াতে হবে।
তুমি এখন ঘুমাও দেখি। আমার ঘুম আসছে—
সুবিনয় পাশ ফিরে সয়। দুজোড়া চোখ নীরবে ভিজে যায়। সুবিনয় ভাবে—সতু যা পায় তাতে ভদ্রভাবে বাঁচা তো দূরের কথা, তিনবেলা ভরপেট খাবারই জোটানো কঠিন। সকালটা মাঠে কাজ আর রাতে কটা ছাত্র পড়ায় বলে তিন বেলা হাঁড়ি চাপে। খুব কষ্টে সুমিকে কলেজে পড়ালো। আর আমার টুকটাক ওষুধ-বিষুধ জোটে। ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস পড়ে সুবিনয়ের। মোরগ ডাকলে বুঝতে পারে ভোর হয়েছে।
ঘড়িতে যখন ঢংঢং করে সাতটা বাজল তখন সূয্যিদেব আকাশে উঁকি দিলেন। আজ আর ভোরে সত্যেন মাঠে যায় নি। সুজাতা দেড় বছরের ছেলে কোলে করে রেলের চাকরি করা জামাইকে সাথে নিয়ে যখন দাওয়ায় এসে দাঁড়াল তখনই সুমি চিৎকার করে উঠল—
বাবা তুমি সবাইকে ছেড়ে কোথায় গেলে গো- - পাড়ার সবাই এসে জুটল। সত্যেন বুঝল “শালার বাপটা তাহলে গেল!!”
গ্রাম থেকে আঠাশ ক্রোশ দূরে শশ্মাণ। ঘরে এক মুঠো চাল নাই, শশ্মাণে নিয়ে যাবার টাকা নাই। একদিকে মরাকান্না আর একদিকে টাকার অভাব সত্যেনকে পাথর করে দিল। অন্ততঃ তিন চার হাজার টাকা। সত্যেন কোনো কথা না বলে হাটের কাছে কাদের চাচার কাছে গেল—চাচা আছেন?
কে? মাস্টার ?কি ব্যাপার?
আমাদের গরুটা বিক্রি করবো—
ও। তোমাদের গরু তো আমার দেখা। তা কত নেবে বলো?
আপনি বলুন চাচা।
আমি আট হাজার দিতে পারি।
বেশ। তবে টাকা এখনি লাগবে।
এখনি?তোমাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে?
চাচা, বাবা আর নাই। শশ্মানে নিয়ে—
তুমি কি বলছো?
হ্যাঁ চাচা।
কখন অঘটন ঘটল? হাই আল্লা!!
সকালে।
গরু পরে নিয়ে আসব। যাও টাকা নিয়ে যাও।
আমিনার মা। আমিনার মা।
কি হল?
ঘর থেকে আট হাজার টাকা নিয়ে এস।
চল মাস্টার । আমি ও তোমার সাথে যাবো। সুবিনয় আর আমি একসাথে পড়তাম। একসাথে খাওয়া, খেলাধূলা , বড় হওয়া। ও বড় সার্থপর। একাএকা চলে গেল। একবার ও বলল না। বৃদ্ধ কাদের চাচার গলা ভারি হয়ে এল।
আজ দুদিন হল সত্যেন বাড়ির কর্তা হয়েছে। সত্যেন দিদিমণির বাড়ি গেল দুদিন বেশি ছুটি নিতে। কিন্তু দিদিমণি ঐ বাড়তি দুদিনের ছুটি কিছুতেই ম্যানজ করতে পারলেন না। চৌদ্দটা সি এল্ । বাবার অসুস্থতার সময় বারোটা সি এল্ নেওয়া হয়ে গেছে। দুদিনের বেশি ছুটি নিতে গেলে উইদ আউট পে হব। অথচ সত্যেন জানে ছুটি কখনো কখনো ম্যানেজ হয়। অবশেষে ঠিক হল কামানো আর শ্রাদ্ধের দিন ছুটি দিবেন দিদিমণি । সত্যেন মনে মনে ভাবল—“ আমরা প্যারাটিচার। তাই চৌদ্দটা ছুটি যথেষ্ট। আমরা প্যারাটিচার। তাই বছরে দশ দিনের বেশি অসুস্থ থাকতে পারি না। আমরা যে লৌহমানব।”হাইরে বিধাতা।
আজ শুভ্রাকে মনে পড়ল তার। জীবণের প্রথম ভালোবাসা । শুভ্রাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল সে। কিন্তু সত্যেন সামান্য প্যারাটিচার—যার না আছে ভূত না ভবিষ্যৎ। শুভ্রার মা ভালো চাকরিকরা ছেলের সাথে লুভ্রার বিয়ে দিয়েছে। হোক না বয়স একচল্লিশ। বড় চাকরি বলে কথা। হয়তো সুখেই আছে সে। আর ক’দিন বাদেই পূজো। শুভ্রা আসবে। সব শুনে সে হয়তো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। আজও শুভ্রাকে সত্যেন ভালোবাসে। কত অপলক নিদ্রাহীন রাত তার কেটেছে—কে রেখেছে তার হিসেব। এখন শুভ্রা এলে সত্যেনকে দেখে মাথা নীচু করে চলে যায়—যেন দেখেইনি তাকে। আসলে ভালোবাসা সমুদ্রের জোয়ারের মত, শ্রাবণের পদ্মার মত। যখন আসে তখন চারিদিকে প্লাবিত করে রাখে। আর যখন যায় তখন ভাঁটার মত সব টেনে নিয়ে যায়। শুধু পড়ে থাকে জমা হওয়া পলি—স্মৃতি ।
সুবিনয়ের মৃত্যু এক বছর পার হয়ে গেল। আজ সুমির বিয়ে। টাকার বন্দোবস্ত হল—চলে গেল বসত বাড়িটা। এই যে সত্যেন, আমি যে তোমাকেই খুজছিলুম।
অনাদি কাকা! তুমি এসেছো?
হ্যাঁ । কি শুনছি?
কি কাকা?
তুমি নাকি বাড়ি বিক্রি করে দিলে?
হ্যাঁ । কাকা।
তুমি কোথায় থাকবে?
এতবড় পৃথিবীতে মা আর ছেলের জায়গা হবে না?
মা? তোমার মাকে তো সুজাতা নিয়ে যাবে বলছে।
হ্যাঁ । আমাকে ও বলেছে। তবে মা জামাই বাড়ি থাকবে না বলেছে।
তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তুমি কোথায় থাকবে? ঠিক করেছো?
হ্যাঁ । নবাদের টালির ঘরটা ভাড়া নেব। তিনশো টাকা ভাড়া বলেছে।
আমি বলছিলাম কি—তুমি আমাদের বাড়ি থাকো। তোমার কাকিমার ও তাই ইচ্ছা। তুমি তো বাবা আমাদের জন্য কম করনি।
না না কাকা। এভাবে বলবেন না।
তুমি ছাড়া তোমার কাকিমাকে আমরা বাঁচাতে পারতাম না।
তুমি যা করেছো তা আমার পেটের ছেলে ও করত না।
কি যে বলেন—
দিনের পর দিন হাসপাতালে পড়ে থেকে তুমি তোমার কাকিমাকে ফিরিয়ে এনেছো।
এ আর এমন কি। মানুষই তো মানুষের পাশ দাঁড়ায়।
তাই তো বলছি। তুমি বাসা ভাড়া নিও না। আমাদের বাড়িতেই থাকো।
কাকা, আমি একটু ওদিকটা দেখে আসি। এখনই বরযাত্রী চলে আসবে। আপনি নিজের মত একটু দেখে শুনে নেবেন।
সুমির বিয়ে হয়ে গেল। অষ্টমঙ্গলার পর সুমি আর আসে নি। অষ্টমঙ্গলার পর কথামত সত্যেন বাড়ি ছেড়ে মাকে নিয়ে নবাদের টালির ঘরে এসে নতুন সংসার পেতেছে। বিয়ের প্রায় মাসখানিক বাদে সুজাতার চিঠি এল। চিঠি সংক্ষেপে লেখা— — —
‘স্নেহের সতু, মা কে আমার বাড়ি পাঠিয়ে দিও। তোমার কাছে মা কে রাখা ঠিক হবে না। বাবা একবার বিনাচিকিৎসায় এক রকম না খেতে পেয়ে মরল। তার উপর তুমি অযথা অনেক টাকা দেনা করে বসলে। বাড়িটা পর্যন্ত রাখতে পারলে না। মা অন্তত শেষ বয়সে দুবেলা পেট ভরে খেয়ে মরুক। সুমির ও তাই ইচ্ছা। আশা করছি পত্রপাঠ অতি শীঘ্রই মাকে আমার কাছে রেখে যাবে। আমরা ঠিক করেছি মা একমাস আমার কাছে একমাস সুমির কাছে থাকবে। আর তুমি ও ভবঘুরে না হয়ে একটা মেয়ে দেখে সংসার করোগে। আর কি? মা কে প্রণাম জানিও। আশির্বাদ রইল।
ইতি,
তোমার দিদি।
সুজাতার চিঠিখানা পড়তে পড়তে অজান্তে চোখ দুটো জলে ভরে গেল।
কার চিঠি রে সতু?
দিদির।
কি লিখেছে?
তোমাকে রেখে আসতে লিখেছে—
আমারও এখানে ভালোলাগছে না বাবা। কিন্তু ঘর থেকে যে দুপা কোথাও যাব তার ও উপায় নাই।
কেন?
কেন কি রে? তোকে রেঁধে দেবে কে?
ও আমি পারব। তুমি কি যাবে?
পারবি? তবে দশ দিনের জন্য রেখে আয় সতু।
বেশ। তবে চলো। সামনের শনিবার ছুটি আছে। তোমাকে রেখে আসবো।
আজ সত্যেনের ঘর নাই, বাড়ি নাই,মা নাই, সুমি- সুজাতা-শুভ্রা —সবাই ,সবাই ছেড়ে চলে গেছে। একবছর হল মা সুজাতা আর সুমির কাছে মাসান্তর পালিতে ভরপেটে আছে। কেউ তাকে চিঠি দেয়না—শুভ্রা-সুজাতা-সুমির মত তবে কি মা ও - - - - -আজও শরতের সেই সকাল — আজ ও গুমোট ভাব। তবে সে ভাব মাটির প্রকৃতিতে নয়, সে ভাব মনের প্রকৃতিতে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন