![]() |
প্রদীপের নীচেই অন্ধকার : পিনাকী চৌধুরী |
প্রদীপের নীচেই অন্ধকার : পিনাকী চৌধুরী
সেইবার দীপাবলির আগের রাতে অশোক অলি গলি, তস্য গলি পেরিয়ে হাজির হল এক নির্জন স্থানে , যেখানে হাজার ওয়াটের কোনো আলো নেই, প্রদীপের আলোও চোখে পড়ে না ! অবশেষে অশোক মনে মনে ভাবলো যে, এটাই যেন নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলবার আদর্শ জায়গা , অন্তত তার পক্ষে ! হেমন্তের সন্ধ্যায় তখন সেখানে এক অদ্ভুত আলো আঁধারী খেলা করছে ! অতঃপর অশোক সেখানে একটি ভাঙ্গা বেদীতে বসলো ! কিন্তু মুহূর্তে সেখানকার নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে গেল " আপনার পাশে কি একটু বসতে পারি ?" অশোক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে যে , এক সুন্দরী কন্যে ! ঠিক যেন পাশের বাড়ির মেয়ে !
সেই কন্যের দু'টি ডাগর চোখের চাউনিতে যেন লুকিয়ে আছে না বলা কিছু কথা ! অশোক ইতস্তত করে উত্তর দেয় " হ্যাঁ, বসুন ! কিন্তু আপনি এই আলোর উৎসবের সময় একাকী এক অচেনা মানুষের পাশে কেন বসলেন ? উত্তরে কন্যে বলে " জানি, আপনি এই প্রশ্ন করবেন , তবে এটুকু বলতে পারি যে, আপনার কোনো ভয় নেই । যাইহোক , এইবার আমি আপনাকে ঘুরিয়ে এই প্রশ্নটা যদি করি , আপনি কেন আলোর রোশনাই ছেড়ে এই অন্ধকারে ?" উত্তরে অশোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে " আজকাল আলোর রোশনাই, উৎসব টুৎসব আর জাস্ট ভালো লাগে না আমার ! তাই ..." এইবলে অশোক সেই কন্যের নাম জিজ্ঞাসা করে ! উত্তরে কন্যে বিমর্ষ হয়ে বললো " নাম জেনে আর কি হবে? আর সত্যিকথা বলতে কি , আমিও আজকাল আলোর রোশনাই এর থেকে অনেক দূরে থাকি ! কি হবে ক্ষণিকের আনন্দ করে ? আর বাদবাকি সময়টাতো কেবলই যাতনাময় ! মৃত্যুই আমার কাছে কাঙ্ক্ষিত সত্য ! হ্যাঁ, মৃত্যুর মতো শাশ্বত সত্য আর কিছুই নেই ! পরম শান্তিরও বটে !
জানেন, নিজের মৃত্যু চিন্তা করলে এক পরম প্রশান্তি লাভ করা সম্ভব !" অশোক এতোক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শুনছিল ! অশোক একটা ঢোঁক গিলে বললো " আপনার কোনো পরিবার নেই ? তাদের সঙ্গেই বা কেন এই উৎসবের সময় আলোর আনন্দ উৎযাপন করছেন না ? " উত্তরে কন্যে খুব শান্ত স্বরে বলে " জানেন, আমি খুব সহজেই সবাইকে আপন করে নিই, আর সেই অর্থে আমার পরিবারের পরিধিটা অনেকটাই বিস্তৃত ! আর খুব সহজেই সবাইকে আপন করে নিই বলেই অন্যদের থেকেই মানসিক আঘাত প্রাপ্তির সম্ভাবনাটা আমার আজ বড়ই বেশি ! আর তাই আজকাল নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি ! " অশোক অবাক হয়ে বললো " সেতো নাহয় বুঝলাম ! কিন্তু আপনার জন্মদাতা পিতা বা মাতা , কিম্বা ভাই বোন , কেউই কি... " অশোকের মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে কন্যে বলে " হ্যাঁ, আমার বাড়িতে সবাই আছে ! আর আজ আমার বাবা মাও আমার আনন্দের জন্য প্রার্থনা করেছেন ! আর আমার আনন্দ তো অপরের কাছে প্রবল দুঃখজনক ! " হতচকিত হয়ে অশোক বলে " কি আবোল তাবোল কথা বলছেন ? " এইবার কন্যে অশোকের চোখে চোখ রেখে বললো " আমার শরীর আজ যদিও সামান্যতম কোনো রোগ নেই, কিন্তু আমার আয়ু আজ সীমিত ! আপনার সাথে আলাপ পরিচয় হয়ে ভাল লাগল ! আজ চলি , পরে আবার কোনোদিন হয়তোবা দেখা সাক্ষাৎ হবে ! শুভ দীপাবলি !"
দু সেকেন্ড পরে অশোক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে যে, সেই কন্যে নেই ! কিন্তু এ কি করে সম্ভব ? বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটতেই চায়না অশোকের ! তারপর অশোক ধীরে ধীরে রাজপথে এসে চারিদিকে আলো দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলো ! আর রাতের আহার সেরে সে ঘুমিয়ে পড়লো ! পরেরদিন মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো অশোকের " আজতো কালী পুজো । বাজার থেকে ১৪ টা প্রদীপ কিনে নিয়ে আয় তো !" ঘুম জড়ানো চোখে অশোক খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তে থাকে, দ্বিতীয় পাতায় একটি বিশেষ খবরে তার চোখ আটকে গেলো , সেই প্রতিবেদনে লেখা আছে " শরীরে কোনো রোগ ব্যাধি নেই , তবে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নেহাতই বীতশ্রদ্ধ হয়ে জৈন ধর্মের এক তিরিশ বছরের সুন্দরী মেয়ে নিজের মৃত্যু কামনায় উপবাস করছেন ! যাকে সান্থারা বলা হয় ! অন্ন এবং জল গ্রহণ না করে সেই মেয়েটি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে ! আর তার এই মোক্ষ লাভের জন্য তার পাশেই তার পিতা মাতাও নিজেদের কন্যার স্বেচ্ছা মৃত্যুর জন্য প্রার্থনায় রত ! " খবরটি পড়বার পরে কিছুতেই যেন হ্যাং ওভার কাটতেই চাইছিল না অশোকের !
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন