 |
গন্ধ : মৃদুল শ্রীমানী |
মহান শিক্ষকদিবস ও সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন : বিপ্লব গোস্বামী
বিশ্বনন্দিত বিশ্ববন্দিত যে কয়েকজন মহাপুরুষের জন্ম ভারতবর্ষে হয়েছে ডঃ সর্ব পল্লী রাধাকৃষ্ণন তাদের মধ্যে অন্যতম।বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রাধাকৃষ্ণন ছিলেন একাধারে বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক,আদর্শ শিক্ষক,মানব দরদী,কূটনীতিবিদ ও বিশিষ্ট লেখক।তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি।
১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর ভারতের মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) থেকে প্রায় পল্লিশ কিলোমিটার দূরে তিরুতানি নামক স্থানে এক দরিদ্র তেলেগু ব্রাহ্মণ পরিবারে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্ম হয়।তার পরিবার এতই দারিদ্র ছিলো যে ননু আনতে পান্তা ফুরায় এরূপ অবস্তা।অত্যন্ত মেধারী ছাত্র রাধাকৃষ্ণনের শৈশব,কৈশোর ও যৌবন অতিবাহিত হয়েছে চরম দারিদ্রতার মধ্যে দিয়েই।মেধারী ছাত্র হিসাবে তিনি যে বৃত্তি পেতেন সেই বৃত্তির টাকায় এক সময় তাঁদের পরিবারের ব্যয় নির্বাহ হত।দারিদ্রতা এতটাই নিষ্ঠুর ছিল যে বাসন কেনার অর্থ না থাকায় তাঁকে কলাপাতায় ভাত খেতে হতো।অনেক সময় কলাপাতা কেনার অর্থ না থাকলে ঘরের মেঝে ভালোভাবে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে সেখানেই আহার্য সমাধা করতেন।এখানেই শেষ নয় দেনায় দায়ে তাকে আদালতের কাঠগড়া পর্যন্ত দাঁড়াতে হয়েছিল।এই দারিদ্রতাই তাঁকে পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনায় পরিণত করেছে।হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ব নন্দিত বিশ্ববন্দিত আদর্শ শিক্ষক।
সমাজের অবহেলিত,নিপীড়িত মানুষের প্রতি ছিল তাঁর হৃদয় ভরা দরদ।তিনি বলতেন " আমরা যদি সুখে স্বাচ্ছন্দে থাকি আর আমাদের চারদিকে অসংখ্য দুর্দশাগ্ৰস্ত, অবহেলিত ও নিপীড়িত মানুষ কোন রকম দিন যাপনে বাধ্য হয় তাহলে সেই বঞ্চিত মানুষদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ, তাদের দুঃখে সান্তনা দান এবং তাদের দুঃখ মোচনের প্রচেষ্টাই হবে আমাদের বিশেষ কর্তব্য।"
রাধাকৃষ্ণন তাঁর কর্ম জীবনের বেশির ভাগ সময় শিক্ষাব্রতী হিসাবে অতিবাহিত করেছিলেন।মাত্র একুশ বছর বয়সে ১৯০৯ সালে মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক রূপে তাঁর কর্মজীবন শুরু।১৯১৮ সালে মহীশূরে বিশ্বাবিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক এবং তিন বছর পর ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের " king George v Chair of Mental & More Science" এর অধ্যাপক নিযুক্ত হন।১৯৩৬ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের " Spalding Professor of Eastern Religion & Ethics" এর পদ গ্ৰহণ।১৯৩৯ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদ গ্ৰহণ।১৯৪৬ সালে -১৯৫২ পর্যন্ত UNESCO তে ভারতীয় প্রধান ছিলেন।১৯৪৯ সালে থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত রাশিয়ায় স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।১৯৫২ সালে প্রথম উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৬২ সালে দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
১৯৬২ সালে তিনি যখন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন সেই সময় রাষ্ট্রপতির মাসিক বেতন ছিল দশ হাজার টাকা।কিন্তু তিনি দশ হাজার টাকা বেতনের দুই হাজার টাকা রেখে বাকি আট হাজার টাকা দেশ গঠনের কাজে ব্যয় করার নির্দশ দেন।ইংরেজ আমলে সিমলার লাটভবন ছিল গরমের দিনে বড়লাটদের সপরিবারেথাকার রাজ প্রাসাদ।সঙ্গে ছিল বড়লাটের অস্থায়ী অফিসের জন্য প্রয়োজনিয় ঘরবাড়ি।এই বিশাল প্রাসাদ এবং তৎসংলগ্ন ঘরবাড়ি রক্ষণাবেখ্যণের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে প্রচুর টাকা ব্যয় হতো।স্বাধীনতার পর সেই ঐতিহ্য রাষ্ট্রপতি বহাল রেখেছিলেন।কিন্তু রাধাকৃষ্ণন রাষ্ট্রপতি পদ অলংকৃত করার পর ঘোষণা করলেন ভারতের মতো গরিব দেশে এভাবে দেশের দরিদ্র মানুষের অর্থের অপচয় কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।তিনি এই ব্যয়বহুল ব্যবস্থার বিলোপ করে সিমলার লাটভবনটি "Indian Institute bod Advance Studies" নামে এক স্বশাসিত সংস্থাগঠনের সিদ্ধান্ত নেন।১৯৬৫ সালে সিদ্ধান্তটি কার্যকর হয়।এই সংস্থিটি বর্তমানে শিল্প,সাহাত্য,ইতিহাস,ধর্ম-দর্শন,সমাজবিদ্যা।প্রভৃতি বিষয়ের উচ্ছতম শিক্ষার কেন্দ্রতে পরিণত হয়েছে।
১৯৫৪ সালে তিনি "ভারতরত্ন" উপাধি লাভ করেন।১৯৬৩ সালে কমনওয়েলথভূক্ত দেশ সমূহের রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে ইংলণ্ডের মহারণি এলিজাবেথ রাধাকৃষ্ণনকে রাজকীয় সংবর্ধনার পাশাপাশি অডা'র অব মেরিট উপাধিতে ভূষিত করেন।১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ভারত সরকার তাঁকে Templeton পুরস্কার দানের কথা ঘোষণা করে।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ইউরোমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে নাসিংহোমে ভর্তি হন।১৯৭৫ ইংরাজির ১৬ এপ্রিল রাত ১২ টা ৪৫ মিনিটে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মনীষী আদর্শ শিক্ষক রাধাকৃষ্ণন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
একজন শিক্ষক তাঁর পাণ্ডিত্য ,মেধা ,শিক্ষা,সততা সব বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা ও যোগ্যতার গুণে কতদূর যেতে পারেন তার উজ্বল দৃষ্টান্ত রাধাকৃষ্ণন।তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকারি হলেও সর্বপরি একজন আদর্শ শিক্ষক।বিশ্ব নন্দিত মহান শিক্ষক রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন বিশেষভাবে পালনের জন্য দেশবাসী ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।তখন তিনি অনুরোধ করেন ৫ সেপ্টম্বর তাঁর জন্মদিনটি শিক্ষকদের জন্য যেন উৎসগ' হয় অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষক দিবস রূপে পালিত হয়।তাই ১৯৬২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে প্রতি বছর এই দিনটি শিক্ষক দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে।এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষা ও শিক্ষক সম্প্রদায়ের প্রতি সামাজিক সচেতননা বৃদ্ধি।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন