তমসা : ঈদারুল ইসলাম

ঈদারুল ইসলাম
তমসা

পাখি দুদিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত । প্রচণ্ড জ্বরে কাহিল হয়ে গিয়েছে সে। একটু পর পর মা'কে ডাকছে। সারাটা দিন সে একাকী যন্ত্রণায় ছটফট করে কাটিয়েছে। বাবা নেই অনেক দিন ! বাবাকে তার মনেই নেই ! তখন সে সবে বছর খানেকের হবে, বাবা হঠাৎই একটা ছোট্ট ঘটনার জেরে আত্মঘাতী হয়েছেন । বাড়ির লোকজনের সাথে সামান্য একটা বিষয়েই বচসা শুরু হয় ,পরে গভীর রাতে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করে সে। বাপ মরা মেয়েটিকে দীর্ঘ চারটি বছর সারাটা দিন একাকী কাটাতে হয়েছে ।

                             **

পাখির মা তমসা কয়েকটা বাড়িতে কাজ করে কোনও মতে সংসার চালাচ্ছে । প্রথমটায় পাখিকে সাথে করে কাজে নিয়ে যেত সে, কিন্তু অনেকেরই অভিযোগ যে মেয়েকে সাথে নিয়ে এলে নাকি কাজে মনোযোগই থাকে না ! মেয়ে বড় হচ্ছে জন্য অনেকটাই খরচ বেড়ে গিয়েছে, পরের বছর স্কুলেও দিতে হবে।  তাই আরও একটা নতুন বাড়িতে কাজ নিয়েছে সে। এ নিয়ে চারটে বাড়িতে কাজ নিয়েছে তমসা। সেই সকাল ছ'টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মেয়ের জন্য খাবার বানিয়ে দিয়ে যায়। রাত্রে বাড়ি ফিরতে অনেকটা দেরি হয়, মাঝে মধ্যেই রাত ন'টা হয়েই যায়। এই কয়েক বছরে সে তাঁর নামটা ভুলেই যেতে বসেছে। আজ তমসার একটাই পরিচয় 'মাসি', হ্যাঁ কাজের 'মাসি' ! দুটো বাড়িতে দুপুরের খাওয়াটা দেয়। একটা সে নিজে খায় আর অপর বাড়ির টা বাসনে করে বাড়িতে নিয়ে যায়। রাতে মা-মেয়েতে মিলে ওই খাবারই ভাগাভাগি করে খেয়ে নেয়। নতুন বাড়িটার দি'ভাই একটু বেশিই কড়া, একটু কাজের কম বেশি হতেই ক্যাঁচক্যাঁচ শুরু করে দেয়। তার উপর আবার জনা সাতেকের বাসনপত্র, এতগুলো ঘর মোছা আর সেইসাথে সবজি কাটা ও কাপড়চোপড় কাচা তো লেগেই রয়েছে, দুপুরের দিকে তাঁর শরীরটা আর চলেই না, ভীষণই পরিশ্রান্ত লাগে। কিন্তু অন্য কোনও উপায়ও তো নেই ! মেয়েকে যে মানুষ করতেই হবে।

                               **

সারাটা রাত মেয়েটা চোখের পাতা এক করেনি। প্রচণ্ড জ্বরে আকুল সে। হাতে পয়সা খুব একটা নেই। মাসের শেষ বলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি। পাশের ঔষধের দোকানে বলে জ্বরের ট্যাবলেট এনে খাওয়ানো হয়েছে ; কিন্তু জ্বর কমার নামই নিচ্ছে না ! একদিন বাদেই মাস পহেলা মাইনে পেলেই মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে তমসা। দেহের তাপমাত্রা এতটাই বেশি যে মেয়েটা একপ্রকার বেহুঁশ হয়েই পড়ে রয়েছে, আর একটু পর পরেই তার মা'কে ডাকছে। তমসা পাশে বসে মাথায় ভেজা কাপড়ের জলপটি দিচ্ছে। মেয়ের যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারছে তমসা, আর মুখ বন্ধ করেই কাঁদছে। হঠাৎই এক ফোঁটা অশ্রু টপকে পাখির মুখে পড়তেই সে চোখ খুলে জানতে চায়- "মা বাবা দেখতে কেমন ছিল ?" তমসা আর নিজেকে সংযত করতে না পেয়ে, মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদেই ফেলে । তার পর মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ানি গান গাইতে গাইতে তমসা পুরনো স্মৃতির পাতায় ফিরে যায়। কত কথা, কত স্মৃতি ! সবই একটু একটু করে মনে পড়তে থাকে। বিয়ের পরে কত স্মৃতি ! পাখির বাবার ফার্নিচারের ব্যবসা ছিল, কাজের ফিনিসিং খুবই ভালো ছিল তাঁর। প্রচুর কাস্টমার আসত আর আমদানিও মন্দ হত না। পাখি জন্মানোর পর কী ধুমধাম করেই না সবাইকে খাইয়েছিল সে ! সেবার পুজোর সময় তমসাকে একটা স্বর্ণোজ্জ্বল পাড়ের হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি এনে দিয়েছিল সে, আর পাখির জন্য একটা টুকটুকে লাল রঙের ফ্রক । কিন্তু হঠাৎই যে কোত্থেকে যে কী হল ! তমসার ওই শাড়িটা আর কোনও দিনই পরাই হল না ।

                                   **

একটু চোখ লেগেছে এমন সময় পাখি আবারও 'মা' 'মা' করে ডেকে ওঠে আর শক্ত করে মায়ের হাতটি ধরে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। তমসা ঠিক করে যে কাল আর কাজে যাবে না, সারাটা দিন মেয়েকে দেবে। পরক্ষণেই মনে পড়ে যে এই মাসে দুদিন কাজে যাওয়া হয় নি, কাল না গেলে নতুন বাড়ির দি'ভাই একদিনের টাকা কেটে নেবে। "না ,কাল কাজে যেতেই হবে !" ওই একদিনের টাকায় মেয়ের জন্য ঔষধ কিনতে পারবে সে।     

                                  **

সকালে একটু দেরিতেই বেরিয়েছিল তমসা। সারাটা রাত ঘুমানোর একটুকুও সুযোগ পায়নি সে। তাই ক্লান্ত শরীরে কাজে মন লাগছে না, তার উপরে মেয়েটার জন্য মন খারাপ করছে । বাকি বাড়িতে বলে কয়ে একটু আগেই ছাড়া পায় সে, কিন্তু নতুন বাড়ির দি'ভাই কিছুতেই ছাড়ছে না। মায়ের মন তো, তাই কোনও কাজেই বসছে না। হঠাৎই কী যেন মনে হয় তমসার !                         

                              **

তমসার কানে অস্পষ্ট একটা শব্দ ভেসে আসে , মনে হয় যেন পাখি তাঁকেই ডাকছে 'মা' 'মা' বলে ! মেয়ের যন্ত্রণার কথা সহ্য করতে না পেয়ে তৎক্ষণাৎ কাউকেই কিছুই না বলেই মেয়ের জন্য খাবার বেঁধে নিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে যায় সে। ঘরে ঢুকে মেয়ের কপালে হাত দিতেই তমসার বুকের মধ্যটা আঁতকে ওঠে ! পাখির সর্ব শরীর যে শীতল ! পাখি নড়াচড়া করছে না কেন ? তমসা চিৎকার করে কেঁদে ফেলে, "পাখি কথা বল, কথা বল মা কথা বল, দ্যাখ আমি তোর জন্য খাবার এনেছি। তুই খাবি না ? আয় মা ওঠ, চল খাবি আয়।"

পাখি আর কোনও দিনই 'মা' বলে ডাকবে না ! দুদিনের জ্বরেই পাখি চলে গেল ! বিছানায় পড়ে রয়েছে পাখির নিথর দেহ !
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.