সমকামী বিবাহ কতটা প্রাসঙ্গিক? : সুকুমার সরকার

সুকুমার সরকার
দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর অবশেষে সমকামী বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দিল ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ! আর তারই উচ্ছাসে রঙধনু কাপড় উড়িয়ে জয়ের উল্লাস করছেন সমকামীরা। কিন্তু সত্যি কি সমকামী বিবাহের দরকার ছিল ? নাকি শুধুমাত্র ভিক্টরিয়ান যুগের নৈতিকতা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক  হবার তাগিদেই পুরানো আইনের সংশোধনী এনে সমকামী বিবাহের বৈধতা  দেওয়া হলো ?
 বিষয়টি ব্যষ্টি , সমাজ ও রাষ্ট্র -- সব দিক থেকে জটিল মনস্তত্ত্বের ! যদিও সমকাম দোষের নয় এবং প্রকৃতি বিরুদ্ধও নয় ; তবুও প্রশ্ন থেকে যায় , সমকামী বিবাহ কতটা প্রাসঙ্গিক ? জন্মগত ভাবে  এক্স ওয়াই হরমোনের তারতম্যের কারনে যারা উভয়লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য বহন করছেন এবং নিজেদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক করছেন তাদের যৌন জীবন যাপন কিন্তু ভিন্ন বিষয়। কিন্তু যারা তেমনটি নন, কেবলমাত্র  বাল্যকাল থেকে কু-অভ্যাসের কারনে কিংবা কুসঙ্গে পড়ে সমলিঙ্গের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলছেন তাদের ব্যাপারটি মোটেই প্রকৃতির স্বাভাবিকতা নয়। এটা এক ধরনের বিকৃত যৌন-যাপন। বিশেষ করে বাল্যকালে অনেক ছেলে মেয়ে কৌতুহল বশতঃ কিংবা বড়দের চাপে পড়ে সমলিঙ্গের যৌন অর্গান নিয়ে খেলা করে মজা পায়। এই মজাটা ধীরে ধীরে কুঅভ্যাসে পরিনত হয়। আর বাল্য কাল থেকেই এই ধরনের কুঅভ্যাসের ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের শরীর-মানস দুর্বলতা এসে যায়। সেই শরীর-মানস দুর্বলতা থেকে তৈরি হয় এক ধরনের ভীতস্মন্যতা। তাদের মনে হয়, বিপরীত লিঙ্গের কাউকে বিয়ে করলে যদি যৌন তৃপ্তি দিতে না পারি কিংবা অসুখী হই ! তাহলে কী হবে? এই ভয় থেকেই তারা বিপরীত লিঙ্গের কাউকে বিয়ে না করে সমলিঙ্গের সঙ্গীর সঙ্গে চিরস্থায়ী যৌন যাপন করতে সমলিঙ্গের বিবাহের দাবী করছেন ।বেশিরভাগ সমকামীতার এটাও একটা বড় বলে মনস্তত্ত্ববিদরা মনে করেন।
এখন এই যে বিভিন্ন ধরণের সমকামীতা ; ধর্মমতগুলি এদের সবার বিরুদ্ধেই খড়গহস্ত ! ধর্মমতের গুরুরা  সমকামকে প্রকৃতি বিরুদ্ধ যৌন যাপন বলেছেন। আর আইনও এতদিন সেই মতো সমকামীদের যৌন-যাপনকে  অপরাধ মনে করে কঠোর শাস্তি প্রদান করেছে। সেই শাস্তি থেকে বাঁচাতেই কি সমকামীদের জন্য সমকামী বিবাহ আইন বৈধ করন করা হলো? যদি তাই হয় ভালো কথা। তবে মনে রাখতে হবে, সব সমকাম যেমন প্রকৃতি বিরুদ্ধ যৌন যাপন নয় ! আবার সব সমকামী যৌন যাপনও  প্রকৃতি-সিদ্ধও নয়।
প্রথমে দেখা দরকার সমকামীদের কারা জন্মগতভাবে যৌনাঙ্গের ত্রুটির কারনে সমকামী। আর কারা কুঅভ্যাসে সমকাম করতে করতে নেশাগ্রস্তের মতো হয়ে গেছেন। যারা জন্মগতভাবে ত্রুটির কারনে সমকামী ধর্মমতের আইন, রাষ্ট্রের আইন সব আইনেই তাদের সমকামকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। এতে সমাজ বা রাষ্ট্র কারও কোনো ক্ষতি হবে না ; যা হবে তা বিরুদ্ধবাদীদের মানসিকতার। কিন্তু বিবাহের প্রশ্নে বিষয়টি অন্যভাবে ভাবতে হবে।
মানব সমাজে বিবাহ ( বি- বহ+ঘঙ =বিবাহ , বিশেষ সামাজিক বন্ধন ) নামক বিশেষ  সামাজিক বন্ধনটার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল শুধুমাত্র যৌন সম্পর্কের স্থায়ী রূপদানের জন্য নয় । যৌন সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে উৎপাদিত  সন্তান-সন্ততির দায় দায়িত্ব বহন ও দায়াধিকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার  তাগিদ থেকে। দুটো কারনের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মানবিকতা , নৈতিকতা এবং বৈধ উত্তরাধিকারের প্রশ্ন।
আজ যারা সমকামীদের জন্য বিবাহের দাবী তুলে আধুনিক হবার চেষ্টা করছেন, তারাই আবার দুইজন নর-নারীর ক্ষেত্রে বিবাহ ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে 'লিভ-টুগেদার' করার পক্ষে গলা ফাটাচ্ছেন। এ কেমনতর আধুনিকতা হলো?
সমকামীরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হলেও সমাজ রাষ্ট্রের কিছু এসে যাবে না। কেননা তাদের যৌন যাপনে কোনো সন্তান-সন্ততি তৈরি হবে না। কিন্তু বিপরীত লিঙ্গের দুইজন নর-নারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হলে সমাজ রাষ্ট্রের অনেক কিছুই এসে যাবে। মানবশিশু পিতৃ-মাতৃ পরিচয় হীন হয়ে পড়বে দায়াধিকার হারাবে। দুটো ক্ষেত্রেই নৈতিকতার প্রশ্ন , উত্তরাধিকারের প্রশ্ন। এখন আধুনিক হওয়া মানে কি নৈতিকতা থেকে সরে আসা?
নৈতিকতা কোনো ভাববাদের বিষয় নয় ! নৈতিকতা ব্যষ্টি, সমাজ ও  রাষ্ট্রের সকল মানুষের, এমন কী সকল জীবের বাঁচা বাড়ার প্রশ্ন। নৈতিকতা ব্যষ্টি, সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি নিধারনের বিষয়। নৈতিকতাকে প্রাচীন ধ্যান ধারণা বলে দূরে সরে রেখে যা খুশি আইন করলে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে যাবে। তবে এটাও ঠিক, নৈতিকতা কোনো স্থির বিষয় নয়। যুগের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিকতার মাপকাঠিও বদলায়। বদলানো উচিত। সমাজ রাষ্ট্রের আইন সেই নিরিখেই প্রণয়ন হওয়া উচিত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নৈতিকতার কোন মানদন্ডে সকল সমকামী বিবাহের বৈধতা পাওয়ার অধিকারী?
দুইজন সুস্থ স্বাভাবিক নর-নারী কেন সমকাম করছে কিংবা করতে বাধ্য হচ্ছে সেটা আগে দেখা দরকার। এটা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়। সেই দায় ঝেড়ে ফেলতেই কি এমন আইন?
আমি হলফ করে বলতে পারি, বেশিরভাগ সমকামীরা পরিস্থিতির স্বীকার। এটা অনেকটা নেশাগ্রস্ত হবার মতো। সুতরাং তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা না করে, ঢালাওভাবে সমকামী বিবাহকে আইনের স্বীকৃতি দিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। এটা ভিক্টরিয়ান না অভিক্টরিয়ান সেই প্রশ্নের চেয়ে এই প্রশ্ন জরুরি, এতে মানব সমাজের জন্য কতটা ক্ষতিকর হবে?
যারা কুঅভ্যাসে ভুল করে সমকামী হয়েছেন, তাদের ভুল সংশোধনের ব্যবস্থা না করে , ঢালাওভাবে সমকামী বিবাহের ব্যবস্থা করার অর্থ তাদেরকে উৎসাহিত করা। এটা কর্পোরেট পুঁজিবাদীদের চাওয়া। আধুনিকতা বা প্রগতিশীলতার লক্ষণ নয়!
পুঁজিবাদ সবকিছুর প্রথাগত দিক ভাঙতে চায়। সমাজকে গড্ডালিকার পথে ঠেলে দিতে চায়। আর তাই একদিকে যেখানে দুইজন নর-নারীর মধ্যে  বিবাহের দরকার সেখানে লিভটুগেদার করাকে উৎসাহ দিচ্ছে। আবার যাদের বিবাহের দরকার নেই সেই সমকামীদের জন্য বিবাহ ব্যবস্থা চালু করতে ইন্ধন দিচ্ছে। এ এক অদ্ভুত দ্বৈরথ মানসিকতা। আর আমরাও পুঁজিবাদীদের পুঁজির কাছে মানসিকভাবে পরাস্ত হয়ে তার স্বপক্ষেই গলা ফাটাচ্ছি।
মানুষের যা ইচ্ছা তাই করতে দিতে হবে এটা কোন ধরনের নাগরিক স্বাচ্ছন্দতা? পায়ু যৌনাঙ্গ নয়। পায়ু মলত্যাগের দ্বার। ওই পথে জনন-যন্ত্র পরিচালনা করাটা স্বাস্থ্য সম্মতও নয়। এটা জেনেও পায়ুকামকে স্বাচ্ছন্দ্য নাগরিক অধিকার বলার অর্থ বিকৃতি মানসিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া। যেমন লিভটুগেদারকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। আসলে এ সবই কর্পোরেট পুঁজিবাদের মানস পরিণতি। মানস-অর্থনৈতিক শাসন শোষনের কৌশল। মানুষের মানস-ভূমির স্বাভাবিক মুভমেন্টকে বিপথে পরিচালিত করাই এদের কাজ।

এর থেকে মুক্তির জন্য কোনো মানস-অর্থনৈতিক দর্শন এতদিন ছিল না। ফলে নৈতিকতার মানদন্ডে কোনটা ঠিক, আর কোনটা ভুল তা নিধারিত করা সম্ভব হচ্ছিল না। এতদিন ধর্মমতগুলির রক্তচক্ষুক এবং পুঁজিবাদীদের মানস-অর্থনৈতিক শোষণের কৌশলকেই আইন মনে করে সমকামীদের প্রতি প্রকৃতি বিরুদ্ধ যৌনাচার বলে শাস্তি দেওয়া হতো। কিন্তু পূর্বেই বলেছি, সব সমকাম প্রকৃতি বিরুদ্ধ নয় !
বর্তমানে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা সবকিছুর অন্তরালে আছে এই ধর্মমত এবং পুঁজিবাদীদের অদৃশ্য  আঙ্গুলি হেলন। এর থেকে বেরিয়ে আসার মতো নৈতিক বা আর্থিক কোনো জোরই কোনো দেশের বর্তমান রাষ্ট্র নেতাদের নেই। ফলে সব দেশেই এই ধরনের পশ্চাদপদ আইন প্রণয়ন হচ্ছে। উদ্দেশ্য সমাজ কাঠামো ভেঙে দিয়ে সমাজ রাষ্ট্র শোষণ শাসনের যাঁতাকল মজবুত করা।
কিন্তু আমরা বলবো, এটা ঠিক নয়। আমাদের হাতে মানস-অর্থনৈতিক দর্শন এসে গেছে। প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের মানস-অর্থনৈতিক দর্শনের দ্বারা সমাজের সর্বস্তরের অব্যবস্থা ও অনিয়মের প্রতিকার আনতে হবে। আজ যারা পরিস্থির স্বীকার হয়ে সমকামী হয়েছেন তাদেরকে সমাজের মুলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে হবে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সকলকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।
আর যারা প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার স্বীকারে সমকামী, তাদের যৌন যাপনকেও সুরক্ষার ব্যবস্থা দিতে হবে। তাদের সমকামকে বৈধতা দিতে হবে। এটাই আধুনিক-মনস্কতার পরিচয়। এটাই নৈতিকতা।
লেখক : সুকুমার সরকার
কালদিঘি, গঙ্গারামপুর
দক্ষিণ দিনাজপুর-৭৩৩১২৪
মোবাইল : +৯১ ৭০৪৭৫৫০২৩১
Sarkarsukumar29@gmail.com
                

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.