![]() |
মাসুদ সুমন |
জোয়ারের স্বচ্ছ পানিতে খালটা টইটুম্বুর হয়ে আছে। খালে গোসল সেরে শাজাহান ঘরে এসে সরিষার তেল গায়ে ডলতে ডলতে মাকে ডাক দেয়, ওমা রান্ধা য়োইছে? শাজাহানের মা ছমিরন বেগম রান্না করছেন। উঠোনের একপাশে ব্যাড়াবিহীন চারটা বাঁশের খুটির উপরে দাঁড়িয়ে থাকা একচালা রান্নাঘর। রান্না ঘর থেকেই তিনি উত্তর দেন, এইত্তো য়োইয়া গ্যাছে। ইট্টু বয়, ডাইলাডা খালি বাগার দিমু। শাজাহান মাটির খাডালে ছপ বিছিয়ে অপেক্ষা করে। মা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত নিয়ে আসেন। সিলভারের গোল বাটিতে পুঁটি মাছের তরকারি। আরেক বাটিতে পাট শাক দিয়ে খেসারির ডাল। শাজাহান কাসার থালে ভাত-তরকারি মেখে গপাগপ খেতে থাকে। মা বলেন, যাবি কোতাও? খাওয়নের সমায় এতো তারাহুরা করোছ ক্যান? আস্তে আস্তে খা। শাজাহান বলে, হ’ মা কাম আছে। মাদারীপুর যামু ইকটু।
: দিনকাল ভালো না বাপ। যেইহানেই যাছ সাবধানে যাইছ।
: হ সাবধানেই যামু। আজাহাররে তো দ্যাখলাম না। ইস্কুলের তোন আহে নাই এ্যাহোনও!
: হ, আইছে। হেই কোনসমায় আইলো। আইয়াই আবার বাইর য়োইয়া গ্যালো। ইস্কুলে নাকি কেলাশ অয় না। য়িন্দু মাস্টাররা সব ইন্ডিয়া পলাইয়া গ্যাছে। মাস্টার নাই। ছাত্রোও নাকি ইস্কুলে তেমন আহে না। পোলাডা হারাদিন কোতায় কোতায় ঘ্ইুরগা বেরায়।
শাজাহান আর কোন কথা বলেনা। খাওয়া শেষ করে দুই খুঁটির মাঝখানে বাঁশের চটি দিয়ে বানানো আলনায় ঝুলতে থাকা হাফহাতা শার্টটা নিয়ে পেছন থেকে দুই হাতের ভেতর গলিয়ে বুকের বোতাম লাগাতে লাগাতে বের হয়। মা, আমি তাইলে গ্যালাম।
জাহানারাদের বাড়ির পাশের গাবতলা দিয়ে যেতে যেতে শাজাহান একবার ভাবে, খানিকক্ষণ দাঁড়ায়Ñ জাহানারা হয়ত খানিক পরেই গোসল করতে আসবে। এখান থেকে জাহানারাদের পুকুর ঘাট বেশ দেখা যায়। আর জায়গাটাও কেমন ছায়া ছায়া। চৈৎ-বৈশাখে ছোট ছোট শাদা ফুলে পুরো গাবতলা ভরে যায়। গাব ফুলের গন্ধে সারা গাছতলা ম ম করে। শাজাহানের বেশ ভালো লাগে। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তাটা মাথা থেকে বাদ দেয়Ñ নাহ্ এখন হাতে সময় নাই। অনেক পথ যেতে হবে। এস্কেন্দার দর্জির আজকেই কাপড়গুলো ডেলিভারি দেয়ার কথা। সেগুলি নিয়ে ক্যাম্পে পৌঁছে দিতে হবে। তাদের গ্রামের অনেকেই ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছে। কেউ কেউ ফিরে এসে কমলাপুর বিলে ডাক্তার বাড়ির মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অংশ গ্রহণ করেছে। মার্চ মাসে যখন নাজিমউদ্দিন কলেজ মাঠে বাশেঁর লাঠি, সড়কি, বল্লম নিয়ে ট্রেনিং হয়েছেÑ সেই ট্রেনিংয়ে শাজাহানও শামিল হয়েছিল। এপ্রিল মাসের সতের তারিখে স্টুয়ার্ড মুজিবের নেতৃত্বে ১৬৫ জনের দল মাদারীপুর থেকে ভারতে ট্রেনিংয়ের জন্য যায়, সে-দলে শাজাহানেরও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়ে ওঠেনি। পরবর্তীতে মাদারীপুর থেকে আরও বেশ কয়েকটি দল গোপনে ভারতে যায়। তখনও শাজাহান যেতে পারেনি। বাপটা আচমকা মরে যাওয়ার পর শাজাহানের উপরেই পুরো সংসারটা। মুক্তিযুদ্ধে না যেতে পারার কারণে বুকের মধ্যে একটা খচখচ অনুভব করে শাজাহান। মার্চ আর এপ্রিলের গোড়ার দিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে চেতনা ঘরে ঘরে সাহস আর দারুণ উত্তেজনা নিয়ে এসেছিল সেটা এপ্রিলের শেষে এসে থিতিঁয়ে যায়। মফস্বল শহরগুলির ঢিলে-ঢালা রাস্তায় জলপাই রঙের পাকিস্থানি গাড়িগুলো যখন গম্ভীর ভঙ্গিতে যায় এবং বেছে বেছে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আর হিন্দুদের বাড়িতে দাউ দাউ আগুন জ্বলতে থাকে তখন বাঙালির বুকের ভেতরও কেমন একটা থম ধরা ভাব চলে আসে। আর দ্রুতই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনও হতে দেখা যায়। পাকিস্থানি আর্মি এসে থানা-পুলিশ-অফিস-আদালাত সবকিছু টেকহোল্ড করলে তার সাথে সাথে স্থানীয় চিত্রপটও পরিবর্তীত হয়ে যায়। খোদ আওয়ামীলীগার যারাÑ যারা মার্চ মাসে উত্তপ্ত বক্তৃতা আর স্লোগানে মুখরিত ছিল তাদের এক অংশ একেবারে চুপসে যায়। শোনা যায় কেউ কেউ নাকি পাক আর্মিদের স্বাগতও জানিয়েছে। ছাত্রলীগসহ আরেক অংশ যারা চূড়ান্ত যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। এই ফাঁকে মুসলিম লীগ, জামাতসহ অন্যান্য ধর্মঘেষা দলগুলো ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনের পর থেকে যারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর সেবায় আর পাকিস্থানের অখ-তা রক্ষায় নিজেদের অন্তর্ভ্ক্তূ করতে পেরে যারপরনাই শুকরিয়া আদায় করে। তারা দ্রুতই শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস গঠন করে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য রক্ষায় নিবেদিত হয়ে পড়ে। এদের সাথে হাত মেলাতে থাকে স্থানীয় স্বার্থান্বেষী এক শ্রেণির সুবিধাভোগী বাটপার। তাদের দৌরাত্মে এলাকায় টেকাই একপ্রকার মুশকিল হয়ে ওঠে। শাজাহান মুক্তিযুদ্ধে যেতে না পারলেও সে মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করে। সে মূলত খলিল বাহিনীর গোয়েন্দা। তার গোয়েন্দা টিমের জন্য চারটা রিক্সা, চারটা ডিঙ্গি নৌকা এবং একটা বাইসাইকেল বরাদ্দ করা আছে। শাজাহান চোখ-কান খোলা রাখে। পাকবাহিনীরা, রাজাকাররা কোথায় কী ঘটালো সেইসমস্ত সংবাদ গোপনে মুক্তিবাহিনীর কাছে সরবারহ করে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দরকারি কাজ-কাম করে দেয়। পুরান বাজারের লাকি টেইলার্সের মালিক এস্কেন্দার দর্জির কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোপনে মোটা কালো কাপড়ের হাফহাতা প্যান্ট ও হাফহাতা শার্ট বানাতে দেয়া হয়েছে। এস্কেন্দার দর্জি গোপনে সেগুলি সেলাই করে রাখবেন।
শাজাহান ছায়া জড়ানো মাটির চিকন পথ দিয়ে এগিয়ে যায়। দুই পাশে ভাটগাছ, আখন্দ গাছ আর বাঁশের লতানো কঞ্চির উপরে স্বর্ণ লতার সবুজ পাতা শুয়ে আছে। বোরহান বিশ্বাসদের বাড়ির উঠোনের ভেতর দিয়ে আবু তালেবদের দো’চালা টিনের ঘরের সামনে এসে শাজাহান ডাক দেয়, আবু তালেব ঘরে আছোছ! আবু তালেবের ছোট বোন রেহানা বেরিয়ে আসে। শাজাহান ভাই, মাজা ভাইতো চরমুগুইরগা গ্যাছে। এ্যাহোনও ফেরে নাই। আপনে ঘরে আইয়া বহেন। শাজাহান বলে, না-রে রেনু এ্যাহন বমু না। আবু তালেব আইলে কইছ, আমি আইছিলাম। শাজাহান পেছন ফিরে হাঁটা দেয়। আবু তালেবের বাপ ঝিয়া বিশ্বাস গাই গরুকে গোসল করিয়ে আতালে বাঁেধন। শাজাহানকে দেখে বলেন, এই দুহারকালা কই যাছ! বয়, ভাত খাইয়া যা। শাজাহান বলে, না কাকা আমি খাইয়া আইছি। এ্যাহোন বমু না। কাম আছে।
শাজাহান হাঁটতে হাঁটতে খাগদি বাসস্ট্যান্ড আসে। বাসস্ট্যান্ড প্রায় ফাঁকা। খোলা আকাশের নিচে একপা ভাঙ্গা একটা টেবিল নিয়ে কাউন্টারে একজন লোক গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে। শনের একচালা ছাউনি দেয়া চায়ের দোকানী চুলার আগুন জ্বালানোর সরঞ্জাম ঠিকঠাক করছে। তার পাশে খালি গা একটা ছেলে বসা। চা দোকানীর ছেলে হবে হয়তো। এছাড়া পুরো বাসস্ট্যান্ড ফাঁকা। শাজাহান বড় কড়াই গাছটার ছায়ায় এসে দাঁড়ায়। মুড়ির টিন মার্কা একটা লক্কর-ঝক্কর বাস এলে শাজাহান তাতে উঠে পড়ে।
বাসের ভিতরে যাত্রী বেশি নাই। সামনের সিটে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা দুইজন মুরুব্বী টাইপের যাত্রী। তাদের দুইজনের মাথায়ই টুপি। মাঝখানে চার-পাঁচজন যাত্রী। মহিলাদের সিটে চার-পাঁচজন মহিলা। সবাই কালো বোরখা পরা। তার ভিতরে একজন অল্প বয়স্কা। সম্ভবত নতুন বিয়ে হয়েছে তার। তার পরনেও কালো বোরখা। তবে মুখটা খোলা। ফর্সা গোলগাল মুখ। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। রাস্তার দুইধারে চক। চকে থৈ থৈ পানি। পানির উপরে মাথা খাড়া করে ধান গাছগুলি বাতাসে দোল খায়। রাস্তার কোন কোন জায়গায় জোয়ারের পানি উঠে গ্যাছে। ধান ক্ষেত আর রাস্তার দুই ধারে ঝাকড়া চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কড়াই গাছগুলিকে পাশ কাটিয়ে বাস চলতে থাকে। নয় নম্বর ব্রিজ পার হয়ে ইটের পুল এলে বাস থামে। বাম পাশে এ.আর. হাওলাদার মিল গেটের সামনে পাকসেনাদের চেক পোস্ট। এখন অবশ্য চেক পোস্টে কোন পাকসেনা নাই। তিনজন রাজাকার দাঁড়ানো। তাদের প্রত্যেকের পরনে লুঙ্গি। গায়ে বিস্কুট কালারের খাকি ফুলহাতা শার্ট। মাজায় বেল্ট জড়ানো। কাঁধে থ্রি নট থ্রি রাইফেল ঝোলানো। একজন রাজাকার বাসে উঠে পুরো বাসের ভেতর দুই চোখ মেলে চক্কর বোলায়। যাত্রীরা সব সুনসান বসে থাকে। রাজাকারটা এবার বাসের মাঝখানে এসে যাত্রীদের ব্যাগ চেক করে। দ্ইু হাত দিয়ে বাসের একপাশের কেরিয়ার ধরে উপরে উঠে কল্লাটা বাড়িয়ে পরখ করে কোথাও সন্দেহজনক কিছু আছে কিনা। তারপর মহিলাদের সামনে যায়। ফিসফিস করে বোরখার ভেতর থেকে একজন মহিলা বলেন, বউ, নেকাব ফালাও। নতুন বউটি কপালের উপরে ওঠানো কালো কাপড়ের টুকরাটি ফেলতে গেলে রাজাকারটি বলে ওঠে, নেকাব ফালানো লাগবে না। ভাবি ছাবের চেহারাখানতো মাশআল্লাহ খুবছুরত। সারা রাস্তায় যখন খোলা রাখতে পারছে এখন আর ঢাকোনের কী দরকার! আর আমরাতো পর কেউ না। বলেই খ্যাক খ্যাক করে হাসে। অপমানে নতুন বউটির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। শাজাহানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। নিচ থেকে একজন রাজাকার তাগাদা দ্যায়, কিরে কাদের এ্যাতো দেরি হইতেছে ক্যান? সন্দেহজনক কিছু পাইছোস? কাদের বলে, না। তয় নুরানি চিজ আছে একখান। নামায়া আনমুনি? নিচ থেকে উত্তর আসে, না, এখন আর দরকার নাই। আমাগো ডিউটির সময় শেষ হয়া যাইবে কিছুক্ষণ পরেই। বেহুদা ক্যাচালের দরকার নাই। কাদের নিচের উত্তরে খুশি হয়না। নাখোশ হয়েই সে বাস থেকে নেমে যায়। যাওয়ার আগে কল্লা বাড়িয়ে নতুন বউয়ের দিকে তাকায়Ñ ভাবিছাব ভালো থাইকেন। বলেই সে আবার তার বিশ্রি খ্যাক খ্যাক হাসি দেয়।
বাস থেকে নেমে শাজাহান চাঁনমারি মসজিদ মোড়ে এলে দেখে তিন চারটা রিক্সা অলস বসে আছে। শাজাহান একজনকে ইশারা দেয়। সে রিক্সা ঘুরিয়ে কাছে এলে রিক্সায় উঠে শাজাহান পুরান বাজারের দিকে যেতে বলে। রিক্সাওয়ালা তাদের গোয়েন্দা দলের সদস্য। প্যাডল ঘুরিয়ে রিক্সা চলতে থাকে। পোস্ট অফিসের মোড় পার হলে রাস্তাঘাট আরও নিরিবিলি হয়ে আসে। শাজাহান দুই পাশে তাকিয়ে ফিসফিস জিজ্ঞেস করে, আলী ভাই শহরের অবস্থা কী? রিক্সাওয়ালা প্যাডল চালাতে চালাতে বলে, অবস্থা বেশি ভালো না। গতকাইল তোরাব খা মেলেটারিগো লইয়া কুলপুদ্দির কু-ু বাড়ি লুট করছে। শাজাহান বলে, কন কী! আলী বলে, হ। আলী লুটের বর্ণনা যা দেয় তা মোটামুটি এরকমÑ রাত তখন আনুমানিক বারোটা। কু-ুরা বিল্ডিংয়ের দোতলায় ঘুমিয়ে আছে। এ¤িœতেই তারা সারাদিন ভয়ের মধ্যে থাকে। গুজবের তো শেষ নাই। এই মিলিটারি আসতেছে... মিলিটারি আসতেছে... ভয়ে তখন বাড়ি-ঘর ছেড়ে সবাই বিলের মধ্যে গিয়ে পলায়। পরে শোনে, না মিলিটারি ফিলিটারি কিছু না। সব গুজব। এ¤িœতেই হিন্দুরা সব ইন্ডিয়া পালিয়ে গ্যাছে। কু-ুদের চৌদ্দ পুরুষের বসত ভিটা। পুরান বাজারে স্বর্ণের ব্যবসায়। বাড়ির মাঝখানে উঠান রেখে তিন পাশে বিশাল বিশাল দালান। দালানের পেছনে ঘাট বাধাঁনো বিশাল বিশাল পুকুর। পুকুরের চারপাশে অসংখ্য গাছ। ডাব গাছ, জামরুল গাছ, আম গাছ, আতা গাছ, হরতকি গাছ। গাছা-গাছালির ছায়ায় সারাক্ষণ পাখির কুজন লেগেই আছে। এইসব রেখে তারা সাতচল্লিশের দেশ ভাগের সময়ই ইন্ডিয়া যায় নাই। এখনও যাবে না বলে ঠিক করেছে। দোতলার পরিত্যক্ত একটা রুমে বিশাল সিন্দুকে সোনা-দানা নগদ টাকা পয়সা লুকিয়ে রেখেছে। সিন্দুকের উপরে অব্যবহৃত কাঠ-পাট, পাটখড়ি, আবর্জনার স্তুপ জড়ো করা। যাতে দেখেও কেউ সন্দেহ করতে না পারে।
রাতের বেলা হঠাৎই সিঁড়িতে দুপদাপ বুটের শব্দ। প্রথমে মধুনাথ কু-ু মনে করেছিলেন তিনি বুঝি দুঃস্বপ্ন দেখছেন। আজকাল মাঝেমাঝেই এমন হচ্ছে। ভয়ংকরসব দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি উঠে বিছানায় বসেন। দরদর করে কপাল থেকে ঘাম পড়তে থাকে। বুকটা ধরফর করতে থাকে। তার স্ত্রী জেগে গিয়ে জিগ্যেস করেন, কী! কী হইছে আপনের! এমন করতেছেন ক্যান? তিনি শান্ত ভঙ্গিতে বলেন, না কিছু না। একটা দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। ঘুমাও। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই যখন দরজায় বুটের লাথির দড়াম দড়াম আওয়াজ শোনেন তখন তার আর বুঝতে কিছু বাকি থাকে না। ততক্ষণে বাড়ির অন্যান্যরাও জেগে গেছে। ভয় আর আতংকে চাপা গোঙানির শব্দ হয়। লাথির তোড়ে মধুনাথ কু-ুই খুলে দেন দরজার কবাট। প্রথমে সিন্দুকের চাবি নিয়ে মধুনাথ কু-ুকে দিয়েই খোলানো হয় বিশাল সেই সিন্দুকটি। সিন্দুকের ভিতরে সোনা-দানা আর নগদ টাকার পরিমাণ দেখে এক মিলিটারি অফিসার বলে, ইয়ে মালাউন আদমী সালা বহুত বানচোত হ্যায়। মধুনাথ কু-ু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। তারপর বাড়ির সব লোকদের একটা ঘরে জড়ো করা হয়। বাসুদেব কু-ুর বউটা ভিষণ সুন্দরী। প্রতিমার মতো গায়ের রং। বাসুদেবের বউ এবং যুবতী বোনটাকে সবার সামনে উপর্যপুরি ধর্ষণ করে খাকি পোশাক পরা মিলিটারিগুলা। তারপর সবাইকে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিচে নামিয়ে আনে। লাইন দিয়ে দাঁড় করায় দোল পূজার বেদির সামনে। জলপাই রঙা হেলমেট পরা দুইজন সৈনিক তাদের বুকের পরে উচিয়ে ধরে মেশিনগান। ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে মধুনাথের মা তোরাব খা’র পা জড়িয়ে ধরেন, বাজান আপনে আমাগো ধর্মের বাপ। জানডা খালি ভিক্ষা দেন। কাইলকেই আমরা এই দ্যাশ থিকা যামু গিয়া। তোরাব খা বলে, হেই বুরি পাও ছার। তোরা হইলি ইসলামের দুশমন। পাকিস্থানের দুশমন। তোগো লাইগ্গাই পাকিস্থান দ্যাশটারে দুই ভাগ করনের ষড়যন্ত্র হইতেছে। মধুনাথের মা তখন এক অফিসারের পা জড়িয়ে ধরে প্রাণ ভিক্ষা চায়। বিনিময়ে ঝটকা বুটের একটা লাথি এসে পড়ে বৃদ্ধার মুখে। ছিটকে পড়েন বৃদ্ধা। গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে মুখ থেকে। আর তখনই ঠা-ঠা-ঠা শব্দে বেরিয়ে আসে বুলেটের ঝাক। কাটা কলা গাছের মতো এলিয়ে পড়ে রক্তাক্ত শরীরগুলো। প্রতিবছর দোল পূজায় যেখানে রঙ ছিটিয়ে হোলি খেলা হতো সেই বেদিই দশটি দেহের লাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। লুটের গল্পের নৃশংসতা শুনতে শুনতে শাজাহানের বুকটা ব্যথায় টনটন করে ওঠে।
খালের উপরে বাঁেশর খুঁটি দিয়ে টং ঘরের মতো সারিবাঁধা টিনের দোকান। সামনে বাঁশের মাঁচা। দোকানের ভিতরে কাঠের পাটাতন। একটা দোকানের সামনে টিনের সাইন বোর্ডে লেখা, লাকি টেইলার্স। দোকানের ভেতরে লম্বা চিকন মতো একজন লোক মাথা নিচু করে খটখট শব্দ তুলে সেলাই মেশিনে সেলাই করছেন। শাজাহান দোকানের ভেতরে গিয়ে কাঠের টুলে বসে। সেলাই মেশিনের পা’দানিতে প্যাডল চালাতে চালাতেই এস্কেন্দার দর্জি বলেন, বহো মিয়া। হাতের কামডা সাইরাই তোমার কাম ধরুম। তোমার কামও বেশি বাকি নাই। আধা ঘোণ্টার বেশি লাগবে না। শাজাহান চুপচাপ বসে থাকে। কু-ু বাড়ির নৃশংসতার কথা শোনার পর থেকে মনটা বিবশ হয়ে আছে। মানুষ এতোটা জানোয়ার হতে পারে? এতোটা? রাগে ক্ষোভে তার শরীরটা রি রি করতে থাকে। মধ্যবয়স্ক এক লোক লাকি টেইলার্সের ভিতরে ঢোকে। শাজাহানকে বসে থাকতে দেখে বলে, কী মিয়া আছো ক্যামন?
: হ কাকা আছি আলহামদুলিল্লাহ। আপনেরা আছেন ক্যামন?
আগন্তুক ব্যক্তিটি চারদিকে একবার চোখ বুলায়। তারপর ফিসফিস করে বলে, গতকাইলকোর খবর হুনছো নি?
: হ হুনছি। তোরাব খা নাকি মিলিটারিগো লইয়া কুলপদ্দির কু-ু বাড়ি লুট করছে!
: হ। বাসুদেবের বউডারে আর বুইনডারে যে অত্যাচার করছে...। ব্যাবাক পুরুষ পোলাগো মাইরগা হালাইছে। খা-া খা-া রক্ত পইরগা রইছে এ্যাহোনও। আগন্তুক ভদ্রলোক তার ফিসফিস কণ্ঠস্বরকে আরও সর্তক করেন, গোপন খবর আছে একখান।
: কী খবর?
: কাইল ব্যানে সোমাদ্দার ব্রিজের আশ-পাশের গ্রামগুলা গারদ কইরগা হালাইবে পাকিস্তানি সেনারা।
: কন কী! আপনে হোনলেন কার থিকা?
: আমার এক চাচতো ভাই আছে এ.আর হাওলাদার মেলে পাকিস্থানিগো বাজার-ঘাট কইরগা দ্যায়। তার থিকা শুনছি। একদম পাক্কা খবর।
এস্কেন্দার দর্জি তার সেলাই মেশিনের খটখট অব্যাহত রেখেই বলেন, তোমরাতো দেখতেআছি আমার দোকানডারে মুক্তি ক্যাম্প বানাই ফালাবা। দেওয়ালেরও কোলোম কান আছে। দিনকাল ভালো না মিয়ারা। কতা-বার্তা একটু সাবধানে কইয়ো।
খবরটা শুনে শাজাহানের বুকের ভেতর কেমন তোলপাড় শুরু হয়। কিছু একটা করার জন্য হাত-পা নিশপিশ করতে থাকে। কাউকে কিছু না বলেই দোকান থেকে বেরিয়ে যায় সে। হনহন করে হেঁটেহেঁটে চলে আসে বাস স্ট্যান্ড।
শাজাহান বাড়িতে ফিরে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে রওয়ানা হয় কমলাপুর ডাক্তার বাড়ি। এবার পানি হয়েছে ব্যাপক। জোয়ারের পানিতে ছুপ ছুপ বৈঠা ফেলে সে এগোতে থাকে। একটা চক পাড়ি দিয়ে আরেকটা চকে এসে পড়ে। দূরে সবুজ বেষ্টনিতে ঢাকা গাছ-গাছালির ফাঁক-ফোকর দিয়ে গ্রামের বাড়ি-ঘরগুলিকে দেখা যায়। কোথাও কোথাও শ্যাওড়া গাছগুলি বুক পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে ঝাকরা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। আবার চকের ভেতরে কোথাও টানটান লম্বা একহারা শরীর নিয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক সারি তাল গাছ। তাল গাছের মাথা থেকে ঝুলছে খড় কুটোয় বোনা বাবুই পাখির বাসা। বর্ষার এইসব গ্রামীণ দৃশ্যপটকে পেছনে ফেলে সে যখন মস্তফাপুর, ঘটকচর, সোমাদ্দার পার হয়ে কমলাপুরের বিলে এসে পড়ে তখন কমলাপুর বিলের পশ্চিম কোণে সবুজ গাছ-গাছালির মাথার নিচে লাল সূর্যটা নেতিয়ে পড়েছে। চারদিক পানিতে ছয়লাব হয়ে আছে। যেন একটা শান্ত সমুদ্রের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলছে তার ডিঙ্গি নৌকা। পুব আকাশে একখানি শাদা চাঁদ বড় থালার মতোন ভেসে ওঠে। বিলের পানিতে শাদা শাদা শাপলা ফুলগুলি তিরতির বাতাসে কাঁপতে থাকে। শাজাহানের জাহানারার কথা মনে পড়ে। একখানি শ্যামলা ভরাট মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সে মনে মনে ভাবে দেশ স্বাধীন হলে জাহানারার বাপের কাছে প্রস্তাব পাঠাবে। জাহানারার বাপ তার প্রস্তাব নিশ্চয় ফিরিয়ে দেবেনা। তার সাথে দেখা হলে জাহানারার বাপ যে আন্তরিকতা নিয়ে খোজঁ-খবর নেয় তাতে সহজেই বোঝা যায় শাজাহানকে সে পছন্দই করে। তাছাড়া ছেলে হিসেবেওতো শাজাহান একেবারে খারাপনা। যদিও তেমন পড়া-লেখা করতে পারেনি। কিন্তু কর্মঠ ছেলে শাজাহান। বাপের রেখে যাওয়া জমি-জিরাত চাষ-বাস করে চার-ভাই-বোন আর মাকে নিয়ে একেবারে খারাপ নেই। বড় বোনটারও বিয়ে দিয়েছে ভালো ঘরে। কিন্তু অবস্থা যা তাতে দেশ স্বাধীন হতে কতদিন লাগে আল্লাহ্ মালুম। দিন দিন মিলিটারিদের অত্যাচার বেড়েই চলছে। তার সাথে যোগ হয়েছে মোনাফেক রাজাকারগুলা। তবে মুক্তিবাহিনীরাও বসে নেই। এখানে সেখানে নানান জায়গায়ই প্রতিশোধ নিচ্ছে মুক্তিবাহিনীরা। শেখ সাব যে কী অবস্থায় আছেন আল্লাই ভালো জানেন। শেখ সাহেবের জন্য তার বুকের ভেতরটা কেমন উথাল-পাথাল করে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ডাক্তার বাড়ির ঘাটে এসে পৌছায় ডিঙ্গি নৌকা খেয়ালই থাকেনা। নৌকার মাথাকে জোয়ান দুই হাতে এক হ্যাচকা টানে অনেকখানি উপরে উঠিয়ে ফেলে শাজাহান।
খলিল বাহিনীর প্রধান মেজর খলিল পাঁচ-ছয় জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গোল হয়ে বসে গল্প করছেন। তার পরনে হাফ প্যান্ট। গায়ে হাফ হাতা গেঞ্জি। হাতে কেচি সিগারেট জ্বলছে। খলিল খান সামরিক বাহিনির কেউ নন। তবু তার নাম মেজর খলিল। তার ক্ষিপ্রতা, দুঃসাহসিকতা, কুশলতার জন্য লোকেরা তাকে মেজর খলিল নামে ডাকে। সাধারণ লোকেরা বলাবলি করে, মেজর খলিলের নাম শুনলে রাজাকারদের বিচি নাকি পেটের ভিতরে ঢুকে যায়। শাজাহানকে আসতে দেখে খলিল খান ডাক দেন, শাজাহান এদিকে আয়। শাজাহান এগিয়ে এলে জিজ্ঞেস করেন, খবর কী বল। শাজাহান গতকালের কুলপদ্দি বাজারের লুটের বিস্তারিত খবর জানায়। শুনতে শুনতে খলিল খানের কালো পেটানো শরীরটা টান টান হয়ে যায়। চোখ দুটা রক্ত বর্ণ হয়ে যায়। সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে ধোঁয়া ছাড়েন। তারপর দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে বলেন, মে মাসে আমরা নির্ভয়পুর বি.এস.এফ ক্যাম্প থেকে মাদারীপুরে আসি। এইটাই ছিল ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে মাদারীপুরে আসা প্রথম দল। আমরা ছিলাম বিশজন। পাঁচজন পাঁচজন করে চারটা দলে ভাগ হয়ে আমরা মাদারীপুরে ঢুকি। কথা ছিল যার যার মা-বাবার সাথে দেখা করে আমরা কালিকাপুরের তালুক গ্রামে গামা মান্নানের বাড়িতে মিলিত হব। তারপর সময় সুযোগ বুঝে গেরিলা হামলা করব। সবাই ঠিকমতো গন্তব্যে পৌছে। কিন্তু বাদল আর শাজাহান নামে দুই মুক্তিযোদ্ধা কুলপদ্দি বাজারে ধরা পড়ে। এই তোরাব খাই তার সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়া অগো ধরে। সময় আসুক তোরাব খা’র ব্যবস্থা আমি নিজ হাতে করব। হিম শীতল কণ্ঠে বলে খলিল খান। শাজাহান বলে, খলিল ভাই আর একটা জরুরী খবর আছে।
: বল কী খবর?
শাজাহান তখন সোমাদ্দার ব্রিজের আশ-পাশের গ্রামে মিলিটারিদের আগামিকালের অপারেশন সম্পর্কে জানায়। শুনে এবারও চুপ মেরে থাকেন খলিল খান। কিছু একটা চিন্তা করেন এক মনে। তারপর বলেন, শাজাহান তুইতো নাজিমদ্দিন কলেজ মাঠে ট্রেনিং করছিস। করছিস না?
: হ। করছি।
: তোরে একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিব। পারবি না?
: হ পারমু।
: মনে রাখিস, এই দেশটা আমাদের। এই যুদ্ধ আমাদের সকলের যুদ্ধ। আমাদের নিরীহ জনগণরে কিছুতেই আমরা পাকিস্থানি কসাইদের কাছে ছেড়ে দিতে পারি না। আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। তাই পাকিদের আগামিকালের অপারেশন কিছুতেই সাকসেশফুল করতে দেয়া যাবে না। অরা জানে এইসব গ্রামবাসীরা আমাদের খাদ্য দিয়ে, অর্থ দিয়ে, থাকার জায়গা দিয়ে সহযোগিতা করছে। সত্যি সত্যি ধ্বংস করে ফেলবে গ্রামগুলারে। কিছুতেই আমরা সেইটা হইতে দিতে পারি না। তাই বলছি, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব দিচ্ছি তোকে। কালকে যখন পাকসেনারা গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হবেÑ নয় নম্বর ব্রিজ পার হলে তুই সেখানে এন্টিট্যাংক মাইন পুতে রাখবি। সোমাদ্দার ব্রিজের আগে রাস্তার দুই পাশে আমর্স নিয়ে আমরা অবস্থান করব। ওদের গাড়ি এলেই আমরা ফায়ার ওপেন করব। ওদের তখন ব্যাক করা ছাড়া উপায় থাকবে না। আর তাড়া খাওয়ার ফলে ওদরে ভেতরে থাকবে তাড়াহুড়া। রাস্তায় মাইন পোতা থাকলেও সেটা নজরে পড়বে না। মাইনে উড়ে যাবে। যদি তুই ঠিকঠাক মতো করতে পারস। সবকিছু আমি বুঝায়া দিব। পারবি না?
: হ খলিল ভাই পারমু।
শাজাহান যখন এন্টিট্যাংক মাইনসহ অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে বাড়ি ফেরে রাত তখন এগারোটা পার হয়ে গ্যাছে। ঘরের পাশে খড়ের পালার নিচে মাইনসহ অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্ট লুকিয়ে রেখে শাজাহান আজাহারকে ঘুম থেকে উঠায়। তারপর আজাহারকে সঙ্গে নিয়ে উঠায় আবু তালেবকে। আবু তালেবদের ঘরের পেছনে তাল তলায় গিয়ে বসে তিনজন। ফিনফিনে জোছনায় পুরো তাল তলা মাখামাখি হয়ে আছে। সামনে চক। চকে থৈ থৈ পানি জোছনা মাখা বাতাসে তির তির কাঁপে। আবু তালেব বলে, কিরে ঘটনা কী ক’তো! এ্যাতো রাইতে উঠালি! দুপুর কালাও হোনলাম খোজতে আইছিলি? শাজাহান বলে, ঘটনা আছে। সে পাকসেনাদের কালকের অপারেশন এবং তাদের মাইন পুতে রাখার প্লানের কথা বিস্তারিত জানায়। তারপর বলে, তোগো দুইজনের সাহায্য লাগবে। পারবি না তোরা? আবু তালেব আর আজাহার দুইজনে একসাথেই বলে, হ পারমু।
ইমাম সাহেবের কণ্ঠে আসসালা তু খাইরুম মিনান নাউন ভেসে আসতেই ধরমর করে উঠে পড়ে শাজাহান। আজাহারও উঠে পড়েছে ততক্ষণে। আজাহার মূলত খবরটা শোনার পর থেকে উত্তেজনায় ঠিক মতো ঘুমাতেই পারেনি। রাতভর অপেক্ষা করেছে, কখন সকাল হবে। কখন সকাল হবে! শাবল, কোদাল আর খড়ের গাদার নিচে লুকিয়ে রাখা যন্ত্রপাতি নিয়ে শাজাহান আর আজাহার ডিঙি নৌকার ধারে এসে দ্যাখে আবু তালেব নৌকার উপরে বসে আছে। সে একটা মাছ মারা কোঁচ আর মাছ রাখার খালুই এনেছে সাথে। শাজাহানই আনতে বলেছে। পথে কারও সাথে দেখা হলেও কেউ যাতে কোন কিছু সন্দেহ করতে না পারে। এবছর পানি যেমন হয়েছে পানির সাথে সাথে মাছও পড়েছে। ক্ষ্যাপলা জাল দিয়ে ক্ষ্যাপ দিলেই জাল ভর্তি পুঁটি, ট্যাংরা, শিং চড়চড় করতে থাকে। চিকন বাঁশের লগিটাকে পানিতে ফেলে ধাক্কা মারতেই নৌকাটা দ্রুত বেগে ছুটতে থাকে। সকালের নরোম হাওয়া এসে গায়ে লাগে। উচু উচু ধান গাছের ভিতর দিয়ে এগোতে থাকে নৌকা। ধানও মাশআল্লাহ্ এবার জবর হইছে। পুব আকাশে কচি সূর্য ঘুমঘুম চোখ মেলে তাকাতে শুরু করেছে। তারা যখন নয় নম্বর ব্রিজের ঢালের খানিকটা দূরে নৌকা থামায় চারদিক তখন আবছা আবছা আলোকিত হয়ে উঠছে। ধান ক্ষেতের ভেতরে চুপচাপ ঘাপটি মেরে বসে থাকে তারা। রাস্তা থেকে তাদের দেখার জো নেই। কিন্তু ধান গাছের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে তারা ঠিক নজর রাখে সরকারি রাস্তার উপরে। রাস্তা একেবারে ফাঁকা। সুনসান নিরবতা। আজাহারের মনে হয় সময় যেন আটকে গেছে। তার বুকের ভেতরটা হাপরের মতো ওঠা-নামা করতে থাকে। এভাবে কতক্ষণ পার হয় আজাহার বলতে পারবেনা। একসময় গম্ভীর আওয়াজে গাড়ি আসার শব্দ হয়। তারা শক্ত হয়ে বসে থাকে নৌকার ভেতর। পরপর চারটা গাড়ি চলে যায় সাঁই সাঁই করে। তারপর আবার রাজ্যের নিরবতা নেমে আসে রাস্তা জুড়ে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শাজাহান দ্রুত লগি দিয়ে ধাক্কা দেয়। ব্রিজের পশ্চিম ঢালে নৌকা থামিয়ে রাস্তায় ওঠে। আজাহার চলে যায় ব্রিজের উপরে। কোন গাড়ি বা লোকজন আসলে সিগন্যাল দেবে সে। শাজাহান বলে, হাতে খুব বেশি সমায় নাই দ্রুত কাম সারতে হবে আবু। আবু বলে, হ। শাজাহান সঙ্গে আনা এসিডের বোতল থেকে বেশ খানিকটা এসিড রাস্তার উপরে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঢালে। তাতে ম্যাজিকের মত কাজ হয়। পিচগুলো গলে যায়। আবু তালেব শাবল দিয়ে চাড়ি দিলে পাথরের নুড়িগুলো আলাদা হয়ে যায়। এরপর ইট উঠাতে আর বেগ পেতে হয়না আবু তালেবের। গর্ত খুড়ে দুটি মাইন পুঁতে রেখে তারউপরে ইট আর পাথরের গুড়ি রেখে গলে যাওয়া পিচগুলো উপর দিয়ে ছিটিয়ে দেয়। তারপর আলকতরা ছিটিয়ে দেয়। যেন দূর থেকে রাস্তা খোড়ার ব্যাপারটা আন্দাজ করা না যায়। শাজাহান বলে, আমাগো কাম শ্যাষ। আজাহাররে ডাক দে।
ভোরের নরোম আলো রাঙা হয়ে চারদিক ছড়িয়ে পড়ে। শাজাহানদের ডিঙি নৌকা ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে এগোতে থাকে। ধানপাতার কারণে দ্রুত নৌকা চালানো যাচ্ছেনা। ধান পাতা বেশ ধার। চামড়ায় লাগলেই ছড়ে যাচ্ছে। নিরাপদ দুরত্বে এসে শাজাহান বলে, আবু তোর কাছে সিগারেট আছে? আবু বলে, সিগারেট নাই। তয় বিড়ি আছে। খাবি!
: দে।
আবু লুঙ্গির গিঁটের থেকে বিড়ি বের করে দেয়। শাজাহান বিড়ি ধরিয়ে চুপচাপ টানতে থাকে। আবু লগি খোচাতে খোচাতে বলে, কাম য়োইবে তো!
: হওয়ারতো কতা। খলিল ভাই যেইভাবে কইছে সেইভাবেই তো পুতঁলাম।
আজাহারের বুকটা আবারও ঢিপঢিপ করতে থাকে। আবারও তার কাছে মনে হয় সময় যেন থমকে গেছে। হঠাৎই বিকট আওয়াজ হয়। সে-আওয়াজ এতো বিকট যে তারা তিন জনেই প্রায় লাফ দিয়ে ওঠে। নয় নম্বর ব্রিজের ঢালে দেখা যায় দাউদাউ আগুন জ্বলছে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন