বাঙালীর উৎসব, পার্বন, সংস্কৃতি সব ভুল ও ইতিহাস : ঋদেনদিক মিত্রো


বাঙালীর উৎসব-পার্বন-সংস্কৃতি সব ভুল  ও ইতিহাস
 

 ঋদেনদিক মিত্রো   

[ From " The festivals, parvan and culture of Bengalis are wrong and long history "  by Ridendick Mitro ] 

     আগে বলি, এই শারদীয়ার সময়  বা শরতের দুর্গা পূজার সময় নানা পত্রপত্রিকায় বাঙালির উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি নিয়ে অনেক লেখা বেরুচ্ছে,  বাঙালির গর্ব নাকি এইসব উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি ! অনেকেই এই সব নিয়ে অনেক ঐতিহাসিক তথ্য হাজির করছেন,  কিন্তু,  জানেন কি,  এইসব বাঙালির উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি বলে যা আমরা বিশ্বাস করে এসেছি,  সবটাই ভুয়ো,  এবং এগুলি কোনোটাই উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি নয়,  এমনকি এগুলির কোনোটাই বাঙালির জনগনের জন্য নয় ! এমনকি গৌরবের ব্যাপার ও নয় ! 

     বিষয়টি সংক্ষেপে সেরে নিয়ে,  এই কেন্দ্রিক আরো বিস্তৃত আলোচনায় ঢুকবো !  তার আগে যেটা বলতে চাই,  এইযে যেকোনো পুজো --- এগুলো  রাজা জমিদারদের বাসনা পূরণের জন্য নানা রূপের প্রাকৃতিক শক্তিকে তোয়াজ দেওয়ার রীতি ও সেই উপলক্ষে নিজেদের সম্পত্তির দেমাক দেখাতে মূল্যবান দ্রব্যের পোশাক পরার প্রচলন ও জনগণকে খাইয়ে প্রচার নেবার রীতি ! এগুলি রাজা ও  জমিদারদের গৃহের নিজস্ব পূজা বা বলা যেতে পারে স্বার্থ পূরণের জন্য শাস্ত্রীয় চালাকি ! পরপর যখন জনগনের ভিতর অনেকেই অবস্থা সম্পন্ন হলো,  তারাও এইসব পূজা ও রীতি চালু করলো রাজা ও জমিদারদের মর্যাদার সমান হওয়ার জন্য ! পরে,  জনগণ দলবদ্ধ ভাবে এইসব পূজা বা রীতি চালু করলো,  কারণ,  বহু মানুষের একত্র হওয়ার যে একটা মজা,  সেইটা তারা অনুভব করলো ও সার্বজনীন পূজা হিসেবে তারা প্রতিটি দেবদেবীর পূজাকে প্রচলন করলো ! এবং,  সেটাও দাঁড়িয়ে গেলো একই নিয়মে সম্পদের অহংকারের প্রতীক হিসেবে ! কারণ,  ক্লাব বা নানা রকমের সংস্থা গুলি একে ওপরের সাথে খরচের বহরের প্রতিযোগিতা করতে থাকলো,  এবং এখানেই শেষ নয়,  প্রতিমা,  প্যান্ডেল,  পূজার পার্শবর্তী এলাকার পরিবেশ,  এইসব নিয়ে পুরস্কার চালু হলো ! তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো,  যেটাকে আমরা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পূজা বলি,  সেটা পুরোটাই অর্থের দেমাক দেখানোর জন্য পারিবারিক বা সংস্থাভিত্তিক চেষ্টা !  তাহলে এটা কোনোভাবেই উৎসব নয়,  এবং বাঙালির উৎসব তো একেবারেই নয় !  কোনো রাজা জমিদারের কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছের ফলে তিনি বা তাঁরা এই পূজার প্রচলন করেন,  সেটা সময়ের সাপেক্ষে জনগণ গ্রহণ করে! তাহলে পূজাটা হলো ব্যক্তিগত সম্মত্তি !  জনগনের নয় ! এবং,  পুজোতে হতো পশু বা নরবলী,  যা আজও হয় কোথাও - কোথাও প্রকাশ্যে বা লুকিয়ে ! 

     যে-কাজে বাসনা পূরণের জন্য জীবহত্যা হয়,  তেলা মাথায় তেল দেওয়া হয়,  অন্যের চেয়ে নিজেকে ধনী প্রদর্শন করতে সেরা পোশাক, গহনা ও অন্যন্য দ্রব্য কেনা হয়,  ও তা প্রকাশ্যে ব্যবহার করে অহংকারের প্রতিযোগিতা হয়,  সেটা তো শোষণের রীতি,  শোষণের রীতি কী করে একটা জনগোষ্ঠীর ধনী-গরীব-শিক্ষিত --মূর্খের উৎসব হতে পারে? সেটা কী করে পবিত্র কাজ হতে পারে,  সেটা কী করে একটি জনগোষ্ঠীর মার্জিত সত্বার গৌরব বলে গণ্য হতে পারে? 

     এবার বলবেন,   পার্বন,  --- পার্বন মানে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন রকম খাবার খাওয়া ! রাজা ও জমিদাররা প্রতিযোগিতা করে নানা রকম খাবার বানাতেন, কারণ,  অঢেল সম্পদ নিয়ে তাঁদের পাচক ও বাড়ির নারীরা অবসরে নানা রকম খাদ্য ও পানীয় নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার দ্বারা আবিষ্কার করতেন,  সেইগুলি তাঁরা প্রশংসা পাবার জন্য বাইরের থেকে আসা অতিথিদের ও অসহায় প্রজা গরীব জনগণকে খাওয়াতেন,  এবং অসহায় গরীব জনগণ সেইগুলি খেতে-খেতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে নিজেরা তৈরী করতে থাকে,  ও এইভাবে তারা শিখে ফেলা রীতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট ঋতুতে নির্দিষ্ট খাবার বানাতে থাকলো পরিবারের সামর্থ অনুযায়ী ! এর নাম হলো পার্বনের খাওয়া ও শেষ অব্দি সেটাকে বলা হতে থাকলো বাঙালির পার্বনের খাওয়া ! 

     এবং বর্তমানে,  যখন পরপর জনগনের হাতে অঢেল অর্থ আসতে থাকলো,  তখন পার্বনের খাওয়াতে জুড়লো মদ ! সেটাও হলো পার্বনের আধুনিকতম খাওয়া ! এবং মদের সাথে নানা অস্বাস্থকর খাবার ও সহযোগী পানীয় খাওয়া ! এবং কোন ব্যক্তি বা সংস্থা কত বেশী মদ খরচ করেছে তার প্রমাণ স্বরূপ কোন পক্ষ কোন পক্ষের চেয়ে বেশী মাতলামি করেছে সেই প্রমাণটাও হয়ে উঠলো পার্বনের অনিবার্য সংযুক্তি ! 

     এবার এলো সংস্কৃতি ! গরীব ছেলেরা বল কিনতে না পেরে কাগজের বল বানিয়ে খেলে ও পরপর তারা যুৎসই কাগজের বল বানাতে ও ওই বল নিয়ে দক্ষতার সাথে খেলতে দক্ষ হয়ে ওঠে!  তখন ওইটাই  হয়ে ওঠে ওদের সংস্কৃতি ! কেউ ওভাবে কচু পাতা পুড়িয়ে বা রেঁধে খায়,  সে স্বাদের একঘেয়েমি কাটাতে একটু চিনি মিশিয়ে দিলো ওতে ! ওই চিনি মেশানো কচুপাতার পোড়া বা ভাজা শরীরের ক্ষেত্রে বিষাক্ত কিনা সে জানেনা,  কিন্তু সে ঐভাবে একটা খাবার বানিয়ে ফেললো দারিদ্রের জ্বালায়,  সেটাই ছড়িয়ে পড়লো পরপর,  হয়ে গেলো " চিনিকচু ওয়াক " বলে একরকম নামের খাদ্য ! এটাও হয়ে গেলো বাঙ্গালার সংস্কৃতি !গরীব লোক বাদ্যযন্ত্র পায়না,  সে দুটো ইট টুকরো দিয়ে বাজিয়ে গান করতে থাকলো,  সেইটাকে আমরা নাম দিলাম বাংলার সংস্কৃতি ! তাহলে বাংলার সংস্কৃতি মানে হলো দারিদ্র জীবনের শখ মেটানোর জন্য কিছু উদ্ভট পন্থায় তৈরী খাদ্য, শিল্প,  সংগীত,  ইত্যাদি ! এইগুলিকে বলা হলো বাঙালির আদি সংস্কৃতি,  ও পরে বলা হলো লোকসংস্কৃতি,  ও তারও পরে বলা হলো বাঙালির সংস্কৃতি ! মূলত এসব হলো উপলব্ধির বিকৃতি ! আমি নাস্তিক নই,  কিন্তু,  তাই বলে ভুল চিন্তাকে আঁকড়ে আস্তিক বলে তো জাহির করে নিজের অস্তিত্বের অপমান করতে পারবো না !

     তাহলে,  এতক্ষন যা দাঁড়ালো প্রমাণ সহ,  সেগুলি আমাদের হতাশ করলো,  এবং বাঙালিরা যেগুলিকে নিজের উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি ভাবি,  আদৌ সেগুলি কোনো উৎসব, পার্বন ও সংস্কৃতি নয়,  সবই ভাবের ঘরে চুরি বা জোচ্চুরি করা ! 

     হ্যাঁ,  বাঙালির কোনো উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি নেই,  এটাই ঠিক,  এটি পৃথিবীতে প্রথম আমি ভাবলাম ও প্রমাণ দিলাম ! 

     তাহলে কি বাঙালি নিঃস্ব,  না,  বাঙালি নিঃস্ব নয়,  সে বিশ্ব,  মহাবিশ্ব ! সেই নিয়েই একটু একটু করে বলছি,  পড়ে যান ! পড়ে দেখুন না,  সময়টা কাজে লাগলো নাকি নষ্ট হলো !

     এবার বলি,  আপনি নিজেকে বাঙালি বলে দাবী করেন ও সেই গৌরবে এই লেখাটি পড়ছেন,  কিন্তু, তার আগে বলুন তো,  বাঙালি মানে কী,  মানে বাঙালি কাকে বলে !  

     একটা কথা,  পুজোর ছুটিতে রয়ে সয়ে পড়ুন,  তাড়াহুড়োর কারণ নেই,  সেই সাথে অতিমারীর আতঙ্কে বাড়ি থেকে চিন্তন নাগরিকরা বেরুবেন না খুব একটা যুক্তি গ্রাহ্য নিরাপত্তার কারণে,  যে কোনো লেখাকে পড়ুন রয়ে সয়ে,  তাতে স্বাদটা অনেক বেশী পাবেন ! 

     যা বলছিলাম একটু আগে,  সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসি, কেউ বলবেন --- যারা বাংলাভাষায় কথা বলে তাদের বাঙালি বলে,  কেউ বলবেন --  যারা বারোমাসে তের পাবন পালন করে তাদেরকে বাঙালি বলে,  কেউ আবার কট্টর ভাষায় বলবেন -- যারা কাঁকড়ার চরিত্র তাদেরকে বাঙালি বলে!  

     আমি বলি,  এইগুলি কোনো ব্যাখ্যা হলো না, কারণ আমি যদি কাউকে প্রশ্ন করি,  মানুষ কাকে বলে,  আপনি বললেন যে দুপায়ে যে হাঁটে সে মানুষ ! 

     এই উত্তর যেমন খাঁটি নয়,  হাস্যকর,  তেমনি বাঙালী নিয়ে উপরের ব্যাখ্যা গুলোই হাস্যকর! 

     আমার মনে বাঙালী মানে যারা বই লিখতে চায়,  ভাবতে চায়,  পড়তে চায়,  পড়াতে চায়,  খেতে চায়,  খাওয়াতে চায়,  আবেগ নিয়ে হাসতে চায়,  কাঁদতে চায়,  পাড়ায় কোনো ভালো লোক মারা গেলে দুঃখ প্রকাশ করে,  রাত্রে করে কঠিন অসুখ হলে কাঁধে নিয়ে হাসপাতালে যেতে চায়,  নদীর ধারে বসতে চায়,  শিক্ষককে পথে দেখলে প্রণাম করতে চায়,  পিঠেপুলি বানিয়ে প্রতিবেশীকে খাওয়াতে চায়,  কারোর বাড়িতে আগুন লাগলে সেখানে দৌড়ে গিয়ে আগুন নেভাতে চায়,  বিপদ গ্রস্ত ওই বাড়ির লোকদের বিপদ থেকে মুক্ত করতে চায়,  অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করতে না পেরে আত্মকেন্দ্রিক মনটাকে ধিক্কার দিতে চায়,  পথের অসহায় পশুপাখিকে কিছু কিনে খাওয়াতে চায়,  সকালে ও সন্ধ্যে বেলায় সংবাদপত্রটা হাতে নিয়ে তৃপ্তি পেতে চায়,  পুরানো নই ও পুরানো ছেঁড়া পোশাকের গন্ধ শুকে অতীত চেতনায় ভাসতে চায়,  কপটচারিতা পাপ বা অপরাধ বলে বিশ্বাস করতে চায়,  ঘরে এখানে ওখানে বই পত্রপত্রিকা ছড়িয়ে রাখতে চায়,  অহিংসার আদর্শে প্রণাম করতে চায়,  আবার প্রয়োজনে প্রফুল্লচাকী,  ক্ষুদিরাম,  মাতঙ্গিনী,  হয়ে উঠতে চায়,  চাষাবাদ করতে চায়,  একটি মুরগি বা মাছ মেরে খেতে গিয়েও তার শরীরটা কেঁপে উঠতে চায়,  কসাইখানার পাস দিয়ে গেলে মুখটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে চোখ ভেজাতে চায়,  বাড়ির তৈরী মুড়ি,  চিড়ে, ফলমূল,  শরবত খেতে চায়, মেলায় গিয়ে একটু নরম হয়ে দুটো কথা বলতে চায় কারোর সাথে,  মাটির ঘরের কোনে বসে সারা বিশ্বকে ভাবতে চায়,  রেডিও শুনতে চায়,  মহানদের জীবনী পড়তে চায়,  এদের বলে বাঙালী ! 

     কিন্তু,  সেই বাঙালী-জীবন-ধারা কোথায় যেন বিপন্ন,  সেই বিপন্নতা গুলি দেখাতে চেয়ে ও তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল ও ভাবনা কতদূর যেতে পারে তাই নিয়ে আমি লিখছি ! 

     জানবেন,  যারা স্পষ্ট কথা বলতে ও শুনতে ভালোবাসে অন্তর থেকে তারাই বাঙালী,  এটা কতটা খাঁটি,  সেটাও আমি ভিতরে বলেছি ! পড়ে যান ! তাই আপনাকে সঠিক অর্থে বাঙালী ভেবেই এই নিবন্ধ পড়তে বলেছি,  যদি ভাবেন আপনি বাঙালী নন,  তাহলে এই লেখা পড়তে হবেনা ! 

     এখানে একটা কথা বলি,  বাঙালী মানে স্বাধীন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ,  এবং এদের রক্ত ধারার বিস্তার যতদূরে গেছে সারা বিশ্বে বাংলাভাষাকে সঙ্গে নিয়ে,  সকলেই এই লেখার কার্যকারণের সঙ্গী ! 

     এবার,  কেউ আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, আমি কেন বাঙালীকে মাছ মাংসের প্রতি বিদ্বেষ আনতে প্রভাবিত করছি ! দেখুন,  আমার কী ক্ষমতা আছে আপনাকে প্রভাবিত করার ! আমি তো সত্যিটাই বলেছি,  কারণ,  বাঙালীই কসাইখানার পাশে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে যায় মনে-মনে,  এবং আর পেছনে অন্য ইতিহাস ও সত্য আছে ! 

     কোনো এক ভুল বা পরিস্থিতির কারণে বাঙালীরা পুরুষানুক্রমে মাছ মাংসের প্রতি লোভী হয়ে উঠলেও,  এটা এদের অন্তরের ইচ্ছে বা নেশা নয়, তাই এরা এতো পিঠেপুলি তৈরী করতে জানে,  আবিষ্কার করেছিল,  এতো মিষ্টিমিষ্টান্ন আবিষ্কার করেছিল,  মসুর ডালকে পাঁচফোড়ন ও জিরে দিয়ে এতো সুন্দর করে রান্না করতে পেরেছিলো,  কাগজালেবুকে খুঁজে আনতে পেরেছিলো,  পুজোপার্বণে এতো রকমের ফলমূল মিষ্টিকে প্রাসাদ তৈরী করে সমাজে ওই ধারা চালু করতে পেরেছিলো,  এবং এতো রকমের বারতিথি সে গ্রহণ করেছে কেবল অন্তরে নিরামিষ ভক্ষণের সত্যকে গ্রহণ করতে চায় বলে, --- তাহলে সর্বসাকুল্যে এটাই প্রমাণিত,  বাঙালীর যে প্রবাহ সেটা আর্য উন্নত ধারা,  এবং যা কিছুই আজ বাঙালীর ভিতর এর বিপরীত আচরণ ও অভ্যেস দেখি,  সবই তার বিপন্ন হয়ে ওঠার ছবি,  প্রকৃত ও স্থায়ী ছবি নয় !

     এই যুক্তি ও প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে,  এই লেখা,  বছর-বছর ধরেই কী করে অদৃশ্য হাতের খেলায় কারা যেন,  অখণ্ড বাঙালী জাতিকে বিপন্ন ও বিকৃত করে দিচ্ছে ! 

     যারা বলে,  বাঙালী লোভী ও স্বার্থপর জাতি,  --- তারা কি একবারও ভেবে দেখেছে যে,  বাঙালী যদি লোভী ও স্বার্থপর হতো,  তাহলে সে অতিথিকে ঋণ করে সেবা দিতে চায় কেন ! বই ভালোবাসে কেন,  পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম পুস্তক মেলা পশ্চিম বাংলায় কেন, আন্তর্জাতিক পুস্তক এর প্রোডাকশনের মানের বিচারে বাংলাদেশের পুস্তক ব্যাবসা রাষ্ট্রসংঘ থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করলো কেন ! 

     আমাদের শিল্প সংস্কৃতির প্রতি রাজনৈতিক নানা চাপকে অনেক গালি পাড়ি আমরা নানা ক্ষোভ বসত,  কিন্তু,  কলকাতার বাংলা একাডেমি চত্বর এর মত ভারতে আর কোথায় এমনটি ছিল বা আছে দেখান !  

     কিন্তু,  আমাদের জনসংখ্যার পরিমান পৃথিবীতে ষষ্ঠ,  কখনো সপ্তম স্থানে,  এবং চিন্তা,  মনন,  শিক্ষা,  আবিষ্কার,  রাজনৈতিক ভাবনা,  ইত্যাদিতে আমরা বহু যুগ থেকে আন্তর্জাতিক ও সারা পৃথিবীকে তার প্রমাণ দিয়ে আসছি ! সমস্ত পৃথিবী আমাদের সেই স্বীকৃতি দিচ্ছে দেশেদেশে,  ও আন্তর্জাতিক ভাবে ! লক্ষ করবেন,  বাঙালীজাত,  সে পূর্বপাকিস্তান বা বাংলাদেশের থেকেই হোক বা পশ্চিমবঙ্গ থেকেই হোক,  এরাই বলিউডে গিয়ে সংখ্যায় যতটা প্রতিষ্ঠিত,  বলিউডের থেকে আসা অবাঙালিরা বাংলার প্লাটফর্মে সেই ভাবে প্রতিষ্ঠা পাননি !  

     এইগুলি প্রমাণ করে,  বাঙালিরা,  সে যে ধর্মের হোক, এরা আন্তর্জাতিক,  গ্রামের কুঁড়ে ঘরে থেকেও আন্তর্জাতিক ! উচ্চ মনস্ক,  উদার,  জ্ঞানপ্রবণ,  শান্ত ও নিরপেক্ষ বিচার বুদ্ধির জাতি ! কিন্তু,  কোনো এক দুর্ঘটনার ঢেউ থেকে বাঙালী হারিয়ে ফেলছে তার সমারোহ ও উল্লেখযোগ্যতা ! তাকে যেন কারা জোর করে শেখাচ্ছে -- ওহে বাঙালী, তুমি অনেক পিছিয়ে,  তোমাকে তৈরী করতে সময় লাগবে ! 

     এই ভাবে বাঙালির মনের ভিতরটা দুর্বল করে দিয়ে তাকে বিপন্ন করে-করে তার ভিতর ঢোকানো হচ্ছে হাজার রকমের গোলযোগ ! যে-জাতি কোনো গুরুজনের কাছে " সিগারেট,  বিড়ি,  মদ,  গাঁজা " এই শব্দগুলি আলোচনা করতে ভয়  পেতো,  কারণ এগুলি ক্ষতিকারক ও বিলাসের প্রতীক, --- সেই বাঙালী জাতিকে নানা নেশায় মত্ত করে রাখা হচ্ছে,  কী গভীর যড়যন্ত্র !  কারা কাদেরকে অদৃশ্য হাত বানিয়ে এসব করছে,  আর কতদিন আমরা এইসব বিপন্নতা নিয়ে জ্বলবো,  বলুন?  

     বাঙালি যদি বই পড়তে চায় না তাহলে শিক্ষককে সে সবচেয়ে সম্মান দেয় কেন, মহত্বকে যদি সে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়,  তাহলে সে মহানদের ছবি কিনে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখে কেন?  

     আমরা এসব ভাবিনা,  কিন্তু,  আজ ভাববার সময় এসেছে ! আর, তাই পত্রিকার সম্পাদকের কথামত দুহাজার কুড়ির শারদীয়া সংখ্যায় বাঙালির উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতে গিয়ে অনেক কথা এসে গেলো চেতনার  গভীর থেকে,  যা আপনাদের কাছে খুলে বলতে চাই ! আপনারা বিশুদ্ধ পাঠক-পাঠিকা,  আপনারা যদি এই ভয়াবহ সত্য গুলি অনুভব করতে ভয় পান,  তাহলে বাঙালিজাতিকে কারা বিপন্নতা থেকে উদ্ধারের দায়িত্ব নেবে?  

     অখণ্ড বাঙালিজাতিকে নষ্ট করার জন্য বিরাট ছক অনেক আগেই তৈরী হয়েছিল,  বাংলাদেশে উনিশ শ একাত্তরে ছাব্বিশে ডিসেম্বর স্বাধীনতা দিবস ঘোষণার আগে সম্ভবত চব্বিশে ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের সৈনিকরা --- বর্তমান বাংলাদেশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কিছু উদ্ভ্রান্ত নাগরিকের সহযোগিতায় পূর্বপাকিস্তানের প্রায় ছয় হাজার বাছাই জ্ঞানী, গুণী,  মেধাদের খুন করেছিল,  প্রকাশ্যে !  তার আগে ও পরে তো আরো খুন হয়েছে, সৎ সাহসী বাঙালিদের খুন করা হয়েছে নির্মম ভাবে ! 

     দু পাঁচজন মেধা ও সৎ সাহসী কোটিকোটি জনগনের একটি দেশকে সমৃদ্ধ করে দিতে পারে,  সেখানে পূর্বপাকিস্তানের হাজার হাজার লাখ-লাখ উন্নত বাঙালিদের খুন করা হয়েছিল,  তার পরে স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ হয়ে দেশটা নানা সময়ে আরো বিপন্নতার মধ্যে দিয়ে চলেছে,  তা সত্বেও সারা পৃথিবীর কাছে চিন্তনে,  সাহসিকতায়,  চেষ্টায়,  সৃষ্টিতে বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম সারির তালিকায় পড়ে ! 

     জানেন কি,  সারা পৃথিবী জুড়ে আজ যে ইউটুব এর সভ্যতা এসে বিশ্বায়নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করলো,  সেটার আবিস্কারক বাংলাদেশের এক যুবক,  বিদেশে গিয়ে নানা অফিসে গিয়ে চাকরি ছেড়েছে,  ঝুঁকি নিয়ে নেমে গেছে আবিষ্কারের খেলায়, তারপর সফলতা পেতেই গুগল কোম্পানি কিনে নিলো তার আবিষ্কার,  এবং সেই টাকার পরিমানটা কত সেটা জানলে আপনি বাকরুদ্ধ হয়ে যাবেন,  ভারতবর্ষের কোনো পুঁজিপতির সেই পরিমান টাকা হয়তো নেই!  

     বাংলাদেশের মাত্র পাঁচহাজার মত সৈনিক গিয়েছিলো আফ্রিকার একটি দরিদ্র দেশ,  উগ্রপন্থীদের দ্বারা বিপন্ন সিয়েরা লিওনে ! সারা পৃথিবীর প্রায় আটত্রিশটি মত দেশ থেকে সৈনিকেরা ওখানে গিয়েছিলো,  উগ্রপন্থী দমন করতে ! বাংলাদেশের সৈনিকেরা ওখানে বন্ধুক রেখে দিয়ে ওই ইংরেজি ও আফ্রিকান ভাষী মানুষকে বাংলাভাষা,  সংস্কৃতি,  কবিতা,  সংগীত, শেখাতে চেষ্টা করে,  সুচিকিৎসা ও সুশিক্ষা দিতে থাকে,  সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার পথ ও পন্থা তৈরীতে সাহায্য করতে থাকে,  এর ফলে কয়েক বছরের ভিতর সারা দেশ থেকে উগ্রপন্থীরা তাদের জীবনের বিকৃত ধারাকে বদলে বেছে নেয় সুস্থ জীবনের পথ! 

     বাংলাদেশের সৈনিকদের এই কাজে অভিভূত হয়ে ওখানকার মাননীয় রাষ্ট্রপতি দুহাজার দুই সালে সরকারী ভাষা হিসেবে পূর্বের ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলাভাষাকে সরকারী ভাবে যুক্ত করেন !  এবং পৃথিবীতে এখন বাংলাভাষার দুইটি রাষ্ট্র হলো ! প্রথমে হয়েছিল বাংলাদেশ,  পরেরটি হলো সিয়েরা লিওন ! ওরা এখন বাংলা সাহিত্য পড়ে ও বাংলা নাচ গান ও অনুভূতি নিয়ে চলছে ওদের ইংরেজী ও আফ্রিকান ভাষার পাশাপাশি ! 

     এইখানেই দেখুন বাঙালির মেধা,  শ্রম,  সততা,  ও সভ্যতাকে বিপন্নতা থেকে রক্ষা করার সঠিক পরিকল্পনার বুদ্ধি ও হৃদয়বোধ কতখানি ! 

     রাষ্ট্রসংঘ বাংলাদেশের  সৈনিকদের এই সফলতায় গভীর ভাবে আপ্লুত হয়ে তাঁদেরকে আরো নানা বিপন্ন দেশে পাঠাচ্ছেন,  বিপন্ন দেশগুলিতে সুস্থ পরিবেশ নিয়ে আসার জন্য ! 

     সেই বাঙালি আজ কোন খাদে এসে ঠেকেছে,  সেই কথাগুলি বলার আগে বলি যে,  পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে বাঙালিরা সেই সব দেশের ভাষায় সাহিত্য লিখে সেই-সেই দেশ গুলিতে প্রথম সারির জায়গায় আছে,  সেগুলি কি আপনারা খোঁজ রাখেন ! ইংরেজি তো আছে বহুকাল থেকে,  ওটা বাঙালির আর একটা মাতৃভাষা হয়ে গেছে ! আমি বলেছি অন্য ভাষা গুলিতে !  

     যাঁরা নোবেল প্রাইজ পাচ্ছেন সারা পৃথিবী জুড়ে,  তাঁদের অনেকের কাজের আদি উৎসাহ বা সূত্র কিন্তু কোনো না কোনো বাঙালি -- বিভিন্ন বিষয়ে ! তা বর্তমান ভারতের তরফ থেকে হোক বা বাংলাদেশের তরফ থেকে হোক !  

     শুধু তাই নয়,  দেশ স্বাধীন হবার আগে ও পরে যেসব বাঙালি কমুনিস্ট বিপ্লবীরা পৃথিবীর বিভিন্ন কমুনিস্ট দেশে চলে গিয়েছিলেন তাঁদের সংখ্যা অনেক ও তাঁদের মেধা,  সৎ সাহস ও দক্ষতা দেখে বিদেশী কমুনিস্ট নেতারা চমকে যান ও কোনো এক অজানা কারণে সেই সব অসংখ্য বাঙালি কমুনিস্ট নেতারা হারিয়ে যান ! তাদের জন্য কোনো সঠিক তদন্ত হইনি ও হিসেব ধরে ইতিহাস লেখা হয়নি ! 

     আমি দক্ষিণ পন্থী বা বাম পন্থী --- কাউকেই পারফেক্ট নিয়মের ধারক বা বাহক বলিনা,  কিন্তু সেসব তর্ক আলাদা ব্যাপার,  আসলে তাঁরা যে-ভাবনাকে ভালো মনে করেছেন,  নিজের বিবেকের কাছে সৎ থেকে সেই পথ নিয়েছেন,  সেটা এখানে বিষয় নয়,  এখানে বিষয় হলো,  বাঙালির চিন্তা,  সূক্ষতা,  সৎ সাহস এতো সঠিক যে,  তারা যে যে-রাজনীতি বা ধর্মনীতি নিয়েই বিদেশে যাক,  সেখানে গিয়ে রাষ্ট্রে এতটাই প্রভাব ফেলতে পারে যে,  রাষ্ট্র নেতারা নিজেদের দুর্বল দিককে ঢাকাতে অন্য ব্যবস্থা নেন ! আমি এটাই বলতে চাইছি ! 

     আমরা কি জানি,  সম্ভবত বসিরহাটের বেকার গরীব ছেলে রবিন বিশ্বাস ব্রিটিশ যুগে আধপাগল হয়ে দিশাহারা হয়ে জাহাজে উঠে চলে গেলো ব্রাজিলে,  সেখানে নেমে  একটা গাছের তলায় ক্ষুধার জ্বালায় চলতে না পেরে বসেছিল বেচারি !  একজন লোক সেই দিক দিয়ে যেতে গিয়ে রবিনের সাথে পরিচয় করে,  ও সব কাহিনী শুনে দয়া করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মেয়ের সাথে বিবাহ দিয়ে ব্রাজিলে থাকার ব্যবস্থা করে ! ব্রাজিলের ওই লোকটি যতদূর মনে পড়ে স্থানীয় ডাক্তার ছিল ! অনেক আগের পড়া কাহিনী বলেছি ! 

     রবিন ওই লোকটির বাড়ি গিয়ে পেট-ভোরে দুটো খেতে পেতো ! মনে কী আনন্দ তার ! ভারতে তার পেটপুরে খাওয়া হতো না ! পড়াশুনোটাও টুকটাক,  তেমন কিছু নয় ! ওই সময় ব্রাজিলে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছিল !  যুবক রবিন আর একা পরের বাড়িতে বসে-বসে কোন লজ্জায় খাবে ! 

     সে যোগ দিলো ব্রাজিলের স্বাধীনতাযুদ্ধে ! ব্রাজিলের সৈনিকরা শাসক পর্তুগিজ সৈনিকদের আধুনিক অস্ত্রের কাছে তথা  শিক্ষিত দক্ষ যোদ্ধাদের কাছে ঠিক পেরে উঠছে না ! 

     পর্তুগিজ সৈনিকরা পুরো ব্রাজিল দখল দিয়ে এবার শেষে এলো চল্লিশজন দুর্বল,  ক্ষুধার্ত,  সাধারণ বন্ধুক সজ্জিত সৈনিককে মারতে,  যাদের নেতা বাঙালি বেকার ছেলে রবিন বিশ্বাস ! ব্রাজিলিয়ান চল্লিশজনকে ঘিরে ফেলেছে দেড় হাজার আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত পর্তুগিজ সৈনিক ! চল্লিশজন ব্রাজিলিয়ান সৈনিক যুদ্ধ করতে চাইলো না,  কারণ,  অকারণ মরে কী হবে ! 

     বাঙালি বাচ্চা রবিন তার সৈনিকদের বাধা দিলো যেন সারেন্ডার না করে ! এবং ইঙ্গিতে বোঝালো যে তার কথা শুনলে জয়ের সম্ভাবনা আছে,  এবং ওই ছোটখাটো একটা ক্যাপ্টেন হয়ে সে তার সৈনিকদের নির্দেশ মত কাজ করতে বললো ! ওরা তখন একটা সাধারণ দুর্গে ঢুকে ছিল ! দেড় হাজার পর্তুগিজ সৈনিকেরা এসেছে ওদের শেষ করে দিলে ব্রাজিলে স্বাধীনতা-যুদ্ধ করার জন্য আর কেউ থাকবে ! 

     হঠাৎ এমন ঘটনা ঘটিয়ে দিলো রবিন,  দেড় হাজার পর্তুগিজ সৈনিক পাগলের মত দৌড়োতে শুরু করলো, তারাই  বাঁচবার জন্য দিশাহারা হয়ে পালতে শুরু করলো, আর যারা শুনেছিলো আগে থেকে এই চল্লিশ জনের ক্যাপ্টেন রবিন নামের এক বাঙালি,  তারা আতঙ্কে গালি দিতে -দিতে দৌড়োতে থাকলো --- ওরে বাবা,  বাঙালি কি জিনিস রে,  আমাদের আর আশা নেই রে,  সব শেষ করে দিলো রে,  ব্রাজিল আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেলো রে ! 

     সেই ব্রাজিলের স্বাধীনতা এনেছিল কলকাতার পাশে উত্তর চব্বিশ পরগনার বসিরহাটের বেকার গৃহছাড়া যুবক রবিন বিশ্বাস ! সেই দেশেই জন্মেছে বিশ্ব বিখ্যাত ফুটবলার পেলে ! 

     এইরকম উদাহরণ কত আছে আমরা জানিনা,  এই উদাহরণ গুলি বলে দেয় বাঙালি কী জিনিস,  তা ভারতের হোক বা বাংলাদেশের বাঙালি হোক !  সেই বাঙালি আজ কোথায় এসে পিঠ ঠেকেছে ! 

     যাইহোক,  বাঙালি নিয়ে বিশ্লেষণ করে এবার আসি উদ্দিষ্ট বিষয়ে, বাঙালী উৎসব, পার্বন ও সংস্কৃতি নিয়ে লিখতে গিয়ে আমাকে বলতে হবে এমন কিছু,  যা নতুন করে কিছু ভাবাবে,  পাঠকের চিন্তার জগতে আনবে আলাদা এক অনুভূতি !  

     পাঠক-মন হবে মুক্ত,  সে কারোর ভাবনার বা ইচ্ছের বা আদেশের দাস নয়,  সে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সব পড়বে,  বুঝবে ও সমাজকে বোঝাবে ! কারণ,  পৃথিবীতের পরিবর্তনের মাধ্যম হলো পাঠক ! আর এদেরকেই ভুলিয়ে রাখতে চায় এক শ্রেণীর শাসক ! এবার আর দেরি না করে চলে আসি উৎসবের আলোচনায় ! 

     আসলে,  উৎসব কী, পার্বন কী,  সংস্কৃতি কী,  সেটা আমরা কজনই বা জানি ! আমরা শৈশব থেকে একটা বিধিসম্মত নিয়মে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হল্লার মুহুর্ত তৈরী করি,  সেটাকে বলি উৎসব ! সেটাকে নিয়ে যখন কোনো বাদ্য,  নাচাগানা ও খানাপিনা হয়,  সেটাকে বলি পার্বন ,  এবং যখন কোনো শিল্প ভিত্তিক পারফরম্যান্স বা প্রয়োগ হয়,  সেটাকে বলি সংস্কৃতি ! 

     অর্থাৎ,  উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি,  তিনটেই হলো সমাজকে একটু নাচিয়ে দেওয়ার পন্থা,  বছরের বিভিন্ন সময় ! এর অনিবার্যতা কত খানি,  সেই বিষয়ে কিছু ব্যাখ্যা করে,  তারপর আসবো বাঙালীর জীবনে উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনায়,  কারণ,  এগুলির বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকগত তাৎপর্য না জেনে কেবল বাঙ্গালীর উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করলে,  বিষয়টি ভুল আবেগে মিশে গিয়ে লেখনীর উদ্দেশ্যগত গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকে হালকা করে দেবে ! 

     অনেক কথা আছে একটু সংক্ষেপে বললে পাঠক-পাঠিকার সুবিধে হবে,  তাই সেই ভাবেই বলেছি,  তারপর শুরু করবো বাঙালীর জীবন নির্মাণের যে আসল সত্য ও ধারা,  যেটাকে আমরা উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি বলে জানি না,  কিন্তু সেই গুলিকেই প্রকৃত উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি হিসেবে মর্যাদা দেওয়া উচিত আমাদের ! কিন্তু আমরা সেই জায়গাগুলিকে এড়িয়ে এসেছি ! আর,  সেইজন্য বাঙালীজাতি আজ চেতনায় বিকৃত ও অনুভূব নিঃস্ব ! কিন্তু,  স্বপ্নে সে নিঃশেষ হয়ে যায়নি,  কারণ,  বাঙালী জানে স্বপ্ন দেখতে,  আর,  এই গুণটা যে-জাতির থাকে সে মরতে-মরতে বেঁচে ওঠে ! তাই,  একদিন বাঙালীজাতি জেগে উঠবে,  নতুন আলোয় ফুটবে,  নতুন উদ্দীপনায় ছুটবে,  কোনোএকদিন নয়,  বরং বলবো সামনেই এসেগেছে সেই দিন,  কারণ,  বাঙালীজাতি রাত জাগতে জানে ---একটি বইকে চোখের সামনে রেখে,  ঘুমাতে চায় বালিশের কাছে একটা বই রেখে! বই পড়ার অভ্যেস ও বই কেনার অভ্যেস তার চলে গেছে অনেকটা,  সে হয়ে যাচ্ছে গায়ে গতর দাস --- এমন একটা মন্তব্য আমরা চারিপাশ-থেকে শুনি,  কিন্তু, বাঙালীর  এই দূরাবস্থা অস্থায়ী,  কারণ,  পুস্তক রচনা যার রক্ত ধারায়,  পুস্তক পাঠ তার অভ্যেস ও সংস্কৃতির বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে না ! 

     যাইহোক,  বাঙালির উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি নিয়ে বলতে গেলে অনেক কথা বলা যায়,  যেগুলি অন্য লেখকগন বলবেন,  বরং তাঁরা নানা শাস্ত্রপাঠ করে অনেক কিছু বলতে পারবেন,  সাজিয়ে ! কারণ,  এমনিতে মুখে-মুখে আমরা বলি বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বন ! 

     যদিও,  অনেক উৎসব,  পার্বনের কোনো যৌক্তিকতা নেই,  যদিও বাঙালিরা নানা প্রাচীন পন্ডিতগন প্রকৃতি ও মহাজগতের সাথে মানবদেহের তথা জীবদেহের সম্পর্ক থেকে অনেক কিছু উদ্ভাবন করেছেন -- যে গুলি মানুষ অনুসরণ করলে তাদের শরীর ও মন ভালো থাকবে ! 

     কোন দিন কী কী খেতে নেই, আবার প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় কখন কী কী খেতে হয় ও কী ভাবে খেতে হয়,  এইসব নিয়ে পুরানো বাঙালী পন্ডিত-গবেষকগন যে সব নির্দেশ দিতেছেন,  সেগুলি সকল ধর্ম ও জাতির উর্দ্ধে সকলের ক্ষেত্রে মঙ্গল জনক !  সেইদিক থেকে বাঙালির পাঁজিপুঁথি দেখে খাদ্য,  উপোষ ও বারতিথি দেখে নানা রীতি পালন খুব প্রাকৃতিক সত্যের ওপর নির্ভরশীল ! দেখুন,  পৃথিবী বা প্রকৃতিতো হিন্দু, মুসলমান,  খ্রীষ্টান,  শিখ,  বৌদ্ধ প্রভৃতির নয়,  পৃথিবী-প্রকৃতি হলো মানব জাতির তথা সব জীব জগতের ! তাই,  প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক রেখে মানুষের প্রতি তাঁদের নির্দেশ গুলি গভীর তাৎপর্যবহ !  

     এতো কিছুর পরেও বলতে হয়,  পাঁজিপুঁথি দেখে যা করি আমরা অনেক মানুষ মিলে সম্মিলিত ভাবে,  সেই গুলিকে আমরা উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি বলি,  কিন্তু,  এগুলি তো উৎসব নয়,  পার্বন নয়,  সংস্কৃতিও নয় ! কারণ,  এগুলি অধিকাংশই হল্লা !  কোটিকোটি মানুষ উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতির নামে যা পালন করে,  তারা যদি এইগুলির গভীরতা বুঝতো,  তাহলে তারা উৎসব-পার্বনের সময়ে ও পরে কুনেশা গ্রহণ করতো না,  প্রতিবেশী-প্রতিবেশীর প্রতি আগ্রাসী হতোনা,  পরিবারে একজন আর একজনের সাথে কূটকচাল খেলতো না,  কর্মক্ষেত্রে কোনো রাজনীতি করতো না,  গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে রক্তক্ষয়ী হানাহানি করে  নিজেরা নিজেদের শেষ করতো না ! ঘুষ খেতো না,  ত্রাণের সম্পদ লুট করতো না, ধার নিয়ে অস্বীকার করতো না,  বিচারের নামে সিদ্ধান্তটা ধনীর দিকে বা কোনো পেশীশক্তির দাদা দিদির দিকে গড়িয়ে যেতো না, শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বনাশগুলি দেখে নীরব থাকতো না,  তেলা মাথায় তেল দিয়ে উৎসব করতো না,  ঋণ করে ঘি খেত না,  ভুয়ো আইনের তৈরী জাতবিদ্বেষকে সমর্থন দিতো না, মন্দিরের বিগ্রহ চুরি করতো না,  ধর্ম নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা করতো না,  অসহায়ের দিকে না তাকিয়ে বাড়ির প্রতিটি লোকের চাকরির জন্য অসৎ পন্থা গ্রহণ করতো না,  বই কিনতে গিয়ে কার্পণ্য দেখাতো  না, টেক্সট বই এড়িয়ে  সাজেশন কপচে পরীক্ষা দিতো না,  জোরে গাড়ি চালিয়ে বিপদ আনতো না,  মস্তানি করে বেড়াতো না,  টাকা বা সম্পত্তি বা ভোগের সামগ্রী বা সুযোগ মেপে বিবাহ করতো না, ভেজাল দ্রব্য বিক্রি করতো না, চিকিৎসা,  ঔষধ, খাদ্য, ও নানা দিকে কপটচারি কাজ করে বেড়াতো না,  ---  বাঙালীর উৎসব বলে কিছু থাকলে,  তার অনুভব গভীর হতো,  সে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়তো, বাড়িতে বই পড়তো,  বন্ধু-পরিচিত লেখকের বই ঝেড়ে নিতো না, সে হতো উন্নত ও স্বচ্ছ ও গভীর ! 

     উৎসবের নাম করে কিছু কেনা,  পার্বনের নাম করে মেলা,  যাত্রা,  ম্যাজিক,  খাওয়া দাওয়া,  সংস্কৃতির নাম করে কিছু অনুষ্ঠান,  এগুলিতো তরল বোধের ছেলেমানুষি! 

     যা উত্তরণ ঘটায় সেটাই উৎসব,  যা চিন্তায় ও স্বভাবে সৎ সাহসে চালিত করে সেটাই পার্বন,  যা জগৎকে শেখাতে পারে সেটাই সংস্কৃতি !  

     মেলায় জুয়া খেলা,  শরীরের ক্ষতিকারক খাবার খাওয়া,  আলগা কথার গল্প, বা কোনো মঞ্চে বা গৃহে কোনো নৃত্য,  সংগীত,  সাহিত্যের অনুষ্ঠান --- এগুলিকে কি সংস্কৃতি বলবেন?  এগুলিতো একটি সমাজে জনগণ নামক গভীর চিন্তাহীন নাগরিকদের বিকটতা,  এগুলিকে কী করে আমরা সংস্কৃতি বলতে পারি?  

     যে বাঙালী বিশ্ব-মড়কে সরকারের দায়িত্বহীনতা দেখে নীরব থাকে,  সরকারী ব্যাবস্থার চৌর্যবৃত্তি দেখে সমর্থন দেয়,  মড়কের সময় শারদীয়া দুর্গা পূজা নিয়ে আলগা হয়ে মেতে ওঠে,  প্রতিদিন দেশে প্রায় এক কোটি করে মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছে জেনেও নিজেদের সাবধানতা শিথিল করে দেয়,  লকডাউনের সময় পথের অসহায় কুকুর,  বেড়াল,  নানা পশুপাখির অসহায়তা নিয়ে নির্বিকার থাকে,  আবার,  লক ডাউনের সময়ে সাপ্তাহিক বাজার না করে আড়ম্বরের সাথে দৈনন্দিন বাজারে যায় -- সেই বাঙালী জাতির আবার বোধ বুদ্ধি কী আছে !  যাদের বোধ বুদ্ধি শিথিল তাদের আবার উৎসব,  পার্বন,  সংস্কৃতি নিয়ে অনুভূতিই বা কী আছে,  যাদের যেটা নিয়ে অনুভূতি নেই সেটা তার হয় কী করে?  

     একজন পাগলকে তার পিতা অনেক সম্পদ দিলো,  কিন্তু সেই সম্পদ নিয়ে তো পাগলের কোনো অনুভব নেই,  তাই আইন মোতাবেক সেই সম্পদ পাগলের নয়,  এবং পাগলের নামে কোনো সম্পত্তি দান আইন বা  যুক্তিগ্রাহ্য নয় !  তেমনি,  বাঙালির নামে যেসব উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি চালু করে গেছেন প্রাচীন পন্ডিত-গবেষকগন,  সেগুলিতে বাঙালির কোনো অধিকার নেই !  তাই,  উত্তরসূরীধারাতে সেগুলি নিয়ে পরিচয় বহণ করার অধিকার নেই বাঙালির ! 

     যদি বলেন,  আমি ঋদেনদিক মিত্রো মানুষটি কেমন পাথরের মন যে,  বাঙালির এতো মেলা পার্বন সংস্কৃতি,  এগুলি নিয়ে কি শৈশবের কোনো স্মৃতি নেই আমার?  

     আমি এর উত্তরে বলি,  আছে ! ছোটবেলা বা বড়বেলা যখন মেলাতে কিছু কিনেছি বা কিনছি,  দেখেছি আমার মত আর একজন বাঙালি ছেলে বা মেয়ে, মুখ শুকিয়ে আমার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ! বা একটি ক্ষুধার্ত ও অপমানিত কুকুর আমার দিকে তাকিয়ে ! বলুন তো  অন্যের কষ্টকে,  যন্ত্রনাকে এড়িয়ে বা ভুলে থেকে নিজের ভোগের জিনিস সংগ্রাহ করে হৈহল্লা করাটা কি বাঙালির উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি?  

     ঠিক আছে অনেকটা গদ্য পড়া হলো,  এখন বাঙালির উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি নিয়ে একটি কবিতা বেরিয়ে আসতে চাইছে এখন এই নিবন্ধেরই একটা অঙ্গ হয়ে ! তাই হোক,  এটা পড়ে নিয়ে,  আবার নেমে যাবো গদ্যে ! এখন পড়ুন :--- 

         বাঙালির উৎসব,  পার্বন,  সংস্কৃতি 
                ঋদেনদিক মিত্রো 

বাঙালীর উৎসব জানো তুমি কী কী?  
কতগুলি পূজা পার্বন,  
বিবাহ, স্বাদ-খাওয়া,  অন্নপ্রাশন,  
   শ্রাদ্ধার্ঘ  সহ আরো কিছু আছে সাথে,  
এই সব ভুলগুলো নিয়ে কেউ 
                             বাঙালীকে মাপে,  
আমি বলি,  বাঙালীর উৎসব মানে হলো  
  রাত্রিতে নিরালায় হেরিকেন-আলোতে 
            লিখে যাওয়া দীর্ঘ চিঠি !  

বাঙালীর আরো উৎসব জানো কী কী? 
বই নিয়ে শুয়ে থাকা,  বই পড়ে ঘুম,  
জানালার পাশে খাটে,  
বইটাকে ধরে হাতে --- 
বুকের ওপর রেখে দেখে যাওয়া --- 
        শব্দ ও বাক্যের আকাশকুসুম,  
বিকেলের ম্রিয় আলো জানালাটা দিয়ে 
        খাটের ওপরে এসে নীরবতা নিয়ে  
             চুপচাপ খুলে দেয় অনেক স্মৃতি ! 

বাঙালীর উৎসব আরো জানো কী কী, 
ফুটবল ও ক্রিকেট,  সেই সাথে আরো  
কত কী যে খেলাধুলা আছে হাজারো, 
দেশের সেরা এবং বিশ্বের সেরা  
পুরস্কার নিয়ে বিখ্যাত এরা,  
কতকি করছে সব,  পত্রপত্রিকা,  
      রেডিও, ইউটুব,  ইন্টারনেট,  টিভি ! 

বাঙালীর উৎসব আরো জানো কী কী?  
মাদুরেতে বসে লুডো, দাবা, তাস খেলা,  
এইভাবে বয়ে যায় কখন যে বেলা,  
কখনো নিজের মত কেউ কিছু লিখি ! 

বাঙালীর মানে জানো --- চিন্তার জয়,  
বাঙালীর মানে হলো --- প্রাণ নির্ভয়,  
কত বীর বিপ্লবী বীরাঙ্গনা,  
কত মহাপুরুষের বাণী, কথা, উপমা,  
গৃহস্থ ঋণ করে যত্ন করেন ---
                        গৃহে এলে অতিথি !  

বাঙালীর রান্না, ঘরোয়া জীবন,  
তার মাঝে চিন্তা, মনন,  সৃজন,  
বর্ণ-পরিচয় ও সহজপাঠ,  
পড়তে-পড়তে শিশু হয় যে বিরাট,  
স্কুলের জানালা দিয়ে দেখে মাঠঘাট,  

স্কুল ছেড়ে উচ্চ শিক্ষায় গিয়ে  
কত কিছু স্মৃতি রাখে সে সাজিয়ে,  
দাম্পত্যে সেই সব স্মৃতিগুলি নিয়ে  -- 
চুপিচুপি অবসরে যায় কাঁদিয়ে ---
                 নিজেকেই একলা নীরব, 
হারানো সময়গুলো আর ফিরে আসবেনা,  
                 দীর্ঘশ্বাসে ডুবে করে অনুভব !  

পিঠেতে লাগায়ে রোদ 
       শীতকালে আঙিনায় বসিয়া-বসিয়া 
         লঙ্কা কষে মেখে দিয়ে 
           হাপুস-হুপুস শব্দে পান্তা খাওয়া,.  
তেতুল গাছেতে উঠে হনুমান বেশ --- 
          ল্যাজ নেড়ে সুখে তার তেতুল খাওয়া ! 

মাদুরে বসিয়া রাতে 
       কয়জন প্রতিবেশী একসাথে ---  
                                রেডিও শোনা,   

শুনতে-শুনতে আহা বয়ে যেত কত কল্পনা,  
          সেই সাথে দেশ নিয়ে দশ নিয়ে 
                         কত আলোচনা !  

মসুর ডালের জলে পাঁচফোড়নের স্বাদ,  
     কাগজা লেবুর সাথে কোনো ভাজা,  
            তার সাথে সাদা হাসি-হাসি ভাত,  
             তার মাঝে খেলে যায় হাত !

আসিলে বিকেল বেলা
  রাখাল আসতো গরু নিয়ে 
     বলতে-বলতে ঠিক নেমে আসতো রাত,  

সেই অমাবস্যা,  সেই জোৎস্না,  আজ আর নেই,. 
    হারিয়ে গিয়েছে তারা  বিদ্যুতের আলোতেই,  
        
তবুও প্রেতের মতন তারা স্মৃতি হয়ে আসে,  
    রাতের পাখির মত 
                  শব্দ করে উড়ে যায় উল্লাসে ---  
  কে জানে কোথায়,  
        হতে পারে তারা যায় 
              ঘোষেদের রাত-মাঠে  
                       এমেচার যাত্রা পালায়,  

বিড়ির আগুনে পথে একা হাঁটে রামু কাকা,  
    কী দুরন্ত চোখ ও সাহস এই কৃষকের ! 
             হিসেবেতে যায় না মাপা !  

ঘরে-ঘরে হেরিকেন,  লম্ফ ও  লণ্ঠন রাতে,  
 কেরোসিনে জ্বলে তারা ভূষাকালি মাখে,  
  একটি আলোকে ঘিরে  
    দুলে-দুলে পড়ে যায় কয়জন ছেলে মেয়ে,  
       মাঝে-মাঝে  অন্যমনস্ক হয়ে
          ভেসে যায় কোনো এক কল্পনাতে ! 

মহান দিগের নিয়ে জীবনী পড়ে
                 মনে জাগে স্বপ্ন চুপিচুপি,  

বাঙালির উৎসব,  পার্বন,  আরো জানো কী কী !

সেই বন, অরণ্য,  ঝোপ ঝাড়, পালকির যাওয়া,  
    সেই নদী,  নৌকা, পালে লাগে হাওয়া,  

সেই সে গোরুর গাড়ি,  ক্যায়চ আওয়াজ,  
   সে শানবাঁধানো ঘাটে 
      চুড়ির শব্দ তুলে বধূ করে কাজ,  

কলসিতে জল আনে দূর হতে নারী,  
  কোনো পুরুষের চোখে পড়িলেই চোখ  
   কাখের জলের ছলকে হেসে যায় ভারি 
                           লাজুক নারী ! 

অতিথি বাড়িতে এলে তাকে যত্ন করা,  
  গ্রীষ্মেতে  হাত পাখা দিয়ে নারী করে যায় 
                 মধুর বাতাস,   
    থালাতে সাজিয়ে দিয়ে ভাত তরকারি,  
                   আশ্চর্য বাঙলার নারী !

এমনি কতকি নিয়ে বাঙলার উৎসব সংস্কৃতি,  
     বই মেলা,  পত্রপত্রিকা, টিভি,  
         মহানের জন্ম,  মৃত্যু দিন পালন করা,  
              আপাতত এখানে এ কবিতার 
                                  টানলাম ইতি,  

এমনি কতকি নিয়ে 
              বাঙলার উৎসব,  পার্বন,  সংস্কৃতি ! 
             
                    ***************
          
     আচ্ছা,  এখন একটু কঠোর হয়ে দুটো কথা বলা হোক !

     তাই বলি একটা কথা, যে-বাঙালির ঘরে-ঘরে কুটকাচালি,  অস্ত্র,  নানা রকম নির্দয়তা ভর্তি হয়ে  আছে,  সেই বাঙালির উৎসব,  পার্বন,  সংস্কৃতির অস্তিত্ব কোথায়?   যদি বলেন,  এতো কবি সাহিত্যিক,  নাটক,  সিনেমা,  নৃত্য,  সংগীত,  এগুলির কি কোনো মূল্য নেই?  আমি বলবো --- না ! কারণ,  চিন্তাশীল মানুষেরা বুদ্ধিজীবীর তকমা নিয়ে সময় ভিত্তিক কিস্তিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে জনগনের কাছে বোবা কালার অভিনয় করছেন,  তাহলে এটাই বাংলার সংস্কৃতি ! তাহলে,  এই কুৎসিত পরিচয়কে সংস্কৃতি বলে বলবো কী করে?  সংস্কৃতি শব্দ তো কুৎসিত হয় না,  সেটা তো সুন্দরের প্রতিফলন হয় ! 

     যে-বাঙালি হাত ধুয়ে খেতে জানতো না,  করোনা মড়ক আসতে বিজ্ঞান সম্মত ভাবে হাত ধুয়ে খাওয়া শিখলো,  সেই বাঙালী আবার কিসে শিক্ষিত,  আর,  যে-শিক্ষিত নয় সত্যি কারে সে সংস্কৃতিবান হয় কিসে?  

     যে-বাঙালীর সরকারী শাসন দপ্তর আবগারি দপ্তর তৈরী করে মানুষকে নেশায় মত্ত করিয়ে সর্বনাশ করে,  ও যে-বাঙালী সেগুলি নিয়ে মজে থাকে সে আবার সংস্কৃতিবান কিসে?  

     যে-বাঙালী তার গর্ব বিদ্যাসাগরের মূর্তির মাথা ফাটানো ও চুরমার করা দেখে নীরব থাকে,  ক্ষুদিরামকে  স্বদেশী ডাকাত বলে প্রচারটা মেনে নেয়,  নেতাজীর অপমান ও রহস্য নিয়ে নীরব,  শতশত চিটফান্ডের লুটেরাদের দেশের সেবক সেবিকা বলে বিশ্বাস করে তাদের হয়ে জয়ধ্বনি দেয়, ভোটের নামে গুন্ডামিকে প্রশ্রয় দেয়,  রবিঠাকুরের নোবেল প্রাইজ চুরি করে পালিয়ে গিয়ে ভুয়ো তদন্ত করে,  ইত্যাদি এইরকম সব অভ্যাসে চরিত্র গঠন করেছে,  সেই বাঙালির আবার সংস্কৃতি কী?  

     যে-বাঙালী বাড়িতে কাজ করা গরীব মানুষদের সাথে কৌশলের দুর্ব্যবহার করে সেটাকে আভিজাত্য ভাবে,  আর শিশুদেরকে পুরুষানুক্রমিক ভাবে এইসব নানা রকম নির্মমতা শিখিয়ে সেগুলিকে বংশের ঐতিহ্য হিসেবে প্রদর্শন করতে গর্ববোধ করে,  সেই বাঙালির আবার সংস্কৃতি কী?  

     বৃষ্টির জল আটকে মিঠে বন্যা তৈরি করে ও বাঁধ ঠিক মত না বেঁধে নদীর বন্যা তৈরী করে --- যে-বাঙালী শাসন কেবল পতাকার রং বদলে একই রকম দুর্দশা ঘটিয়ে যায়,  নতুন -নতুন রাজা রানী এসে, সেই বাঙালির আবার সংস্কৃতি কী?  এইসব সর্বনাশ দেখে যে-বাঙালী নীরব ও নির্বিকার,  সেই বাঙালীর আবার জীবনবোধ কী?  যাদের জীবনবোধ নেই তাদের আবার সংস্কৃতি কী?  

     বাঙালির উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি কোথায়?  বাবু, ধনী,  জমিদার বা একটু স্বচ্ছল লোকেরা নিজেদের পরিবারের দেমাক দেখাতে যাত্রা,  থিয়েটার, এইসব নিয়ে মত্ত থাকতেন,  পার্বনের নাম করে অনেক লোককে খাওয়াতেন,  অসহায় ভুখা শিশু নরনারীরা এসে সেই খাবার খেয়ে খাদ্যদাতাদের পরিবারের প্রশংসা করে যেতেন বাধ্য হয়ে, সেগুলিকে কি সংস্কৃতি বলবো !  

     যে-বাঙালি দোকানে মাপে চুরি করে,  নীচু মানের জিনিস দিয়ে উঁচু মান বলে বিশ্বাস করায়,  জমি বা কোনো সম্পদ বেচতে গিয়ে দামে ও মাপে ঠকায়,  সেই বাঙালির আবার সংস্কৃতি কী?  

     যে-বাঙালি ব্রিটিশকে বর্ণ বিদ্বেষী বলে গালি পেড়ে নিজেরাই বিবাহের বিজ্ঞাপনে জাতের বর্ণ ও চামড়ার বর্ণ নিয়ে বিদ্বেষ ছড়িয়ে নিজেদের পরিচয় বহণ করে,  সেই বাঙালীর আবার সংস্কৃতি কোথায়?  

     যে-বাঙালী স্বাভাবিক কথাটাও হাঁক দিয়ে বলে,  খাবার সময় কথা বলে,  কোন খাবার কতটা সেদ্ধ করে খেতে হয় জানেনা,  খেয়ে উঠে  কী ভাবে খাটে শুতে হয় কখন কী ভাবে কতক্ষন দেহটাকে কোনদিকে করে -- সেটাও জানেনা,  একটি মানুষ আর একটি মানুষকে বিশ্বাস করতে পারে না,  বাড়িতে কেউ এলে  " আধ কাপ লাল চা খেয়ে যান " বলে বোকা চালাকি করে অতিথির সাথে,  সেই বাঙালির আবার সংস্কৃতি কী?  

     যে-বাঙালি শিশু শ্রমকে সমর্থন যোগায়,  সেই বাঙালির আবার চিন্তা,  শিক্ষা ও সংস্কৃতি কী?  

     যে-বাঙালি মাতঙ্গিনী হাজরার নন্দীগ্রামে গণহত্যা ঘটায়,  সেই বাঙালির আবার গৌরব কী,  সংস্কৃতি কী?   

     যে-বাঙালি শিক্ষকগন মাসে-মাসে বাক্সভর্তি টাকা বেতন পেয়েও স্কুলে আসা  ছাত্রের খাবারের চাল চুরি করে,  এবং ছাত্রের খাবারের মত না খেয়ে আলাদা দামী খাবার খায় ছাত্রদের সামনে বসে,  টিউশন করা বেআইনি জেনেও শিক্ষকগন  টিউশন করে বেকার ছেলে মেয়েদের পেটের ভাত কেড়ে নেয়,  ঘুষ নিয়ে ছাত্র ছাত্রী ভর্তি নেয়,  সেই বাঙালির আবার শিক্ষা কী,  সংস্কৃতি কী?  

     যে-বাঙালি বাড়ির টিউশন মাস্টারকে উপযুক্ত বেতন ও সম্মান দিতে কুন্ঠিত হয়,  সেই বাঙালির আবার সংস্কৃতি কী? 

     যে-বাঙালি পূর্বপাকিস্তানের  উনিশ শ বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ও ভারতের আসামের শিলচরে উনিশ একষট্টি উনিশে মে তারিখে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে গর্ব করে,  সেই বাঙালি আবার বাংলা বই কিনতে চায় না, বাংলা স্কুলে পড়াতে চায় না ছেলে মেয়েদের,  সেই বাঙালির আবার গৌরব বোধের শুদ্ধতা কোথায়?  গৌরব বোধের শুদ্ধতা যাদের নেই তাদের সংস্কৃতি কোথায় থাকতে পারে সেটা তো বুঝতে পারছিনা ! 

     আছে-আছে,  বাঙালির উৎসব আছে, পার্বন আছে,  সংস্কৃতি আছে,  অগ্নিযুগের কাহিনী ও স্বর্ণযুগের সৎ সাহসী সৃষ্টিগুলি,  আসুন সেইগুলিকে নিয়ে আমরা পড়তে বসি শিশু হয়ে ,  আর জোরে-জোরে বাপ্ ছেলে মেয়ে বউ স্বামী বাড়ির কাজ করার লোক,  গরীব,  ধনী,  নেতা,  মন্ত্রী, সকলে মিলে পড়তে বসি নতুন করে বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয়,  রবিঠাকুরের সহজপাঠ! 

     খিদে পেলে খাবো বাড়িতে ভাজা মুড়ি, চালভাজা,  ঢেঁকিতে তৈরী চিড়ে,   কেনা জল সরিয়ে ডিপ টিউব ওয়েলের জল,  নারকোল,  বাড়ির বাগানের কুল,  জাম,  ডাঁটা,  সবজি ! 

     খাদ্যের কৈফিয়তে কসাইখানাকে সমর্থন না জুগিয়ে ওই নৃশংসতার কেন্দ্র গুলিকে বন্ধ করে দেবো,  রঙ্গীন মিষ্টি বা রাসায়নিক মিশ্রিত কোনো খাবার বা পানীয় বর্জন করবো,  সিনথেটিক পোশাক কিনবো না,  আমদানি রপ্তানিও করবো না,  সুন্দর হওয়ার নামে রাসায়নিক বিষাক্ত দ্রব্যকে নিয়ে আল্লাদে মাতামাতি করবো না,  বই কিনবো, বই পড়বো, পুকুরে ভেলা ভাসিয়ে চড়বো,  জলে একটি পিঁপড়ে ভেসে গেলে সেটাকে তুলে আনবো যত্ন করে,  বাড়িতে হাঁস মুরগি পুষে তাকেই আবার বোধ করে নির্মমতার পরিচয় দেবো না,  প্রতিটি জীবের বাঁচবার অধিকারে বিশ্বাস করবো, পাকা বাড়ি বানালেও পাশে জুড়ে একটা মাটির হেঁসেল  ও দাওয়া বানাবো, গোয়াল তৈরী করে গরু রাখবো,  মাঠে চাষ করবো গরু নিয়ে,  নিবারণ কাকার থেকে রাত্রে কেরোসিনে জ্বলা পুরানো হেরিকেনের পাশে বসে  পুরানো অনেক গল্প শুনবো,  দিদার সাথে জোৎস্না-দাওয়ায় বসে রূপকথা শুনবো ! 

     আমাদের সবই ছিল,  ভালো কিছু ছিল,  সবই হারিয়ে ফেলেছি আমরা,  হারিয়ে ফেলতে হচ্ছে,  কারণ,  আমাদের গৌরবের মহাপুরুষ ও বিদুষীদেরকে ভুলিয়ে দিয়ে আমাদের সকলের ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে আম্বেদকর নামক এক আজব জীবকে !  আমাদের রাস্তায়,  স্কুলে,  কলেজে,  বিশ্ববিদ্যালয়ে,  অফিসে,  ক্লাবে,  অনিবার্য ভাবে রাখতে বাধ্য করছে ভারতের এক ভুল ভাবনার মানুষ আম্বেদকরের  ছবি ও মূর্তি, ---- বিদ্যাসাগর,  রামমোহন,  রবিঠাকুর,  প্রফুল্লচাকী,  বেগম রোকেয়া,  নজরুল,  বাঘা যতীন, মাস্টারদা সূর্যসেন,  জে -সি -বোস, মেঘনাথ সাহা,   পি -সি -রায়, সত্যেন বোস, মনিলাল ভৌমিক,  জীবনানন্দ,  জসিমুদ্দিন, সুকান্ত, ক্ষুদিরাম, রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়,  দয়ারাম সাহানি,  রাধানাথ শিকদার, মাতঙ্গিনী হাজরা,  স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, পি-সি-সরকার প্রমুখদের মত শতশত সঠিক গৌরবের ছবি ও মূর্তিকে সরিয়ে বা এঁদের  গুরুত্ব কমিয়ে দিয়ে ! 

     এখানে ভীমরাওজি আম্বেদকরকে আলোচনায় আনার জন্য ওনার ভুল গুলি কোথায় সেটা নিয়ে একটু ইঙ্গিত না দিলে পাঠক আমাকে ভুল বুঝবেন,  বা একটা বিভ্রান্তি চলে আসবে ! তাই কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে আবার স্বাভাবিক আলোচনায় ঢুকে যাবো ! আম্বেদকরের ভুলের বিরুদ্ধে ও সংবিধানের ভুল ধরে আমি মূল যুক্তিপ্রমাণ  ও সহযোগী প্রমাণ সহ প্রায় একশত টি প্রমাণ আমার ননফিকশান প্রায় চারশ পৃষ্ঠার " দংশন " উপন্যাসে সাঁইত্রিশ অধ্যায়ে প্রকাশ করেছি, যা কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের উল্লেখযোগ্য অনেক নেতা নেত্রীর হাতে গেছে,  এবং সকলেই নিরব !  একবছরের সশ্রম কারাদণ্ডের চ্যালেঞ্জ ছিল ! সবাই নীরব ! আম্বেদকরের অনুগামী ও সরকারী সংস্থাগুলি নীরব ! এমন কী আম্বেদকর ভক্ত ডাক্তার ওদের একজনকে বলেছিলেন,  " ওরেব্বাবা,  ঋদেনদিকের লেখায় হাত দেবেন না !"  এইরকম অনেক ঘটনা আছে ! আবার আম্বেদকর অনুগামী ওই বিভাগীয় সরকারী অফিসার ও অনেক নাগরিক আমার যুক্তিগুলি পড়ে চমকে গিয়ে বলেছিলেন --- আমরা এতো ভুলে বাস করছিলাম,  সেটা আপনারা বই থেকে জানলাম !

     এই সময়ে বলে রাখি, আমার যে কোনো লেখা বা বক্তব্যের জন্য প্রকাশক বা সম্পাদক বা প্রচারকরা কতৃপক্ষ দায়ী নয়,  কারণ লেখা হয় লেখকের ইচ্ছেতে,  বক্তা বক্তব্য বলেন নিজের ইচ্ছেতে,  যাঁরা সেটা প্রকাশ করেন তাঁরা জনগনের হাতে ছেড়ে দেন সেই সৃষ্টির গুণাগুণ বিচারে জন্য ! তাই যার কাজ সেই দায়ী সব কিছুতে ! যেমন এখানে আমি ! এটাই আইনত সত্য !

     দুহাজার ষোলোতে ওই উপন্যাসটি কলকাতার একটি সাহসী প্রকাশনী থেকে বেরুনোর পরে দেখা গেলো পরপর সারা ভারতে নানা স্থানে আম্বেদকরের চিন্তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে আন্দোলন শুরু হয়েছে ! যদিও এর ওপর একটা নিবন্ধ সম্ভবত দুহাজার এগারোতে সময়টা হবে একটি সাপ্তাহিকে বেরিয়েছিল ! আমার কাছে সেই সংখ্যা মনে হয় আছে,  খুঁজলে পাবো,  কিন্তু,  এইমুহূর্তে এটা লেখার সময় ওটা বের করে দেখা সম্ভব হচ্ছে না ! কেউ জানতে চাইলে বলে দেব ! সোনারপুরের একটি সাপ্তাহিক সাংবাদিক সংবাদপত্রে সেটি বেরোয় ! তারপর ওই সমর্থনে চিঠি আসে ওই সংবাদ পত্রে ! দু একটা ছেপে পুরো বিষয়টি চুপ হয়ে যায় কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ! এবং আবার আরকোনো লেখা ওরা আর প্রকাশ করতে চাইলো না ! বিশেষ গোপন সূত্রে জেনেছিলাম যে,  ওই লেখাটি যারাই পড়েছে তাদের পূর্বের ভুল বিশ্বাস বদলে যাচ্ছে,  কিন্তু,  এক শ্রেণীর লোক মানুষের ওপর ভুল বিশ্বাস চাপিয়ে স্বার্থ লোটার জন্য  আমার ওই হাজার দুই আড়াই শব্দের নিবন্ধর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকে  চাপিয়ে রাখার জন্য শুধু সচেষ্ট নয়,  আমার আর কোনো লেখা  ওই মুদ্রিত পত্রিকায় যাতে প্রকাশিত না হয়,  সেজন্য সম্পাদকের ওপর চাপ দেয় ! একই সাথে আমার দ্রুত সুনামে অনেকেই সহ্য করতে পারেনি,  তারা তাই দপ্তরকে আগলে রেখেছিলো যাতে দপ্তর আমাকে আর পাত্তা না দেয় ! 

      এগুলি আমি নিজেই প্রমাণ দেখতে পাচ্ছিলাম,  পরপর,  আজও নানা পত্র পত্রিকায় ও সংবাদ ও শিল্প সংস্কৃতি মাধ্যমে আমাকে নিয়ে রাজনীতি হয়,   খুব কষ্ট পাই আপন পরিচিত লোকেরাই কী ভাবে আমাকে বিপন্ন করছে,  যদিও তারা বাইরে খুব হাসি খুশি আচরণ !  

     যাইহোক,  ওখানে কেউ বা আবার দপ্তরে কাউকে বলেছিলো যে ঋদেনদিকের সাহসী লেখা বেরুলেই তো পত্রিকার প্রতি মানুষের গুরুত্ব বাড়বে,  বিক্রিও বাড়বে পরপর,  আর যারা ধমকাচ্ছে যে ওর লেখা বেরুলে তারা পত্রিকা কিনবে না,  তাতে পত্রিকার ক্ষতি হবেনা,  কারণ কয়টা সস্তার সুবিধেবাদী লোক কোনো পত্রিকা সত্য বলার জন্য না কিনলে তাতে পত্রিকার কিছু যায় আসে না ! বৃহত্তর সংখ্যার পাঠক তো কিনবে ! 

     কিন্তু,  কেন্দ্রীয় কতৃপক্ষ চুপচাপ থাকলো,  কারণ তারা এত বৃহৎ যুক্তি নেবেনা,  যেমন চলে চলুক !  

     এমনকি কাউকে-কাউকে দেখা গেলো,  তারা কেন্দ্রীয় কতৃপক্ষের কাছে ভালো হয়ে নিজেদের কাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আমার সাথে বন্ধুত্ব অস্বীকার করে দূরত্ব রাখা শুরু করলো ! আমি যদিও তাতে কারোর-কারোর ওপর রাগ করতাম না,  কারণ আমি তাদের পরিস্থিতিগত অসহায়তা বুঝেছিলাম ! বিপরীতে কারোর-কারোর চালাকি আমাকে খুব কষ্ট দিতো,  কারণ তাদের ওইসব লাঙবাজি ও চালাকি করার দরকার ছিলোনা,  কারণ তারা খুব একটা অসহায় ছিল না ! 

     এটাই কি বাঙালির আর একটি রূপ,  জানিনা ! আপাতত, এমন রূপ তো আমার নেই,  তাই হয় ওরা বাঙালি,  নয়তো আমি বাঙালি ! কারণ,  দুটো বিপরীত চরিত্র এক পরিচয়ের হতে পারে না !

     যাইহোক এখন এবার ফিরে যাবো আর একটু আগে,  যেখানে ভীমরাওজি আম্বেদকরের ভাবনা ও কাজের প্রতি আমি অনেক অনাস্থা প্রকাশ করেছি,  এবং বাঙালিদের ওপরেও  তাঁর নাম চাপিয়ে দিয়ে কী করে বাঙালি মনীষী,  বিদুষী,  বীর বীরাঙ্গনাদের অবস্থানকে হালকা করে দেওয়া হচ্ছে পরপর ! আমার এই কথা  নিয়ে অনেকেই আমার প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করতে পারেন,  সেই ভুল যাতে না করেন,  তাই ভীমরাওজির অনেক ভুলের  মধ্যে মাত্র কয়েকটি বলছি ! কারণ এখানে প্রসঙ্গকেন্দ্রিক মাপের বাইরে কিছু বলা যাবেনা ! ততটুকুই বলছি ! তারপর একদম শেষে একদম উপরের প্রসঙ্গ নিয়ে এসে লেখাটি শেষ করবো !

     এখন বলুন তো,  একজন নাগরিক হিসেবে আপনাকেই মাত্র কয়েক প্রশ্ন করি আমি :---

     (1 ) মদের দোকান তুলতে চেয়ে আপনি কি মদের দোকানকে আবার মদ বিক্রির লাইসেন্স দিয়ে যাবেন ধারাবাহিক ভাবে?  নিশ্চই নয় ! তাহলে জাত বিভাজন নামক কুসংস্কার তুলে দিতে চেয়ে জাত বিভাজনের চুক্তিতে মানুষকে সুযোগ দেবার আইন চালু করে কী ভাবে জাত বিভাজনের কুসংস্কার তুলে দেওয়া যাবে?  

     (2 ) সব পদবীতে যদি সৎ,  অসৎ, বোকা,  বুদ্ধিমান, মূর্খ,  জ্ঞানী,  ভীরু ও সাহসী আছে,  তাহলে কোন পদবী কেন উঁচু বা নীচু?  আপনি বলুন ! 

      (3 ) স্বাধীন দেশে বাস করে আপনি ছোটলোক বা অস্পৃশ্য হবার চুক্তিতে নিজের দেশের সম্পদ বা সুযোগ নেবেন কেন?  যে আইন আপনাকে অকারণে ছোট করে,  মানহানি করে সেটা কী করে আইন বা সঠিক বিচার বিভাগের মর্যাদা পেতে পারে?  

     (4 ) যুগযুগ ধরে সকলের রক্ত সকলের  সাথে মিশেছে, পেশা ও চিন্তা মিশেছে,  তাহলে কে কোন সাবকাস্টের পরিচয়ে খাঁটি হতে পারে?  

     ( 5 ) আম্বেদকর-অনুগামীরা বলছেন যে,  পেশা থেকে জাত বিভাজন তৈরী,  তাহলে মানুষ পেশা বদলালে সরকারী নথিতে তার জাত-পরিচয় বদলানোর জন্য কেন সরকার ও আম্বেদকর-দপ্তরের নেতারা সাহায্য করবেন না ! কেন মুচির ছেলে ডাক্তার বা শিক্ষক হলে বা অন্য যে-কোনো পেশা নিলে নতুন পেশার নামে জাত-পরিচয় সে পাবেনা?  

     ( 6 ) নীচু জাত পরিচয়ে যদি আপনি বেশী সুযোগ ও সুরাহা পাবার পথ পাবেন,  তাহলে,  দুর্বল  শিক্ষা ব্যবস্থা ,  দারিদ্র,  বেকারত্ব,  ভুল চিকিৎসা,  ভেজাল খাবার ও ভেজাল ঔষধ, ও নানা রাজনৈতিক, ধর্মীয় তথা নানা অরাজনৈতিক হিংসার দ্বারা আপনি উচ্চ বর্ণ পরিচয়ের মানুষদের মত আক্রান্ত হন কেন?  

     (7) আপনি যে-জাতি বা সাবকাস্ট বলে পরিচয় প্রদান করুন না কেন,  কর্ম দক্ষতা অন্য সহকর্মীর মত দেখাতে হয়,  ও তারা যতক্ষণ কাজ করে ততক্ষন কাজ করতে হয় আপনাকে,  তবেই তাদের মত বেতন পান,  তাহলে আপনার উচ্চ বর্ণ বা নিম্ন বর্ণের পরিচয়ের আলাদা অস্তিত্ব কী থাকলো?  কী ভাবে চালাকিটা করে আপনার অস্তিত্ব বিপন্ন করা হচ্ছে আম্বেদকর পদ্ধতি প্রয়োগ করে সেটা কি এখনো বুঝতে পারছেন না?  

     (8) আপনাকে কতগুলো চালাকি কথা বলে ভুল বুঝিয়ে ছোট জাতের পরিচয় নিতে বাধ্য করিয়ে তারপর আপনাকে তাতিয়ে দিচ্ছে -- তোমাকে কে ছোটজাত বা অস্পৃশ্য বলে ঘৃণা করছে বা অত্যাচার করছে,  আন্দোলন করবে চলো ! অংক কিছু বুঝলেন?  " দলিত " শব্দটি একটি যুক্তিহীন শব্দ এ ক্ষেত্রে,  কারণ কোটিকোটি মানুষের আত্মবিশ্বাসকে দুর্বল করে দলিতের ছাপ লাগিয়ে  রেখে তাদের শক্তিহীন করে দেশের ভুল শাসনের বিরুদ্ধে নিস্তেজ করে রাখার জন্যই এতো কৌশল ! আমার অংক তাই বলে,  আপনার  কোনো ব্যাখ্যা যদি আমার এই যুক্তিগুলিকে ভুল প্রমাণ করতে পারে তবে সেটাও আপনি জনঅরণ্যে মেলে ধরুন যুক্তিসহ ! মানুষ যেটা সঠিক সেটাই খুঁজে নিক ! 

     এইভাবেই তৈরী হয়েছে ধাপের পর ধাপ  তপসীলি জাতি,  উপজাতি ও পিছড়ে বর্গা শ্রেণী,  বা SC,  ST,  OBC, ইত্যাদি !  কী করে বাঙালি এগুবে,  সেও তো ভুল ভাবনা ও অভ্যেসের কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে ! 

     দেখুন,   শাসন ব্যবস্থা সঠিক হলে সব মানুষ কি খাঁটি মানুষ হবে --- এমন আশা করিনা,  একটা সংখক মানুষ ধুর্ত থাকবে,  কিন্তু,   সামগ্রিক ভাবে বেশী সংখক মানুষ তো একটা সঠিক নিয়ম ও অভ্যেস নিয়ে পরিবারজীবন,  সমাজ জীবন ও দেশ প্রকৃতিকে সুস্থ করে তুলবে ! 

     (9) যে ভীমরাওজি আম্বেদকর ব্রাহ্মণ পরিচয়ের লোকদের ঘৃণা করে প্রতিশোধ নেবার জন্য অন্যদের উৎসাহিত করেছেন,  তিনি "আম্বেদকর" পদবী নেন এক ব্রাহ্মণ-এর পোষ্য পুত্র হয়ে,  এবং দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন এক ব্রাহ্মণ কন্যাকে !  

     ভীমরাওজি অর্থনৈতিক ভাবে কোনো অসৎ লোক ছিলেন না,  কিন্তু তাঁর ভুল আবেগের ভাবনা ও ভুল আইনের প্রয়োগ ভারতের এতো অস্থিরতার কারণ বলে যদি গণ্য করি সেটা কি ভুল হবে?  এর বিরাট কু প্রভাব বাংলাকেও দুর্বল করেছে, প্রতক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে,  সেই প্রমাণ টেনে আনতে হলো বাঙালির উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি নিয়ে লিখতে গিয়ে ! কারণ,  বাঙালিকে উপলব্ধিহীন করার পেছনে যেসব বিষয় কাজ করছে তার মধ্যে ভীমরাওজির অনেক ভুল ভাবনাও দায়ী ! 

     (10) কেউ বলবেন,  সংবিধানের ধারাগুলি তো প্রতি দশ বছর অন্তর পরিবর্তন করার আইন আছে,  --- এখানেও আপনাদের ভুল আশা কাজ করছে,  কারণ যারা ভুলকে টিকিয়ে রাখবে,  তারা কি ভুলের সংশোধন করতে চাইবে কোনোদিন? 

     তাহলে,  পুরো ব্যাপারটা এমন ভাবে সাজানো যাতে দেশের মানুষ পুরো বিভ্রান্ত হয়ে থাকে, এবং সেই বিভ্রান্তের উৎসকে সেরা মহামানব বানিয়ে সঠিক মহাপুরুষ ও বিদুষীদেরকে কৌশলে পরপর আবছা করে দেওয়া হচ্ছে ! বাঙালিজাতী সেই প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আজ বিপন্ন,  সে মিথ্যে শান্তনায় কিছু বিধিবদ্ধ সংস্কারে ঢুকে থেকে সেই গুলিকে উৎসব,  পার্বন ও সংস্কৃতি ভাবছে ! এইভাবে আসছে তার বিপন্নতা আর ধ্বংসের চোরা স্রোত !  যে-জাতি হারিয়ে ফেলছে তার মস্তিষ্কের ক্ষমতা,  শিরদাঁড়ার সোজা রাখার ক্ষমতা,  স্পষ্ট কথা বলার ক্ষমতা,  সেই জাতির কি উৎসব,  পার্বন,  ও সংস্কৃতি নিয়ে কোনো শুদ্ধ অনুভূতি থাকতে পারে?  পারেনা,  কোনোদিনই পারেনা ! 

     বলুন বন্ধু,  আমি যদি সেই বিপদ ও বিপন্নতা থেকে বাঙালিজাতিকে বেরিয়ে আসার জন্য বৈজ্ঞানিক কারণ দেখাই সেটা কি আমার অপরাধ?  

     এতো জ্বালা সহ্য করেও কেন আমরা জেগে উঠছি না?  

     তবুও আমরা নীরব,  ধোঁকা শাসন ব্যাবস্থার গবেষণাগারে আমরা বাঙালিরা হয়েগেছি নির্দয় বা নির্বোধ রাজনীতিবিদদের গিনিপিগ, আমরা উর্ভ্রান্ত,  আর উদ্ভ্রান্ত যারা তাদের উৎসবের নাম উদ্ভ্রান্ত, পার্বনের নাম উদ্ভ্রান্ত,  সংস্কৃতির নাম চাটুকারিতা,  শিক্ষার নাম না-শিক্ষা,  পেশার নাম লুট,  নেশার নাম কাপুরুষতা, চরিত্রের নাম ফাঁকি,  শান্তির নাম মিথ্যে শান্তনা,  বেঁচে থাকার নাম কৃতদাসবৃত্তি,  প্রতিবাদের নাম ভন্ড নেতা নেত্রীর লেজুড় হওয়া,  ভালোবাসার নাম নাটক,  ত্যাগের নাম সুদে আসলে প্রাপ্তির লোভ,  শ্রদ্ধার নাম পরিশ্রমহীন সম্পত্তি পাবার আশা,  স্নেহের নাম বংশধরদেয় চাটুকার ও গুরুজনের অপরাধের ইতিহাস ধরতে না-পারার মত বোকা বানানোর ট্রেনিং,  সেবার নাম ভুয়ো ভাউচার বানিয়ে সরকার ও জনগনের সম্পত্তি লুটের কাজকর্ম, চাকরির নাম অন্যায় দেখে সমর্থন করার কাজ ! 

     হায়রে বাঙালি,  তোর রক্তেই লুকিয়ে আছে:-  
     "আলোকেরই ঝর্ণা ধারায় ঝরিয়ে দাও, " 
    " কারার ওই লৌহ কপাট,  ভেঙে ফেল কর রে  লোপাট " 
     " অবাক পৃথিবী অবাক " 

     " বন্দে মাতরম "  
     " হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন " 
   

     আমাদের আছে,  সব আছে,  আরো কত কী আছে,  ওঁরা নিশ্চয় ফিরে আসবেন একদিন,  আমরাই নিয়ে আসবো ওঁদের,   আমাদের অভ্যেসে,  চিন্তায়,  চরিত্রে,  আর সাহসের নির্মাণে ! 

     
               ( by Ridendick Mitro )

 [ লেখক পেশায় পৃথকভাবে ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় কবি,  উপন্যাসিক,  প্রাবন্ধিক,  গীতিকার,  অনুবাদ নয় ! একটি জনপ্রিয় বিশ্ব প্রচারিত বিশ্বজাতীয় সংগীত " world anthem -- we are the citizen of the earth " এর  গীতিকার ! বিবিধ প্রকাশনী থেকে অনেক গ্রন্থ রয়েছে দুটি ভাষাতেই ! কলকাতা,  ভারত ]    

 

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.