প্রয়াণ দিবসে নিবেদিতা স্মরণ
মৃদুল শ্রীমানী
আজ ভগিনী নিবেদিতার প্রয়াণ দিবস। তেরই অক্টোবর, ১৯১১ তারিখে, চুয়াল্লিশ বছর বয়সে দার্জিলিং এ তাঁর দেহাবসান ঘটে। জন্মেছিলেন এই অক্টোবরেই, আঠাশ তারিখে, ১৮৬৭ সালে। ১৮৯৫ সালে, লণ্ডনে আঠাশ বছরের তরুণীর সাথে বছর বত্রিশের যুবক বিবেকানন্দের সাক্ষাৎ ও আলাপ হয়। ঋজু ও মার্জিত, একই সাথে তেজোময়ী মেয়েটির ব্যক্তিত্ব তাঁকে গভীরভাবে উদ্দীপ্ত করে। ১৮৯৮ সালের পঁচিশে মার্চ তাঁর গুরু বিবেকানন্দ তাঁকে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষা দেন। ভারতের সার্বিক কল্যাণসাধনে জীবন ও মন উৎসর্গ করেন মেয়েটি। ১৮৯৮ এর নভেম্বরে কলকাতার বাগবাজারে মেয়েদের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন নিবেদিতা। ১৮৯৯ সালে কলকাতায় মারাত্মক প্লেগ দেখা দিলে জীবনপণ করে আর্তসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতা ঠিক কী, এবং সদর্থে জাতীয়তাবাদ বলতে কী বোঝায়, সে নিয়ে নিবেদিতার স্পষ্ট ও সুঠাম ধারণা ছিল। সেই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের সেরা প্রতিভাধর ব্যক্তিদের উজ্জীবিত রাখার জন্য কাজ করে গিয়েছেন নিবেদিতা। বিজ্ঞানসাধক জগদীশচন্দ্র বসু, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু সহ বহু ভারতীয় ব্যক্তিত্বকে হৃদয় উজাড় করে আশা ভরসা জুগিয়েছেন এই মহীয়সী।
সাহিত্যে তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ, একই সাথে প্রগতিশীল ও গঠনমূলক চিন্তায় বিশ্বাসী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সবটা যে ওঁর মতে মিলত তা তো নয়। তেজোদীপ্ত ব্যক্তিত্বময়ী কর্তব্যপরায়ণ মেয়েটির নিজস্ব বিচার ভাবনার সাথে প্রাজ্ঞ বিচক্ষণ কবির চিন্তার পুরো মেলবন্ধন না হবারই কথা। কিন্তু নিবেদিতার উপস্থিতিতে এমন একটা মাধুর্য থাকত যে মেয়েটির সাথে সব মতপার্থক্য ভুলে যেতেন রবীন্দ্রনাথ। কবির জন্ম মে, ১৮৬১। নিবেদিতার অক্টোবর, ১৮৬৭। কবির থেকে বছর ছয়েকের ছোট নিবেদিতা। কবির গল্প কাবুলিওয়ালা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন বিদেশিনী, আর জোর খাটিয়ে ঢুকে পড়েছেন বিপত্নীক কবির সাহিত্যের অন্দরমহলে। গোরা উপন্যাস লিখছিলেন বছর পঞ্চাশের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। লেখা দেবেন বলে আগাম টাকা চেয়ে নিয়েছিলেন প্রবাসী সম্পাদকের থেকে। আড়াই বছর ধরে কিস্তি লিখে লিখে শোধ করতেন কবি। মা মরা ছোটছেলে শমীর মৃত্যুতেও গোরা উপন্যাসের কিস্তি পাঠানো বন্ধ করেন নি তিনি। সেই গোরার নিয়মিত পাঠিকা ছিলেন আইরিশ মেয়েটি। মাঝে মাঝেই কবির কাছে খোঁজ নিতেন গোরার কিস্তি তৈরির বিষয়ে। একবার গোরা লেখার একেবারেই শেষ পর্যায়ে কবির কাছে এসেছেন নিবেদিতা। আপনজনের মতো দাবি করলেন, গোরা কিভাবে শেষ করছেন, আপনার প্ল্যানটা শুনতে চাই।
গোরা যখন জানল তার জন্মের প্রকৃত খবর, তার পরে অনুরাগিণী সুচরিতার সাথে তার দূরত্ব কায়েম হয়ে গেল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই পরিকল্পনা শুনে গোলমাল বাধিয়ে দিলেন নিবেদিতা। না না, কিছুতেই আপনি অমন নিষ্ঠুরের মতো ওদের প্রেমকে শেষ করে দিতে পারেন না। মিলিয়ে দিন বলছি। দার্শনিক নিস্পৃহতায় কবি বলেন, সমাজবিধিতে যে এ মিল হতেই পারে না। তা হোক, তুমি কবি, তুমি শিল্পী, দাও ওদের মিলিয়ে। নিবেদিতার চোখে অদ্ভুত আকুতি। কবি শক্ত হয়ে থাকেন। কিছুতেই মেনে নেবেন না নিবেদিতার অসঙ্গত আবদার। তিল তিল করে আড়াই বছর ধরে তিনি গড়ে তুলেছেন গোরা। আর আজ একটা মেয়ের চোখের জলের কাছে হার মেনে এতদিনের সাধনায় জল ঢেলে দিতে পারবেন না তিনি। নিবেদিতা নাছোড়। দিতেই হবে শেষটা বদলে। গোরা সুচরিতাকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া চলবে না। প্রেমের টানে যে মেয়েটা নিজের দেশ সমাজ পরিবার আর পরিচিত পরিবেশ স্বেচ্ছায় ছেড়ে এসেছে, গুরুকে ভালবেসে গুরুর দেশের স্বার্থে নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে গুরুর স্বদেশকেই আপন স্বদেশ জেনেছে, এমনকি গুরুকে যথার্থ শ্রদ্ধা করে বলেই গুরুর সংগঠনের অহেতুক নিষেধাজ্ঞাকে হেলায় তুচ্ছ করে সংগঠনের বিরূপতাকে বুক পেতে নিতে ভয় পায় নি যে মেয়ে, তার আকুতি তো সোজা আকুতি নয়। প্রেমের আম্রমুকুলের কাছে হার মানে জ্ঞাননিম্ব ফল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলমে গোরা সুচরিতার মিল হয়ে যায়। গোরা বই হয়ে বেরোলো ১৯১০ এর ফেব্রুয়ারিতে। নিবেদিতা সমস্ত ভাব ভালবাসার পরপারে চলে গেলেন ১৯১১ এর অক্টোবরে, আজকের মত এক । মাত্রই চুয়াল্লিশ বছর বয়সে। নিবেদিতা শুধু বুকভরে ভালবাসাই দিতে জানতেন না, ধাক্কা দিতেও জানতেন। আলাভোলা ঋষিতুল্য বিজ্ঞানসাধক জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর চেয়ে সাত সাতটি বছরের বড় হলেও তাঁকে খোকা বলতেন নিবেদিতা। জ্ঞান ও চিন্তার উপর ব্যক্তি মালিকানায় বিশ্বাসী ছিলেন না মুক্তভাবুক জগদীশ। তাই গবেষণা জাত ফলের উপর পেটেন্ট নেবার বিপক্ষে ছিলেন। আদরের খোকাকে বকে ধমকে পেটেন্ট নিইয়েছিলেন।
বাংলাকে ভালবাসার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ভালবাসতেন নিবেদিতা। সে সময়েও কলকাতার বিদ্যালয়ের ছাত্রী রেখাকে লাইন বলতেই স্বচ্ছন্দ ছিল। তাদেরকে নিজের মাতৃভাষার শব্দচয়নে অনুপ্রেরণা দিতেন নিবেদিতা। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন বাগবাজারের বাসিন্দা। নিবেদিতার বিদ্যালয় ও বাসা ছিল ওই একই এলাকায়। একবার সেন ও নিবেদিতা একসাথে গল্প করতে করতে পথ হাঁটছিলেন। পথে হঠাৎ তেজি ও ক্রুদ্ধ ষাঁড়ের ছোটাছুটি দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সেন দৌড়ে পালিয়ে একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। সাথে যে নিবেদিতা আছেন, ষাঁড়ের ভয়ে সেটা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। গড়পড়তা বাঙালি পুরুষের পক্ষে এই আচরণ মোটেও অভাবনীয় নয়। পরে নিবেদিতা সেনকে খুঁজে বের করে জোর ধমক দিয়েছিলেন।
নিবেদিতা যেন বাঙালির অন্ধকার ঘরে আলো ঢেলে দিতে এসেছিলেন।
This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন