বনমালীর চাকরি পাওয়া : চন্দনকুমার কুণ্ডু


বনমালীর চাকরি পাওয়া

 
চন্দনকুমার কুণ্ডু

বনমালী দাসের বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। রোগা লিকলিকে চেহারা। মাথায় ওপরের দিকে গোল টাক, অনেকটা টুপির মত দেখতে লাগে  । চোখগুলো একটু ঘোলাটে। পাংশু মুখে গভীর ক্লান্তির ছাপ। পায়ে একজোড়া পুরোনো চপ্পল। গায়ে সস্তার জামা প্যান্ট । একটি থলে হাতে গুটিয়ে ধরে রাখে সব সময়।
 
সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই বনমালীর কলেজে  আসা চাই। সিনিয়র অধ্যাপকদের রুমে অনায়াসে ঢুকে গিয়ে বলে,
--স্যার, আমার ব্যাপারটা একটু দেখলেন না! আপনারা বললেই তো হয়ে যাবে। একটু বলে দিন না স্যার।

স্যারেরা ব্যস্ত থাকলে পরের কোন দিন আসতে বলেন। হাতে সময় থাকলে মজা করে বলেন,

--আরে আমি করে দিয়েছি তো। তোমার চাকরি হয়েই গেছে। তুমি এক কাজ কর...

বলে তিনি আর একজন সিনিয়রের কাছে পাঠিয়ে দেন। এখন জুনিয়র, সিনিয়র, শিক্ষক, অশিক্ষক সকলেই বনমালীকে একডাকে চেনে। ছাত্র , ছাত্রীরাও সুযোগ পেলে তাকে নিয়ে মজা করতে ছাড়ে না। কিন্তু বনমালী ভাবলেশ হীন। সে যেন এসব গায়েই মাখে না। তার  ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা,  এই কলেজে চাকরি করবেই।

সে বছর কুড়ি আগের কথা।  বিবেকানন্দ কলেজের সুনাম তখন তুঙ্গে। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের উদ্যোগে কলেজের বিশাল ক্যাম্পাস ঘেরার কাজ চলছে। সামনের বাগান নানা রকম গাছ গাছালিতে ভরে ফেলা হয়েছে। বাউন্ডারির তিনদিক জুড়ে নিম আর মেহগনির চারা লাগানো হয়েছে। ছোট ছোট গাছ গুলির পাতা তির তির  শব্দ করে দুলে দুলে তাদের মহিরুহে পরিণত হওয়ার প্রতিজ্ঞা জানাচ্ছে যেন। চারিদিকে সবুজায়নের সমারোহ তাক লাগিয়ে দিয়েছে । কলেজের ক্লাসের ফাঁকে শীতের সময় ফুটবল খেলার মহড়াও দেখার মত। ওই ক'বছর  বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন কলেজের সঙ্গে এ কলেজের ছেলেরা ফুটবল খেলায় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিত অনায়াসে। এই রকমই এক সময়ে কলেজের  নানান কাজে যোগ দিয়ে ভালো লেগে যায় বনমালীর। পরিশ্রমী, কর্মনিষ্ঠ, বিনয়ী বনমালী অল্প দিনেই সবার মন জয় করে নেয়। এরপর থেকেই  কলেজের নানা কাজে কর্মে বা অনুষ্ঠানে বনমালীর ডাক পড়বেই সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। উচ্চশিক্ষা লাভ না করলে ও বনমালী অশিক্ষিত নয়। স্কুলের সবকটা পাশ সে দিয়েছে। কিন্তু এব্যাপারে কেউ জিজ্ঞাসা করলেই কেমন যেন হয়ে যায় সে। কাঁচু মাচু মুখ করে বলে ,

--পড়াশোনার কথা বোলছেন স্যার? ওই করেছি টুক টাক। ও আপনাদের কাছে বলার মত লয়।

স্যারেদের কত পড়াশোনা,  কত ডিগ্ৰি, কত মেহনত  তা সে জানে। তাই সে স্যারেদের সামনে মাথা নিচু করে কথা বলে শিক্ষাকে সম্মান জানায়। লাইব্রেরীতে মাঝে মাঝে বইয়ের ধুলো ঝেড়ে গুছিয়ে রাখতে ডাক পড়ে তার। এত বইয়ের মাঝে উদাস হয়ে কখনো ভাবে কলেজে কাজ করতে না এলে জানতেই পারত না এত রকমের বই হতে পারে। জানবেই বা কী করে গ্ৰামের স্কুলে পড়াশোনা। অল্প বয়েস থেকেই চাষের কাজে বাপকে সাহায্য করতে হয়েছে। ফলে চাষ বা পড়াশোনা কোনটাই ঠিক ঠাক হয়ে ওঠে নি। এসবের ভাবনার মধ্যেই একদিন ডাক দেন প্রিন্সিপ্যাল স্যার। এ মানুষটিকে বড় খাঁটি আর ভালো মানুষ বলেই মনে হয় বনমালীর। ঘরে ঢুকে নমস্কার করে দাঁড়াতেই  প্রিন্সিপ্যাল স্যার জিজ্ঞাসা করেন-

--বনমালী চাকরি করবি?

বনমালী কি বলবে! এই সামান্য পড়াশোনায় তাঁকে কে চাকরি দেবে! সে ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারে না। স্যার একটু থেমে বলেন-

--তুই তো কাজ কর্ম ভালই করিস। যখন তখন তোকে দরকারও পড়ে। তুই চাকরি করতে চাইলে কাল থেকেই বাগানের কাজে লেগে যা। আর আমার কাছে একটা দরখাস্ত করে দিয়ে যাস। এখন কিছুদিন কাজ কর। পরে আমি পার্মানেন্ট করে নেব।

   কিন্তু বনমালীর মাথায় কী ভাবনা চিন্তা আছে তা কেই বা জানে! মাথা চুলকে, আরো একটু বিনয়ী হয়ে বলে,

-- স্যার চাকরিই যখন দিবেন অপিস বা লাইবেরি তে দ্যান কেনে। ও বাগানের কাজ  আমার পছন্দ লয়।

--কিন্তু ও কাজ পেতে গেলে তোকে অপেক্ষা করতে হবে। এখনই অফিসে লোক নেওয়া তো হচ্ছে না। কিন্তু তুই এ কাজটায় জয়েন করলেই ভালো করতিস।

বনমালী আর এই চাকরি নিয়ে মাথা ঘামায় নি। প্রিন্সিপ্যাল স্যার ও এ নিয়ে তাকে জোরাজুরি করেন নি। কাজেই বনমালীর জায়গায় অন্যলোক বাগানের কাজে লেগেছে। বনমালী আগের মতই যখন ডাক পেয়েছে প্রতিদিনের মজুরীতে কাজ করে খুশি মনে টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। এভাবে কেটে গেছে আরো একটা বছর। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের চাকরি দেওয়ার প্রস্তাবটা যত দিন পার হয়েছে তত যেন বেশি করে বনমালীর মাথায় জেঁকে বসেছে। একদিন সাহস করে স্যারের চেম্বারে ঢুকে সে বলেই ফেলে,

--স্যার, আমার চাকরির ব্যাপারটা যদি একটু দ্যাখেন-

প্রিন্সিপ্যাল স্যার ছোট্ট একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন,

--কলেজে তো আর ফি বছর চাকরি হয় না বনমালী।কখনো সখনো দু-একটা হয়। যারা অনেকদিন অল্পটাকায় কাজ করে পরে তাদের পার্মানেন্ট করে নেওয়া হয়। দেখি অফিসে লোক নেওয়া হলে তোকে বোলব।

কিন্তু বনমালীর জন্য সে সুদিন আর আসে না। যথা সময়ে প্রিন্সিপ্যিল স্যার রিটায়ার্ড হয়ে যান।

কলেজে একটা ছন্দপতন ঘটে যায় যেন। এতদিন প্রিন্সিপ্যাল স্যারের উদ্যোগে কলেজ এক ধারায়  চলেছে এখন আর একরকম। কলেজেরই এক অধ্যাপক প্রিন্সিপ্যাল ইনচার্য  হয়েছেন। ধীরে ধীরে কলেজের গতি অন্যধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করেছে‌।কিন্তু বনমালী তার নিজের খেয়ালে আগের মতই আসা যাওয়া বজায় রেখেছে। প্রিন্সিপ্যাল ইনচার্য প্রশান্ত বাবুও শান্ত , ধীর স্থির মানুষ। বনমালীকে তিনিও ভালোমতোই  চেনেন। কিন্তু তিনি ও লক্ষ করেছেন, ইদানিং বনমালীর আচরণ কেমন যেন একটু অন্যরকম ঠেকছে। কাজের মাঝে  মাঝেই তাঁর ঘরে ঢুকে এক নাগাড়ে বলে চলে,

--স্যার আমার ব্যাপারটা একটু দেখবেন। চাকরিটা না পেলে মরে যাব স্যার। আপনি তো সব জানেন... ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রশান্ত বাবু তাকে আস্বস্ত করেন, সুযোগ পেলে তিনি নিশ্চয় চেস্টা করবেন। বনমালীকে তিনিও কম স্নেহের চোখে দেখেন না। কিন্তু কি আর করা যাবে‌। এমনিতেই কলেজের ফাণ্ডের অবস্থা ভালো নয়। এই অবস্থায় লোক নিয়োগ করবেনই বা কী ভাবে!


কিন্তু সময় থেমে থাকে না। দেখতে দেখতে প্রশান্তবাবুর ও সময় পার হল। আবার ও প্রিন্সিপ্যাল ও প্রিন্সিপ্যাল ইনচার্য মিলিয়ে সংখ্যা বাড়তে বাড়তে কত তম তে এসে দাঁড়িয়েছে তা প্রিন্সিপ্যাল রুমের সুদৃশ্য বোর্ডে লেখা আছে। তার হিসাব বনমালী রাখে না। তার সময় সেই বিশ বছর আগের কলেজেই থেমে আছে। বনমালীর তত্বাবধানে বেড়ে ওঠা গাছ গুলোও যেন কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে পা দিয়েছে। সেই সবুজে ঘেরা বনানী কলেজের সৌন্দর্যকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সারাবছর পাখির কল কাকলিতে ভরে থাকে কলেজ চত্বর। কলেজ পরিসরে এবং সদশ্য সংখ্যায় এখন অনেক বিস্তৃত। প্রত্যেক বছর নতুন একদল ছাত্রছাত্রী ভর্তী যেমন হয় তেমনি বিদায় নেয় আর একদল। শিক্ষকদের মধ্যে এই আসা যাওয়াটা অনেক কম। তবুও নতুন ও পুরানো মিলিয়ে অধ্যাপক অধ্যাপিকার সংখ্যা  এখন অনেক। কিন্তু নতুন বা পুরাতন যাই হোক না কেন বনমালীকে সবাই এক ডাকে চেনে।

এ বছরের মত কলেজে ভর্তি শেষ। দুমাস যেতে না যেতেই নবীন বরণ, সোসাল ও হয়ে গেল ঘটা করে।
বাকি শুধু ইলেকশন, ছাত্রসংসদ  নির্বাচন। এবারের নির্বাচন আগের পাঁচটা নির্বাচনের মত নয়। যুযুধান দুই পক্ষ কেউ তৃণাগ্ৰ ভূমি ছেড়ে দিতে রাজি নয়। অনেক আগে থেকেই সে প্রস্তুতি চলছে। সেশন শুরু হওয়ার পর থেকেই  মিটিং, মিছিল , তর্কাতর্কি , হাতাহাতি নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখতে দেখতে ভোটের সময় উপস্থিত । জানুয়ারি মাস।  ঠাণ্ডা ভালই। মাঝে মাঝেই উত্তুরে হাওয়া শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এরই মধ্যে কলেজ চত্ত্বরে গরম হাওয়া। দুই পক্ষ সমস্ত আসনেই নমিনেশন দিয়েছে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই আর ঝামেলার আশংকায় অনেকেই ভোটের দিন পিছটান দেবে বলে মনে মনে স্থির করেই রেখেছে।


ভোটের দিনে সকাল ন'টা থেকেই কলেজের অধ্যাপক ,অধ্যাপিকা ও শিক্ষাকর্মীরা এসে গেছেন।  কলেজের দুপ্রান্তে দুই পক্ষের ছেলে মেয়েরা জড় হয়েছে।  মাঝে মাঝেই ইতি উতি অচেনা মুখের আনাগোনাও চোখে পড়ছে। যথা সময়ে ব্যালটে ভোট নেওয়া শুরু হয়েছে। ঘন্টাখানেক ভোট হওয়ার পরেই  চিৎকার চেঁচামেচি কলেজ প্রাঙ্গনের ঠিক বাইরে শোনা গেল। এক পক্ষের ছাত্রের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে অন্যপক্ষ। হঠাৎ দুটো বোম পড়ল। প্রচণ্ড শব্দ আর ধোঁয়ায় চারিদিক ভরে গেল। ভোট বন্ধ করে দিলেন প্রিন্সিপ্যাল স্যার। ধুলো , ধোঁয়া, চিৎকার চেঁচামেচিতে রণক্ষেত্র হয়ে উঠল কলেজ চত্বর। মুহুর্মুহু বোম পড়তে পড়তে একসময় অফিস ঘরের একপ্রান্তে কাগজ পত্রে আগুন ধরে গিয়ে দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করল। দূরের বারান্দা থেকে সকলেই দেখতে পেলেন, এর মধ্যেও প্রাণপনে কেউ যেন আগুন নেভানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। আবারও একটা বোম পড়ে জায়গাটা ধোঁয়ায় কুণ্ডলি পাকিয়ে গেল। একটা অস্ফুট আর্ত চিৎকার শোনা গেল শুধু। আরও ঘন্টাখানেক পরে পুলিশ ও দমকল এল। ছাত্রদের হটিয়ে জায়গা খালি করে ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা ওপরে উঠলেন। একে একে অন্যান্যরাও  অফিস ঘরের সামনে গিয়ে দেখলেন , খালিগায়ে আধপোড়া একটা দেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। গায়ের জমাটা দিয়ে আগুন নেভানোর প্রাণপন চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত নিভে গেছে নিজেই।


চাকরিতে যে শান্তি পাবে ভেবেছিল, মৃত্যুতে সে চির শান্তি  লাভ করেছে।


                     --------///--------///////------

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.