নাগপঞ্চমীর অজানা ইতিহাস : সঞ্চারী ভট্টাচাৰ্য

সঞ্চারী ভট্টাচাৰ্য

নাগপঞ্চমীর অজানা ইতিহাস 

সঞ্চারী ভট্টাচাৰ্য


নাগপঞ্চমী কবে উদযাপিত হয়?
নাগপঞ্চমী, শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণ পঞ্চমী অর্থাৎ পূর্ণিমার পরে; যে কৃষ্ণপক্ষ তার পঞ্চম দিন। নাগপঞ্চমীতে মনসাপুজোর রেওয়াজ আছে গোটা ভারতে। অনন্ত নাগ; বাসুকি নাগ; শঙ্খ নাগ; পদ্ম নাগ এমন সব কত কত নামের সর্পদেবদেবীর পুজো করা হয় এ দিন। ঘরের মূল প্রবেশ পথের দু’পাশে মনসা ডাল বা সিজ ভেঙে এনে রাখা হয়। এটি কাঁটা যুক্ত; ক্যাকটাস জাতীয় গাছ।

অনন্ত নাগ : ইনি শেষনাগ হিসাবে অভিহিত হয়ে থাকেন। এঁর ফণার সংখ্যা মোট ছয়টি এবং তা পদ্মফুলের মতো বিস্তৃত। পুরাণ মতে― নাগদের মধ্যে ইনিই সর্বশ্রেষ্ঠ।ইনি পৃথিবীকে ধারণ করে আছেন।ইনি যখন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তখন সমস্ত পৃথিবী কম্পিত হয়। কশ্যপ মুনির ঔরসে কদ্রুর গর্ভে ইনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এঁর স্ত্রীর নাম ছিল তুষ্টি। উচ্চৈঃশ্রবা নামক অশ্বের লেজের বর্ণ নিয়ে  কদ্রুর  সাথে বিনতার তর্ক হলে, কদ্রু অশ্বের লেজ কালো বলেন। কদ্রু তাঁর কথা সত্য প্রমাণিত করার জন্য, তাঁর সর্পপুত্রদের উচ্চৈঃশ্রবার লেজে অবস্থান করতে বলেন। অনন্ত মায়ের এই আদেশকে অগ্রাহ্য করে অভিশপ্ত হন। এই সময় তিনি তাঁর মাকে ত্যাগ করে গন্ধমাদন, বদরিকাশ্রম, গোকর্ণ, পুষ্কর, হিমবান প্রভৃতি পূণ্যতীর্থ ভ্রমণ করেন এবং এসকল তীর্থস্থানে কঠোর তপস্যা করেন। এই সময় তিনি বায়ুভক্ষণ, ব্রতপরায়ণ, জিতেন্দ্রিয় অবস্থায় তপস্যা করেন। ফলে তাঁর গায়ের মাংস, চর্ম এবং শিরাসমূহ শুকিয়ে যায়। ব্রহ্মা তাঁর এই কঠোর তপস্যার কারণ জানতে চাইলে, তিনি বলেন যে, পরলোকেও তাঁর সাথে এই দুর্জন ভাইরা যেন না থাকে এবং তপস্যার দ্বারা প্রাণ ত্যাগ করতে চান। ব্রহ্মা তাঁকে পাতালে গিয়ে পৃথিবীকে নিশ্চলভাবে ধারণ করতে বলেন। সেই আদেশ অনুসারে তিনি পাতালে গিয়ে পৃথিবী ধারণ করেন। এই সময় তিনি পাতালের নাগদের রাজা হিসাবে মনোনীত হন।ব্রহ্মা নাগদের শত্রু গরুড়ের সাথে বন্ধুত্ব ঘটিয়ে দেন।

মায়ের অভিশাপ থেকে তাঁর অন্যান্য ভাইদের রক্ষা করার জন্য তিনি উপায় অন্বেষণ করতে থাকেন। এই সময় এলাপত্র নামক এক নাগ অনন্তকে বলেন যে, অভিশাপদানকালে তিনি মায়ের কোল থেকে শুনেছিলেন— জরৎকারুর সন্তান আস্তীক মুনি সাপদের রক্ষা করবেন। এরপর অনন্ত জরৎকারু মুনিকে খুঁজে বের করেন এবং তাঁর সঙ্গে তাঁর নিজের বোনের বিবাহ দেন।উল্লেখ্য এই বোনের নামও ছিল মনসা।

কালিকা পুরাণ মতে― প্রলয় শেষে বিষ্ণু লক্ষ্মীর সাথে এই সাপের মধ্যম ফণায় শয়ন করেন এবং এর ফণাগুলো বিষ্ণুকে ছাতার মতো আচ্ছাদিত করে রাখে। এঁর দক্ষিণ ফণায় বিষ্ণুর উপাধান ও উত্তর ফণায় পাদপীঠ। বিষ্ণু পুরাণের মতে- বলরাম এনার অবতার। বাসুকির অন্যান্য নাম―অনন্তশীর্ষ, অহিপতি, অহিরাজ, অহীন, অহীশ্বর, বাসুকি, শেষনাগ। [সূত্র: মহাভারত। আদিপর্ব।ষটত্রিংশ-অষ্টাত্রিংশ অধ্যায়]



উচ্চৈঃশ্রবা :- ইনি হলেন একটি দৈবঘোটক৷ পুরাণ অনুসারে সমুদ্রমন্থনের সময় এই ঘোড়াটি মন্থনোত্থিত হলে দেবরাজ ইন্দ্র এঁর ওপর নিজের কর্তৃৃত্ব বিস্তার করেন৷ হিন্দু পুরাণ অনুসারে এটি সাতটি মাথাযুক্ত এবং উড্ডয়নক্ষম৷ এটিকে সর্বোৎকৃৃষ্ট ঘোড়া হিসাবে মান্যতা দেওয়া হয় এর আদিরূপে সমস্ত ঘোটককুলের রাজা হিসাবে গণ্য হয়৷উচ্চৈঃশ্রবাকে নিয়ে একাধিক মতামত হয়েছে, কারো মতে এটি সূর্য দেবতার বাহন তথা তার রথের অবস্থিত সাতটি ঘোড়ার একত্ররূপ, আবার কারো মতে এটি অসুররাজ মহাবলীরবাহন৷ পুরাণ মতে উচ্চৈঃশ্রবাকে শ্বেতঘোটক বা সাদা রঙের ঘোড়া হিসাবে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে৷

নাগপঞ্চমীর নেপথ্যের পৌরাণিক ইতিহাস (পুরাণে নাগজাতির বর্ণনা):-

মঙ্গলকাব্যে বর্ণিত নাগজাতির ইতিহাস :-

বাংলা মঙ্গলকাব্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যে কথাটি বলতে হয় তা হল মঙ্গল কাব্যগুলির মধ্যে 'মনসামঙ্গল'- কাব্য হলো সর্বাধিক প্রাচীন| মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে মনসামঙ্গল কাব্যের প্রকৃত উদ্ভবকাল নিরূপণ করা দুরূহ কাজ| কারণ সমাজে সর্প পূজাকে আশ্রয় করেই এই জাতীয় সাহিত্য গড়ে উঠেছিল| তাই সমাজে সর্পদেবতা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে মনসামঙ্গল কাব্যের ইতিহাস জড়িয়ে আছে| কিন্তু ভারতের সর্বোচ্চ সর্বদেবতা পরিকল্পনা অভিন্ন ঐতিহ্যের ধারা অনুসরণ করে বিকাশ লাভ করেছে, তাই এর প্রকৃতিও অত্যন্ত জটিল|

সভ্যতার আদি ও মধ্যযুগের মানুষের, বিশেষ করে আমাদের মতো ভারতীয় উপমহাদেশের বাসিন্দাদের, প্রকৃতি ও পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে নিবিড় যোগ ছিল৷ প্রকৃতি বলতে আমি গাছপালা, পশু-পাখি, জলাশয়, নদ-নদী, সমুদ্র— এই সব কিছুর কথাই বলছি৷ আমরা যত আধুনিক হতে শুরু করলাম, নগরায়নের দিকে এগোতে লাগলাম, এই যোগও ক্ষীণ হতে শুরু করল আর যে প্রাণীকুল এক সময়ে সব থেকে কাছে ছিল, তারাই বোধ হয় সবচেয়ে দূরে সরে গেল৷ প্রাণীটির নাম সাপ, অন্ধকারে যাদের নাম নিতে আজও গ্রামাঞ্চলের মানুষ ভয় পান৷

সর্প পূজার উৎপত্তি সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধের অন্ত নেই| পাশ্চাত্য পন্ডিত জে  ফার্গুসন তাঁর 'Tree and Serpent Worship' - নামক গ্রন্থে বলেছেন, সর্প পূজা সর্বপ্রথম ভারতবর্ষের বাইরে তুরানিয় জাতির মধ্যে উদ্ভূত হয়, তাই সর্প পূজার সঙ্গে আর্য জাতির মৌলিক কোন সম্পর্ক ছিল না| পরে আর্যরা  ভারতবর্ষে এসে তুরানি জাতির কাছে থেকে এই সর্প পূজার শিক্ষা লাভ করে| তবে কেউ কেউ মনে করেন, ভারতীয় নাগগণ একটি জাতি বিশেষ| তারা হয়তো সর্পকে জাতীয় অভিজ্ঞান রূপে ব্যবহার করত, এছাড়া সর্পের সঙ্গে তাদের আর কোন সম্পর্ক ছিল না| তাই নাগ এবং সর্প  একার্থবাচক শব্দ নয় | আবার কেউ কেউ মনে করেন যে,  ভারতবর্ষে জলদেবতাকেই সর্প  বলা হত| যদিও এই সকল মতবাদ অনুমান মাত্র। 

যেটি মূল কারণ বলে মনে হয় তা হলো ভারতীয় সর্পপূজার মূলে বহির্ভারতীয় কোন প্রভাব নেই।  এই দেশেই সর্প পূজার উদ্ভব হয়েছিল। কারণ সর্প গ্রীষ্মপ্রধান দেশের জীব| আর ভারতবর্ষ ও আফ্রিকা মহাদেশই প্রধানত গ্রীষ্মমন্ডলীয় অক্ষরেখার মধ্যে অবস্থিত।  আদিমকাল থেকেই এই দুই দেশ অগণিত সর্পের বাসভূমি।  ভারতবর্ষে সর্পের জাতিসংখ্যা আফ্রিকার তুলনায় অধিক সুতরাং এই দেশে যত ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির সর্পের উল্লেখ পাওয়া যায়, পৃথিবীর আর কোথাও তা পাওয়া যায় না| তাই একথা মেনে নিতে অসুবিধা হয় না যে, আদিম যুগ থেকেই সর্প এদেশে ভয় ও পূজার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে|

একথা সত্য যে, প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে নাগ এবং সর্প একার্থবাচক ছিল না | নাগ বলতে সম্ভবত গন্ধর্ব, কিন্নর, যক্ষ এই ধরনের কোন উপজাতিকে বোঝাত| আর সর্প বলতে প্রকৃত প্রাণীটিকে বোঝাত| অতএব নাগ আর সর্প সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র | আর্যত্তর  সমাজের মধ্যে সর্প পূজা প্রচলিত থাকলেও তার সঙ্গে যে আর্য সমাজের কোন সম্পর্ক ছিল না তা স্পষ্টতই অনুভব করা যায়| মহাভারতের মধ্যে নাগ একটি জাতি, তারা আর্য বিরোধী তাই আর্যদের সঙ্গে সর্বদা বিবাদে মেতে থাকত| সমাজে তখনো তারা দেবতা বলে পূজা পেতে আরম্ভ করেনি| এর পরবর্তীকালে সমাজ থেকে জীবিত সর্প পূজার স্বতন্ত্র ধারাটি নাগ ও সর্প এই দুটি শব্দের অর্থ- সাদৃশ্যের জন্য নাগ জাতির ঐতিহ্যের সঙ্গে এসে মিলিত হয়, ফলে সমাজে নাগ পূজার প্রচলন হয় | এইসময় থেকেই মহাভারতের নাগ জাতির অধিপতি বাসুকি সর্পরাজ রূপে পূজা পেতে থাকেন| এমনকি নাগরাজ বাসুকি ভগ্নি জরৎকারু মুনির পত্নী বাংলাদেশে সর্পদেবী মনসায় রূপান্তরিত হন|

সর্প পূজা ভারতের কোন জাতির মধ্যে সর্বপ্রথম উদ্ভূত হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়| আর্য সভ্যতায় যে প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় তার মধ্যে সর্প পূজার কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায় না| প্রাচীনতম বৈদিক সাহিত্যে অর্থাৎ ঋকবেদের মধ্যে সর্পের উল্লেখ আছে তা সত্য, কিন্তু সর্প পূজার উল্লেখ নেই| কিন্তু এর পরবর্তী রচনা যজু ও অথর্ববেদে সর্পের বিস্তারিত উল্লেখ পাওয়া যায়| আবার অথর্ববেদে সর্প সম্পর্কিত কতগুলি মন্ত্রের উল্লেখ আছে| তাই একথা অনুমান করা যেতে পারে যে, বৈদিক যুগের পর থেকে আর্য সমাজে সর্প পূজার প্রচলন শুরু হয়| এই সর্প পূজাকে কেন্দ্র করেই বাংলা সাহিত্যে মনসা দেবীর গান কাব্যের মর্যাদা লাভ করে| যা 'মনসামঙ্গল'- কাব্য নামে সুবিদিত|

মনসামঙ্গলের আদি রচয়িতা কে! এই নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না| তবে খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে কবি বিজয়গুপ্ত যে কাব্যখানি রচনা করেছেন তাতে বলা হয়েছে, " প্রথমে রচিলা গীত কানাহরি দত্ত "- অর্থাৎ পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্বেই মনসামঙ্গল কাব্য লেখার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল| এর কারণ স্বরূপ বলা যেতে পারে দ্বাদশ শতাব্দীতে ও তার পরবর্তীতে দেবদেবীর মাহাত্ম্য সূচক যে সংস্কৃত উপপুরাণগুলি রচিত হয়েছিল যেমন- পদ্মপুরাণ, দেবী-ভাগবত,  ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, এগুলিতে মনসা দেবীর উল্লেখ আছে| তাই এটা ধরে নিতে হয় যে আনুমানিক খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই 'মনসামঙ্গল'- কাব্য লেখা শুরু হয়|

গরুড় পুরাণে বর্ণিত নাগজাতির ইতিহাস :-

গরুড় পুরাণ থেকে জানা যায়; ব্রহ্মার পুত্র কাশ্যপ মুনির তৃতীয় স্ত্রী রুদ্র ছিলেন নাগ বংশের কন্যা। তিনিই নাগকুলের জননী। অন্যদিকে কাশ্যপ মুনির অন্য এক স্ত্রী জন্ম দেন গরুড়ের। এই কারণে; রুদ্র অত্যন্ত বিরূপ ছিলেন তাঁর প্রতি। ছোটবেলা থেকে মায়ের প্রতি দ্বিচারিতা দেখে; গরুড় প্রতিজ্ঞা করে নাগ কূলকে ধংস করবে।প্রায় সমস্ত বিদ্বান এই ব্যাপারে এক মত যে; নাগ ভারতের অত্যন্ত প্রতাপী জাতি। আধুনিক নাগ এই নাগ প্রজাতিরই বংশজ। পুরাতত্ত্ববিদের মতে; নাগবংশী নাগলোক সমুদ্রতল অথবা গোড়া থেকেই উষ্ণকোটিবন্ধীয় পর্বতমালায় থাকতেন। তারা খুব পরিশ্রমী; এবং জ্ঞানী ছিলেন।

মহাভারতেও এই নাগেদের উল্লেখ আছে। কথিত আছে; নাগ কন্যা খুব সুন্দরী হতেন। তৃতীয় পাণ্ডব; অর্জুনের স্ত্রী উলুপি ছিলেন; এমনই এক নাগকন্যা। ভারতের পাশাপাশি চীনেও নাগলোক নিজের সম্বন্ধ বিস্তার করেছিল। ভারতের মতো সেখানেও তাদের পূজো হয়|মহাভারতে জানা যায়; কুরু বংশীয় রাজা পরীক্ষিত তক্ষক নাগের আঘাতে মারা গেলে তাঁর পুত্র জন্মেজয় প্রতিজ্ঞা করেন পৃথিবী থেকে নাগ বংশকে ধ্বংস করবেন। তিনি এক যজ্ঞ শুরু করেন; যেখানে হাজার হাজার সাপ যজ্ঞের আগুনে এসে পড়তে থাকে। জরৎকারু মুনির পুত্র আস্তিকের হস্তক্ষেপে এই যজ্ঞ বন্ধ হয়। যে দিনটিতে সর্প যজ্ঞ বন্ধ হয়; সেই দিনটা ছিল শ্রাবণ মাসের শুক্ল পঞ্চমী।পারিবারিক উন্নতি ও কুশলের জন্য; এই পূজাকে অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করে লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী। উত্তর ভারতের বহু জায়গায়; নাগ পঞ্চমী উপলক্ষে সাপকে দুধ খাইয়ে পূজা করা হয়। এই পূজার বিভিন্ন ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়।

আমাদের পুরোনো সাহিত্য-সংস্কৃতিতে কিন্তু সর্পঘনিষ্ঠতার যথেষ্ট নিদর্শন রয়েছে৷ ‘মহাভারত’ ও ‘ভাগবত’-এ কৃষ্ণকে যেমন বিষ্ণুর অবতার বলা হয় তেমনই কৃষ্ণ অগ্রজ বলরামকে বলা হচ্ছে শেষনাগ অর্থাৎ বাসুকীর অবতার৷ পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, বিষ্ণুলোকে ক্ষীরোদসাগরে অনন্তনাগের কোলে নারায়ণ অধিষ্ঠান করেন৷ সম্প্রীতির নিদর্শন আরও আছে— প্রাচীন সাহিত্যে দেবাদিদেব মহাদেব, যিনি কৈলাসবাসী, অর্থাৎ পাহাড়ের দেশের অধিবাসী, তাঁর রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে ঋষিরা বলছেন, তাঁর গলায় সাপ জড়ানো, মানে তিনি সাপের কণ্ঠ  বেষ্টনী ব্যবহার করে থাকেন৷ ‘মহাভারত’-এই পাচ্ছি বিষ্ণুর বাহন গরুড় সাপের চিরবৈরী, অথচ গরুড়ের গুরুদেব, স্বয়ং নারায়ণ অনন্তনাগের পালঙ্কে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যান৷

দ্বাপরযুগে এসে ‘মহাভারত’-এর আদিপর্বে সাপ ও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে একটা উপাখ্যান পাচ্ছি— কুরুপাণ্ডবের বাল্যকালে, ভীমের পরাক্রমে ঈর্ষান্বিত দুর্যোধন তাঁকে বিষাক্ত মিষ্টান্ন খাইয়ে জলে ফেলে দিয়েছিলেন৷ কালকূটে আচ্ছন্ন ভীমসেন জলের তলায় নাগরাজ্যে গিয়ে পড়েন৷ সেখানে অসংখ্য বিষধর সাপ তাঁকে দংশন করায় বিষে বিষক্ষয় হয়ে মধ্যম পাণ্ডব নিজ শক্তি ফিরে পান এবং তখন তাঁর দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে নাগকুল তাঁকে সর্পরাজ বাসুকীর কাছে নিয়ে যায়৷ বাসুকী ভীমের পরিচয় জানতে পেরে পরম প্রীত হয়ে স্বজাতির কাছে ভীমকে নিজের দৌহিত্র বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং বিশেষ আপ্যায়ন করে ভীমের সামনে অমৃতের ভাঁড়ারঘর খুলে দেন৷ ভীম আট চৌবাচ্চা, মতান্তরে কুম্ভ, অমৃত পান করে অযুত হস্তীর বল লাভ করেছিলেন৷ উপযুক্ত বিশ্রামের পরে নতুন জামাকাপড় পরিয়ে বাসুকী তাঁকে মর্ত্যলোকে পাঠিয়ে দেন৷

‘মহাভারত’-এর এই উপাখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, মানুষ ও নাগের মধ্যে সম্পর্ক কতটা ঘনিষ্ঠ ছিল৷ এই মহাকাব্যেই আরও একটু এগিয়ে আদিপর্বেই পাচ্ছি আর একটা কাহিনি— তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন, বংশের রক্ষণশীল মানসিকতার বিরুদ্ধাচারণ করার জন্য দ্বাদশবর্ষকালীন বনবাস ও ব্রহ্মচর্য স্বীকার করে পরিব্রাজনে বেরিয়ে হরিদ্বারে গঙ্গাস্নান করার সময়ে নাগরাজকন্যা উলূপী তাঁকে দেখতে পান এবং অর্জুনের রূপে মোহিত হয়ে তাঁকে পাতালে নিয়ে গিয়ে বোঝান যে, ব্রহ্মচর্য কেবলমাত্র দ্রৌপদীর জন্য, এখানে তাঁকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করে  ফেললে অর্জুনের ব্রতভঙ্গ হবে না৷ উলূপীর কথায় মোহিত হয়ে তিনি সেই রাতটা উলূপীর সঙ্গে কাটিয়ে পরের দিন সকালে আবার হরিদ্বার ফিরে যান|কোনও বিবাহ অনুষ্ঠান হয়েছিল কি না, সে বিষয়ে মহাভারতকার নীরব৷ কিন্তু উলূপী ঘোর আধুনিকা ছিলেন, মাত্র এক রাতের শয্যাসুখের জন্য কুমারী মা হতেও রাজী ছিলেন৷ এই মিলনের ফসল অর্জুনপুত্র ইরাবান, যিনি পিতার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন, এমনকী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষে লড়ে প্রাণও দিয়েছিলেন |

অর্জুনের পরবর্তী গন্তব্য ছিল উত্তরপূর্ব ভারতের মণিপুর, যে অঞ্চলের অনেক লোককথায় আজও সাপ ও মানুষের মধ্যে গভীর সম্প্রীতির কাহিনী বর্ণিত রয়েছে৷ ‘মহাভারত’-এর শেষভাগে, যদুবংশ ধ্বংসের সময় দ্বারকায় বটবৃক্ষের নীচে যোগসমাহিত বলরামের মুখ দিয়ে এক সহস্রফণা রক্তবর্ণ মহাসর্প বেরিয়ে এসে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে আর সেই সঙ্গেই বলরামের জীবলীলাও শেষ হয়ে যায়৷

এই নাগেরা সম্ভবত ছিল এক পরাক্রান্ত প্রাচীন উপজাতি, নবাগত আর্যদের সঙ্গে তাদের ভালবাসা-মন্দবাসা দুই-ই চলত৷ ভালবাসার গল্প এতক্ষণ বললাম, ঝগড়া শুরু হল পরবর্তীকালে এবং বৈরিতা তুঙ্গস্পর্শ করেছিল পাণ্ডবপৌত্র পরীক্ষিতের সময়ে, যখন নানা কৌশলে তক্ষকনাগ পরীক্ষিতকে হত্যা করে৷ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পরীক্ষিতের ছেলে জন্মেজয় সর্পবধ যজ্ঞ শুরু করেন৷ সাপের বংশ লুপ্ত হতে চলেছে দেখে জরৎকারু মুনির পুত্র আস্তিক কোনওমতে তাঁকে নিরস্ত করেন৷ যেদিন সর্পবধ যজ্ঞ বন্ধ হয়েছিল, সেই দিনটি এখনও ‘নাগপঞ্চমী’ বলে সমাদৃত৷ সেই দিনটিতে সাপবংশ বিশেষভাবে পূজিত হলেও নাগজাতির প্রতিপত্তি কিন্তু জন্মেজয়ের যজ্ঞের ফলে মোটামুটি শেষ হয়ে গেছিল৷ যারা কোনওমতে টিকে গেছিল, তবে তারা আর্যদের অত্যাচারে ভিটে-মাটি ছেড়ে পাহাড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে প্রাণে বেঁচেছিল৷

‘নাগ’ শব্দের ব্যুৎপত্তি হল ‘নগ’ (পর্বত বা বৃক্ষ)+অ প্রত্যয়৷ ভাবার্থে, অর্থাৎ সহজ ভাষায়, যারা পাহাড়ে বা গাছের কোটরে বাস করে৷ হয়তো এদের টোটেম ছিল সাপ, তাই কালক্রমে দু’টি শব্দের মানে এক হয়ে গেছিল৷ হয়তো উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের নাগা উপজাতি এদের থেকেই উদ্ভূত ৷ এখনও ভারতের বহু এলাকায় নাগ পদবী প্রচলিত আছে৷ ‘নাগ’ শব্দের সঙ্গে নাগা সন্ন্যাসীদের কোনো সম্পর্ক কিন্তু নেই ৷ নাগা সন্ন্যাসী মানে একেবারেই আলাদা, তাদের সঙ্গে সরীসৃপের কোন সম্পর্ক নেই৷ সেখানে নাগা মানে ‘নঙ্গা’ অথবা নগ্নের অপভ্রংশ৷ ‘নাগ’ শব্দের আর একটি অর্থ হল হাতি, তবে এর ব্যবহার তুলনায় সীমিত৷ সাপের সঙ্গে হাতির বোধহয় একমাত্র সাদৃশ্য হল দু’জনেরই মাথায় মণি পাওয়া যায় বলে প্রবাদ আছে৷

নেপালের উপকথায় বর্ণিত নাগজাতির ইতিহাস :-

সুদূর সত্যযুগের কাহিনি৷ আকাশছোঁয়া হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে ছিল এক বহু যোজনবিস্তৃত জলাশয়৷ সেই জলাশয়ের অধীশ্বর ছিল নাগেরা, তারা তাদের অতুল ঐশ্বর্য নিয়ে সেই জলাশয়ের নীচে বাস করত, তাই এর নাম ছিল নাগহ্রদ৷ সেই পবিত্র ভূখণ্ডে বহু সিদ্ধপুরুষ যাতায়াত করতেন৷ একদিন সেখানে এলেন সপ্ত আদিবুদ্ধের প্রথম বুদ্ধ মহামুনি বিপশ্বীন৷ তিনি একটি পদ্মবীজ জলাশয়ের কেন্দ্রে নিক্ষেপ করে বলে গেলেন— যেদিন এই ফুল ফুটবে, সেদিন স্বয়ম্ভু বুদ্ধ এখানে এক অগ্নিশিখারূপে দেখা দেবেন৷ তিনি আরও ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে, চীনদেশ থেকে বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রী এসে এই এলাকার আমূল সংস্কার করবেন৷ (জানিয়ে রাখি, এই বোধিসত্ত্বটি এক দাপুটে পুরুষপুঙ্গব ছিলেন, যদিও মঞ্জুশ্রী নামটি শুনে আমরা তাঁকে স্ত্রীলিঙ্গ মনে করি) |

আরও কয়েক শতাব্দী পরে বোধিসত্ত্ব এলেন, তাঁর এক হাতে প্রজ্ঞাপুস্তক, অন্যহাতে মহাপরাক্রমী চন্দ্রহাস তরবারি ৷ চারদিক ঘুরে দেখে তাঁর মনে হল, পবিত্র শিখার প্রকৃত উপাসনার জন্য হ্রদের জল নিষ্কাশন করতে হবে৷ তিনি দশ দিক কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছেড়ে তাঁর তরবারি দিয়ে আশপাশের পাহাড়গুলিকে দ্বিখণ্ডিত করে দিলেন৷ হু হু করে জলাশয়ের জল বেরিয়ে চলে গেল ভারতভূমির দিকে৷বিপন্ন নাগেরা মঞ্জুশ্রীরই শরণ নিল৷ তিনি বললেন— বৃহত্তর কল্যাণের জন্য তাদের এটুকু ক্ষতি মেনে নিতে হবে, তবে তারা যেন এলাকা ছেড়ে চলে না যায়, তাদের উপযুক্ত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা তিনি করবেন৷ বোধিসত্ত্ব জানতেন, নাগেরা বৃষ্টি, ধনরত্ন ও আরও অনেক কিছুর রহস্য জানে, তাদের চটালে ওখানে ধর্মসংস্থাপনা সম্ভব হবে না৷ মঞ্জুশ্রীর পরামর্শে নাগেরা সপরিজন উঠে এল পাশের তাওদা জলাশয়ে, সেখানে তারা নাকি আজও পরমসুখে বাস করছে৷ জল সরে যাওয়ার পরে গোটা জায়গাটা একটি সুন্দর উপত্যকা হয়ে উঠল৷ সেখানে একটি সুন্দর শহরও গড়ে উঠল৷ প্রথমে একে বলা হতো মঞ্জুপত্তনম্, তারপরে শহরের সুদৃশ্য কাঠের প্রাসাদগুলির জন্য ‘কাষ্ঠমণ্ডপম্’ বলে জায়গাটি পরিচিতি পেল, কালক্রমে কাষ্ঠমন্ডপম্ থেকে কাঠমান্ডু নামটি পাকাপাকি হয়ে গেল৷ ইতিহাস বলছে, কাঠমান্ডু উপত্যকা সৃষ্টি হয়েছিল খ্রিস্টজন্মের প্রায় এক লক্ষ বছর আগে৷

বিষ্ণুপুরাণে বর্ণিত নাগজাতির ইতিহাস :-

অসুরদের সাথে যুদ্ধে যখন দেবতারা হেরে যান, এবং স্বর্গ রাজ্য থেকে বিতারিত হন, তখন তারা নারায়নের স্তব করতে শুরু করেন। নারায়ণ এসে ব্রহ্মাকে বললেন যে সমুদ্রকে যদি মন্থন করা হয় তবে তার থেকে অমৃত পাওয়া যাবে। সেই অমৃত পান করে সমস্ত দেবতাগণ অমর হয়ে যাবে। স্বর্গ রাজ্য পুনরুদ্ধার অচিরা সফল হবে।তাই যাও, গিয়ে দেবতা আর অসুর মিলে সমুদ্রকে মন্থন কর। তোমরা অসুর দের কি ভাবে দিকভ্রষ্ট করবে সেটা ঠিক করে নাও কেননা একা দেবতা গোষ্ঠীর শক্তি নেই সে এই বিরাট কাজটাকে শেষ করতে পারবে। অমৃত পেলে পরে আমি তাঁর ব্যবস্থা করব যাতে তোমরাই সমস্তটা পেতে পার। নারায়নের এই কূটবুদ্ধিযুক্ত মন্ত্রণা পেয়ে দেবতারা উল্লসিত হলেন আর ঠিক করলেন যে সমূদ্র মন্থনের কাজ শুরু করা হোক।

কিন্তু কি দিয়ে মন্থন করা হবে?  আবার নারায়ণ বুদ্ধি দিলেন মন্দার পর্বতটাকে নিয়ে গিয়ে সেটাকে দিয়ে মন্থন কর। মন্দার পর্বতের কাছে গিয়ে দেখা গেল সে এক অতি বিশাল পর্বত। এগার হাজার যোজন উঁচু, তেমনি তার বেড়। তাকে কি করে নড়ান যাবে। সবাই মিলে চেষ্টা করে বিফল হল।তখন বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলে বিষ্ণুর পরামর্শ অনুযায়ী নাগরাজ বাসুকী গিয়ে মন্দার পর্বতকে উপড়ে নিয়ে এলেন আর সেই পর্বতকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হল। কিন্তু পর্বত তার নিজের ওজনে সমুদ্রে ডুবে যেতে লাগল। বায়ুকে বলা হল তুমি শক্তিধর আছ, তুমি এটাকে ধরে রাখ। বায়ু বলে মন্দার পর্বত এত মোটা যে আমি তাকে হাতের বেড়ে পাবনা। তাই ধরে রাখতে পারব না। ওদিকে পর্বত তো ক্রমশঃ ডুবে যাচ্ছে।

তখন সমুদ্রে এক কূর্মরাজ থাকতেন। তাকে নানান স্তব করার পরে তিনি রাজী হলে তাঁর উপরে মন্দার পর্বতকে বসান হল। বসানোর আগে ইন্দ্র অবশ্যি মন্দার পর্বতের তলার দিকটাকে তাঁর বজ্র দিয়ে সমান করে কেটে  দিলেন যাতে পর্বতকে কূর্মের পিঠে বসান যায়। কিন্তু এই সব দেখে সমুদ্ররাজ বললেন যে, এই মন্থনে তো আমার অনেক ক্ষতি হতে পারে। তা আপনারা যখন অমৃত পাবেন তখন যেন আমাকেও তাঁর একটু ভাগ দেওয়া হয়।বাসুকী নাগকে বলা হল, তুমি হবে দড়ি। অসুরেরা বলল যে লেজ নিকৃষ্ট জায়গা অতএব আমরা মুখের দিকটা ধরব। তখন বাসুকির লেজ ধরল দেবতারা আর ফণা ধরল অসুরেরা। টানাটানির চোটে বাসুকির দীর্ঘশ্বাস নির্গত লাগল। তাঁর সেই নিঃশ্বাস ধোঁয়া হয়ে মেঘের সৃষ্টি করল।

মন্থনের চোটে জল এত আলোড়িত হতে লাগল যে সেখানে যত জলচর ছিল, তারা মারা গেল। পাহাড়ের গাছপালা গুলোতে আগুন লেগে গেল। তখন দেবতারা প্রার্থনা করায় মেঘের থেকে বৃষ্টি এসে আগুন নিভিয়ে দিল। আর ঘষাঘষির ফলে যে সমস্ত গাছ পিশে যেতে লাগল, তাদের রস জলে পড়ায় জলের প্রাণীরা আবার তাদের জীবন ফিরে পেল। এত সব কান্ড করে সবাই ভীষণ পরিশ্রান্ত হল কিন্তু অমৃত পাওয়া গেল না।
ব্রহ্মা তখন আবার বিষ্ণুর শরনাপন্ন হলে বিষ্ণুর বরে আবার সবাই গায়ে জোর পেয়ে মন্থন কাজ শুরু করল। এইবার কিছু কিছু করে সমুদ্র থেকে জিনিষ বার হতে শুরু হোল। কিছুক্ষনের মধ্যে চন্দ্রমা বা চাঁদের উৎপত্তি  হল, তার পরে এল ঐরাবত, চারটে বিরাট দাঁত, সাদা রঙ, পর্বত প্রমাণ বৃহদাকার গড়ন। এর পরে এল উচ্চৈশ্রবা ঘোড়া, কালো  রঙ। তারপরে পারিজাত পুস্প, তার পরে এলেন ধণ্বন্তরী অমৃতের কলসী কোলে করে। সবাই আরও চাই আরও চাই করে টেনেই যাচ্ছে।

এদিকে সমুদ্ররাজ বরূন দেবতাকে  এসে নালিশ করে বললেন যে সমস্ত জলপুরী তোলপাড় করে যে মন্থন হচ্ছে তাতে তো আমার সব কিছু ধংস হয়ে যাচ্ছে। তখন বিষ্ণু বললেন দুর্বাসার শাপে লক্ষী দেবী তোমার কাছে ছিলেন। এখন যদি লক্ষী দেবীকে নারায়ণের কাছে ফেরত পাঠাও তবে তিনি মন্থন বন্ধ করে দেবেন।এই শুনে সমুদ্ররাজ বরূন তাড়াতাড়ি লক্ষী দেবীকে চতুর্দোলায় চড়িয়ে সমুদ্রের থেকে বার করলেন। নারায়ণ লক্ষীদেবীকে পেয়ে গেছেন, অমৃত নিয়ে ধণ্বন্তরিও এসে গেছেন, অতএব নারায়ণ মন্থন বন্ধ করার আজ্ঞা দিলেন। মন্থন বন্ধ হল।ওদিকে সমস্ত দেবতা আর অসুরেরা সাগর মন্থনে ভাগ নিয়েছে, কিন্তু শিবকে কেউ ডাকেওনি আর কিছু দেবার কথাও বলেনি। নারদ তাই দেখে শিবের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়ে বললেন, "হে মহাদেব, আপনি কি জানেন যে সমূদ্র মন্থন করে দেবতা আর অসুরেরা যে যা পাচ্ছে তাই নিয়ে নেবার কথা ভাবছে। আপনি কি কিছু পেয়েছেন বা আপনাকে কি কেউ কিছু দিয়েছে?

শিব কিছু বললেন না কিন্তু দেবী ত্রিলোচনা রাগে খেঁপে গিয়ে নারদ কে বললেন যে কাকে তুমি এই সব কথা বলছ? এই মহাশয়ের কি এসব দিকে কিছু খেয়াল আছে। ওনাকে কেউ ডাকল কি না তাতে ওনার কিছু এসে যায় না। এই জন্যই আমাকে দক্ষের সভাতে দেহত্যাগ করতে হয়েছিল।গঞ্জনা শুনে শিব হেঁসে বলেন, যা অন্যেরা চায় না সেটাই তো আমার ভূষণ। দেখনা বাঘের চামড়া কেউ নিল না, তাই সেটা আমার পরিধান। সবাই অগুরু চন্দন ইত্যাদি নিল, তাই ছাইভষ্ম আমার অঙ্গের ভূষণ, সেই রকম ধুতুরা ফুল, অস্থির মালা এই সবই আমার আভূষন।দেবী বলেন এই সব তোমার স্তোক বাক্য। ও সব কথা যদি এক গৃহী বলে তবে চলে, তোমার মুখে নয়। তোমাকে অন্য দেবতারা অবহেলা করে বলেই তোমাকে কোন খবর দেয়নি।

এইসব শুনে রাগে শিবের মাথা গরম হয়ে যায় । সাধে কি আমরা বলি নারদ নারদ। যত ঝগড়া বাঁধানোর মূলে কিন্তু এই দেবতাটি। শিব নন্দীকে বললেন আমার রথ অর্থাৎ ষাঁড়টাকে  সাজাও। আমি যাচ্ছি। কিন্তু কি ভাবে যাচ্ছি। যেন যুদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে।যেখানে যত ভূতপ্রেত, যারা শিবের অনুচর, তারা চারদিক থেকে এসে হাজির। সাথে কার্তিক ময়ূরে চড়ে,গনেশ তাঁর ইঁদুর বাহনে, সাথে নন্দী ভৃঙ্গী, সবাই গিয়ে সাগর পারে হাজির হলেন।তিনি গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বলি ব্যপারটা কি হচ্ছে? কি সব সমুদ্র মন্থন না কি সব হচ্ছে। কি ব্যপার? ইন্দ্র বললেন, সমুদ্রমন্থন হচ্ছিল, এখন শেষ হয়েছে। নারায়ণ আমাদের দিয়ে সমুদ্রমন্থন বন্ধ করিয়ে তাঁর বাড়ি গেছেন।

শিব রেগে বললেন, যে তোমাদের এত আস্পর্ধা, আমাকে কিছু না জানিয়ে মন্থন শেষ করলে। আর যা পেয়েছ, তা সব নিজেরাই নিয়ে নেবে, এটা কি করে হয়। আবার শুরু করা হোক। সব চুপ। কারুর মুখে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না।তখন কশ্যপ মুনি বললেন, দেখুন মহাদেব, আগে দুর্বাসা মুনি ইন্দ্রকে একটা মালা দিয়েছিল পড়বার জন্য। কিন্তু ইন্দ্র সেটাকে তাঁর হাতির মাথায় রেখে দেবার পরে হাতী সেটাকে মাটিতে ফেলে দেয়। দুর্বাসা মুনি খেঁপে  গিয়ে শাপ দেন সমস্ত দেবতা ও  দেবীরা তাদের শক্তি হারাবেন আর লক্ষী দেবী সাগরে গিয়ে থাকবেন।

শক্তি হারানোর পরে দেবতারা তাদের রাজ্য হারান। পরে তারা নারায়ণকে পূজা করে তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ পান যে সাগর মন্থন করলে তারা তাদের হারান শক্তি ফিরে পাবেন। নারায়ণ সাগর মন্থনের আজ্ঞা দিয়েছিলেন, লক্ষী দেবীকে পেয়ে সাগর মন্থন বন্ধ করিয়ে নারায়ণ বাড়ি গেছেন। এখন আপনি আবার বলছেন মন্থন শুরু করতে।এদিকে সবাই ক্লান্ত, নাগরাজের সমস্ত হাড়গোড় ভেঙে চুরমার, মুখ দিয়ে লালা বেরোচ্ছে । বরুণ দেবের ঘরবাড়ি সব নষ্ট হয়ে গেছে, এর পরে আর একবার মন্থন করবার জন্য বলবেন না।

শিব বললেন, আমি এসেছি আমার জন্য অন্তত আর একবার শুরু করো । শিবের কথা না মানলে বিপদ তাই আবার শুরু হল। এইবার কিন্তু টানাটানির চোটে নাগরাজের মুখ থেকে বিষ বার হতে শুরু হল। মন্দার পর্বতে ঘষাঘষির ফলে দাবানল জ্বলে উঠল। সব দেবতারা পালাতে শুরু করল।বিষে সমস্ত চরাচর বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে দেখে দেবতাদের স্তুতিতে তুষ্ট হয়ে শিব এক চুমুকে সেই বিষটাকে নিয়ে নিজের গলাতে রাখলেন, পান করলেন না। তাই থেকে তাঁর নাম হল নীলকন্ঠ।তখন শিব আদেশ করলেন যে এবার আর মন্থন করে কাজ নেই, মন্দার পর্বত নিয়ে যেখানে ছিল সেখানে নিয়ে গিয়ে রাখ। কারুর আর গায়ে জোর নেই, শেষ পর্যন্ত শিব নিজেই মন্দার পর্বতকে নিয়ে তাঁর জায়গাতে রেখে দিলেন।

কিন্তু যে জিনিষগুলো মন্থনে বার হল সেগুলোর কি বাটোয়ারা হল!লক্ষী তো নারায়ণের কাছে গেল। রম্ভা, মেনকা, ঊর্বশী এরা সব দেবলোকে গেল। সুরা দেবী অসুরের দিকে গেল। কামধেনু গেল বিষ্ণুর ভাগে। ঐরাবত গেল ইন্দ্রের কাছে আর উচ্চৈঃশ্রবা গেল অসুরদের কাছে। মণিমানিক্যের মধ্যে কৌস্তুভ নিলেন বিষ্ণু। পারিজাত গেল দেবলোকে। চন্দ্র গেল শিবের জটায়। আর অসুরেরা একজোট হয়ে সুধার কলসী নিয়ে নিল।বিপদ দেখে শিব বলে ঝগড়া করবে না আমি ঠিক করছি। ইতিমধ্যে নারায়ণ  মেয়ে সেজে এসে হাজির। তাঁর কি সে রূপ। ঐ রূপলাবণ্যে সবাই মোহিত। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া থামিয়ে সবাই সেই মোহিনী রূপ দেখতে লাগলো।সুযোগ বুঝে গরুড় এসে অমৃতের কলসী নিয়ে পালাল। যাবার পথে কলসী  থেকে চার ফোঁটা অমৃত পৃথিবীতে পড়ে যায়। সেই চার জায়গাতে এখন কুম্ভ মেলা হয়। এ দিকে মোহিনীবেশী নারায়ণ গরুড়ের কাছ থেকে অমৃত নিয়ে বিলি করবার জন্য সবাইকে লাইন দিয়ে বসালেন।

তারপরে প্রথমে দেবতাদের দিক থেকে অমৃত পান করানো শুরু করলেন। অসুরেরা দেখল যে দেবতারা সব অমৃত আগে পান করে নিলে তাদের ভাগে কিছুই থাকবে না, আর নারায়ণ খেয়াল রাখছিলেন যেন কেউ লাইন না ভেঙে আগে ঢুকে আসে। কিন্তু রাহুকেতু নামে এক অসুর দেবতাদের মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে দেবতা সেজে অমৃত খেয়ে নেয়। সূর্য আর চন্দ্র সেটা দেখতে পায়। নারায়ণ তখন তাদের গলা কেটে দিতে রাহু আর কেতু আলাদা হয়ে দু-টুকরো হয়ে যায়। কিন্তু অমৃত খাবার ফলে তাদের মৃত্যু হয় না, তারা আকাশে ঘুরে বেড়াতে থাকে। আর সেদিন থেকে রাহু আর কেতুর সাথে সূর্য আর চন্দ্রের শত্রুতা, এরা সূর্য  আর চন্দ্রকে দেখতে পেলেই খেয়ে নেয় কিন্তু গলা কাটা  থাকাতে তাদের আর হজম করতে পারেনা।

পরিশিষ্ট :-

এই কাহিনী থেকে মনে হয় মানুষের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য সত্যিই বোধ হয় সুদূর অতীতে নাগজাতিকে একদা উচ্ছেদ করা হয়েছিল, মানবিকভাবেই হোক বা অমানবিক ভাবেই হোক৷ সেই দুঃখের স্মৃতি এখনও আমাদের অরণ্যপর্বতে ছড়ানো রয়েছে৷ আর সেই থেকেই হয়তো সাপের মানুষের প্রতি এত ঘৃণা,এত হিংস্রতা৷

তথ্যসূত্র :-

Jones,Constance (2007). Encyclopedia of Hinduism. New York: Infobase Publishing. p. 300. ISBN 0-8160-5458-4.

Social History of Kerala: The Dravidians By L. A. Krishna Iyer p.003

H. V. Trivedi (1957). Catalogue of the Coins of the Naga Kings of Padmavati. Department of Archaeology & Museums, Madhya Pradesh.

R. K. Sharma (2001). "Ancient history of the Naga tribe of Central India". In A. A. Abbasi (ed.). Dimensions of Human Cultures in Central India: Professor S.K. Tiwari Felicitation Volume. Sarup & Sons. ISBN 978-81-7625-186-0.
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.