 |
সঞ্চারী ভট্রাচার্য্য |
রাবণের অস্তিত্বের এক অজানা ইতিহাস
সঞ্চারী ভট্রাচার্য্য
আমাদের
ভারতীয় সংস্কৃতির এক সুবৃহৎ উপাখ্যান হলো রামায়ণ। মহাভারতের মত রামায়ণও
ভারতীয় সংস্কৃতির এক বিরাট স্থান জুড়ে রয়েছে। রামায়ণ এমনই এক নিদর্শন
যা থেকে এর রস পিপাসুরা যুগপৎ ধর্মীয় খোরাক ও সাহিত্যিক খোরাক দুইই
সমানভাবে লাভ করতে পারেন। ৬৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পরে শতপথ ব্রাহ্মণে চ্যবন
নামে যে মুনির কথা বলা হয়েছে, কথিত আছে তিনি নাকি সর্বপ্রথম রামায়ণ
রচনার চেষ্টা করেছিলেন। অশ্বঘোষ তার 'বুদ্ধচরিতে'( খ্রিস্টীয় প্রথম অব্দ)
-বলেছেন যে, " চ্যবন এই গ্রন্থ রচনায় ব্যর্থ হলে তার বংশধর বাল্মিকী এই
মহাকাব্য রচনা করেছিলেন|" রামায়ণ সম্পর্কে এইরকম নানা গল্পকথাই আমাদের
জীবন চর্চার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
রামায়ণে
আবর্তিত চরিত্রগুলির ঝলক ও বাস্তবভিত্তি আমাদের বর্তমান সমাজ ও সংস্কৃতির
ভাবনাতেও বিদ্যমান| তবে রামায়ণে বহুলচর্চিত বিষয়বস্তুগুলি কেবলমাত্র রাম ও
সীতাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে| রাবণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তেমন কোনো
উল্লেখ পাওয়া যায়নি| প্রায় ১৭ লক্ষ ১৮ হাজার বছর আগের ত্রেতাযুগের এই
অজানা ইতিহাস চর্চা নিয়ে আজও মানুষের মধ্যে কৌতূহলের শেষ নেই| রামায়ণের
ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে প্রতিটি ভারতবাসীই অবগত| নিজস্ব আঙ্গিকে বর্ণিত
এই চরিত্র সমূহের মূল বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেকেই তাদের মনন ও
চিন্তাশীলতার ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছেন| কারোর মতে এই ঘটনা শুধুই এক গল্প কথা
আবার কারোর মনে তা জীবন্ত ইতিহাস রূপে পাকাপাকিভাবে নিজেও স্থান দখল করে
নিয়েছে| এই ঐতিহাসিক দলিলের ব্যাখ্যা কারীর বৈচিত্রও যথেষ্ট স্পষ্ট|
রামায়ণকে নতুন থেকে পুরনো আবার একইভাবে পুরোনো থেকে নতুন এ আবির্ভূত করার
চেষ্টা চালিয়ে গেছেন বহু বিশেষজ্ঞ| যার জন্য এই ইতিহাস আমাদের কাছে
কোনদিনই পুরনো হয়নি।
এই জীবন্ত ইতিহাসেরই একটি অংশ হলো
'লঙ্কা' রাজ্য| যা বর্তমানে 'শ্রীলঙ্কা' নামে পরিচিত| আবার অনেকেই একে রাবণ
রাজার দেশ বলেও অভিহিত করেন| কিন্তু এই রাবণ চরিত্রের বাস্তবায়ন আদপেও
কখনো হয়েছিল কিনা সেই প্রাগৈতিহাসিক ব্যাখ্যা প্রায় মেলে না বললেই চলে|
ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা এবং আবিষ্কৃত তথ্যসমূহ রাবণ চরিত্রটির বাস্তবতাকে কতখানি
প্রমাণিত করতে পেরেছে সে বিষয়ে বর্তমান সমাজ আজও অন্ধকারে| কেউ কেউ মনে
করেন রাবণ নাকি অমর ছিলেন ফলে রামচন্দ্রের হাতে তার মৃত্যু ঘটলেও তার দেহের
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি| এ প্রসঙ্গে রামায়ণে কোনো উল্লেখ নেই|
তাই আজও লঙ্কাবাসীরা মনে করেন রাবণের দেহ স্বমহিমায় বিরাজিত এবং
সংরক্ষিত| তিনি আবার প্রাণ ফিরে পাবেন ও লঙ্কাকে পুনরায় শাসন করবেন| এরকম
বহু আঞ্চলিক কথনের ভারে আজও নিমজ্জিত এই লঙ্কা প্রদেশটি।
কোন
সেই অনাদি যুগ থেকে, ছোট্ট দ্বীপভূমি সিংহলের সঙ্গে ভারতবর্ষের আত্মার
সম্পর্ক। এই দ্বীপভূমিকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে আমাদের মহাকাব্য রামায়ণের
কাহিনী। পরিত্যক্ত ঊষর শহর উষণগোডা, বর্তমান শ্রীলঙ্কার এক পাথর অধ্যুষিত
অঞ্চল, জমি তার একেবারে অনুর্বর, কোন গাছপালা জন্মায় না। অন্যমতে এই
জায়গাটিতে নাকি ছিল রাবণের রাজপ্রাসাদ, বলা হয় হনুমানের লঙ্কা দহনের ফলে
এখানের জমিতে কোন ফসল ফলেনা।উষণগোডা শহরটির সঙ্গেও রাবণের বিমানবন্দরের যোগ
আছে, কারণ এই শব্দটির অর্থ মাটি থেকে উপরে ওঠা।
ভারত
মহাসাগরের একটি দ্বীপদেশ হচ্ছে শ্রীলঙ্কা যার অস্তিত্বের কথা পাওয়া যায়
আমাদের রামায়ণে। রামায়ণের -লঙ্কা কাণ্ডে ভারত ও শ্রী লঙ্কার মাঝে যে
রাম-সেতুর কথা উল্লেখ আছে সম্প্রতি আর্কিওলজিস্টরা স্যাটেলাইট চিত্রের
মাধ্যমে তার অস্তিত্বের প্রমান পেয়েছেন। এই শ্রীলঙ্কাতে সর্ব-প্রথম সনাতন
ধর্মের পদচিহ্ন পড়ে খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫০০ শতকে যখন তৎকালীন ভারতবর্ষ থেকে
বিজয় নামে একজন আর্য তার ৭০০ অনুসারী নিয়ে সেখানে গমন করেন। বিজয় ছিলেন
শ্রীলঙ্কার প্রথম রাজা।
অনেক ঐতিহাসিকদের হতে, এই বিজয়ের
আদি নিবাস ছিল আজকের পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার সিঙ্গুরে । পরবর্তীতে নানা
সময়ে ভারতবর্ষ থেকে নানা সময়ে হিন্দুরা সেখানে যান এবং স্থায়ীভাবে বসবাস
শুরু করেন। শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ হিন্দুই জাতিগত ভাবে তামিল সম্প্রদায়ের
অন্তর্ভুক্ত এবং অধিকাংশ তামিল শ্রীলঙ্কাতে আসে উপমহাদেশের ব্রিটিশ
শাসনামলে বিভিন্ন শ্রমজীবী কাজের শ্রমিক হয়ে।
লঙ্কাপুরীর
সীতা কোঠুয়া বলে জায়গাটি নাকি ছিল মন্দোদরির প্রাসাদ। সীতার কুঠির থেকে নাম
হয়েছে সীতা কোঠুয়া। সীতা কোঠুয়াতে গেলে দেখতে পাবেন ঘন জঙ্গলের মধ্যে এক
বিশাল রাজপ্রাসাদ ভিত অবধি বেঁচে আছে। ভিত অংশটি কিন্তু ভালো ভাবেই রাখার
চেষ্টা করা হয়েছে।সীতা কোঠুয়ার কাছেই ছিল বিমান সারাইয়ের স্থান গুরুলুপোথা।
সীতা কোঠুয়ার বর্তমান অবস্থান হাসালাকা নামক স্থানে।
এরপরে
রাবণের রথ সীতাকে নিয়ে যায় অশোক বনে বা বাটিকায়।পাহাড়ের উপরে নাকি রথের
চাকার মতন দুটি সমান্তরাল দাগ এখনও চোখে পড়ে । এই পথের ধারেই রয়েছে
ক্রন্দনরত সীতার চোখের জলে সৃষ্ট অশ্রুকুন্ড। যতই শুখা মরসুম হোক না কেনো,
অশ্রুকুণ্ডের জল নাকি কখনও শুকায় না। এখানের পাহাড়ের মাটিতে একধরনের অদ্ভুত
লাল রঙের ফুল ফোটে যা শ্রীলঙ্কায় আর কোথাও দেখা যায়না। যদিও এই ফুল দেখার
সৌভাগ্য কারুরই হয়নি কিন্তু শোনা যায় ফুলের পাঁপড়ি এবং সরু সরু পরাগ
দণ্ডগুলি মিলে তীর ধনুক সদৃশ্য লাগে, ভক্তরা মনে করেন ফুল তো নয় যেন তীর
ধনুক হাতে স্বয়ং রামচন্দ্র দাঁড়িয়ে আছেন। এই ফুলের নাম হচ্ছে সীতা
ফ্লাওয়ার। এই সুন্দর ফুলটি আদতে সীতা-অশোকা ( Saraca asoca) ফুল।
রাবণের
নামে রয়েছে রাবণ গুহা ও ঝর্ণা| শ্রীলঙ্কার বহু হিন্দু তামিল, বৌদ্ধ ও
খ্রীস্টান সিংহলি, রামায়ণ সম্পর্কে সম্যক অবহিত। আরো মজার কথা হচ্ছে, তামিল
কম্বন রামায়ণ এবং বাল্মীকির সংস্কৃত রামায়ণ, দুটি ভার্সান সম্মন্ধেই অনেকে
অবহিত। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, বরং এটাই স্বাভাবিক কারণ সিংহলি
জনসংখ্যার জেনেটিক স্টাডিতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, এঁদের মধ্যে
৫৭.৪৯% বাঙালির ও ৪২.৫% তামিল জিনগত উপাদান রয়েছে। ভি এন টি আর স্টাডি তো
দেখাচ্ছে ৭০.০৩% সিংহলি জিনের উৎস বঙ্গ দেশ। শ্রদ্ধেয় উমাশঙ্কর বাবু নিজের
অসাধারণ চরিত্র গুণেই চিরকাল সর্বত্র সম্মান পেয়ে এসেছিলেন, ওনার লেখাতেই
পাওয়া যায়, তৎকালীন শ্রীলঙ্কাবাসীরা বাঙালিদের বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন,
বিজয় সিংহকে স্মরণ করে।জেনেটিক টেস্টে উড়িয়া জিনগত কোন প্রমাণ না থাকা
সত্ত্বেও কিন্তু এখন দেখছি কিভাবে যেন সিংহলীদের মাথায় ঢুকেছে, বিজয় সিংহ
হয়ত উৎকল থেকে শ্রীলঙ্কায় গেছিলেন। সিংহল রাজকাহিনী কুলভাষ্য অনুসারে একজন
উৎকল রাজা জয়গোপা এক সিংহল রাজকুমারীকে বিবাহ করেছিলেন। তাঁদের পুত্র
নিশঙ্খমাল্লা কালক্রমে ১১৮৭- ১১৯৬ সাল অবধি ছিলেন শ্রীলঙ্কার রাজা।
শ্রীলংকার
প্রধান ধর্ম বৌদ্ধ যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০% এবং তারা জাতিগতভাবে
সিংহলি। বর্তমানে হিন্দুরা শ্রীলঙ্কার ২য় বৃহত্তম ধর্ম যাদের সংখ্যা ২০১২
সালের তথ্য অনুযায়ী ২৫ লক্ষের কিছু বেশী এবং মোট জনসংখ্যার ১৩ %। বাংলাদেশ ও
পাকিস্তানের মত শ্রীলঙ্কাতেও হিন্দু জনসংখ্যা কমছে । ১৭ শতকে পর্তুগীজ ও
পরে ব্রিটিশরা শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার একটি অংশকেই জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্মে
দীক্ষিত করে যার মধ্যে বড় একটি অংশই ছিল হিন্দু তামিল শ্রমিকরা।
শ্রীলঙ্কা
আর ভারতের মধ্যে যুগ যুগ ধরে চলে আসা ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, ধার্মিক ও
সাংস্কৃতিক মিল বন্ধনের জন্য সমস্থ জাতের লোকেদের কাছেই সীতা দেবী হচ্ছেন
শ্রদ্ধেয় এবং পরম আদরণীয় ভালোবাসার পাত্রী । ভালো মন্দ মিশিয়ে বীর রাবণও
কিন্তু নায়ক না হোন, খল নায়ক কখনই নন। বরং সিংহলীরা বীর রাবণকে শ্রদ্ধার
সঙ্গে স্মরণ করে তাঁর চরিত্রের মধ্যে নিহিত বহুবিধ গুণাবলীর জন্য। এক তো
রাবণ এখানকার ভূমিপুত্র, তার পর স্ত্রীকে হরণ করে নিয়ে এসেও, তাঁকে স্পর্শ
না করে আলাদাভাবে মহিলা অঙ্গ রক্ষক দিয়ে বহুদূরের অশোক বনে তিনি রেখে
এসেছিলেন। রামের আদেশে সীতাকে যেখানে অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয়েছিল, সেখানে
দুর্ভাগা মন্দোদরীর উপরে দেবাদিদেব থেকে বালি, সুগ্রীব, হনুমান, অঙ্গদ ,
অনেকেই বিভিন্ন সময়ে অত্যাচার করা সত্বেও রাবণ চিরকাল তাঁকে পাটরানীর
মর্যাদায় রেখেছিলেন, কখনই তাঁর সতীত্ব নিয়ে কোন সন্দেহ করেননি।
সিংহলে
বৌদ্ধ থেকে হিন্দু, সবার বিশ্বাস রাব্ণ ছিলেন আমার আপনার মতন স্বাভাবিক
সুস্থ অত্যন্ত বলশালী নৃপতি, যিনি নিজ ক্ষমতা দ্বারা সোনার লঙ্কাপুরী
নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর দশ মাথার কথা প্রতীকী কারণ তাঁর রাজত্বে সর্বমোট
ছিল ১০ টি প্রদেশ আর লঙ্কাপুরা ছিল রাজধানীর নাম । প্রতিটি প্রদেশের জন্য
তিনি ব্যবহার করতেন আলাদা আলাদা রাজ-মুকুট। তাই শ্রীলঙ্কায় তাঁর সাধারণ নাম
দশ শীর্ষ। মনে পড়ল, ঠিক এভাবেই তো প্রাচীন মিশরের ফারাও রাজারা দক্ষিণ
মিশরের জন্য সাদা আর উত্তর মিশরের জন্য লাল, আলাদা আলাদা মুকুট ব্যবহার
করতেন।
রাবণ যে কোন অদ্ভুত দর্শন রাক্ষস নন, সাধারণ মানুষ
তার সবচেয়ে বড় প্রমান শ্রী লঙ্কার পূর্ব প্রান্তে, তামিল হিন্দুপ্রধান
স্থান ট্রিনকোমালি (আরেক নাম গোকর্ন) বন্দর নগরীর স্বামী রকে অবস্থিত
বিশ্ববিখ্যাত কোনেশ্বরম শিব মন্দিরের চত্বর থেকে সিঁড়ি বেয়ে কিছুটা নীচে দু
হাত জোড় করে থাকা সোনালী রঙের রাবণ মূর্তিটি। এই মূর্তিতে রাবণের
কেবলমাত্র একটিই মাথা।এই মন্দিরটিকে বলা হয়, দক্ষিণের কৈলাশ বা কোনেশ্বরম
শিব মন্দির, কারণ কৈলাশ এবং এই দক্ষিণ কৈলাশের একই লঙ্গিটিউড এর অবস্থান।
কোনেশ্বরম
শিব মন্দিরটি নিয়ে কিছু বিস্তারিত অনুসন্ধানের দরকার আছে।বর্তমান মন্দিরটি
যদিও ১৯৫২ সালে নির্মিত, কিন্তু আদি মন্দির বহু প্রাচীন, ঐতিহাসিক ও
পুরাতাত্ত্বিক মতে এটি নির্মাণ করেছিলেন শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের অন্যতম
শ্রেষ্ঠ চোলা রাজা এলারা মানু নিধি চোলান। অনুরাধাপুরার এই রাজা
খ্রিস্টপূর্ব ২০৫-১৬৭ সন অর্থাৎ দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে রাজত্ব করেন। ওনার সময়ে এই মন্দিরটি তার গঠন শৈল্পে ছিল সারা পৃথিবীতে অদ্বিতীয়।
এখানে
জানিয়ে রাখি, শ্রী লঙ্কার ঐতিহাসিক পালি রাজ কাহিনী মহাবংশে, এলানের
প্রভূত প্রশংসা করা হয়েছে। তিনি এমন নিরপেক্ষ শাসক ছিলেন যে, গর্হিত কাজের
জন্য নিজ পুত্রকেও মৃত্যু দন্ড দিয়েছিলেন। আজ থেকে ৪০০ বছর আগে,
পুণ্যার্থীদের দানে এই মন্দিরটিতে জমা হয়েছিল রাশি রাশি ধনরত্ন এবং এটি ছিল
তৎকালীন এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে ধনী মন্দির । ১৬২২ সালের ১৪ ই এপ্রিল তামিল
নববর্ষের দিনে , পর্তুগীজ সেনাপতি কোনস্টান্টিনো নোরানহো ও পর্তুগীজ
সেনারা তামিল পুণ্যার্থীদের ছদ্মবেশে নৃশংস ভাবে এই মন্দিরটি লুট করে , যা
ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ লুন্ঠন কাহিনী। পুরোহিতদের হত্যা করে, দু বছরের
মধ্যে এই মন্দিরটি সহ জাফনার ৫০০ টি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে ফেলা হয়।
মন্দিরের ধ্বংসস্তুপ দিয়ে তৈরি করা হয় ট্রিনকোমালি ফোর্ট এবং চার্চ।
আবার
লঙ্কার প্রাক ইতিহাস অনুযায়ী, রাবণ তো ছিলেন বীর যোদ্ধা, অতি সামান্য লোকও
যদি প্রকৃত মানুষ হন, তবে তার বোনের অসম্মান কি মেনে নিতে পারেন ? রাবণের
বোনের নাক কেটে দিয়ে, লক্ষ্মণ যে অত্যন্ত অন্যায় কাজ করেছিলেন, সেই
অন্যায়ের বিরুদ্ধেই রাবনের সীতা হরণ। বোনের অপমানের বদলা নিতে রাবন তো রাম
পত্নী সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে এলেন। কিন্তু ফিরে এসে পড়লেন ধর্ম সংকটে, কারণ
মন্দোদরীর কাছে প্রথম বারের মতন শুনলেন যে সীতা নাকি তাঁরই কন্যা। রাবণের
সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাঁরই একদা ছোট্ট মেয়েটি, যে আজকে তাঁর ঘোরতর শত্রুর
স্ত্রী। সেই শত্রু যে কিনা লক্ষণের গর্হিত অপরাধকে বাঁধা দেয়নি, তাঁরই হাতে
পড়ে রাবণ রাজার নন্দিনী বিনা দোষে বনবাস জীবন যাপন করছে। তাই রাবণের মনে
এই ভাবনা আসতেই পারে, যত দিন তিনি রাজা থাকবেন, মেয়ে তাঁর কাছেই থাকবে,
ততদিন তাঁর মেয়েকে আর কোন কষ্টকর জীবন কাটাতে হবেনা। কন্যা সীতার প্রতি
পিতা রাবণের এই ভালোবাসাকে সর্বত্র ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
রাবণ
নাকি সংগীত প্রেমিক ছিলেন এবং বীণা বাজাতেন। কম্ব রামায়ণে নাকি লেখা আছে,
রাবণের রথের পতাকায় বীণার ছবি আঁকা থাকত। আরেকটি কথা জানা যায় , ১১ শতকের
চোলা রাজাদের কিছু তাম্রলিপি পাওয়া গেছে যার থেকে বোঝা যায় সিংহলের চোলা
রাজারা নাকি রাবণকে তাঁদের পূর্বপুরুষ মনে করতেন এবং রাবণের মতোই তাঁদের
পতাকায় বীণার ছবি আঁকা থাকত ।
শ্রীলঙ্কার সীতা মন্দির বেশ
বিখ্যাত। জায়গাটির নাম , সীতা এলিয়া, নুয়ারা এলিয়া শহরের একপ্রান্তে এর
অবস্থান। ভৌগোলিক ভাবে এই স্থানটির নাম হাকগালা পর্বত আর অশোক বাটিকার নাম
হাকগালা উদ্যান। এই পর্বতের উপরে কিছুদিনের জন্য নাকি সীতাকে বন্দী করে
রাখা হয়েছিল। সেই জায়গায় পাহাড়ের জল জমে বর্তমানে একটি পুকুর তৈরি হয়ে
গেছে, যাকে বলে সীতা পুষ্করিণী বা সীতা পকুনা।
সোনার
লঙ্কায় বহুকিছু ছিল যা প্রজাবৎসল রাবণের কথা মনে করায়। গাভাগালা বা গৌসালা
নামক বিশাল স্থানটিকে মনে করা হয় এটি ছিল বিশাল এক গোসালা। এখান থেকে নাকি
রাবণের নিজস্ব বিমানে করে দুধ নিয়ে যাওয়া হত রাজবাড়ীতে এবং কিছু দুধ
প্রজাদের জন্য রাখা থাকত।শোনা যায় রাবণের নাকি বেশকটি বিমান ছিল এবং
সেগুলির জন্য তিনি নাকি সর্বমোট ৬ টি বিমানবন্দর নির্মাণ করেছিলেন। সিগরিয়া
বাদে বাকিগুলোর মধ্যে একটির নাম ছিল ১) বেরাগণটোটা, আশ্চর্য্যের ব্যাপার
এই নামটির সিংহলী অর্থ বিমান অবতরণ স্থল। এটির অবস্থান মহিঅঙ্গনা নামক
স্থানে। এরকম আরো ছিল ২) তোটুপলাকান্দা বা মাউন্টেন পোর্ট- এটির অবস্থান
শ্রী লঙ্কার অন্যতম জনপ্রিয় ভ্রমন স্থল হরটনস প্লেনে , ৩) বাড়িয়াপোলা বা
এয়ার ক্রাফট পোর্ট- এই নামে দুটি জায়গা আছে, একটি মাতালাতে, অন্যটি
কুরুনাগালাতে , ৪) গুরুলোপোথা, ৫) জাফনার কাছে নীলাবাড়ী।
কিছুদিন
আগেও সিগরিয়া দূর্গ নিয়ে শ্রীলঙ্কান ট্যুরিজমের পক্ষ থেকে লেখা হত, রাবণের
রাজপ্রাসাদ এবং পুষ্পক বিমানের ওড়বার কল্পকাহিনী, মুখ্যত ভারতীয় পর্যটকদের
আকর্ষণ করবার জন্য। লায়ন রকের , বর্তমানে যে দুটি বিশাল থাবার অস্তিত্ব
আছে, তাদের চেহারা কিন্তু সিংহের থাবার মতন আদৌ নয়, ময়ূর বা গড়ুরের নখের
মতন দেখতে। লোকশ্রুতি অনুসারে পুরো সিগরিয়া ফোর্টটিই নাকি ছিল পুষ্পক রথ।
তবে সীতা হরণ করে ফিরে এসে রাবণ প্রথমে যেখানে নামে বলে বিশ্বাস, তার নাম
বেরাগানতোতা। পুষ্পক বিমান কে সিংহলিতে বলে ” ডান্ডু মোনারা যন্ত্রনায়া ” ।
ডান্ডু মোনারা মানে উড়ন্ত ময়ূর।বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হবার আগে শ্রী
লঙ্কার আদিবাসীরা পরিচিত ছিলেন নাগা এবং যক্ষ্ম নামে। নাগারা ছিলেন শিব
ভক্ত, আর বিখ্যাত যক্ষ রাজ ছিলেন কুবের এবং তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই রাবণ।
সিংহলের প্রথম রাজা বিজয় সিংহ তখনকার যক্ষরাজকে পরাজিত করেই রাজা হন।
রামায়নে
এক বর্ণনায় রয়েছে স্বর্গে যাবার সোপানশ্রেণী নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন
লঙ্কাধীপতি রাবণ। স্বর্গে যাবার সিঁড়ির নির্মাণপর্বও শুরু করেছিলেন তিনিই,
কিন্তু শেষপর্যন্ত অযোধ্যা নরেশ রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত হবার ফলে
ব্যর্থ হয় লঙ্কেশের যাবতীয় প্রয়াস। অর্ধ নির্মিত অবস্থায় থেকে যায়
স্বর্গের সিঁড়ি। রামায়নের এই পর্ব অনেকের মনেই প্রশ্নের সঞ্চার করে রাবণের
স্বর্গের সিঁড়ি নির্মাণ পর্ব কি নিছকই কল্পনা নাকি সত্যি আর সত্যি হলে
কোথায় রয়েছে এই স্বর্গের সিঁড়ি ?
বাস্তবে সত্যিই রয়েছে
রাবন দ্বারা নির্মিত স্বর্গে যাবার অর্ধ নির্মিত সোপানশ্রেণী। শ্রীলঙ্কার
শিগিরিয়া নামক এক স্থানে। শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল প্রভিন্সের ডাম্বুলা নগরের
নিকটে মাটালা জেলায় রয়েছে ঘন অরন্যে আবৃত শিগিরিয়া নামক এক পার্বত্য অঞ্চল।
সেই অঞ্চলেই রয়েছে রাবনের বহু চর্চিত স্বর্গের সিঁড়ি। বর্তমানকালে
শিগিরিয়া অঞ্চলের এই আশ্চর্যজনক স্বর্গের সিঁড়ি লায়নস রক বা সিংহের প্রস্তর
নামে পরিচিত। শুধুমাত্র একটি অতিকায় সুউচ্চ প্রস্তরখণ্ড বেয়ে গিরিবর্ত্ম
বেয়ে মহাকাশের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে এগিয়ে গেছে একের পর এক সোপানশ্রেণী আর
প্রস্তরখণ্ডের একেবারে উপরে অবস্থান করছে এক বহু শতাব্দী প্রাচীন
রাজপ্রাসাদের ভগ্নস্তুপ। সোপানশ্রেণীর শুরুর দিকে দুপাশের শোভা বর্ধন করছে
সিংহের পাঞ্জার সাথে সাদৃশ্য যুক্ত দুটি বিশাল প্রস্তর খণ্ড। রাবণ কথার
পুস্কলা পথ মহাকাব্য অনুসারে লঙ্কাধীপতি রাবণের নির্দেশে তাঁর রাজ্যের
প্রধান স্থপতি মায়া দানব এই স্বর্গের সিঁড়ি নির্মাণ করতে শুরু করেন। এই
মায়া দানবই নির্মাণ করেছিলেন লায়নস রকের উপরে অবস্থিত সুপ্রাচীন
রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষটি। রাবণের শাসনকালে শিগিরিয়া অঞ্চলের নাম ছিল
অলকামাণ্ডব।
স্থানীয় লোকগাথা অনুসারে সেই সময়ে এই
অলকামাণ্ডবই রাবণের রাজধানী ছিল আর এখানেই অবস্থিত ছিল রাবণের রাজপ্রাসাদ।
কিন্তু নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হবার পূর্বেই রামচন্দ্র তাঁর অনুজ ভ্রাতা
লক্ষণ আর বানর সেনাদের নিয়ে লঙ্কা আক্রমন করেন। সেই মহাযুদ্ধে নিহত হন
রাবণ। রাবণের মৃত্যুর পর তাঁর নশ্বর দেহ কোন গুপ্তস্থানে লুকিয়ে ফেলেন তাঁর
বিশ্বাসঘাতক ভ্রাতা বিভীষণ। এরপর নিজে লঙ্কার রাজসিংহাসনে আসীন হয়ে বিভীষণ
তাঁর রাজধানী শিগিরিয়া বা অলকামাণ্ডব থেকে স্থানান্তরিত করে কেলানিয়াতে
নিয়ে আসেন। পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে বিস্মৃতির অতলে চলে যায় অলকামাণ্ডবের
অর্ধনির্মিত স্বর্গের সিঁড়ি। আজও শিগিরিয়া অঞ্চলে ভ্রমন করতে গেলে দেখা যায়
লায়ন্স রকের স্বর্গের সিঁড়ি আর তার উপরে অবস্থিত প্রাচীন রাজপ্রাসাদের
ভগ্নাবশেষ।
ভূমি থেকে অন্তত ৬০০ ফুট উচ্চে অবস্থিত
শিগিরিয়ার লায়ন্স রকের রাজপ্রাসাদের ভগ্নস্তূপটি। ইতিহাস বলছে ১৮৩১ সালে
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জোনাথন ফরবস নামের এক সেনাধক্ষ্যর দ্বারা আবিষ্কৃত
হয়েছিল শিগিরিয়ার এই রহস্যময় স্বর্গের সিঁড়ি। ব্রিটিশ সেনাধক্ষ্য জোনাথন
ফরবসের দিনপঞ্জিকা অনুসারে, "সভ্য সমাজ থেকে বহুদূরে শিগিরিয়ার ঘন অরন্যে
আবৃত পর্বত প্রান্তরে সিংহের পাঞ্জার সাথে সাদৃশ্য যুক্ত শুধু একটিমাত্র
সুবিশাল আর সুউচ্চ প্রাকৃতিক প্রস্তর খণ্ডের দুর্গম গিরিপ্রান্ত বেয়ে ধাপে
ধাপে উপরে আরও বহু উপরে যেন মহাকাশের দিকে ক্রমান্বয়ে উঠে গেছে একাধিক
সোপানশ্রেণী।সেই শীর্ষদেশে অবস্থান করছে এক বহু শতাব্দী প্রাচীন রহস্যময়
রাজপ্রাসাদের ভগ্নস্থুপ।"
ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে
খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকে শিগিরিয়ার এই রহস্যময় রাজপ্রাসাদকে এক
বৌদ্ধ মঠে রূপান্তরিত করা হয়, কিন্তু তাঁর পূর্বে আনুমানিক ৫০০
খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত শিগিরিয়ার এই রাজপ্রাসাদ কোন এক স্থানীয়
শক্তিশালী হিন্দু রাজার রাজপ্রাসাদ ছিল। লায়ন্স রকের শীর্ষে রাজপ্রাসাদ
চত্বরে রয়েছে এক সুরম্য উদ্যান আর কয়েকটি প্রাচীন সরোবরের ভগ্নাবশেষ। এরপর
এক সুবিশাল পাহাড়ি গুহাকে রাজপ্রাসাদের রূপদান করা হয়েছে। সেই রাজপ্রাসাদের
গুহা অভ্যন্তরের প্রাকারে রয়েছে বেশকিছু পুরাকালের সুন্দরী রমণীদের
চিত্রকলা। কিছু কিছু স্থানীয় পুরাতত্ত্ববীদদের মতে এইসব রমণীরা প্রাচীনকালে
সেই সময়কার স্থানীয় রাজার রাজসভার নর্তকী আর পরিচারিকা ছিলেন। চিত্রগুলিতে
দেখা যায় এক আশ্চর্য জিনিষ প্রত্যেক রমণীদের তলদেশ এক রহস্যময় ঘন মেঘরাশি
দ্বারা আবৃত। অর্থাৎ চিত্রানুসারে তাঁরা পৃথিবীর ভূমিতে দণ্ডায়মান নন।
তাঁরা মহাশূন্যে ভাসমান অপ্সরা। স্থানীয় অধিবাসীদের মতে এইসব রমণীরা আসলে
ছিলেন স্বর্গ থেকে দেবতাদের দ্বারা প্রেরিত অপ্সরাগণ। তাই চিত্রগুলিতে
তাঁদের মহাকাশে ভাসমান অবস্থায় দেখা যায়। তাঁদের মতে রাবণের নির্দেশে মায়া
দানব শিগিরিয়ার সিঁড়ি নির্মাণ করতে শুরু করেছিলেন স্বর্গের সাথে সংযোগ
স্থাপনকারী মেরু পর্বতের সহিত যুক্ত করবার অভিপ্রায়ে। বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে
মেরু পর্বত হলো স্বর্গের সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপনকারী এক পবিত্র মহাজাগতিক
পর্বত। ভারতবর্ষের হিন্দু আর বৌদ্ধ উভয় ধর্মেই রয়েছে মহাজাগতিক মেরু
পর্বতের সংজ্ঞা। বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মীয় পুস্তক অনুসারে মেরু পর্বতকে এক
সুবিশাল আর মহাজাগতিক স্বর্ণালি আলোকছটার গোলক বা ত্রিকোণ পিণ্ড হিসেবে
বর্ণনা করা হয়েছে। ধর্মীয় পুস্তকগুলির বর্ণনা অনুসারে মেরু পর্বত হলো
মহাশূন্যে ভাসমান এক স্বর্ণালি আলোকছটার গোলক যা মর্ত্যভূমি থেকে দর্শন
করলে সোনা দ্বারা আবৃত এক পর্বতমালা বলে ভ্রম হয়। শূন্যে ভাসমান এই সোনার
পর্বতমালার মধ্যে রয়েছে দেবলোকে যাত্রার পথ। ধর্মীয় পুস্তক অনুসারে
মহাকাশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এক ভিন্ন মাত্রায় রয়েছে এই মেরু পর্বত। সাধারন
মানবজাতির পক্ষে খালি চোখে দর্শন সম্ভব নয় মেরু পর্বতের। জ্ঞানী, গুনি আর
মহৎ ব্যক্তিরা কেবলমাত্র সঠিক ধ্যানের সাহায্যে নিজেদের মানসচক্ষু দ্বারা
দর্শন লাভ করতে পারেন পবিত্র মেরু পর্বতের।
প্রাচীন
ভিনগ্রহীদের আগমনী তত্ত্বে বিশ্বাসী পণ্ডিতদের মতে আসলে এই মেরু পর্বত হলো
অন্য মাত্রায় মহাশূন্যে ভাসমান এক অত্যাধুনিক উড়নচাকি বা স্পেসশিপ। উন্নত
ভিনগ্রহী দেবতারা বা ভবিষ্যৎ মানবজাতি তাঁদের উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানের
সাহায্যে কৃত্তিম ওয়ার্মহোল নির্মাণ করে সফলতার সাথে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়
যাত্রা করে এই মেরু পর্বতের সাহায্যে। রাবণের নির্দেশে মায়া দানব এই
সুবিশাল শিগিরিয়া সোপানশ্রেণী নির্মাণ করে আসলে শূন্যে ভাসমান মেরু পর্বত
নামধারী সেই রহস্যময় উড়নচাকির সাথে সংযোগস্থাপন করে অন্য নক্ষত্রলোকে
অবস্থিত ভিনগ্রহীদের স্থানে যাত্রা করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ সংক্ষেপে
শিগিরিয়ার প্রাসাদকে দেবতাদের মহাকাশযানের ল্যান্ডিং বা লঞ্চ প্যাড হিসেবে
ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন মায়া দানব। এরজন্যই একে স্বর্গের সিঁড়ি নামে অভিহিত
করা হয়েছে। আর রাজপ্রাসাদের গুহা অভ্যন্তরে অঙ্কিত প্রাকার চিত্রের
অপ্সরারা আসলে মহাকাশ থেকে আগত ভিনগ্রহী নারী মহাকাশচারী। প্রাচীনকালে
আমাদের পূর্বপুরুষ আদি মানবরা নিজেদের চর্ম চক্ষুদ্বারা এইসব মহাজাগতিক
ঘটনা প্রত্যক্ষ করে তীব্র বিস্ময়ে ভিনগ্রহীদের দেবতা বলে মনে করেছিলেন এবং
নিজেদের দেখা ঘটনাবলির সাথে কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে শিগিরিয়া রাজপ্রাসাদের
প্রাকার গাত্রের উড়ন্ত রমণীদের চিত্র অঙ্কন করেছিলেন। শিগিরিয়ার রহস্যময় এই
স্বর্গের সিঁড়ির চারপাশে আর শীর্ষদেশে রয়েছে আরও বহু অজানা বন্ধ গুহামুখ।
পুরাতত্ত্ববীদদের ধারনা এইসব রহস্যময় বন্ধ গুহামুখের অভ্যন্তরে ঘন আধারের
মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আরও বহু অজানা রহস্য, হয়তো এইসব রুদ্ধ গুহা অভ্যন্তরের
মধ্যে হাজার হাজার বছর ধরে লুকায়িত রয়েছে লঙ্কাধিপতি রাবণের রহস্যময়
পুষ্পকরথ বা তাঁর মরদেহ। হয়তো এইসব রুদ্ধ গুহামুখের ভেতরে রয়েছে ভিন্ন
মাত্রা বা অতীত অথবা ভবিষ্যৎকালে সময়যাত্রার চাবিকাঠি। এইসব রুদ্ধ
গুহামুখের রহস্যের সমাধান হলে উন্মোচিত হবে রামায়নের অন্তিম পর্বের বহু
অজানা রহস্য।
অবিশ্বাস্য বলে মনে হলেও ভারত ও শ্রীলঙ্কার
মধ্যে সংযোগকারী রাম সেতুর অস্তিত্ব শুধু পৌরাণিক গল্পেই নয়, বাস্তবেও
থাকতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সায়েন্স চ্যানেলের এক অনুষ্ঠানে দাবি করা
হয়েছে।পৌরাণিক গল্পে রাম সেতুকে ‘আদম সেতু’-ও বলা হয়। ওই চ্যানেলের
অনুষ্ঠানে দাবি করা হয়েছে, ‘সেতুটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়নি, মানুষই হয়তো
এটি তৈরি করেছিল।’‘ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে সংযোগকারী স্থলসেতু নিয়ে সনাতন
পুরাকাহিনি কি সত্যি?’ সায়েন্স চ্যানেলের অনুষ্ঠানে জুড়ে দেওয়া বৈজ্ঞানিক
বিশ্লেষণের নথিপত্র সেই সত্যতার দিকে ইঙ্গিত করছে।
অনুষ্ঠানে
দাবি করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (নাসা) কিছু
স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে প্রায় ৪৮ কিলোমিটার
দীর্ঘ পাথরের কাঠামো পেয়েছেন। চিত্রে বালুতটের ওপর পাথরগুলো দেখা যাচ্ছে।
অগভীর জলে এমন বালুতট তৈরী হয়। মাটির সঙ্গে মিশে স্তূপাকৃতি ধারণ করতে পারে
বালি। তিনি আরো বলেছেন, বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ওই পাথরগুলো বালির চেয়ে
বেশি পুরোনো।নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, পাথরগুলো প্রায় ৭ হাজার বছরের পুরোনো
এবং বালুতটের বয়স প্রায় ৪ হাজার বছর।
কিন্তু
ভূতাত্ত্বিক ড. অ্যালান লেস্টার মনে করেন, পাথরগুলো দূরবর্তী কোনো স্থান
থেকে আনা হয়েছিল এবং ডুবন্ত দ্বীপের মতো বালির স্তূপের ওপর দিয়ে বসানো
হয়েছিল।ভারত ও শ্রীলঙ্কার মাঝে সমুদ্রের ওপর তৈরী পথের নকশা নিয়ে দীর্ঘদিন
ধরে বিতর্ক চলে আসছে। সেখানে সেতুর মতো অংশটিকে 'রাম সেতু' বলে সম্বোধন করা
হয়। ভারতের তামিলনাড়ুর পাম্বান দ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মান্নার দ্বীপের মাঝে
এর অবস্থান। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, এটি চুনাপাথর দিয়ে তৈরি করা
হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে প্রাকৃতিক নিয়মে এটি গড়ে উঠেনি, এটি মানুষের
তৈরী।কিন্তু হিন্দু পুরাণে এর অন্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে। রামায়ণে বলা হয়েছে,
ভগবান শ্রীরামচন্দ্র রাবণ রাজার হাত থেকে সীতা মাতাকে লঙ্কা থেকে ছাড়িয়ে
আনতে এই সেতু তৈরি করেছিলেন। রাম সেতু নিয়ে আরো যেসব গল্প প্রচলিত রয়েছে,
তা একনজরে দেখে নেওয়া যাক-
পৌরাণিক মহাকাব্য রামায়ণে যা উল্লেখ আছে :-
হাজার
হাজার বছর আগের কথা (ত্রেতা যুগ)। রাক্ষসরাজ রাবণ সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে
যান এবং নিজ রাজ্য লক্ষায় বন্দি করে রাখেন। অতঃপর সীতাপতি ভগবান
শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কা আক্রমণের উদ্দেশ্যে ভ্রাতা লক্ষণ, ভক্ত হনুমান এবং এক
বিশাল বানর বাহিনী নিয়ে সমুদ্রতীরে এসে উপস্থিত হন। কীভাবে তিনি সাগর পাড়ি
দিয়ে লঙ্কায় যাবেন? তখন ১ কোটি বানরসেনা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরামের পবিত্র
নাম পাথরে লিখে সমুদ্র পথে একটি পাথরের সেতু তৈরি করেছিলেন। শ্রী রাম নাম
খচিত সেই পাথরগুলো অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে জলে নিক্ষেপের পর নিমজ্জিত না
হয়ে ভেসে উঠেছিল।
ভারতের দক্ষিণ
উপকূলকে লঙ্কার (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) সঙ্গে যুক্ত করা হয় এই সেতুর মাধ্যমে।
এই সেতু দিয়ে শ্রীরাম তার বানর বাহিনী নিয়ে লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধার
করেনবিশ্বের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, বাস্তবে এই সেতু ছিল এবং
এখনো আছে। কিন্তু এটি কি নিছক ধর্মবিশ্বাস নাকি এর কনো বাস্তবিক ভিত্তি
আছে? ২০১২ সালে নাসা তাদের নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহের ছবির সাহায্যে রামায়ণে
উল্লেখিত সুনির্দিষ্ট সেই স্থানেই রাম সেতু চিহ্নিত করেছে বলে জানায়। তারা
আরো জানায়, সেতুর দৈর্ঘ ৩০ কিলোমিটার, যা বর্তমান ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের
রামেশ্বরম দ্বীপ থেকে শ্রীলঙ্কার তালাই মানার পর্যন্ত বিস্তৃত।
এই সেতুতে হাঁটা যেত!
দাবি
করা হয়, ১৪৭০ সাল পর্যন্ত রাম সেতুতে চলাচল করা যেত। তখনো এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ
থেকে উপরে ছিল। কিন্তু ওই বছর শক্তিশালী সাইক্লোনের তাণ্ডবে ধ্বংস হয়ে যায়
সেটি। তবে এর সত্যাসত্য নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্কের কোনো সুরাহা হয়নি।রাম
সেতুর একাধিক নাম রয়েছে। যেমন আদম ব্রিজ, নালা সেতু, সেতুবন্ধ ইত্যাদি। কোরাল
রিফ জমাট বেঁধে প্রাকৃতিক উপায়ে এই ব্রিজ তৈরি হয়েছে বলে কেউ কেউ বিশ্বাস
করেন। ভারতের পাম্বান দ্বীপ থেকে শ্রীলঙ্কার মান্নার দ্বীপ পর্যন্ত এই
কোরাল রিফ বিস্তৃত।
রাম সেতু এখন সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে চলে
গেলেও এর ওপর দিয়ে জাহাজ চলাচল করতে পারে না। সরাসরি না গিয়ে ঘুরে অন্য পথে
ভারতীয় জাহাজগুলো শ্রীলঙ্কায় যায়।মহাসাগর গবেষণা বা ও শিয়ানোগ্রাফি
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রামসেতু ৭ হাজার বছরের পুরনো। অদ্ভুতভাবে সেই সময়ই
রামায়ণে বর্ণিত ঘটনাগুলো ঘটেছে।রাম সেতু তৈরি হয়েছিল ভাসমান পাথর দিয়ে।
রামায়ণে তেমনই বর্ণনা পাওয়া যায়। আশ্চর্য হলেও এখনো এমন পাথর তামিলনাড়ুর
রামেশ্বরমে পাওয়া যায়।
রামায়ণ
মহাকাব্যের নায়ক রামচন্দ্র রাজপুত্ত্বর, ধর্মপরায়ণ, বীর, ধীর, সুসভ্য,
সুকান্ত, জ্ঞানী, গুণী ইত্যাদি শত শত গুণাত্মক বিশেষণে ভূষিত। পক্ষান্তরে
রাবণ – বিকলাঙ্গ (দশমুণ্ড), স্বৈরাচারী, অসভ্য, রাক্ষস, কামুক ইত্যাদি শত
শত দোষাত্মক বিশেষণে দুষ্ট। কিন্তু বাস্তবিকই কি তাই? হয়তো আর্য-ঋষি
বাল্মীকি — আর্যপ্রীতি ও অনার্যবিদ্বেষ বশত শ্রীরামকে প্রদীপ্ত ও রাবণকে
হীনপ্রভ করার মানসে একের প্রোজ্জ্বল ও অন্যের মসিময় চিত্র অংকিত করেছেন
নিপুণ হস্তে রামায়ণের পাতায়। কিন্তু তার তুলির আঁচড়ের ফাঁকে ফাঁকে
প্রকাশ পাচ্ছে রাবণের কৌলিন্য, শৌর্য-বীর্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের আসল কান্তির
ছিটেফেঁটা ; যার ঔজ্জ্বল্য রামচরিত্রের উজ্জ্বলতার চেয়ে বহুগুণ বেশী।
রামচন্দ্র
ছিলেন ক্ষত্ৰকুলোদ্ভব, চার বর্ণের দ্বিতীয় বর্ণের মানুষ। সেকালের
ক্ষত্রিয়রা ছিলো বংশগত যোদ্ধা, অর্থাৎ নরঘাতক। আর রাবণ ছিলেন ব্রাহ্মণ
বংশীয়। এ কথাটা শুনে রামভক্ত হিন্দু ভাইয়েরা হয়তো আঁতকে উঠতে পারেন।
ব্রাহ্মণ-এর সাধারণ সংজ্ঞা হলো – ব্রহ্মাংশে জন্ম যার, অথবা বেদ জানে যে,
কিংবা বেদ অধ্যয়ন করে যে, নতুবা ব্রহ্মের উপাসনা করে যে — সে-ই ব্রাহ্মণ।
ঋষিগণ সর্বত্রই উক্ত গুণের অধিকারী। তাই ঋষি মাত্রেই ব্রাহ্মণ। রাবণের দাদা
পুলস্ত্য ছিলেন ব্ৰহ্মার মানসপুত্র এবং স্বনামধন্য ঋষি। কাজেই তিনি ছিলেন
বংশে ও গুণে উভয়ত ব্রাহ্মণ। পুলস্ত্য ঋষির পুত্র অর্থাৎ রাবণের পিতা
বিশ্ৰবাও ছিলেন একজন বিশিষ্ট ঋষি। কাজেই তিনিও ছিলেন বংশগত ও গুণগত
ব্রাহ্মণ। তাই ব্রাহ্মণ ঋষি বিশ্ববার পুত্র রাবণ গুণগত না হলেও কুলগত
ব্ৰাহ্মণ ছিলেন নিশ্চয়ই। এতদ্ভিন্ন নিম্নলিখিত আলোচনাসমূহে রাম ও রাবণের
ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার তুলনামূলক কিঞ্চিৎ পরিচয় পাওয়া যাবে।
১.
রাবণের রাজমহলকে (কখনো লঙ্কাকেও) বলা হয়েছে ‘স্বর্ণপুরী। এতে রাবণের
ঐশ্বর্য, শিল্প-নিপুণতা, সৌন্দর্যপ্রিয়তা, রুচিবোধ ইত্যাদি বহু গুণের
পরিচয় মেলে। কিন্তু রামচন্দ্রের বাড়িতে এমন কিছুর উল্লেখ দেখা যায় না,
যার দ্বারা তার ওসব গুণের পরিচয় পাওয়া যায়।
২
লঙ্কায় সীতাদেবী রক্ষিতা হয়েছিলেন রাবণের তৈরী অশোক কাননে। তা ছিলো
রাবণের প্রমোদ উদ্যান, যেমন আধুনিক কালের ইডেন গার্ডেন। সে বাগানটিতে
প্রবেশ করলে কারো শোকতাপ থাকতো না। তাই তার নাম ছিলো অশোক কানন। সে
বাগানটির দ্বারা রাবণের সুরুচি ও সৌন্দর্যপ্রিয়তার পরিচয় পাওয়া যায়।
অধিকন্তু তিনি যে একজন উদ্ভিদবিদ্যা বিশারদ ছিলেন তা-ও জানা যায়। আর তার
প্রমাণ মেলে একালের সুপ্রসিদ্ধ খনার বচনে। খনা বলেছেন –
“ডেকে কয় রাবণ, কলা-কচু না লাগাও শ্রবণ।”
শত
শত জাতের ফল-ফুল ও লতাগুলেমর বৃক্ষরাজির একস্থানে সমাবেশ ঘটিয়ে তা
লালনপালন ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু জানা যায়
না রামচন্দ্রের বাড়িতে কোনো ফুল-ফলের গাছ আদৌ ছিলো কি না।
৩.
রামচন্দ্র লঙ্কায় গিয়েছিলেন কপিকুলের (বানরের) সাহায্যে মাটি-পাথর কেটে
বাঁধ নির্মাণ করে, দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায়। কিন্তু লঙ্কা থেকে ভারতের
দণ্ডকারণ্য তথা পঞ্চবটী বনে রাবণ যাতায়াত করেছিলেন ‘পুষ্পক’ নামক বিমানে
আরোহণ করে অতি অল্প সময়ে। রাবণ যে একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বা বৈমানিক এবং
কারিগরিবিদ্যা-বিশারদ ছিলেন, তা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এ ক্ষেত্রে রাবণের
সহিত শ্রীরামের তুলনাই হয় না।
৪.
রামচন্দ্র যুদ্ধ করেছেন সেই মান্ধাতার আমলের তীর-ধনু নিয়ে। আর রাবণ
আবিষ্কার করেছিলেন এক অভিনব যুদ্ধাস্ত্র, যার নাম ‘শক্তিশেল। তা শক্তিতে
ছিলো যেনো বন্দুকের যুগের ডিনামাইট। নিঃসন্দেহে এতে রাবণের বৈজ্ঞানিক
গবেষণা ও উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় মেলে।
৫.
রামচন্দ্রের নিক্ষিপ্ত শরাঘাতে রাবণের মুমুধু সময়ে তার কাছে গিয়ে
রামচন্দ্র রাজনীতি সম্বন্ধে তার উপদেশপ্রার্থ হয়েছিলেন এবং মৃত্যুর
মুখোমুখি হয়েও তিনি রামচন্দ্রের সে প্রার্থনা পূর্ণ করেছিলেন ধীর ও
শান্তভাবে, সরল মনে। এতে প্রমাণিত হয় যে, রাবণ সে যুগের একজন
রাজনীতি-বিশারদ ছিলেন। অধিকন্তু ছিলেন ধৈর্য, সহন ও ক্ষমাশীল এবং
প্রতিহিংসাবিমুখ এক মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
৬.
রামায়ণ মহাকাব্যে রাবণকে বলা হয়েছে দশানন। কিন্তু বাস্তবে রাবণের দশটি
মুণ্ড নিশ্চয়ই ছিলো না। তবে তার মাথার মজ্জা অর্থাৎ জ্ঞান ছিলো দশটা
মুণ্ডের সমান। তা-ই রূপকে বিদূপে অংকিত হয়েছে রাবণ দশমুণ্ডু রূপে।
৭.
রাক্ষস বা নরখাদক বলা হয়েছে রাবণকে। উপরোক্ত আলোচনাসমূহের পরে এ বীভৎস
বিশেষণটি সম্বন্ধে আর কিছু সমালোচনা আবশ্যক আছে বলে মনে হয় না। তবুও
প্রিয় পাঠকবৃন্দের কাছে একটি প্রশ্ন না রেখে পারছি না। রাবণের দাদা হচ্ছেন
পুলস্ত্য, পিতা বিশ্ৰবা, ভ্রাতা কুম্ভকৰ্ণ ও বিভীষণ, বৈমাত্রেয় ভ্রাতা
কুবের এবং পুত্র ইন্দ্রজিৎ (প্রসিদ্ধ বৈমানিক) ; এরা সকলেই ছিলেন সভ্য,
ভব্য, সুশিক্ষিত, গুণী ও জ্ঞানী ব্যক্তি। এঁরা কেউই রাক্ষস বা কাচামাংসভোজী
মানুষ ছিলেন না। রাবণও তার শৈশবকালাবধি মাতা-পিতার রান্না করা খাবারই
খেয়েছেন নিশ্চয়। অতঃপর যৌবনে হঠাৎ করে একদিন তিনি খেতে শুরু করলেন জীবের
কাচামাংস ৷ বিমান বিহার, শক্তিশেল নির্মাণ ও অশোক কানন তৈরী করতে জানলেও
তিনি রান্নার পাকপাত্র গড়তে বা রান্না করতে জানেন নি। বেশ ভাল। কিন্তু
তিনি কোথায় বসে, কোন দিন, কাকে খেয়েছেন – তার একটিরও নামোল্লেখ নাই কেন?
৮ রাবণের সন্তানাদি সম্বন্ধে একটি প্রবাদ আছে –
“একলক্ষ পুত্র আর সোয়ালক্ষ নাতি,
একজন না থাকিল বংশে দিতে বাতি।”
আর অপর একটি প্রবাদ আছে –
“যাহা কিছু রটে
তার কিছু বটে।”
প্রবাদবাক্যের
লক্ষ পুত্র না হোক তার শতাংশ সত্য হলেও রাবণের পুত্রসংখ্যা হয় এক হাজার
এবং তার অর্ধাংশ সত্য হলেও সে সংখ্যাটি হয় পাঁচশ’। আর তা-তো বিস্ময়ের
কিছু নয়। জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রও ছিলেন একশ এক পুত্রের জনক। আর রাম? তার
পুত্রের সংখ্যা কথিত হয় মাত্র দুটি বলা চলে একটি। কেননা তারা ছিল সীতার এক
গর্ভজাত, যমজ সন্তান। তদুপরি সে পুত্রযুগল জন্মেছিলো নাকি রামচন্দ্রের
বিবাহের তেল্পান্ন বছর পর (বাস্তব ১২ + ১৪ = ২৬ বছর পর)। বছরের এ হিসেবটা
প্রিয় পাঠকদের কাছে একটু বেমানান বোধ হতে পারে। তাই বছরগুলোর একটা হিসাব
দিচ্ছি। বিবাহন্তে রামচন্দ্র গৃহবাসী ছিলেন ১২ বছর, বনবাসী ১৪ বছর এবং গৃহে
প্রত্যাবর্তন করে রাজাসনে কাটান নাকি ২৭ বছর (ঐ ২৭ বছর উদ্দেশ্যমূলক,
কালপনিক)। এর পর কলঙ্কিনী বলে প্রাথমিক অন্তঃসত্ত্বা সীতাদেবীকে নির্বাসিত
করা হয় বাল্মীকির তপোবনে, সেখানে জমে সীতার যুগল সন্তান কুশ ও লব।
সীতাদেবী
বন্ধ্যা ছিলেন না এবং উক্ত তেল্পান্ন বছরের মধ্যে বনবাসকালের দশ মাস (অশোক
কাননে রাবণের হাতে সীতা বদিনী ছিলেন ১০ মাস) ছাড়া বায়ান্ন বছর দুমাস
সীতা ছিলেন রামচন্দ্রের অঙ্কশায়িনী। তথাপি এ দীর্ঘকাল রতিবিরতি
রামচন্দ্রের বীর্যহীনতারই পরিচয়, নয় কি ?
৯.
রামচন্দ্রের কাহিনীকারের মতে চোদ্দ বছর বনবাসান্তে রামচন্দ্র দেশে
প্রত্যাবর্তন করে নির্বিঘ্নে সংসারধর্ম তথা রাজ্যশাসন করেছিলেন দীর্ঘ ২৭
বছর। অতঃপর প্রজাবিদ্রোহ দেখা দিয়েছিলো। কেননা লঙ্কার অশোক কাননে বন্দিনী
থাকাকালে রাবণ সীতাদেবীর সতীত্ব নষ্ট করেছিলেন এবং অসতী সীতাকে গৃহে স্থান
দেওয়ায় প্রজাগণ ছিলো অসন্তুষ্ট।
উপরোক্ত বিবরণটি শুনে
স্বতই মনে প্রশ্নের উদয় হয় যে, মরার দুযুগের পরে কান্না কেন ? বনবাসান্তে
রামচন্দ্র স্ববাসে প্রত্যাবর্তন করলে তাঁর বনবাসের বিবরণ তথা লঙ্কাকাণ্ড
দেশময় ছড়িয়ে পড়েছিলো তার দেশে ফেরার সংগে সংগেই এবং সীতাকলঙ্কের
কানাকানিও চলছিলো দেশময় তখন থেকেই। আর গুজবের ভিত্তিতে সীতাদেবীকে
নির্বাসিত করতে হলে তা করা তখনই ছিলো সঙ্গত। দীর্ঘ ২৭ বছর পর কেন ?
রামচন্দ্র
সীতাদেবীকে গৃহত্যাগী করেছিলেন শুধু জনগণের মনোরঞ্জনের জন্য, স্বয়ং তাঁকে
নাকি ‘নিকলঙ্কা’ বলেই জানতেন। এইরূপ পরের কথায় নিষ্কলঙ্কা স্ত্রী ত্যাগ
করার নজির জগতে আছে কি? এই তো সেদিন (১৯৩৬) গ্রেট বৃটেনের সম্রাট অষ্টম
এডোয়ার্ড মিসেস সিম্পসনকে সহধর্মিনী করতে চাইলে তাতে বাধ সাধলো দেশের জনগণ
তথা পার্লামেন্ট মিসেস সিম্পসন হীনবংশজাত বলে। পার্লামেন্ট এডোয়ার্ডকে
জানালো যে, হয় মিসেস সিম্পসনকে ত্যাগ করতে হবে, নচেৎ তাঁকে ত্যাগ করতে হবে
সিংহাসন। এতে এডোয়ার্ড সিংহাসন ত্যাগ করলেন, কিন্তু তাঁর প্রেয়সীকে
ত্যাগ করলেন না। শুধু তা-ই নয়, তাঁর মেঝ ভাই ডিউক-অব-ইয়র্ককে সিংহাসন
দিয়ে তিনি সস্ত্রীক রাজ্য ছেড়ে চলে গেলেন বিদেশে। রামচন্দ্রেরও তো মেঝ
ভাই ছিলো!
সীতাদেবীর সতীত্ব রক্ষার জন্য রামায়ণের
কাহিনীকার চেষ্টার কোনো ক্রটি করেননি। যেখানে তিনি লৌকিক অবলম্বন খুঁজে
পাননি, সেখানে অলৌকিকের আশ্রয় নিয়েছেন। দু-একটি উদাহরণ দিচ্ছি —
ক.
রাবণের অশোক বনে সীতার সতীত্ব রক্ষার কোনো অবলম্বন তিনি খুঁজে পাননি। তাই
সেখানে বলেছেন যে, জোরপূর্বক কোনো রমণীর সতীত্ব নষ্ট করলে রাবণের মৃত্যু
হবে, এই বলে কোনো ঋষি তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। কাজেই মৃত্যুভয়ে রাবণ
সীতাকে স্পর্শ করেননি। সুতরাং সেখানে সীতার সতীত্ব বেঁচে আছে।
খ.
সীতাকে নিয়ে রামচন্দ্র অযোধ্যায় পৌছুলে সেখানে যখন সীতাকলঙ্কের ঝড়
বইছিলো, তখন বলেছেন যে, সীতাদেবীকে অগ্নিকুণ্ডে ফেলে তাঁর সতীত্বের পরীক্ষা
করা হয়েছিলো, তাতে তাঁর কেশাগ্রও দগ্ধ হয়নি। সুতরাং সীতার সতীত্ব বেঁচে
আছে।
গ. বহুবছর বাল্মীকির তপোবনে কাটিয়ে শ্রীরামের
অশ্বমেধ যজ্ঞে কুশ-লবসহ বাল্মীকির সাথে সীতাদেবী রামপুরীতে উপস্থিত হলে
পুনঃ যখন তিনি লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ভোগ করতে থাকেন, তখন কবি বলেছেন যে,
সীতাদেবীর অনুরোধে ধরণী দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিলো এবং সীতাদেবী সে গর্তমধ্যে
প্রবেশ করে স্বর্গে বা পাতালে গিয়েছেন ইত্যাদি।
উপরোক্ত ঘটনাগুলো হয়তো এরূপও ঘটে থাকতে পারে। যথা –
ক.
রাবণের রূপলাবণ্য ও শৌর্যবীর্য দর্শনে প্রীতা হয়ে সীতাদেবী রাবণকে
স্বেচ্ছায় করেছেন দেহদান এবং তাঁকে রাবণ করেছেন বীৰ্যদান। সীতাদেবীর প্রতি
রাবণ বলপ্রয়োগ করেন নি, তাই তিনি মরেননি। হয়তো এমনও হতে পারে যে, রাবণ
যেদিন সীতার প্রতি বলপ্রয়োগ করেছেন, সেদিন তিনি রামের হাতে মরেছেন। আর
সেইদিন সীতাদেবী হয়েছেন অন্তঃসত্ত্বা।
খ. সীতাদেবীকে
নিয়ে রামচন্দ্র অযোধ্যায় পৌছুলে লঙ্কাকাণ্ড প্রকাশ হওয়ায় সেখানে তখন
সীতাকলঙ্কের ঝড় বইছিলো নিশ্চয়ই। হয়তো সীতার স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য
প্রথমত জেরাজবানবন্দি, কটুক্তি, ধমকানি-শাসনি ও পরে মারপিট ইত্যাদি শারীরিক
নির্যাতন চালানো হচ্ছিলো তাঁর প্রতি। কিন্তু তিনি নীরবে সহ্য করেছিলেন
সেসব নির্যাতন, ফাস করেননি কভু আসল কথা। আর সেটাই হচ্ছে সীতার
অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া।
গ. শ্রীরামের রাজপ্রাসাদে
সীতা প্রসঙ্গে অতঃপর থমথমে ভাব বিরাজ করছিলো কিছুদিন (২৭-২৮ দিন বা এক
রজোমাস যাকে বলা হয় ২৭ বছর)। পরে সীতাদেবীর মাসিক নির্বাসিত করেছিলেন
বাল্মীকির তপোবনে এবং সেখানে জন্মেছিলো তাঁর যুগল সন্তান কুশ-লব।
সন্তান
কামনা করে না, এমন কোনো লোক বা জীব জগতে নেই। কারো সন্তান না থাকলে তার
দুঃখের অবধি থাকে না ; বিশেষত ধনিক পরিবারে। আর রাজ্যেশ্বর রামচন্দ্রের
বৈবাহিক জীবনের দীর্ঘ ২৬ বছর পরে আসন্ন সন্তান পরিত্যাগ করলেন শুধু কি
প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য? নিশ্চয়ই তা নয়। তিনি জানতেন যে, সীতার গর্ভস্থ
সন্তান তার ঔরসজাত নয়, ঔরসজাত রাবণের। আর সঙ্গত কারণেই সীতার গর্ভজাত
সন্তানের প্রতি তার কোনো মায়ামমতা ছিলো না, বরং ছিলো ঘৃণা ও অবজ্ঞা। তাই
তিনি সীতা-সুতের কোনো খোজখবর নেননি বহু বছর যাবত। বিশেষত ঋষি বাল্মীকির
আশ্রম অযোধ্যা থেকে বেশি দূরেও ছিলো না, সে আশ্রম তিনি চিনতেন। অতঃপর
সীতাসহ কুশ-লব বিনা নিমন্ত্রণে (বাল্মীকির নিমন্ত্রণ ছিলো) ঋষি বাল্মীকির
সাথে শ্রীরামের অশ্বমেধ যজ্ঞে উপস্থিত হয়ে যেদিন রামায়ণ কীৰ্তন করে,
সেদিন কুশ-লবের মনোরম কান্তি ও স্বরে-সুরে মুগ্ধ হয়ে রামচন্দ্র তাদের
দত্তকরূপে গ্রহণ করেন। হয়তো তখন তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে, ঘটনাক্রমে ফেলনা
হলেও ছেলে দুটাে (কুশ-লব) রাজপুত্র তো বটে।
কুশ-লবকে গ্রহণ
করলেও সীতাকে গ্রহণ করেননি রামচন্দ্র সেদিনও। সীতাদেবী হয়তো আশা করেছিলেন
যে, বহু বছরান্তে পুত্ররত্ন-সহ রাজপুরীতে এসে এবার তিনি সমাদর পাবেন।
কিন্তু তা তিনি পান নি, বিকল্পে পেয়েছিলেন যতো অনাদর-অবজ্ঞা। তাই তিনি
ক্ষোভে-দুঃখে হয়তো আত্মহত্যা করেছিলেন। নারীহত্যার অপবাদ লুকানোর
উদ্দেশ্যে এবং ঘটনাটি বাইরে প্রকাশ পাবার ভয়ে শ্মশানে দাহ করা হয়নি সীতার
শবদেহটি, হয়তো লুকিয়ে গ্রোথিত করা হয়েছিল মাটির গর্তে, পুরীর মধ্যেই।
আর তা-ই প্রচারিত হয়েছে ‘স্বেচ্ছায় সীতাদেবীর ভূগর্ভে প্রবেশ বলে।
সে
যা হোক, অযোধ্যেশ্বর রাম ও লঙ্কেশ্বর রাবণের সন্তান-সন্ততি সম্বন্ধে
পযালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, রাবণ ছিলেন শত শত সন্তানের জনক, আর রামের
ছিলো না একটিও পুত্র। তিনি ছিলেন বন্ধ (আঁটকুড়া)। লঙ্কেশ্বর রাবণের
যাবতীয় গুণগরিমা ও সৌরভ-গৌরব গুপ্ত রাখার হীন প্রচেষ্টার মুখ্য কারণ —
তিনি আধ্যাত্মবাদী ছিলেন না, ছিলেন জড়বাদী বিজ্ঞানী। বিশেষত তিনি আর্যদলের
লোক ছিলেন না, ছিলেন অনার্যদলের লোক। এরূপ অনুমান করা হয়তো অসঙ্গত নয়।
আর
একটি কথা। শুধুমাত্র রাম ও রাবণকে নিয়ে রামায়ণ হতে পারে না, হনুমানকে
বাদ দিয়ে। তাই এখন হনুমান প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করছি । ঋষি বাল্মীকি ছিলেন
প্রচণ্ড রামভক্ত। কৃত্তিবাসী রামায়ণে তার কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়া যায়।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে কথিত হয়েছে যে, বাল্মীকি যৌবনে রত্নাকর নামে একজন
দস্যু ছিলেন। পরে নারদের উপদেশে দসুবৃত্তি ত্যাগ করে ছয় হাজার বছর
একস্থানে উপবিষ্ট থেকে রামনাম জপ করেন। সেই সময় তার সর্বশরীর বলমীকে
সমাচ্ছন্ন হয়। পরে তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে বলমীক হতে উখিত হওয়ায় তিনি
বাল্মীকি নামে খ্যাত হন।
যিনি আহার-নিদ্রা ও চলাফেরা
পরিত্যাগ করে ছয় হাজার বছর বা ছয় বছরও রামনাম জপ করতে পারেন, রামের
শৌর্য, বীর্য, গুণ-গরিমা ও ইজ্জৎ বৃদ্ধির জন্য তিনি কি না করতে পারেন?
শীরামের প্রাধান্য রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি গুণী, জ্ঞানী ও সুসভ্য রাবণকে
রাক্ষস বানিয়েছিলেন, ভাগ্যিস পশু বানান নি। রামায়ণ মহাকাব্যের বনপর্বে এক
বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে হনুমান, জাম্ববান, সুগ্ৰীব ও তার ভ্রাতা
বালীরাজ। রামায়ণের কাহিনীকার তাদের সদলে অঙ্কিত করেছেন পশুরূপে। বিশেষত
হনুমান, সুগ্ৰীব ও বালীরাজকে সদলে বানর বানিয়েছেন এবং জাম্ববানকে
বানিয়েছেন ভালুক। কিন্তু তারা কি আসলেই পশু ছিলো?
সে যুগে
স্বর্গগত দেবতাদের কেউ কেউ মর্ত্যবাসী কোনো কোনো মানবীর সাথে যৌনাচারে
লিপ্ত হতেন এবং তৎফলে কোনো সন্তানের জন্ম হলে সে দেবতা হতো না বটে, কিন্তু
সাধারণ মানুষও হতো না, হতো অসাধারণ মানুষ। যেমন – সূর্যদেবের ঔরসে কুমারী
কুস্তির গর্ভে জন্ম নেন কর্ণ। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত যোদ্ধা ও দাতা। দেবতা
যমের ঔরসে পাণ্ডুপত্নী কুন্তির গর্ভে জন্মলাভ করেন যুধিষ্ঠির। তিনি ছিলেন
ধাৰ্মিক চূড়ামণি, যার ফলে তাঁর নাম হয়েছিল ধর্মরাজ। ইন্দ্রদেবের ঔরসে
কুস্তির ক্ষেত্রে জন্ম নেন অৰ্জুন। তিনি ছিলেন সে যুগের ভারতবিখ্যাত যোদ্ধা
ইত্যাদি। কিন্তু কোনো দেবতা কখনো কোনো পশুর সাথে যৌনাচারে লিপ্ত হচ্ছেন
এবং তাতে কোনো পশুরূপী সন্তান জন্ম নিচ্ছে, এমন কাহিনী কোথাও কোনো
পুরাণশাস্ত্রে দেখা যায় না। পৌরাণিক মতে এখানে হনুমানের কিঞ্চিৎ পরিচয়
দিচ্ছি। এতে দেখা যাবে যে, হনুমানরা সবাই ছিলো মানুষ। এবং ওদের আভিজাত্যও
রামের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
প্রথমত হনুমান — পবনদেবের ঔরসে মানবী অঞ্জনার গর্ভে এর জন্ম। কাজেই হনুমান দেব-মানবের বংশজাত একজন বীর্যবন্ত মানব।
দ্বিতীয়ত
জাম্ববান – এ হচ্ছে দেবতা ব্ৰহ্মার পুত্র। জাম্ববানের কন্যার নাম জাম্ববতী
এবং তাকে বিয়ে করেন হিন্দুদের পরম পূজনীয় শ্ৰীকৃষ্ণ। সুতরাং জাম্ববান
হচ্ছে শ্ৰীকৃষ্ণের শ্বশুর। কাজেই সে ভালুক বা পশু হতে পারে না, সে ব্রহ্ম
বংশের মানুষ ; সুতরাং ব্রাহ্মণ।
তৃতীয়ত বালী ও সুগ্ৰীব –
দেবরাজ ইন্দ্রের (মতান্তরে সূর্যের) ঔরসে ও ব্রহ্মার মানসকন্যা রক্ষরজার
গর্ভে বালী ও সুগ্ৰীবের জন্ম হয়। সুতরাং বালী ও সুগ্ৰীব হচ্ছে ইন্দ্রের বা
সূর্যের পুত্র এবং ব্রহ্মার দৌহিত্র (নাতি)। বিশেষত ব্ৰহ্মার বংশজাত বলে
তারা ব্রাহ্মণত্বের দাবীদার।
উপরোক্ত আলোচনাসমূহের দ্বারা
অনুমান হয় যে, রামায়ণোক্ত বানররা পশু ছিলো না, তারা ছিলো ভারতের
‘কিঙ্কিন্ধ্যা’ নামক অঞ্চলের আদিম অধিবাসী এবং আলোচ্য ব্যক্তিরা ছিলো
সেকালের বিশিষ্ট ব্যক্তি। কেননা রামায়ণ মহাকাব্যে অজস্র বানরের আভাস
থাকলেও প্রাধান্য পেয়েছে এরাই।
এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী
মর্গানের মতবাদ অনুধাবনযোগ্য। মর্গানের মতে – বেচে থাকার তাগিদেই মানুষকে
জোট বাধতে হয়েছে। জোট মানে দল। কিন্তু কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে দল বাধবে?
মৰ্গানের গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে, সে সময় মানুষ দল বেঁধেছিলো জ্ঞাতি
সম্পর্কের ভিত্তিতে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জ্ঞাতি, একই পূর্বপুরুষ থেকে
তাদের জন্ম। মর্গান এমনি এক একটি দলের নাম দিয়েছিলেন গেনস (Gens)।
মর্গানের পরের যুগের নৃবিদরা গেনস্ শব্দের বদলে ক্লান (Clan) শব্দটি
ব্যবহার করেছেন এবং ক্লান শব্দটিই চলছে।
কয়েকটি ক্লান
একসঙ্গে জোট বাধলে যে বড়ো দলটি গড়ে ওঠে, তার নাম দেয়া হয়েছে ট্রাইব
(Tribe)। আবার অনেকগুলো ট্রাইব মিলে আরো বড়ো একটি সংগঠন, তার নাম
কনফেডারেসি অব ট্রাইবস। সাধারণত জন্তু-জানোয়ারের নাম
থেকেই ক্লানের নাম হতো। যেমন – ভালুক, নেকড়ে বাঘ, হরিণ, কাছিম ইত্যাদি।
আবার ফুল, ফল, লতাপাতার নাম থেকেও ক্লানের নামকরণ হতো। এধরণের নামকরণের
মূলে যে বিশ্বাসটি রয়েছে, তাকে বলা হয় টোটেম বিশ্বাস।
পাক-ভারত
উপমহাদেশের সাওতাল উপজাতির শতাধিক গোত্র বা টোটেম আছে, হো উপজাতির আছে
৫০টিরও বেশী। এরূপ মুণ্ডা উপজাতির প্রায় ৬৪টি, ভীল উপজাতির ২৪টি, ছোটাে
নাগপুরের খারিয়া উপজাতির ৮টি এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার দৌড়ি
উপজাতির মধ্যে ৪টি গোত্র বা টোটেম রয়েছে। এদের প্রত্যেক গোত্রই — পশু,
পাখী, গাছপালা অথবা কোনো বস্তুর নামে পরিচিত। আমাদের দেশেও হিন্দু
সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐরূপ বহু গোত্রের নাম দৃষ্ট হয়, যদিও এগুলোকে ঠিক
টােটেম বলা যায় না। যেমন – সেন (শ্যেন = বাজপাখী), নাগ (সপ), সিংহ
(পশুরাজ) ইত্যাদি। গোত্রের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেকে তার গোত্রের টোটেমের
নামে পরিচয় দিয়ে থাকে। যেমন – সিংহ গোত্রের সবাই সিংহ, বাঘ গোত্রের সবাই
বাঘ, হরিণ গোত্রের সবাই হরিণ ইত্যাদি।
মর্গানের মতে বিশেষত
আধুনিক বহু নৃতত্ত্ববিদের মতে – রামায়ণোক্ত ) জাম্ববান ও হনুমানাদি ভালুক
ও বানররা পশু ছিলো না, তারা ছিলো সেকালের কিষ্কিন্ধ্যার (ভারতের
দণ্ডকারণ্যের অংশবিশেষ, আধুনিক নাম নাশিক) অনার্য অধিবাসী (মানুষ)। বানরাদি
ছিলো তাদের টােটেম বা বংশগত উপাধি মাত্র। অধিকন্তু এ-ও অনুমান হয় যে,
হয়তো হনুমান ও সুগ্ৰীব ছিলো কোনো ক্লান ও ট্রাইব-এর অধিকর্তা এবং বালী
ছিলো কোনো ‘কনফেডারেসী অব ট্রাইবস-এর অধিপতি, অর্থাৎ রাজা।
পরিশেষে
– রামভক্ত ভাইদের সবিনয়ে বলছি যে, মানুষ ও পশু-পাখীর চেহারা, চরিত্র ও
ভাষা – এ তিনে প্রকাশ পেয়ে থাকে তাদের স্বকীয়তা বা ব্যক্তিত্ব। কিন্তু
ভাষার ক্ষেত্রে মানুষের সমকক্ষ অপর কোনো জীব নেই। কেননা মানুষের মতো অন্য
কোনো জীবের – দন্ত, ওষ্ঠ, তালু, জিহা ইত্যাদি স্বরযন্ত্র নেই। তাই রামায়ণে
কবি কিষ্কিন্ধ্যবাসীদের চেহারা বদলিয়ে বানরাদি বানিয়েছেন বটে, কিন্তু
তাদের ভাষা ও চরিত্র বদলাতে পারেননি, তা রেখেছেন সর্বত্রই মানুষের মতো।
রামায়ণ গ্ৰন্থই তার সাক্ষী।
দশাননের এমন কিছু স্বপ্ন ছিল,
যা আমাদের কল্পনারও অতীত।মহাকাব্য ‘রামায়ণ’-এ রাবণকে এমন এক তুলিতে
এঁকেছিলেন কবি বাল্মীকি, যাতে তাঁকে এক নির্যস খলনায়ক বলে কিছুতেই মনে
হয়না। সত্যি বলতে, রাবণের উপরে আরোপিত হয়েছে এমন কিছু বিরল গুণাবলি, যা
সাধারণত মানুষের মধ্যে দেখা যায় না। তবে এটাও ঠিক, রক্ষরাজ রাবণ তো ‘মানুষ’
ছিলেন না। তাঁর জন্ম এবং সাধনা তাঁকে এক প্রবল পরাক্রমশালী ‘অর্ধ-দেবতা’
হিসেবেই তাঁকে স্থিত করে। ‘রামায়ণ’-এ রাবণকে এভাবেই দেখানো হয়েছে যে, তিনি
পারেন না হেন কাজ নেই। কিন্তু কিছু চরিত্রদোষ তাঁকে নায়কের আসন থেকে চ্যুত
করে এবং এক ট্র্যাজিক চরিত্র হিসেবেই সিদ্ধি দেয়। এই চারিত্রিক
দুর্বলতাগুলিই রাবণকে তাঁর বেশ কিছু সংকল্পের বাস্তবায়নে বাধা দেয়। বা আরও
খোলসাকরে বললে, চূড়ান্ত আত্মম্ভরিতার কারণে এমন কিছু সংকল্প রাবণ করে
বসেন, যা প্রবল পরাক্রমশালী হওয়া সত্ত্বেও তিনি পূরণ করতে ব্যর্থ হন। কী
সেই সব কাজ, যা রাবণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু করতে পারেননি?
সীতা কি রাবণের কন্যা ছিলেন?
রামায়ণের
অন্যতম মুখ্য চরিত্র সীতা। হিন্দু ধর্মমতে সীতাকে দেবী হিসেবে মানা হয়।
মূল রামায়ণ বাল্মিকীর রচনা হলেও এর আরও অনেকগুলি ভার্সান রয়েছে। রামায়ণের
পরের যে ভার্সান অত্যন্ত জনপ্রিয়, তা হল তুলসীদাস রচিত রামায়ণ। এছাড়াও
রাম, সীতা ও রাবণের এই মহাকাব্যের আরও ৩০০টি ভার্সান রয়েছে। প্রতিটি
ভার্সানেরই একে অন্যের সঙ্গে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।
রামায়ণে
রামের প্রধানতম প্রতিপক্ষ রাবণের কথা কে না জানে? তাঁর স্ত্রী মন্দোদরীর
কথাও কারোর অজানা নয়৷ কিন্তু তাঁর জীবনের কথা কতজন জানে? রামায়ণে রাম ও
সীতার খবর সবাই রাখে৷ তাদের বনবাস, রাম-রাবণের যুদ্ধ সবার জানা৷ কিন্তু
মন্দোদরীর ইতিহাস রয়ে গিয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ রাবণের স্ত্রী হিসেবেই
মহাকাব্যে বেঁচে রয়েছেন তিনি৷ কিন্তু মন্দোদরীর একটি আলাদা ইতিহাস রয়েছে।
স্বর্গের
অপ্সরা মধুরা ছিলেন মধুরা৷ একদিন তিনি শিবের সান্নিধ্য পেতে কৈলাসে যান৷
তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না দেবী পার্বতী৷ তাঁর অনুপস্থিতিতে শিবকে
মোহবিষ্ট করার চেষ্টা করেন মধুরা৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেখানে উপস্থিত হন
পার্বতী৷ শিবের ভষ্ম তিনি মধুরার শরীরে মাখামাখি অবস্থায় দেখতে পান৷ আর
যায় কোথায়? তৎক্ষণাৎ মধুরাকে তিনি শাপ দেন৷ পার্বতীর শাপে ১২ বছর কুয়োর
মধ্যে ব্যাঙ হয়ে কাটাতে হয় মধুরাকে। কিন্তু পার্বতী
এতটাও কঠোর ছিলেন না৷ শিবের অনুরোধে নিজেকে শান্ত করেন তিনি৷ মধুরাকে বলেন,
১২ বছর পর নিজের রূপে আবার ফিরতে পারবেন মধুরা।
অসুরের
রাজা মায়াসুর ও তাঁর স্ত্রী হেমার ২ পুত্র ছিল৷ কিন্তু কোনও কন্যা সন্তান
ছিল না৷ তাই তাঁরা মেয়ের জন্য তপস্যা শুরু করেন৷ এর মধ্যেই মধুরার ১২
বছরের শাপিত জীবন কেটে গিয়েছিল৷ তিনি স্বমহিমায় ফিরে এসেছিলেন৷ কুয়োর
মধ্যে বসেই কাঁদছিলেন তিনি৷ কাছেই তপস্যারত মায়াসুর ও হেমা তাঁর কান্যা
শুনতে পান৷ মধুরাকে কুয়ো থেকে উদ্ধার করে প্রাসাদে নিয়ে যান তিনি৷ মধুরা
হয়ে যান মন্দোদরী।
একবার রাবণ মায়াসুরের প্রাসাদে
বেড়াতে আসেন৷ সেখানে মন্দোদরীকে দেখেন তিনি৷ মন্দোদরীর রূপমুগ্ধ রাবণ
তাঁকে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন৷ কিন্তু মায়াসুর রাবণের সঙ্গে মেয়ের
বিয়ে দিতে অস্বীকার করেন৷ কিন্তু রাবণ হার মানবার পাত্র নয়৷ মন্দোদরীকে
জোর করে বিয়ে করেন তিনি৷ বাবার অবস্থা নিয়ে চিন্তিত ছিল মন্দোদরী৷ তাই
বিয়েতে তিনি বাধা দেননি৷ রাবণ ও মন্দোদরীর ৩ ছেলে হয়৷ মেঘনাদ, অতিকায় ও
অক্ষয়কুমার৷
নিজের দায়িত্ব নিয়ে সচেতন ছিলেন মন্দোদরী৷
তাই যখন তিনি শুনলেন রাবণ বিপথে যেতে চাইছেন, বারবার স্বামীকে সতর্ক
করেছিলেন তিনি৷ রাবণের কাছে তিনি ভিক্ষা চেয়েছিলেন, সীতাকে যেন তাঁর
স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷ কারণ তিনি জানতেন, অভিশাপ অনুযায়ী একদিন
রাম আসবেন ও রাবণ বধ করবেন৷ যখন রাম ও রাবণের যুদ্ধ হয়, স্বামীর সঙ্গে
যুদ্ধক্ষেত্রেই উপস্থিত ছিলেন তিনি৷ সাহস জোগাচ্ছিলেন স্বামীকে৷ যদিও তিনি
জানতেন তাঁর ভাগ্যে কী রয়েছে।
রাবণের মৃত্যুর পর
যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিলেন মন্দোদরী৷ স্বচক্ষে দেখেছিলেন স্বামীর মৃতদেহ৷
দেখেছিলেন স্বামীর সঙ্গে মারা গিয়েছেন তাঁর ছেলেরা ও দেওররা৷ শোক সামলে
ওঠার পর রামের দিকে ঘুরে তাকিয়েছিলেন মন্দোদরী৷ বুঝেছিলেন, এই ব্যক্তি
অমর৷ সাধারণ মানুষ তিনি নন৷ তিনি সাক্ষাৎ বিষ্ণু। রাবণের
লঙ্কার ভার রাম বিভীষণকে সঁপে দেন৷ মন্দোদরীকে বিয়ে করার পরামর্শও তিনি
বিভীষণকে দিয়েছিলেন৷ মন্দোদরীকে তিনি লঙ্কার রানি ও বিধবার কর্তব্যের কথা
স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।
রাম, সীমা ও লক্ষণ বানর সেনাকে
নিয়ে অযোধ্যায় ফেরা পর নিজেকে প্রাসাদের মধ্যে আবদ্ধ করে দিয়েছিলেন
মন্দোদরী৷ কিছুদিন পর তিনি প্রাসাদের বাইরে বের হন ও বিভীষণকে বিয়ে করেন৷
লঙ্কাকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন তিনি৷
মন্দোদরীর মেয়ে সীতা?
রাবণের
একটি অভ্যাস ছিল৷ তিনি যে কজন সাধুকে হত্যা করতেন, তাঁদের রক্ত একটি
পাত্রে সঞ্চিত করতেন৷ রাবণ বিশ্বাস করতেন এই রক্ত তাঁকে মহাশক্তি দেবে৷ ঋষি
ঘৃতসমাধাকে যখন তিনি হত্যা করেন তখন তাঁর থেকে একটি দুধভর্তি ঘড়া পান
রাবণ৷ ঋষি সেখানে দুর্বা ঘাসের দুধ বের করে সেটি শুদ্ধ করেছিলেন৷ দেবী
লক্ষ্মীকে নিজের মেয়ে হিসেবে পাওয়ার বাসনা ছিল তাঁর।
তারই
আয়োজন চলছিল। তাঁকে হত্যার পর সেই ঘড়া রাবণের হাতে আসে৷ নিজের রক্তপূর্ণ
পাত্রে তিনি সেটি মিশিয়ে দেন৷ এদিকে রাবণের কাজে ক্রুদ্ধ মন্দোদরী সেই
পাত্রের সমস্তটা পান করেন৷ আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন তিনি৷ কিন্তু যেহেতু
সেই তরলটি দেবী লক্ষ্মীকে মেয়ে হিসেবে পাওয়ার বাসনা থেকে তৈরি হয়েছিল,
গর্ভবতী হয়ে পড়েন মন্দোদরী৷ প্রসবের পর মেয়েকে অনেক দূরে মাটির নীচে
পুঁতে রাখেন তিনি৷ মিথিলার রাজা সেই মেয়েকেই মাটির নীচ থেকে খুঁজে পান৷
জন্ম হয় মৈথিলীর৷ তবে এ নিয়ে ধর্ম ও শাস্ত্রে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে৷এমনকি
প্রায় প্রতিটি ভার্সানেই সীতা চরিত্র সম্পর্কে কিছু আলাদা আলাদা তথ্য
পাওয়া যায়। এরকমই সীতা সম্পর্কে ৫টি ভিন্ন ভিন্ন চমকপ্রদ তথ্য আজ আপনাদের
সামনে তুলে ধরব।
* বাল্মিকীর রামায়ণ অনুসারে সীতা ছিলেন
জনক রাজার পালিত কন্যা। যিনি আসলে লক্ষ্মীদেবীর অবতার। এই কারণেই সীতা
স্বামীর প্রতি ভালোবাসা ও ধৈর্য্যশক্তির প্রতীক। কিন্তু সংঘদশা জৈনের
ভার্সান-মতে সীতা ছিলেন আসলে রাবণের ঔরস-জাত কন্যা। লঙ্কেশ্বর ও মন্দোদরীর
এই কন্যার জন্মের আগেই ভবিষ্যত্বাণী হয়েছিল যে এর কারণেই রাক্ষসবংস ধ্বংস
হবে। তাই জন্মের পরেই সীতাকে পরিত্যাগ করা হয়। মাটিতে পুঁতে দেওয়া ছোট্ট
সীতাকে উদ্ধার করেন জনক রাজা।
* রামায়ণের অন্য ভার্সান
অনুযায়ী, রাবণ আসল সীতাকে অপহরণ করতে পারেননি। দেবী পার্বতী আসল সীতাকে
নিজের কাছে রেখে মায়া সীতা তৈরি করে তাঁকে লঙ্কা পাঠান। এই মায়া সীতাই পরের
জন্মে দ্রৌপদী হয়ে জন্ম নেয়।
* ভিন্নমত আছে সীতার
জন্মস্থান নিয়েও। কোনও কোনও মতে সীতার জন্ম হয় জনকপুরে, কোনও ভার্সান
অনুযায়ী সীতা জন্মান দক্ষিই নেপালের মিথিলায়। আবার কারোর মতে সীতার জন্ম হয়
বিহারের সীতামারহি-তে।
* এটাও বলা হয়ে থাকে যে রাবণ একবার
বেদবতী নামে এক সুন্দরী মহিলার শ্লীলতাহানি করেন। বেদবতী রাবণকে অভিশাপ
দেন যে এর প্রতিশোধ তিনি নেবেন। তিনিই পরের জন্মে সীতা হয়ে জন্মান।
*
আনন্দ রামায়ণেও অনেকটা একই কথা বলা আছে। আনন্দ রামায়ণ অনুসারে রাজা
পদ্মাক্ষর কন্যা পদ্মার শ্লীলতাহানি করেছিলেন রাবণ। তিনি সীতারূপে জন্মে এর
প্রতিশোধ নেন।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন