ফাগুন বউ : চন্দন কুমার কুণ্ডু

চন্দন কুমার কুণ্ডু
 
ফাগুন বউ
 
চন্দন কুমার কুণ্ডু

অনেকগুলো ছেলে বন্ধু তিতিরের। যখন যার সাথে ওকে আলাদা ভাবে দেখা যায়, মনে হয় ও যেন তারই প্রেমিকা। উচ্ছ্বল তিতিরের ছেলেবন্ধুদের মধ্যে ফল্গু ধারার মত ভেতরে ভেতরে একটা প্রতিযোগিতা আছে। নিষাদ আর অরণ্য'র মধ্যে এই প্রতিযোগিতাটা একটু বেশি। শান্ত ধীর স্থির বুদ্ধিদীপ্ত অরণ্য। আর সুঠাম চেহারার রাফ অ্যান্ড টাফ নিষাদ। কে তিতিরের কত বেশি কাছের প্রমাণ করতে ব্যস্ত সকলেই। তারপর হঠাৎ করেই অরণ্যর চাকরি পাওয়া। সবকিছুকেই কেমন যেন ঘুলিয়ে দিল।
                 
বসন্তের বিকেল। সবুজ ঘাসে ঢাকা খেলার মাঠে কয়েকটি বাচ্চা খেলা করছে। তাদের মায়েরা একদিকে বসে গল্প গুজবে ব্যস্ত। এদিক ওদিক কিছু ছেলে মেয়ে  গল্পে মশগুল।  মাঠের এক প্রান্তে পাশাপাশি দুটো ফাগুন বউ হলুদ ফুলে ভরে গেছে। একটা মুচকুন্দ গাছের তলায় বসে তিতির আর অরণ্য। তাদের ঠিক পিছনের কদম গাছের ডালে একটা কোকিল একটানা কুহু কুহু রবে চারিদিক মোহময় করে তুলেছে। সূর্য  পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়তেই সমস্ত আকাশ জুড়ে রঙিন আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়ল। মনে হল কেউ যেন আবির ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশে। হঠাৎ তিতির বলে বসল,
--এই অরণ্য চল বিয়ে করি।
--তুই সত্যি বলছিস? আমাকে বিয়ে করবি তুই!
--কেন তুই কি চাস না? তাহলে আর বলব না।
অভিমানের সুর তিতিরের গলায়।
আর কিছু বলতে হয় নি তিতির কে, একেবারে সোজা তার মায়ের কাছে টেনে নিয়ে গেল অরণ্য। তার মা তো আগে থেকেই জানেন। ছেলের মন জুড়ে আছে তিতির। যদিও মায়ের কাছে কোন দিনই তিতির তাকে ভাল বাসে কি না বা তিতির কে বিয়ে করার কথা বলেনি অরণ্য। তিনিও ভাবছিলেন, কতই বা ছেলের বয়স, বিয়ে বিয়ে করে পাগল করার দরকার নেই। ছেলে নিজেই বলবে ঠিক সময় হলেই। অরণ্যর সঙ্গে তিতির কে দেখে খুশিই হলেন তিনি।বাড়ি ঢুকেই এক মুখ হাসি নিয়ে খুশিতে উজ্জ্বল অরণ্য বলল,
--মা, কে এসেছে দেখ।
--ওমা তিতির। এস এস  কতদিন পর এলে তুমি।
-- হ্যাঁ কাকিমা, ভাল আছেন ?
পা ছুঁয়ে প্রণাম করল তিতির। চিবুকে হাত ছুঁয়িয়ে আশীর্বাদ করে অরণ্যর মা বললেন,
--ভাল থাক মা। সুখি হও।
কোন ভূমিকা না করে অরণ্য মা কে উদ্দেশ্য করে বলে,
-- মা, তিতির বিয়ের কথা বলছে। তাই ওকে তোমার কাছে নিয়ে এলাম। বাকি কথা তুমি বলে নাও।
তিতির অরণ্যর বাড়িতে  আজ প্রথম এসেছে এমন নয়। কিন্তু যত বারই এসেছে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে হই হই করে এসেছে। খাওয়া দাওয়া করে, চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছে। আবার হই হই করতে করতেই চলে গেছে। অরণ্যের মা ও স্নেহ ভরে ছেলে আর ছেলের বন্ধুদের এসবের মধ্যে খারাপ কিছু দেখেননি কোনদিন‌। স্কুলের শিক্ষাকর্মী নির্ভেজাল ভাল মানুষ অরণ্যের বাবা  সংসারের কোন ব্যাপারেই বাড়তি আগ্ৰহ দেখান নি। স্ত্রীর ওপর সংসারের ভার দিয়ে মহাদেবের মতই নিশ্চিন্ত থেকেছেন তিনি।
তিতির আর অরণ্যর বিয়ে নিয়ে আর বেশি কথার দরকার পড়ল না। তিতির ই অরণ্যকে ধরে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিল, সঙ্গে বসল নিজেও। কিন্তু যে পাখি অসীম আকাশে উড়তে পছন্দ করে  খাঁচায় তাকে ধরে রাখে কার সাধ্য?

বিয়ের পর মাত্র কয়েকটা দিন তারপর তিতির আবার যে কে সেই। স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি  সব যেন কেমন মেকী ঠেকল তিতিরের চোখে।          
--রঙ্গমঞ্চে চোখে মুখে রঙ মেখে এ যেন এক সস্তার যাত্রাপালা,অসহ্য!
চিরদিন যা মনে হয়েছে তাই করেছে সে। যা মুখে এসেছে তাই বলেছে। কিন্তু এযেন এক চরম বিড়ম্বনা; এ জীবন  সে চায়নি। এ জীবন সে চায় না। আগের মত আবার ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে। এবারে যেন বাঁধ ভাঙা উদ্দামতা। নারী সূলভ যেটুকু সংকোচ, যেটুকু লজ্জা ছিল  তাও চলে গেছে এই ক'দিনে। জীবন যেন উপভোগ্য হয়ে উঠেছে অনেক বেশি।

ছ'মাস যেতে না যেতেই চিড় ধরেছে শাশুড়ি বউ-এর সম্পর্কে। তিতির এখন আর ছেলের বান্ধবী নয়, তার বাড়ির বউ। অরণ্যর মা,বউমার উচ্ছ্বল জীবন মানতে পারেন নি। যতই হোক, তিনি পুরোনো কালের মানুষ। একালের ছেলে মেয়েদের রকম সকম তাঁর চিন্তার বাইরে। মায়ের আচরণ বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে অরণ্যর ও। ফল যা হবার তাই হয়েছে। অরণ্যরা বাড়ি ছেড়ে উঠেছে ভাড়া বাড়িতে। নতুন চাকরি, নতুন অফিস ,নতুন সংসার সবকিছু মাঝে মাঝে কেমন ঘেঁটে যায় অরণ্যর কাছে। তবু সারাদিনের শেষে যখন তিতিরের মুখোমুখি বসে বা যখন তিতির কে গভীর ভাবে কাছে টেনে নেয়, তখনো যেন বিশ্বাস করতে পারে না যে, তিতির তার স্ত্রী; একান্তই তার। কৃতজ্ঞতায় ছোট হয়ে যায় অরণ্য।

চাকরির বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তিতিরের বায়না,যে করেই হোক একটা ফ্ল্যাট কিনতেই হবে। কত দিন আর ভাড়া বাড়িতে থাকবে তারা! অরণ্য চেষ্টা চরিত্র করে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে কিনে ফেলল একটা ফ্ল্যাট। তিতিরের আব্দার বিয়ের পর অরণ্য তাকে বিশেষ কিছুই দেয়নি, তাই  তাকে ফ্ল্যাটটা উপহার দিক। ভালবেসে বিয়ে করেছে অরণ্য এটুকু উপহার আর এমন কী! বিয়ের আগে মাঝে মাঝেই তার মনে হয়েছে তিতিরের সঙ্গে বিয়ে না হলে সে মরেই যাবে। বিয়ের এত গুলো দিন পরে তিতির কে কিছু দিতে পেরে খুব খুশি সে।

অরণ্য একদিন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে কিছু টাকা মায়ের হাতে দিতে যায়। কিন্তু মা স্বস্নেহে সে টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বলেন,
--তোর নতুন সংসার। অনেক টাকা পয়সার প্রয়োজন। আমাদের জন্য চিন্তা করিস না। তোর বাবার রোজগারেই তোকে বড় করেছি। এখন বেশি টাকা নিয়ে কী করব!
মনটা খারাপ হয়ে যায় অরণ্যর। কত আশা ছিল তার। চাকরি পেলে সংসারের সব দায়িত্ব নিজে হাতে নেবে। বাবা ,মা কে কোন পরিশ্রম আর করতে দেবে না সে। বিয়ে করে সংসারী হয়ে আত্মীয়-পরিজনদের দেখিয়ে দেবে বিয়ে করলে ছেলেরা পর হয়ে যায় না।
এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফেরে অরণ্য। সেদিন রাত্রেই তিতির আব্দার করে সামনে বিবাহ বার্ষিকীতে তাকে একটা স্কুটি কিনে দিতে হবে। ক্ষণিকের জন্য একটু অবাক হয় অরণ্য। কত তফাত দুজনের মধ্যে। তার মাও একজন নারী। মায়ের হাতে টাকা তুলে দিলেও মা ছেলের নতুন সংসারের কথা ভেবে তা ফিরিয়ে দিয়েছেন। আর তার স্ত্রী ...
কিছু বলে না সে। পরক্ষণেই মনে হয়, তিতির  বাড়ি ছেড়ে, বাবা, মা কে ছেড়ে শুধু তার টানে এসেছে, তারও কিছু চাওয়া পাওয়া থাকা স্বভাবিক। তিতিরের আব্দার টুকু সহজ ভাবেই মেনে নেয় সে।

অরণ্যর ফ্ল্যাটে বন্ধুদের যাতায়াত নেই এমন নয়। কিন্ত অরণ্যর সঙ্গে তাদের আড্ডা আর আগের মত জমে না। অরণ্যও কেমন যেন আন ইজি ফিল করে এখন। সে নিজেও বোঝে না কেন এমন হয়। বন্ধুরা বলে, চাকরি পেয়ে অরণ্য পুরো পাল্টে গেছে। কোন মন্তব্য করে না তিতির। বন্ধু থাকা কালীন কত ঝগড়া করেছে তারা। অরণ্য আর তিতির মারপিট করতেও ছাড়েনি। তিতির ভুল কিছু করলে জোরের সঙ্গে প্রতিবাদ করেছে, সাবধান ও করেছে কখনো কখনো। কিন্তু বিয়ের পর একি পরিবর্তন তার! তিতিরের কোন কিছুতেই দোষ দেখে না সে। প্রতিবাদ করে না কোন কিছুরই‌। সব দাবি, রাগ, উচ্ছাস , হইচই নির্বিবাদে মেনে নেয়। তার এই অতি ভালমানুষিটা আস্ত আস্তে অসহ্য হতে শুরু করেছে তিতিরের কাছে। তাই বিনা কারণেই ঝগড়া করতে চায় তিতির। চিৎকার করে বলে,
--এই অতি ভালমানুষিটা তোর মুখোশ। কেন তুই আমাকে বারণ করিস না? কেন রাগ করিস না? তুই  চাস  আমি উচ্ছন্নে যাই। আমি নষ্ট হয়ে যাই।
-- কী যে বলিস! তা চাইব কেন। তুই যাতে ভাল থাকিস,  তাই চাই আমি।
-- আমার ভাল থাকার খোঁজ রাখিস তুই? আমি তোকে দেখিয়ে দেব আমার ভাল থাকা কী? তুই প্রস্তুত থাকিস।

বসন্ত যায় যায়। শিমুলের লাল শেষ হয়ে বড় বড় ফলগুলি গাঢ় সবুজ থেকে ধূসর হতে শুরু করেছে। আর কদিন পরেই ফেটে  ছড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায়। পলাশ ও ঝরে পড়েছে। বিবর্ণ পাতা নিয়ে সৌন্দর্য শূন্য গাছ গুলি দাঁড়িয়ে আছে।
                 বঙ্গপোসাগরে গভীর নিম্নচাপ ঘূর্ণী ঝড়ের আকার নিয়েছে। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির দাপট বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। আকাশ কে চিরে বিদ্যুতের ঝলকানি চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। ঝড় বৃষ্টির দাপট  কমতে কমতে সন্ধ্যা গড়িয়েছে। অরণ্য সারা শরীর ভিজে সপসপে হয়ে জল কাদা মেখে ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছে দেখল ঘর বন্ধ। চাবি খুঁজতে পকেটে হাত ঢুকিয়েই মনে পড়ল, দুদিন আগেই তার কাছ থেকে তিতির ডুপ্লিকেট চাবি চেয়ে নিয়েছিল। গেটের পাশে চাবি রাখার গোপন জায়গায় হাতড়ে চাবি পেল না, পেল তিতিরের হাতে লেখা এক টুকরো কাগজ। বা‌ঁ হাতে কাগজটা ধরে ডান হাত দিয়ে ভিজে মাথা থেকে ঝরে পড়া কপালের জল মুছল। হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে জল মুছে কাগজটা দুহাতে মেলে পড়ে দেখার চেষ্টা করল। তাতে লেখা,
-- তোর কাছে মুক্তি চেয়েছি আগেই। সামনে থাকলে আমাকে তুই মুক্তি দিতে পারবি না, তা আমার চেয়ে ভাল আর কে জানে? আমি নিষাদের সঙ্গে ভাল থাকতে চললাম। তুই তোর ভাল মানুষি নিয়ে থাক। আমার জীবনের যা কিছু সম্পদ তা অনায়াসে তোকে দিয়েছি। আমি শুধু তোর এই ফ্ল্যাটটুকু নিলাম। এখানে আর আসবি না কোনদিন।  যোগাযোগ করার চেষ্টাও করিস না। ভাল থাকিস।
                                                    ---তিতির
এক লহমায় সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেল যেন। গাছেরাও এখন স্থির। বৃষ্টি পড়ছে না। আকাশটাও গুম হয়ে আছে । উদ্ভ্রান্ত, বিধ্বস্ত অরণ্য হাঁটতে হাঁটতে কখন বাড়ির সামনে পৌঁছে গেছে। সম্বিত ফিরে তাকাতেই চোখে পড়ল ,সামনের আমগাছটা থেকে একটা পেঁচা ঝপ করে মাটিতে নেমে একটা ইঁদুরের টুঁটি চেপে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। অরণ্য মনে মনে ভাবল, এই দুর্যোগের মধ্যেও শিকার করতে বেরিয়েছে পেঁচাটা!!!

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.