'বুদ্বুদ ও প্রতিধ্বনি',
'বিরকিচা নগরের পদ্য',
'ধুলোট' এর পর রাজীব ঘোষাল এর কাব্যগ্রন্থ 'খ্যাপাটে ঈশ্বর'। আত্মসমাহিত নিগূঢ় আবেগে ভরপুর এই বইটি পড়ে মনে হয়েছে এক রক্তবর্ণ প্রলাপ যেন ঘিরে ধরেছে কবিকে। বাউল যেমন করে ঘুরে ঘুরে আপন খেয়ালে সমস্ত ব্যাকরণের ঊর্ধ্বে সুর ভাসিয়ে দেন, ঠিক তেমন করেই রাজীব ঘোষালও কথাকে ভাসিয়ে দিয়ে বলেন 'আমার এ গান ছেড়েছে সকল অলংকার'। বাইরের এই অলংকারকে বাদ দিয়ে যদি কবিতার গভীরে প্রবেশ করা যায় ,দেখা যায় সত্যতম উচ্চারণে রয়েছে অন্যরকম এক সুর। সেই সুরেই কবিতার আসল অস্তিত্ব। সহজ ভাষায় সত্যের দিকে পৌঁছবার চেষ্টা করেছেন কবি। শব্দ নির্মানে কোথাও একবিন্দু চাতুর্য নেই। শব্দগুলো যেন ভেতর থেকে এক অন্তর্লীন ছন্দের রহস্যে বাঁধা-'a form cut into time'
আস্তিকতা ও নাস্তিকতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রায় প্রতিটি কবিতায় 'ঈশ্বর' শব্দটিকে রেখে কবি ঈশ্বরের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে কখনও কলমে তুলে নিয়েছেন ঈশ্বরকণা; আবার কখনো খুঁজে বেড়িয়েছেন মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে প্রস্থানের পথ। কবি লিখেছেন -সেই ব্রহ্মাণ্ড ঘিরে অজস্র ঘুম ও এক আধটি জাগরণ/যার ভেতর তোমার অনন্ত সন্ধান যুগপৎ জন্ম ও মৃত্যু... আদতে তুমি জানো ডিম ও ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে তফাৎ দর্পণের দু'প্রান্তের অক্ষমতা টুকু"
আবার লিখেছেন -"মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশের কোনো প্রস্থান ছিল না / বহুবার সুড়ঙ্গের মুখে চিৎকার ধ্বনি অন্তর্হিত হওয়ার পর থেকেই সিদ্ধান্ত ছিল; অবিনশ্বর বলে কিছু নেই।''
চৌষট্টি পৃষ্ঠার শিরোনামহীন তিপ্পান্নটি কবিতার এই কাব্যগ্রন্থটি
হাতে নিয়ে উৎসর্গ পত্রে এসে পাঠককে একবার থমকে যেতেই হবে। এমন অভিনব উৎসর্গ আমি অন্তত আগে দেখিনি। মহর্ষি কণাদ থেকে স্টিফেনহকিং, মহর্ষি বেদব্যাস থেকে বিনয় মজুমদার এমন এক একজনকে মহান ব্যক্তিকে বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ।কবির অন্তর্দর্শন থাকবে এটাই স্বাভাবিক,কবি একই সঙ্গে রোমান্টিক ও সমাজ সচেতন হবেন এটাও স্বাভাবিক, কিন্তু রাজীব ঘোষাল এরমধ্যেও যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে ঈশ্বরকে 'খ্যাপাটে' বলে সম্বোধন করে চেনাজগতের মানুষের ভেতর ঈশ্বর খুঁজে ফিরেছেন।এটাই কাব্যগ্রন্থটির অভিনবত্ব। বেশ কয়েকটি কবিতা তাই হয়ে উঠেছে চরিত্র কেন্দ্রিক অনেকটা ছোট গল্পের মতো।
কখনও কবি একজন মেষপালকের কিংবা প্রশান্ত হরবোলার মধ্যে ঈশ্বরকে খুঁজেছেন আবার কখনও শৈশবের মাদারির খেলা দেখানো আলখাল্লা পরা লোকটির কিংবা সেই এমন এক পুরোহিতের ভেতর ঈশ্বর খুঁজেছেন যিনি একাধারে কবি, দার্শনিক ও বিজ্ঞানময়।
ছাপ্পান্ন পৃষ্ঠায় ঠাকুমাকে নিয়ে লেখা কবিতায় কবি যখন বলেন- 'সে পাড়ি দেবে /পৃথিবীর গণ্ডি ছাড়িয়ে মহাকাশে যেখানে কেবলই/ অন্ধকার আর অন্ধকার।/...ওই অন্ধকারে, খ্যাপাটে নাতির কী যে অনুসন্ধান"!- তখন যেন 'ঈশ্বর' নেমে আসেন মাটির পৃথিবীতে। এভাবেই চিরপরিচিতকে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব আঙ্গিকে।
কাব্যগ্রন্থটি শেষ হয়েছে একটি দীর্ঘ কবিতা দিয়ে।এই কবিতাটাই যেন পুরো বইটির সারাংশ ।কবি লিখছেন--"শুধু জানি কালী কালো, জানি কালো কৃষ্ণ হয়। অথচ যে কালী-কৃষ্ণ সে এক দেবতা জানি।ভিন্ন মতে মানি তাকে বিজ্ঞান পুরুষ...''ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত কবি নিজের ভেতরেও ঈশ্বরের সন্ধান করেও নিজের 'আমি'কে সেখানে খুঁজে না পেয়ে সর্বশক্তিমানের কাছে শেষমেশ আবেদন করেছেন -'হে আমার অনালোক! হে আমার রুদ্ধদ্বার !/নিজেকে খোলো, খোলো অন্ধবাসা.../ তোমাকে দেখি প্রাণভরে আর মন ভরে গড়ে নিই রূপ।"
মহুয়ার গন্ধ মাখা এই কাব্যগ্রন্থটিতে তৎসম তথা সাধু শব্দের সমাবেশ একটু বেশি মনে হলেও বেশ কয়েকটি সতস্ফুর্ত আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগও আকর্ষণীয়।
পরম্পরা প্রকাশিত এই বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন রোচিষ্ণু সান্যাল প্রচ্ছদের রং ও প্রতীক কৃষ্ণগহ্বরের ইঙ্গিত দেয়।মূল্য ১২৫ টাকা
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন