ঝড় তুফানের কথা : মৃদুল শ্রীমানী


ঝড় তুফানের কথা

মৃদুল শ্রীমানী

ঝড় তুফান টাইফুন সাইক্লোন টর্ণেডো, যাই বলুন না কেন, সেটি আদত বিচারে বাতাসের চাপের হেরফের।
বাতাসের চাপ জিনিসটা যে কী সাংঘাতিক সেটা আমার ছোটবেলায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী অটো ভন গেরিক। সেই ম‍্যাগডেবার্গ শহরের মহানাগরিক ছিলেন তিনি। অতীতের গুণীরা বলতেন nature abhors a vacuum. কিন্তু গেরিক তাঁর "একসপেরিমেন্টা নোভা" ব‌ইতে বাতাসের শূন‍্যতা নিয়ে আলোচনা করলেন। ১৬৫৪ সালে তিনি ব‌ই লিখেছেন ভ‍্যাকুয়াম পাম্প নিয়ে, আর ১৬৫৭ সালে কুড়ি ইঞ্চি ব‍্যাসের দুটি অর্ধগোলক গায়ে গায়ে এঁটে তার ভিতরের হাওয়া টেনে বের করে দিয়ে বাতাসের চাপ যে সর্বতোমুখী, সেটা প্রমাণ করে দিলেন। ওই গোলকের দুই দিকে আংটায় আটখানা করে তাজা ঘোড়া লাগিয়ে  তারপর টান দিয়ে তবে খোলা গেল।
গত ২১ মে ছিল গেরিকের প্রয়াণ দিবস।  ১৬৮৬ তে প্রয়াত হন। জন্মেছিলেন ৩০ নভেম্বর ১৬০২ সালে।

 ২
বাতাস নিয়ে ভাবি। আর শরৎ সাহিত্যের শ্রীকান্ত হয়ে ভাবি ঝড়ের কথা। কাপ্তান ক‌ইছে ছাইক্লোন হতি পারে। এই যে এতবড় পৃথিবী পশ্চিম থেকে পুবে পাক খাচ্ছে, তাতে হাওয়ার উপর একটা প্রভাব পড়ে। সে কথাটা আমার ছোটবেলায় কানে কানে বলে গিয়েছেন উইলিয়াম ফেরেল ( ২৯.০১. ১৮১৭ - ১৮.০৯.১৮৯১)। মৌসুমি নামে বোন ছিল বড়জেঠুর ঘরে। তাকে বহুদিন আগে হারিয়েছি। মৌসুমি বাতাস হয়ে সে মাঝে মাঝে টান দিয়ে যেত আমার চেতনার গোড়ায়। ফেরেল সাহেব শিখিয়েছেন তার চলনপথের কায়দা কানুন। আমেরিকার এই গণিত বিশারদ আইডিয়াটা পেয়েছিলেন এক ফরাসি বিজ্ঞানীর কাছে। তিনি গুস্তাভ গ‍্যাসপার্ড করিয়োলিস। তিনি ঘুরন্ত যন্ত্র নিয়ে ভাবতে ভাবতে ১৮২৯ সালে  ব‌ই লিখেছেন "ক‍্যালকুল দে লা এফেট দেস মেশিনস"।  তিনি বলেছিলেন বেশ বড় কোনো একটা জিনিস ঘুরলে তার চারপাশে সে একটা ঝাঁকি দেয়। ওই থেকে বোঝা গেল, পৃথিবীর ওপরে চলন্ত জিনিস উত্তর গোলার্ধে চলনপথের একটু ডানদিকে ছিটকে যাবে, আর  দক্ষিণ গোলার্ধে তেমন চলন্ত জিনিস বামপন্থী হতে চাইবে। এই নিয়ে কথা বলেছেন ১৮৩৫ সালে।  তিনি অবশ‍্য সুদূর কল্পনাতেও ভাবেন নি যে তাঁর ধারণাটা ফেরেল সাহেব বাতাসের ক্ষেত্রে খাটিয়ে দেবেন।  ঝড়ের কথাও এই সূত্রে আসে।  ২১ মে ছিল করিয়োলিস সাহেবের জন্মদিন। ১৭৯২ সালে জন্মেছেন। একান্ন বৎসর বয়সে ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৪৩ সালে তিনি প্রয়াত হন।

 ৩
তুফানী চুমুক জানার অনেক আগেই নজরুল ইসলামের সাথে এক‌ই কণ্ঠে বলেছি "মোদের পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান ঊর্ধ্বে বিমান ঝড় বাদল"। তার‌ও আগে থেকে আমি বিবেকানন্দ স্বামীকে জানতাম তুফানী সাধু হিসেবে। অমন ডাইনামিক সাধু আর দেখলাম না। সন্ন‍্যাস নিয়েছেন তো কী? গর্ভধারিণী মা আর অন‍্যান‍্য আত্মীয়াকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছেন তিনি। আইরিশ যুবতীকে নিয়ে গিয়েছেন আলমোড়া। ব্রহ্মচর্য টসকায় নি। ঝড়ের পাখি ভাবতাম ডিরোজিও সাহেবকে। ঝড়ের কাছেই আমার ঠিকানা ছিল।
ঝড় আসছে কি না, কতক্ষণে আসবে, কতদূরে রয়েছে, এইসব বলার জন‍্য আবহবিজ্ঞানীরা ব‍্যারোমিটার যন্ত্র কাজে লাগান। বাতাসের চাপ মেপে ঝড়ের মেজাজ মর্জি গতিপ্রকৃতি জানার প্রাথমিক চেষ্টা করেন তাঁরা।
গ‍্যালিলিও পারেন নি। অতো বড়ো বিজ্ঞানসাধক ভাবতেই পারতেন না বাতাসের ভর থাকলেও সামগ্রিক আবহমণ্ডলের  একটা চাপ দেবার ক্ষমতা আছে। সেটা তিনি আদৌ বিশ্বাস‌ই করতেন না। জমিদার বাড়ির বাগানে গাছপালায় জল দিতে হবে। পাম্প করে জল টেনে তুলতে হবে। জল কি উঠবে? দেখা গেল, জল চৌত্রিশ ফুটের বেশি তোলা যাচ্ছে না। কারণটা ভাবতে বসলেন গ‍্যালিলিও সাহেবের ইতালীয় ছাত্র ইভানজেলিস্তা টরিসেলি ( ১৫.১০. ১৬০৮ - ২৫.১০.১৬৪৭)। ভরতি করে পারদ ঢেলে নিলেন একমুখ সিল করা, একমুখ খোলা একটা এক মিটার লম্বা নলে। এবার নলের খোলা মুখে আঙুল চেপে পারদ ভরতি পাত্রে খোলা মুখটা ডুবিয়ে আঙুল সরিয়ে নিলেন। নলের পারদ কিছুটা নেমে এল। ছিয়াত্তর সেন্টিমিটার বা ত্রিশ ইঞ্চি উচ্চতায় থেমে র‌ইল পারদস্তম্ভ। বারবার প্রতিবার ওই এক‌ই উচ্চতায় থামে পারদস্তম্ভ। ১৬৪৩ সালে এইসব করলেন। তৈরি হল ব‍্যারোমিটার। বললেন আবহমণ্ডলের চাপে জল ওঠে চৌত্রিশ ফুট অবধি। আর পারদ ওঠে ছিয়াত্তর সেন্টিমিটার অবধি। ১৬৪৪ সালে এইসব ভাবনা নিয়ে ব‌ই লিখলেন "অপেরা জিওমেট্রিকা"। দার্শনিক রেনে দেকার্তে এ নিয়ে ভেবেছিলেন আগেই, ১৬৩১ সালে। ভাবনা মাত্র। হাতে কলমে করে সেই সব বিবরণ আর ব‍্যাখ‍্যা আর বিশ্লেষণ করে দেখালেন টরিসেলি।  এরপরে ফরাসি বিজ্ঞানী ব্লেইজ পাস্কাল ( ১৯.০৬.১৯২৩ - ১৯.০৮. ১৬৬২)  ব‍্যারোমিটার যন্ত্রের আরো উন্নতি করেন। সমুদ্র সমতলে বাতাস প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে কতটা চাপ দেয় সেটা আজ মানুষ জানে। ওকে বলে এক এটিএম। টর এবং পাস্কাল নামেও বাতাসের চাপের একক আছে। ওইসব নামে টরিসেলি ও পাস্কালকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন আবহবিজ্ঞানীরা।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.