উত্তম চৌধুরীর চূর্ণ কবিতারা অভিনব আলোচনায়, বাবলি সূত্রধর সাহা

উত্তম চৌধুরীর কবিতার বই
 
উত্তম চৌধুরীর চূর্ণ কবিতারা অভিনব আলোচনায়  
বাবলি সূত্রধর সাহা

" কবির অসুখ হলে
তার মনের অসুখ হয়না"- একজন সফল কবিই এ কথা বলতে পারেন বা লিখতে পারেন। অসংখ্য প্রতিকুলতা,সমস্যা,অসুস্থতা নিয়েই মানুষের জীবন।কবি উত্তম চৌধুরী তাঁর ব্যতিক্রমী মনোভাব ফুটিয়ে তুলেছেন " চূর্ণ কবিতারা" কাব্যগ্রন্থে।কবি নিয়ম ভেঙে অজস্র শব্দগুচ্ছ লিপিবদ্ধ করেছেন যা কি না শিরোনামহীন।সংখ্যার নিরীখে কবিতাগুলো লেখা হয়েছে।মোট ১২০ টি টুকরো কবিতা আছে এই কাব্যগ্রন্থটিতে।সময়ের স্রোতে ভেসে যায় কবি এবং কবিতা " কেন ভাবি! কেন ভেসে যাই! - কবিতা ১
কবির এত রঙীন অনুভূতি আছে আর সেটা ফুটে ওঠে লেখায়।" চেনা শব্দে তুৃমিও রঙীন।" কবিতা ২। কবির এই কবিতায় বর্ণনাহীন খুশির জোয়ার। নিজস্ব প্যারামিটারে ওঠানামা করে তাঁর ছন্দের পারদ।" আবেগের রং খুলে যায়,চোখে চোখে কথায় কথায়" কবিতা ৬
ডুয়ার্স মানেই আলিপুরদুয়ারের সবুজ বনজ গন্ধ আর অরণ্য ঘেরা পাহাড় চূড়া।সেই আলিপুরদুয়ারের সুপরিচিত কবি উত্তম চৌধুরী স্বমহিমায় জ্বলজ্বল করেন
ছন্দ যেমন তাঁর নখদর্পনে তেমনি গদ্য নিয়েও নিত্য গবেষনা তাঁর অন্যতম নেশা।
" এই জলজ ছায়ায় বসেই তিনি লেখেন - " বনছায়াদের কথা জানি
" মায়াময়, আশ্চর্য শীতল আমার সম্বল"।  কবিতা৭ আবার " আকাশের চোখে সন্ধ্যাতারা হবে এটাও ভাবতে পারেন।" কবিতা ৮  অভিমান নিয়ে লেখেন - যেতে পারি নাও যেতে পারি। তোমার বাড়ি। চোখ তুলে বসে থেকোনা"। কবিতা ৯
নীরব নদী কবিকে ডাকেনা।এক আশ্চর্য  আর্তি ভাষাময় হয়ে উঠেছে এই লেখায় যেমন " নীরব দীর্ঘতম নদী আর ঢেউ আমাকে ডাকছেনা কেউ কবিতা ১১"
মুখ আর মুখোশের ভীড়ে সততাও পণ্য হয়ে যায়।"এখানে সততা বিক্রি হয়"। ( কবিতা ১২)
আলিপুরদুয়ার মানেই উত্তম চৌধুরীর কবিশহর তাঁরই নামাঙ্কিত পত্রিকা। এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত কথা বলতেই হয়।কলকাতা থেকে " কবিতা পাক্ষিক" এর সম্পাদক শ্রদ্ধেয় প্রভাত চৌধুরী আমাকে বলেছিলেন আলিপুরদুয়ারে উত্তম চৌধুরী থাকেন।ওনার কবিতার সান্নিধ্যে থেকে কবিতাকে সমৃদ্ধ করুন।এই সমৃদ্ধ হয়েই তাঁর কবিতার আলোচনা করার সাহস পেয়েছি।
অসম্ভব সংকটের ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি।কবিও এই সময়কে বানজারা সময় বলেছেন।মুখ আর মুখোশের মধ্যে পার্থক্য করাই দায়।" মুখ আর মুখোশের মেলা।তোমাকে ডেকে নিয়ে গড়িয়ে দেবে ধুলোর ভেতর" ( কবিতা ১৩)।
কবির মানস চোখে নদীও আঁচল পেতে দেয় শোক দুঃখ গুলোকে ভাগ করে নেওয়ার জন্য।" পুরনো নদীর কাছে ফিরে আসি "( কবিতা ১৭)। কবিমন আলোর বৃত্তে বেড়ে ওঠে এবং আঁধারকে রেখে দেয় ঠাণ্ডা ঘরে।পরিত্যক্ত যন্ত্রনা, সামাজিক টানাপোড়েন তাঁকে কষ্ট দেয়। ক্রমশ বৃত্ত ভেঙে তিনি ইচ্ছেডানার পাড়ে যেতে চান।" ইচ্ছেডানার পাড়ে সেজে উঠছে উদ্যানের মুখ "( কবিতা ১৯)।
জীবন ভুল করে আর তার মাসুল গুনতে গুনতেই সময় হারিয়ে যায়।কথা পুড়ে যায় তীব্র দহনে।" ভুলের মাসুল লিখি নীলবর্ণ জলে"( কবিতা ২০)।  প্রতিনিয়ত শব্দের নির্মাণ ভাঙাগড়া তিনিই পারেন।দক্ষ শিল্পী তিনি।অদ্ভুত বিমূর্ত ছবি আঁকতে পারেন উত্তম চৌধুরী।আঁকা ও লেখা তাঁর জীবনের অ্যাসেট।দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে তিনি  দৃশ্যমুখ পত্রিকা সম্পাদনা করে আসছেন। গল্পে ডুয়ার্স, অল্পকথার বাছাই গল্প, সিঞ্চুলার শব্দবৃষ্টি সম্পাদনা করেও তিনি ১৪ টি কাব্যগ্রন্থের ধারক ও বাহক।হওয়া না হওয়ার দ্বন্দ্বে জীবন এগিয়ে চলে। শান্তিপ্রিয় কবি নিজেকে আড়ালে রেখেই কবিতাকে দ্বিধা দ্বন্দ্ব থেকে বের করে নিজ আকাশে উড়িয়ে দেন।" হওয়ার ভেতর যেমন না থাকে। না এর ভেতর তেমন হওয়াটা"( কবিতা ২৪)। 
 
উত্তম চৌধুরী

ষড়রিপুর মেলবন্ধনে প্রতিটি জীবন।ভালোবাসা ছড়িয়ে দিলে তা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে।তীব্র উপেক্ষা সত্বেও কোনদিকে না তাকিয়ে তিনি শুধুই শব্দকে আশ্রয় করে শান্তির পতাকা নিয়ে কবিতার মিছিলে হাঁটতে ভালোবাসেন।" উপেক্ষার বর্ণ  আছে। তোমরা টেবিল জুড়ে বসে থাকো।আমি বরং শ্বেতবর্ণ পতাকা নিয়ে উত্তরে যাই।"( কবিতা ৩১) একবুক অভিমান বুকে জমিয়ে তিনি দিগন্তের পারাবারে হেঁটে যান।হতাশা, বিপন্নতা,আর দুঃস্বপ্নের মধ্যেও আমরা স্বপ্ন নিয়েই বাঁচি।চারদিকের স্বার্থপরতা ও অমানবিকতা কবিমনকে যন্ত্রনাকাতর করে তোলে।সেই জন্যই তিনি লেখেন-" একটুকরো স্বপ্নের ভেতর বেঁচে আছি।দোহাই, সরে দাঁড়ান।স্বপ্ন ধর্ষিত হলে মানুষ আর মানুষ থাকেনা "( কবিতা ৪৫)। জন্ম- মৃত্যুর মাঝে শুধু একটাই ব্যবধান যাওয়া আর আসার।" জন্ম এক, মৃত্যু এক।"( কবিতা ৫০)। কবি উত্তম চৌধুরী নিবিষ্ট মনে শুধুই কবিতার বৃত্ত ভেঙে চলেন।সনেট কবিতার পরম্পরায় তিনি দুর্দান্ত বিপ্লব ঘটিয়েছেন।আশ্চর্যরকম কারিগরি দক্ষতা দেখিয়েছেন চতুষ্পদী ছন্দে।তাই তো " সনেট আটচল্লিশ" কবিতার অভিধানে বৈপ্লবিক জেহাদ। শঙ্খ হাতে বিজয় পতাকা  নিয়ে শুভ চেতনাকেই তিনি জাগাতে চান।" পাঞ্চজন্য বেজে ওঠে
রোদপাখি ডাক দিয়ে যায়,আমি যাব ঠিক নৈঋতে।"( কবিতা ৫৩)।
পৃথিবীর সাথে সাথে মানুষও পরিবর্তনশীল।মনের দরজা খোলা রাখলেও কেউ এসে কড়া নাড়েনা। সত্যিই রং বদলায় মানুষ গিরগিটির মতো।" যার আসার কথা ছিল
সে আসেনি,
গিরগিটি রং বদলায়।
তাই দুঃখ পাইনা।"( কবিতা ৬০)
চূড়ান্ত বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে সবার জীবনে পারস্পরিক ভারসাম্য বজায়  রেখেই।তার প্রভাব মনের অতল জলে তীব্র আলোড়ন তোলে। মন ভাঙে, হৃদয় ভাঙে,চোখ থেকে সরে যায়  বিশ্বাসের খোলস। তাঁর লেখায় "৷ তোমার চোখ থেকে খসে গেছে চোখ।মন থেকে খসে গেছে মন"। ( কবিতা ৬৫)।
 
বাবলি সূত্রধর সাহা

জল পাতাদের জলজ স্রোতে,বনজ ধোঁয়ায় কবির যাপন। তাঁর কর্মজীবনের শুরুটাই জয়ন্তীর সূর্যোদয় ছোঁয়া পনের বছর।গ্রীষ্মের দাবদাহ, বর্ষার জল থৈ থৈ জয়ন্তী নদী বা শীতকুয়াশা  মেখেই তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি কবিতাকেই হৃদয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। " পাতাদের দেশ থেকে তুলে আনি গাছের উপমা।জল থেকে মেঘ।"( কবিতা ৭২)। " দীর্ঘ নদীর পাশে দীর্ঘ হয়ে উঠি।"( কবিতা ৭৭)। মাটির গভীরে শেকড়ের টানের মতো কবিতা লেখা
 দূর হতে দূরান্তরে পাতাল পর্যন্ত পরিব্যাপ্তি শব্দের তরঙ্গে। কবি তাঁর মনের ভাষায় লেখেন - আমাকে টেনে  নিচ্ছে অরণ্যগাথা। আমাকে গান শোনাচ্ছে নদী  জলতরঙ্গে" ( কবিতা ৭৯)।
ছিন্ন পত্রাবলীর মতো চূর্ণ কবিতারাও মাল্টি কালার।অজস্র অনুভূতির মেলবন্ধন ঘটেছে লেখাগুলোতে।পড়তে পড়তে বয়স যেন অনেকটাই পিছিয়ে যায়। পাঠক যখন কবিতার সাথে একাত্ম হয় তখন কবির লেখা সার্থক।" এত শব্দ নেচে ওঠে।এত শব্দ দেয় হাততালি"( কবিতা৮৫।)  দুরন্ত ঘূর্ণির মতে জীবন চলে।দেখা না দেখা, পারা না পারার ভারসাম্য রক্ষা করতেই হিমসিম খেতে হচ্ছে সকলকে।" তোমাকে কেউ দেখবে না।
জীবন মানেই না জীবন" ( কবিতা৮৮)। শব্দের সাথে  দিন যাপন । ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে থাকা এক মানুষ যিনি নাকি সর্বান্তকরণে শব্দকে জঠরে লালন করেন। তাই তো তিনি লিখতে পারেন-" শব্দের দানাপানি খেতে খেতে কবিটি ঘুমিয়ে পড়বে।
লোকেরা তর্জনি উঁচিয়ে বলবে সে এক শব্দখোর ছিল" ( কবিতা ৮৯)।
সমস্ত পৃথিবী এখন অসুখে আক্রান্ত।ভয়াবহ যাপন চলছে।এ এক নিষ্ঠুর অবকাশ যাতে কোন প্রাণ নেই, স্থবিরতা গ্রাস করেছে সকলকে।তবু কবি লিখেই চলেন। তাঁর সৃষ্টির সুধা  যেন বর্ষিত হতে থাকে কবিতায়।বিষাদগ্রস্ত হয়েও কলমে আঁচড় দিয়ে লেখেন -" ঘাসে ঘাসে জমেছে বেদনা।
গাছে গাছে আক্ষেপের ভাষা।
তুুমি কি অন্য কিছু নও
শুধুই কবিতার চাষা!"( কবিতা ৯৯)
শৈশব, কৈশোরের কিনারা ধরে যৌবনে পৌঁছনো।বাঁধভাঙা যন্ত্রণার দহনে ভালোবাসাও হারিয়ে যায় কনে দেখা আলোতে।" কৈশোরের কিনারে কিনারে তোমাকে দেখেছি,তুমি ছিলে কনে দেখা আলো"( কবিতা ১০২)।
ডুয়ার্সের হাট মানেই মুরগি লড়াই,হাঁড়িয়া আর মাদল গান।কবির চোখে চোখে ভাসে ফেলে আসা ডব্বোর হাট। রাত্রিওপুরনো হয়।সময় পল অনুপল জরাজীর্ণ হয়।শুধু স্মৃতিগুলো জীবন্ত হয়ে থাকে কবির মনে আর শব্দের মিছিলে।" গ্রিল ধরে ঝুলে আছে অসংখ্য জীর্ণ মুহূর্তরা" ( কবিতা ১০৯)। শাল সেগুন আর শিমূল চিকরাশির পাতা বিছানো পথে এখন কবির যাপন।রঙীন স্বপ্নে তিনি পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে দৌড়ে যেতে চান মহাপ্রস্থানের পথে।প্রতিনিয়ত তিনি চিলাপাতার বনাঞ্চল পেরিয়ে মানুষ তৈরির সুদক্ষ কারিগর রুপে পৌঁছে যান তাঁর গন্তব্যে।
" স্বপ্নগুলো ঘোড়া হয়।
লাল - নীল, সবুজ হলুদ। "( কবিতা ১১৩)।
সুখ দুঃখ মিলেই জীবন।দুটো বৃত্ত গড়া আর ভাঙা  কবির লেখনীতে উঠে আসে।
" যখন আমি বৃত্ত ভেঙে বক্ররেখায় উঠে এলাম।"( কবিতা ১১৯)।
শূণ্য ছাড়া সংখ্যা হয়না।একজন সফল দক্ষ শব্দচাষী কেবলই ভাবেন তাঁর লেখা অসম্পুর্ণ। আজীবন লিখেও তিনি সন্তুষ্ট নন।শব্দই তাঁর জীবন। কবিতা তাঁর মোক্ষ।তাই তাঁর মনের  অন্তস্থল থেকে উঠে আসে সুতীক্ষ্ণ শব্দবাণ-
" শূণ্য থেকে শুরু করে
শূণ্যে ফিরে যাই।
মনে হয় ব্যর্থ পরিক্রমা
ব্যর্থ জন্ম, ব্যর্থ মৃত্যু।"
তবুও মাঝে মাঝে কারও কারও স্মৃতি ফলক বাঁচাকে  উসকে দেয়।""। ( শেষ কবিতা ১২০)।
একজন বাংলা ভাষার সফল কবি উত্তম চৌধুরী অত্যন্ত নিষ্ঠা নিয়ে কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখছেন।তিনি ও তাঁর  অসংখ্য কবিতার মিছিলে আমরাও পা মিলিয়েছি।চূর্ণ কবিতারা যেন নিজ আকাশে প্যারাসেলিং করতে সক্ষম হয়। 

চূর্ণ কবিতারা
উত্তম চৌধুরী
কৃষ্ণসীস প্রকাশন ( দুর্গাপুর)
মূল্য- ৭০ টাকা৷।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.