গল্প নয় : সন্দীপ কুমার ঝা

সন্দীপ কুমার ঝা

গল্প নয়  

সন্দীপ কুমার ঝা

নীল রঙের একটা নদী। স্বপ্নের মতো  দাগ বুকের ভিতর। তার ভিতরে ম্লান হয়ে আসা ছেলেবেলার হাত। বুড়ো  বটের পাশে জংলি মাঠ। বনকুলের ঝাড়। বেতবন। এসব কিছু আধভেজা পাটের গন্ধে ভরে উঠলে,গদ‍্য নয়, জীবন পর্যন্ত দীর্ঘ একটা কবিতার জন্ম হয়। আমি সে কবিতার নাম রেখেছি, আমার 'পাড়া গাঁ'।

আজ বহুদিন পর ফিরছি যখন, তখন দুই একটা শঙ্খের করুণ আওয়াজ, সেখানকার উঠোন জুড়ে নামিয়ে আনছে রাত। সেদিনও দেখেছিলাম, পৃথিবীর একপ্রান্তে, এই সব ডাঙায়, আমাদের গ্ৰামীণ পিতামহ প্রপিতামহের দল, নিজের ছায়া আগলে বসে থাকতেন, হয়তো আজও...

গ্ৰামের দিকে যত এগোলাম, ততই একটা অস্বস্তি, পা বেয়ে মাথায় উঠতে লাগল। কিসের অস্বস্তি জানিনা। আকাশে ভাঙা লণ্ঠনের মত চাঁদ। দুটো পায়ের আওয়াজ ছাড়া এই পথে এখন আর কিছু নেই।থাকেও না।

আলো ক্ষীণ। তবুও পরিচিত এই গ্ৰামের পথ জুড়ে পরে থাকা, অসহায় আত্মসমর্পণের ভঙ্গিটাকে পড়ে নিতে অসুবিধা হল না। সে আলোয় স্পষ্ট দেখলাম,প্রায় জনশূন্য এই পল্লীবাড়ির ভিটে থেকে অজস্র নগরমুখী পায়ের দাগ। ভিটেমাটি ছেড়ে নেমে এসেছে পথে। আমি জানি,এখানেই কোথাও  মিলিয়ে আছি আমি।

মূলতঃ যাদের সাথে দেখা করতে এসেছি-সেই আমবাগান, ঘনিষ্ঠ অন্ধকার, বটঝুড়ির দোলনা, এক্কাদোক্কার উঠোন, গোল্লাছুট, বাদুড়রঙা এই পথের শেষে তারা হয়তো এখনো দাঁড়িয়ে আছে, নদীর পাড়ে। এখনও একটা দুটো গাঢ় রঙের ময়না,হয়তো নদীর ভাঙা পাড়ে আমার জন‍্য অপেক্ষা করছে,ভাঙা নদীর পাড়ের মুখে। আজও..

হঠাৎ, একটা হাত নিঃশব্দে আমার হাত ধরল পেছন থেকে। পাথরের মত ভারি আর অসম্ভব ক্লান্ত সে স্পর্শ চমকে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।ফিরে দেখলাম,আমার ছেলেবেলার সেই- মাষ্টার মশাই।

"মাষ্টার মশাই আপনি ভালো আছেন?"- অর্থহীন এ প্রশ্ন,সমান অর্থহীন শূন্যতায় পাক খেয়ে খেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। উত্তরটা খোঁজার চেষ্টা করলাম মাষ্টারমশাইয়ের চোখে,যেখানে জীবনের যোগবিয়োগ শেষে,সব ফল শূন‍্যতায় ধরা আছে।

হয়তো বয়সের কারণে, তবে মাষ্টার মশাইকে একটু বেশিই শীর্ণ মনে হল। তবে একই রকম স্থির আর স্নিগ্ধ। স্পর্শ জুড়ে তেমনি নির্দেশ আর আদুরে আমন্ত্রণের পরিচিত অনুভব।

একপা, দুইপা করে কথা এগোল।জানলাম আমার এই অঙ্ক মাষ্টারমশাইয়ের ছেলেরা, আরও ভালো অঙ্ক বুঝেছিল। তারা এখন বড় বড় শহরে, ছোট ছোট বাসায় থাকে। আমাদেরই মত। কেবল নগরমুখী তীব্র টানে উজাড় হয়ে যাওয়া এ পল্লীতে, নিজের পিতৃভূমি কে যখের মত আঁকড়ে ধরে বসে আছেন,আমার মাষ্টার মশাই। পিতৃভূমির প্রতি যাবতীয় কর্তব‍্য, সমস্ত ঋণ পরিশোধের দায়ভার যেন একা তাঁর। ছেলেরা যে তাঁকে শহরে নিয়ে যেতে চায়নি, তা নয়। তবুও যে মাষ্টার মশাই একদিন ব্ল‍্যাকবোর্ডে নির্ভুল অঙ্ক কষতেন, জীবনের অঙ্কের খাতায়,তাঁর এই ইচ্ছাকৃত ভুলের জন‍্য, আজ তাঁকে আরো বেশি শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে হল।

পবিত্র সেই ম্লান জ‍্যোৎস্নায়, তখন মুখোমুখি আমি আর মাষ্টার মশাই। আমার ন‍্যায় নীতির উৎসমুখ। চোখের তলায় ভেসে উঠছে আমার বাল‍্যপাঠ, মাষ্টার মশাইয়ের বেত, তাঁর আদর, উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারিত নীতিমালার পাঠ। চামচিকের মত অন্ধকারে, সুযোগসন্ধানী হয়ে কখন যে উড়ে গেছি, পালিয়ে গেছি-সব। দূরে,আরও দূরে, ইটের জঙ্গলে। সারি সারি আত্মসর্বস্ব খোপের ভিতরে, সেই সব মিথ‍্যা জমা আছে। শুধু এই সমুদ্রের মত অন্ধকার আর একাকীত্বের বুকে পা দিয়ে, একলা পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে থেকে গেছেন আমার মাষ্টার মশাই!

আমার ভেতরে তখন লজ্জার মুষলবৃষ্টির বান ডাকছে।বৃষ্টি আজকেও থেমে যাবে নিশ্চয়। ভোরের আলো ফুটলে আমিও আবার ফিরে যাব সেই পাষাণ অরণ‍্যে। শুধু একা অসীম দায়ভার কাঁধে,থেকে যাবেন তিনি আর তার একাকীত্ব।

আর ভাবতে পারলাম না! আমার বাল‍্যপাঠ, ছোটবেলায় পড়া আমার নীতিমালাগুলো যেন একত্রে একটা প্রকাণ্ড থাপ্পড় হয়ে উঠল। তারপর আচমকা আছড়ে পড়ল,আমার পল্লী বিলাসের গালে। নিজের প্রতি প্রচণ্ড লজ্জায় ঘৃণায়, চিৎকার করে,নিজেকেই বলতে ইচ্ছে হল -হে পবিত্র গ্ৰামদেশ,তুমি যদি দিয়েছ এ চেতনা , তবে তুমিই দাও মৃত্যুর পবিত্র মাটি। কিন্তু পারলাম না!

মাষ্টার মশাই মাটির দাওয়া ছেড়ে, ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। হাত রেখেছেন আমার মেরুদণ্ডহীন পিঠে। ম্লান আলোতেও স্পষ্ট দেখতে পেলাম-তিনি হাসছেন। বুঝলাম আমার মাষ্টার মশাই এখনো হেরে যাননি।

নীচু হয়ে, তাঁর পায়ে হাত দিলাম, ছুঁয়ে দেখলাম মাটিকেও।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.