![]() |
ছবি ধর |
' হ্যা বাবা আসবো তো ,এই তিন চার দিনের মধ্যেই এসে পড়বো , তুমি কেমন আছো ? '
ভালো আছি বাবা , তুমি কি আমার জন্য লাল বাতি জ্বলা সেই গাড়ীটা কিনেছো ? আমার বন্ধুরা সবাই চালায় ,আমিও চালাবো , আনবে তো ? গাড়িটা কিন্তু সাদা রঙেরই আনবে তোমাকে বলেছিলাম না ?
হ্যা আনবো সোনা ,তোমার দাদু কেমন আছে ?
দাদু ভালো আছে ,
মা কোথায় কাজ করছে বুঝি ?
দাঁড়াও মাকে দিচ্ছি তুমি ধরে থাকো , মা ..মা
এই নাও বাবা ফোন করেছে ---
দৌঁড়ে গিয়ে মাকে ফোনটা দেয় ঋক।
সীমা ফোনটা তাড়াতাড়ি নেয় ,
আর বলোনা রাস্তা ফুরোয় না ; আজ বারো দিন থেকে হাঁটছি আর হাঁটছি !
সীমা বলে 'খাবার খাচ্ছতো '?
হ্যা তুমি সাবধানে থাকবে আর বাবার শরীর কেমন আছে ? ঋকের দিকে খেয়াল রেখো l
বাইরে বের হবে না ,গ্রামেও এখন অনেক পরিযায়ী শ্রমিক আসবে , তাদের থেকে করোনা ছড়াতে পারে।
সীমা বলে, ঠিক বলেছো, টিভিতে দেখছিলাম মানুষ থেকেই নাকি ভাইরাসটা অন্য মানুষের দেহে আসে।
খুব চিন্তা হচ্ছেগো তোমার জন্য !
শোনো তোমার কাছে টাকা পয়সা আছে তো ? আমি কয়েকদিন আগেই ব্যাংকে রেখেছিলাম বেশ কিছু টাকা , আমার একটু কষ্ট হলেও আমি বাড়ী ফিরলেই সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। এই যাত্রায় বাড়ী ফিরে এসে আর কখনো গ্রাম ছেড়ে কোনোদিন কোথাও যাবো না। কাজ করবো দিনরাত এককরে, তেমন হলে চাষবাস করবো জলকাদা মাটিতে, তবুও যাবো না তোমাদের ছেড়ে। ঋককে মানুষ করবো দুজন মিলে। বলতে বলতে অতুলের কান্না জড়িয়ে আসে। সীমাও চোখের জল কয়েকবার মুছেছে , সে শুধু অতুলের কথা শুনছিলো চুপকরে। পাছে বুঝে যায় অতুল, তাই,হুম হুম করে যাচ্ছিলো। কিন্তু মনের ভেতরটা কেমন তোলপাড় করে উঠলো।
অতুল বলে চার্জ কম আছে বুঝলে ?
জল খাবে , আর বিশ্রাম নিয়ে তার পর হাঁটবে , সবাই একসাথে আছো তো ? দল ছাড়া হবে না কিন্তু ! এখন কোথায় আছো ? কবে বাড়ী পৌঁছবে হ্যালো. হালো ....হ্যালো....
ফোন কেটে যায় আর কোনো কথারই উত্তর শুনতে পায়না সীমা।
কায় আইসে , অতুল ? বাপ তু্ই আসলি ?
অতুল আইসেনাই, আইসবে। আর আজ কাইল এর মধ্যেই। চিন্তা করেন না তোমরা।'
সত্যকাকার দৃষ্টিশক্তি কমেছে বুঝতে পারে কমল।
কমল বাড়ীর দিকে চলে যায়।
পথে এই গ্রামের বিভাসকাকা কমলকে দেখে জিজ্ঞেস করে 'কেমন আছিস রে ভালো তো ?' মাথা ঝুকিয়ে কমল উত্তর দেয় ভালো আছে।
বিভাসকাকা আরও জিজ্ঞেস করে - আচ্ছা কমল তু্ই কি লকডাউন উঠে গেলে আবারও যাবি দিল্লী বোম্বে কাজের খোঁজে ?
' না কাকা সরকার থেকে যদি কিছুদিন রেশন আর চাষ বাসের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্য করে তাহলে গ্রামেই থেকে যাবো। '
বাহ ভালোরে এখন আর বাইরের রাজ্যে যাবি নাতো পরিবার ছেড়ে। যা বাড়ী গিয়ে নাওয়া খাওয়া কর। কমল হাঁটতে থাকে বাড়ীর দিকে।
সত্য বসে বসে ভাবে সবাই একে একে গ্রামে ফিরলেও তার ছেলে আজকেও এলো না। চোখে কম দেখেন তার পরও গ্রামের এই একটাই পথ ধরে যেই যাক তিনি মনে করেন এই বুঝি অতুল ফিরলো। কিন্তু অতুলটা আসতে দেরী করছে বড়ো। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। বার বার বৌমাকে জিজ্ঞেস করেন অতুল ফোন করেছিল কিনা ,কেমন আছে , কবে পৌঁছবে এসব। সীমাকে ডেকে বলে দেন আজ দুপুরে খাওয়া বেশী হয়েছে রাতে তাই আর খাবেন না। সীমার বুঝতে বাকি থাকেনা না খাওয়ার কারণ।
অতুলের বউ সীমা আর তিন বছরের ছেলে ঋককে রেখে বছর খানেক আগে দিল্লীতে গেছে কাজের জন্য। ভিনরাজ্যে কাজ করে অনেক বেশী রোজগার হবার আশায়, বেশ চলছিলও সব কিছু। গ্র্রামের আরও অনেকে বিহার, রাজস্থান, গুজরাট ব্যাঙ্গালোর, মুম্বাই রাজ্যে কাজ করে। অতুলও কমল, শিবেন, তারকদের সাথেই গেছে কিন্তু যার যখন সময় হয় সে তখন ছুটিতে আসে। কিন্তু এবার এই বিশ্ব মহামারী করোনার জন্য লকডাউন হওয়ায় ওরা যোগাযোগ করে সকলে মিলে হাঁটতে শুরু করে, কাজ বন্ধ টাকাও শেষ, খাওয়া নেই ঘরে, ঘর বলতে এক একটা রুমে চার পাঁচ জন মেস করে থাকা সারাদিন পর কাজের শেষে ঘরে ফিরে সকলেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে সকালে উঠেই যে যার মতো আবারও কাজে বের হয়।
রেশন কার্ড নেই ওখানে যে, চাল থেকে শুরু করে সব কিছুই কিনতে হয় বিভুঁইয়ে। তাই ওখানে কিভাবে থাকবে ? অগত্যা বাড়ীর পথ ধরে সকলে। ছাত্র ছাত্রীদের সরকার বাস দিয়ে বাড়ী ফেরার ব্যবস্থা করেছে কিন্তু অভিবাসী শ্রমিকরা অবহেলিত। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ সাইকেলে দূর দূরান্ত থেকে ঘরে ফিরতে পথের ঠোক্কর খাচ্ছে। অনেকে প্রায় একমাস ধরে আজও পথেই আছে। কিভাবে এই পথের পরিযায়ীদের একেকটা দিন যাচ্ছে সে এক ঈশ্বরই জানেন।
সমাপ্ত
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন