ওগো দুখজাগানিয়া : বিশ্বজিৎ লায়েক

বিশ্বজিৎ লায়েক
 ওগো দুখজাগানিয়া

"প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে" --- কিন্তু যারা সেই চরণের ধ্বনি শুনতে না পায়!  তবে কি ব্যর্থ এই জীবন! তা কেন! দেখো, একটা নক্ষত্র ঝরে পড়ছে-- শব্দহীন বিষাদ ও অশ্রুতে। তুমি সেই নক্ষত্রের আলো চিনে চিনে দেখছো " তরুণ চোখের করুণ চাওয়া।"
ক্লান্ত হয়ে উঠছ। অভিমন্যুর মত মতো জটিল বৃত্তের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছো। ভাবছো," সে যে বাসা বাঁধে নীরব মনের কুলায়ে" কে সে? কোথায় থাকে! কেন কেন " আমার প্রাণে সে দেয় পাখার ছায়া বুলায়ে।।"
দিন যায়। রাত যায়। কুমারী কংসাবতীর জল শুকাতে শুকাতে আমাদের অশ্রু পর্যন্ত নেমে আসে। তুমি মৃত স্বপ্নদের জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা কর। স্বপ্ন এসে বালিশের নীচে চাপা পড়ে। " যখন মল্লিকাবনে প্রথম ধরেছে কলি/ তোমার লাগিয়া তখনি, বন্ধু বেঁধেছিনু অঞ্জলি।"
ঠিক কি যেন হয়। কিছুই বুঝতে পারো না তুমি। কেবল শূন্য ক্রমশ শূন্যের দিকে হেঁটে যায়। এত শূন্য নিয়ে কী করবে তুমি! ভাসিয়ে দেবে! কোথায়! সমস্ত চৌম্বক ক্ষেত্র জুড়েই তো বসন্ত যাপন! " এতদিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুণে/ দেখা পেলেম ফাল্গুনে।"
" তোমার উদাস হাওয়ার মতো উড়ে তোমার উত্তরী।" আমার মনেও জাগিয়ে দিলে " তোমার মুখের চকিত সুখের / হাসি দেখিতে যে চাই"--- চাই বললেই আমারও ইচ্ছে করে অমিত যেরকম লাবন্যের কানে ফিসফিস করে বলছে জন ডানের কবিতা--
"For God's sake, hold your tongue and let me love!" তোমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠছে না! আমি কিন্তু সত্যি সত্যি উন্মাদ পাঠশালায় গিয়ে শিখছি পিথাগোরাসের সূত্রের বদলে "তোমার চোখে দেখার আগে তোমার স্বপন চোখে লাগে/ বেদন জাগে গো--/ না চিনিতেই ভালোবেসেছি।"
তখন সাহস ছিল। " অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবন" ছিল না মোটেই তাই " বসন্ত জাগ্রত দ্বারে" তাকে ফেরাইনি। ডেকে এনেছি ঘরে। বলেছি বসো। তোমাকে গান শোনাব---
" ভালোবেসে,  সখী, নিভৃতে যতনে/ আমার নামটি লিখো-- তোমার/ মনের মন্দিরে।/ আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে/ একটি বিন্দু এঁকো - তোমার/ ললাট চন্দনে।"
সেদিন আকাশে বিপুল মেঘ। আকুলি বিকুলি। সমুদ্রের লবণ এসে নোনা করে দিচ্ছে আমেজ। " যেন কী বলিতে চায়, না বলিয়া যায় সে।" সকালেই তুমুল মেঘ দেখেই ভাবলাম বৃষ্টি হবে। হল না। কেবল আঁধার পৃথিবী। পথ চেয়ে বসে আছি। " আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।"
ঘুমের ভেতর গলগল করে নামছে স্বপ্ন।  বিছানায় টুপটাপ খসে পড়ছে এক একটা নক্ষত্র। রাতের তারারা জেগে আছে আমার বুকের ভেতর। " ঘুমের ঘন গহন হতে যেমন আসে স্বপ্ন / তেমনি উঠে এসো এসো। /যেমন আসে সহসা বিদ্যুৎ / তেমনি তুমি চমক হানি এসো হৃদয় তলে--"
ঘুম ভাঙলে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। আয়নার বাইরের আমি দেখে আয়নার ভেতরের আমিকে। সন্ধ্যে হয়। রাত্রি তার ছাই ফেলে যায়।  "দুজনের চোখে দেখেছি জগৎ, দোঁহারে দেখেছি দোঁহে--" পাশাপাশি হাঁটছি। কারো মুখে কোনো কথা নেই। নীরব এই সম্পর্ক। কোনো ইরেজার নেই মুছে দেবে আমাদের প্রথম ছুঁয়ে থাকা " জানি নিশ্চয় তুমি আছ আমি আছি।"
" ভালোবেসে থাকো যদি লও এই হৃদি--"  এখনও বসন্ত জেগে আছে। মনে। প্রাণে। সংগোপনে। হয়ত " বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা।" ভরুক। তাতে কি! পৃথ্বী জুড়ে সাপের জিভের মতো লকলক করছে লোভ। কিন্তু আমাদের পেরিকার্ডিয়াম ভেদ করে বেরিয়ে আসে স্বপ্ন। " রোদন- ভরা এ বসন্ত,  সখী/ কখনো আসেনি বুঝি আগে।/ মোর বিরহবেদনা রাঙালো কিংশুকরক্তিমরাগে।"
দুজনের চোখে দুজনের স্বপ্ন।  তুমি আছ, আমি আছি।কেউ কাউকে ফিরিয়ে দিইনি অবহেলায়। জ্যোৎস্নায় ভিজে গেছি। শরীরের গন্ধ বিলিয়ে দিয়েছি বাতাসে, মেঘের শরীরে। চাঁদের তরণী বেয়ে ছুটে গেছি সেই নক্ষত্রের কাছে যে তোমাকে দিয়েছিল বেঁচে থাকার আলো। " চাই না শান্তি, সান্ত্বনা নাহি চাব।/ পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি,/ মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি।।"
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.