কুমোরটুলির কথা
পিনাকী চৌধুরী
অতীতে বহুবার পাড়ার দুর্গা প্রতিমা আনার নিমিত্তে এবং একবার পেশাগত কারণে কুমোরটুলিতে গেছি। উত্তর কলকাতার আহিরীটোলা ও শোভাবাজারের মধ্যবর্তী স্থানে এই অঞ্চলটি অবস্থিত। সারি সারি ছোট ছোট সব স্টুডিও, সেখানে যেন তখন মৃৎশিল্পীদের দম ফেলার ফুরসত নেই ! বস্তুতঃ দেবী পক্ষের সূচনায় সেখানে যেন গভীর রাতেও অসংখ্য মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠতো সমগ্র এলাকাটি ! কুমোরটুলির ঠিক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে স্রোতস্বিনী গঙ্গা ! গভীর রাতেও সেখানে দেখেছি নৌকা চলাচল । মাঝেমধ্যেই আমরা কয়েকজন বিভিন্ন স্টুডিওতে উঁকি মেরে দেখতাম মৃৎশিল্পীদের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি ! তবে এখন যদিও অনেকটা সময় বাকি দুর্গা পুজোর , কিন্তু সম্ভবতঃ কুমোরটুলির ইতিহাসে এই প্রথম ছন্দপতন !
ইতিমধ্যেই বাসন্তী পুজো বাতিল করা হয়েছে, নববর্ষের হালখাতাও সেভাবে হয়নি বললেই চলে, ফলস্বরূপ বহু গণেশ মুর্তি এখনও সেখানে অবিক্রিত অবস্থায় রয়ে গেছে ! কিন্তু '২০ সালের দুর্গা পুজোর ছবিটা কিরকম হবে, তা জানার জন্য হয়তো আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে আমাদের ! তবে মৃৎশিল্পীদের যে আজ দুশ্চিন্তার কালো মেঘ গ্রাস করেছে, তা নিশ্চিত ! তবে কুমোরটুলি কিন্তু আজও হয়তো কলকাতার অন্যতম হেরিটেজ ! আর কুমোরটুলি মানেই যেন এক সব পেয়েছির দেশ ! হ্যাঁ, এই বিশেষ পটুয়াপাড়া থেকেই ফি বছর সারা বিশ্বের প্রায় ৯৪ টি দেশে দুর্গা প্রতিমা প্রেরণ করা হয় ! মূলত বিশ্বের মানচিত্রে কলকাতার এই কুমোরটুলি অঞ্চল কিন্তু আজও সসম্মানে জায়গা করে নিয়েছে !
১৯৮৪ সালে বিখ্যাত প্রতিমা শিল্পী গোরা চাঁদ পালের দুর্গা প্রতিমা প্রথম লন্ডনে রপ্তানি করা হয় । সেই থেকে আজও বৈচিত্র্যে, বিন্যাসে এবং অভিনবত্বে কুমোরটুলির দুর্গা প্রতিমা জগৎ বিখ্যাত ! আজও হয়তো কুমোরটুলি মানেই যেন এক নস্টালজিয়া ! আমরা যদি ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখি, তাহলে দেখা যাবে ১৭৫৭ সালের সেইসব সাদা কালো দিনে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তার করতে মনোনিবেশ করে। সেই সময় গোবিন্দপুর গ্রামে কোম্পানি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় । আর এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সুতানুটি অঞ্চলে। তবে গোবিন্দপুরের ধনিক সম্প্রদায় পাথুরিয়াঘাটা ও জোড়াসাঁকো অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।এর পাশাপাশি আরও কয়েকটি অঞ্চল গড়ে উঠে, যেমন, ছুতারপাড়া, শুড়ি পাড়া, কুলুটোলা , আহিরীটোলা ও কুমোরটুলি !
![]() |
পিনাকী চৌধুরী |
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে কিন্তু বড়বাজার অঞ্চলের আগ্রাসনের শিকার হয়ে উত্তর কলকাতার মৃৎশিল্পীরা শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন । ব্যতিক্রম কিন্তু এই কুমোরটুলি । হ্যাঁ, কুমোরটুলির পটুয়ারা গঙ্গা মাটি সংগ্রহ করে মাটির পাত্র, পুতুল ইত্যাদি নির্মাণ করে সুতানুটি বাজারে বিক্রি করতে থাকলেন। সময় থেমে থাকেনি! তারপর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল ! পরবর্তীকালে তাঁরা ধনী সম্প্রদায়ের বাড়ির পুজোর নিমিত্তে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ করতে শুরু করেন ! তারও বেশ কিছু সময় পরে কলকাতায় বিভিন্ন সর্বজনীন দুর্গোৎসব শুরু হয় ! পুজো কমিটিগুলো ধীরে ধীরে এই কুমোরটুলি থেকেই দুর্গা প্রতিমা সংগ্রহ করতে থাকে। অতীতের একসময় কুমোরটুলি অঞ্চলে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বসবাস ছিল। ১৭০০ সালে কুমোরটুলির নন্দরাম সেন কলকাতার প্রথম কালেকটার নিযুক্ত হন, তাঁকে ব্ল্যাক ডেপুটি বলা হত! এছাড়াও স্বনামধন্য কবি ও সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শৈশবের কিছু দিন এই অঞ্চলে অতিবাহিত হয়েছিল !
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন