![]() |
বসন্তের রঙ : পৃথা ব্যানার্জী |
জয়ীতার আজ দুদিন জ্বর। তবুও যে কটা বাড়িতে ফুল আর মালা দেবার থাকে কাল দিয়ে এসেছে। কিন্তু আজ আর বাড়ি থেকে বার হতেই পারেনি। কি করবে ভাবছে! আজ বেস্পতিবার কতোগুলো মালার
ওর্ডার থাকে।
রুমা মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,---"ফুল নিয়ে চিন্তা করছো, আজ আমি দিয়ে আসি"?
জয়ীতা অস্থির হয়ে বলল,
---"একদম না, তোকে আমি একলা ছাড়তে পারবো না। রাস্তায় কতো গাড়ি। এখন কাকে আর পাবো যে তোর সঙ্গে যাবে"!
---"তাই বলে মা ফুলগুলো নষ্ট হবে? আমার ওপর একটু ভরসা করো"।
জয়ীতার কথা না শুনে রুমা তার লাঠি আর ফুলের ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল।
বছর দুয়েক আগে এক দুর্ঘটনায় রুমার চোখ চলে যায়। কিন্তু এই অন্ধকার রুমার জীবনে তার ছায়া ফেলতে পারেনি। তার মনের জোরের কাছে অন্ধকার হেরে গিয়েছে। শুধু পড়াশোনা টাকে জয় করতে পারলোনা রুমা।
মায়ের ফুলের দোকান সে সামলে নিলো। হাতের স্পর্শে সে চিনে নিল প্রতিটা ফুলকে। ঠিক তেমন ভাবেই সে শিখলো প্রতিটা ফুলকে মালার সুতোর মধ্যে সাজাতে।
ফুলের বাজার থেকে ফুল আনা, দুটো মন্দির আর কয়েকটা বাড়িতে নিত্যদিনের ফুল দিয়ে আসার কাজটা জয়ীতা করে নেয়।
কিন্তু আজ যদি রুমা না বার হয় তাহলে অনেক ক্ষতি হবে। পয়সা দিয়ে কেনা ফুলগুলো পচে যাবে।
সবজায়গায় ফুল দিয়ে একদম শেষে রুমা রায় বাড়িতে ঢুকলো।
---"কাকিমা ফুল এনেছি"।
---"ও মা তুই কেনো রে, আজ মা কোথায়"? আল্পনা রুমাকে জিজ্ঞেস করল।
---"মায়ের খুব জ্বর"। তারপর একটু থেমে বলল,
---"কাকিমা বাবু দা একটু ওষুধ এনে দেবে"?
---"বাবু তো নেই তবে আমার ভাইপো এসেছে। দাঁড়া ডাকছি ওকে"।
অঞ্জন এসে দাঁড়ালে আল্পনা রুমাকে বলল,---"একটু বলে দে তোর মায়ের অসুখটা তাহলে সেই বুঝে ওষুধ আনবে"।
অঞ্জন রুমাকে দেখে বেশ অবাক হলো। প্রায় দু বছর আগে এক বিয়ে বাড়ীতে দেখা হয়েছিল এই মেয়েটার সঙ্গে। মনের মাঝে ভালোলাগার একটা তাগিদ অনুভব করে আলাপ করেছিল। অনেক কথা হয়েছিল। কিন্তু সকাল বেলা বেড়িয়ে আসার হুড়োহুড়ি তে আর কথা হয়নি। ঠিকানা না জানার জন্য তাকে খুঁজে পায়নি। খুব কষ্ট পেয়েছিল অঞ্জন। এমন ভাবে তার প্রথম ভালোলাগা যে হারিয়ে যাবে তা বুঝতেই পারেনি।
সেই মেয়েই যে আজ তার সামনে এটা সত্যিই যে বিশ্বাসের বাইরে।
রুমা যখন বলছিল কথাগুলো তখন অঞ্জন আশ্চর্য্য হয়ে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করল। রুমার দৃষ্টি টা কেমন! কথা বলছে তার সঙ্গে অথচ তাকিয়ে আছে অন্য দিকে। যাইহোক সমস্ত কৌতূহল চেপে সে চলে গেল ওষুধ আনতে।
ওষুধ নিয়ে রুমা চলে গেলে অঞ্জন আল্পনা কে বললো,---"পিসিমনি আমি এই মেয়েটাকে চিনি। অনেক দিন আগে এক বিয়ে বাড়ীতে আলাপ হয়েছিল। কিন্তু আজ কেমন একটু অদ্ভুত দেখলাম"!
---"তুই যখন দেখেছিলিস তখন ও ভালো ছিলো কিন্তু এখন ও চোখে দেখতে পায়না। এক দুর্ঘটনায় মেয়েটা চোখ হারিয়েছে"।
অঞ্জন অবাক হয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো যা শুনছে তা কি সত্যি!
অঞ্জন অস্থির হয়ে উঠলো রুমার সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু অসুবিধে অনেক। প্রথমত বাড়ি চেনেনা, দ্বীতীয় হচ্ছে এমন হঠ করে কারও বাড়ি যাওয়া ঠিক নয়। তাই অপেক্ষা পরদিনের।
পরদিন সকাল হতেই অঞ্জন চলে এলো ফুলের দোকানে।
দেখলো রুমা একমনে মালা গাঁথছে আর গান গাইছে।
অঞ্জন দোকানের কাছে দাঁড়াতেই,
---"কি চাই বলুন, ফুল না মালা"?
----"আমি ফুল নিতে আসিনি। আমি পরিচিত মানুষ টাকে নতুন করে চিনতে এসেছি" ।
চমকে উঠে অঞ্জনের কথাগুলো আপন মনে বিড়বিড় করলো রুমা।
---"মনে আছে শ্রুতির বিয়ের কথা। আর সেই সারা রাতের গল্প"! অঞ্জন জিজ্ঞেস করলো।
---"সোনারপুর, শ্রুতি, আনন্দ হৈচৈ, বিয়েবাড়ি! তারপরেই তো সব অন্ধকার" খুব ধীরে ধীরে একটা একটা করে কথাগুলো বললো রুমা।
---"আচ্ছা এই অন্ধকার টা সরিয়ে আমরা যদি এখন একটু আলোর দিকে ফিরে দাঁড়াই"!
---" আলো কে আর কোনোদিনও পাবোনা আমি। তখন আপনি কি যেন বলছিলেন, নতুন করে চেনা"!
---"তোমার মনে আছে শ্রুতির বিয়ের রাতে একজনের সাথে কিছু গল্পের মুহূর্ত"।
রুমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মনে মনে বললো প্রথম বসন্ত এসেছিল সেদিন আমার মনের দুয়ারে। কি করে ভুলি সেই মুহুর্ত কে!
---"মনে পড়লো না! আমি কিন্তু ভুলিনি। মনের ভেতরে আঁকা সেই মুখটাকে আমি আজও খুঁজি"!
---"হারিয়ে যাওয়া কোনোও কিছুই আর ফিরে আসে না"!।
---"আমি যদি বলি মন থেকে যদি খোঁজা যায় তাহলে ঠিক ফিরে পাওয়া যায়, আর আমি ফিরে পেয়েছি"।
---"সব হারানো জিনিষ পেলে কি আর আনন্দ হয়"?
---"কিন্তু আমার যে আনন্দ হয়েছে। কেন জানিনা রুমা আমি তোমাকে ভুলতে পারিনি। হয়তো একেই বলে ভালোবাসা যা প্রথম দেখাতেই হয়"।
---"আমিতো ভুলেই গিয়েছি, কিছু মনে নেই"।
---"দিন মাস বছর ধরে আমি চেষ্টা করবো তোমার সেই ভুলে যাওয়া মনটাকে ফিরিয়ে আনতে। আসল ভালোবাসা হলো পাশে দাঁড়ানো। আমি তোমার পাশে দাঁড়াবো"।
*****
ছমাস পারে আজ জয়ীতার খুব আনন্দের দিন। ঘরে অনেক লোকের ভীড়। আর সেই ভীড়ের মধ্যে বার বার জয়ীতার চোখ ভরে উঠছে জলে। কে বলে ভগবান কথা শোনেনা! জয়ীতার ঘরে তাইতো ভগবান অঞ্জন কে পাঠিয়েছেন।
যেদিন মেয়ের চোখ চলে গেল সেদিন নিজেও জয়ীতা চোখে অন্ধকার দেখছিলো। ঠাকুরের কাছে কেঁদেছিল। আজ সেই ঠাকুরের দয়াতেই রুমার বিয়ে!
অঞ্জন রুমাকে জোর করেই বড় চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। নিজের দায়িত্বে অপারেশন করায়। তার চেষ্টা সার্থক হয়েছে।
আজ সকলের মুখে মুখে একটাই কথা,
---"মেয়েটার কপালের জোর আছে বলতে হবে"!
---"কি হলো রে রুমা আর কতো লজ্জা করবি, পান পাতাটা সরিয়ে অঞ্জন কে দেখ, লগ্ন যে পেরিয়ে যাচ্ছে"।
অঞ্জন আর রুমাকে ঘিরে সবাই বলে উঠলো।
দুজনের চার চোখের মিলন হলো!
আজ সেই রাত এসেছে অঞ্জন আর রুমার জীবনে। যে রাতের স্বপ্ন রুমা কোনোদিন দেখেনি।
রুমাকে দুহাতের মাঝে জড়িয়ে তার দু চোখের ওপর ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে অঞ্জন বললো,
---"রুমা এই দুটো চোখের ওপর দাবি আমার। তাই আজ বলছি এই দুটো চোখে যেনো কখনও জল না আসে"।
---"তুমি আমার জীবন আলোয় ভরে দিয়েছো। তোমাকে না পেলে জানতেই পারতাম না যে বসন্তের স্পর্শ এমনভাবে জীবনকে রঙিন করে রাখে"!
---"দিয়ে গেনু বসন্তের এই গান খানি----"
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন