![]() |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলমে মুসলমানের কথা : মৃদুল শ্রীমানী |
জমিদার তার সব কিছু উপযুক্ত পুত্রের হাতে সঁপে দিয়ে চলে গেলেন। এবার থেকে ছেলেই জমিদারী দেখুন। তিনি থাকবেন বিরলে । কোলাহল থেকে অনেক দূরে ।
কিন্তু একবার তাঁকে আসতে হল। নতুন জমিদার প্রজাদের উপর বড়ো উৎপাত করে চলেছেন। গরিব প্রজার হয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে অছিমদ্দি । মুসলমান তরুণটি । নয়া জমিদার সেই রুখে দাঁড়ানো মুসলমান তরুণকে কেসে কেসে জেরবার করে দিচ্ছেন।
প্রাক্তন জমিদার এসে তার পুত্রকে সংযত হতে অনুরোধ করলেন। বললেন , অছিমদ্দি কে নিজের ছোট ভাই জ্ঞান করতে।
নয়া জমিদার বাবার দিকে বাঁকা চোখে তাকালেন । জানতে চাইলেন " অছিমদ্দি আপনার সন্তান?"
বৃদ্ধ স্মিত মুখ ।
নয়া জমিদার আরও স্পষ্ট করে। জানতে চাইলেন " যবনী গর্ভে ? "
বৃদ্ধ বললেন " হাঁ বাবা।"
রবীন্দ্রনাথের লেখা গল্প । গল্পগুচ্ছে পড়েছি।
রবীন্দ্রনাথের 'দুরাশা' নামে গল্পটি বেশ মনে আছে। দার্জিলিঙে ক্যালকাটা রোডের ধারে এক মুসলমান মেয়ের সাথে দেখা হয় গল্পকথকের। সে মেয়ে এক মুসলমান ভুস্বামীর কন্যা । অন্দর মহল থেকে সে কখনো দেখেছে তাদের বাড়ির হিন্দু প্রতিরক্ষা কর্মীটিকে । হিন্দু লোকটির স্নান, আর নিয়ম পুজা পাঠ সব মিলে তার মনে এক গভীর মায়াময় সম্ভ্রম তৈরি করে দিয়েছিল। মুসলিম মেয়েটির কল্পনার চোখে হিন্দু সিপাহীটি হয়ে ওঠে রক্তমাংসের দেবতা। তারপর বাধল সিপাহী বিদ্রোহ । হিন্দু সিপাহীটি জড়িয়ে পড়লো বিদ্রোহে । তার প্রতি ভেতরের শ্রদ্ধা ভালবাসার টানে ঘর ছাড়লো মুসলিম মেয়ে । মেয়ে সিপাহীটিকে জানে আপন করে। সিপাহীটি তাকে চেনে না। শুধু তার ব্রাহ্মণ্য আর নিয়ম নিষ্ঠাকে অতিলৌকিক আভায় রাঙিয়ে একতরফা প্রেমে পথে নামে মেয়ে। যুদ্ধে আহত হয়ে হিন্দু সিপাহী যখন তৃষ্ণায় কাতর , মেয়ে তখন তাকে পরম ভালবাসায় বিপদ মাথায় করে জল এনে দেয়। ওই রক্তাক্ত পরিস্থিতির মধ্যেও হিন্দুয়ানি ছাড়ে নি সিপাহী । মুসলিম মেয়ে কেন জল খাইয়ে তার জাত মারবে? মেয়ের মাথায় কঠিন শক্ত হাতের আরো কঠিন লোহার বালা দিয়ে আঘাত করে সিপাহী । মূর্ছিত হয়ে পড়ে থাকে মেয়ে। কিন্তু হিন্দু নিয়মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ তরুণের প্রতি আস্থা আরো বেড়ে যায় তার। বাপ রে! হিন্দুয়ানি সোজা জিনিস ! কতো জন্মের পুণ্যফলে তা অর্জিত!
মেয়ে আবার খুঁজে চলে তার অন্তরের দেবতাকে । মাথায় পাওয়া কঠিন লোহার আঘাতকে সে দেবতার আশীর্বাদ বলে মনে করে । খুঁজে একদিন পায়। দূর থেকে দেখতে পায় তার রক্ত মাংসের দেবতাটিকে।
তার পর চূড়ান্ত হতাশা। সে হতাশার কথাই ব্যক্ত করেছে মুসলিম মেয়ে গল্প কথকের কাছে। পরম নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ সমস্ত গরিমা বিসর্জন দিয়ে ভুটিয়া বস্তিতে সংসার পেতে ভুটিয়া স্ত্রী পুত্র সহযোগে ভুট্টা ক্ষেতে ফসল তুলছে । গল্পের নাম দুরাশা । যে হিন্দু ব্রাহ্মণ্য কে সে পরম ও চরম ভেবে এসেছে, তার এই বাস্তবতা দেখে মুসলমান মেয়ের হৃদয় গুঁড়িয়ে গিয়েছে । ভেতরে আমার ছটফট করছে গল্পটি ।
রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসে পেয়েছি: একদিন পথ চলার সময়ে গোরা দেখতে পেলো একটি বৃদ্ধ মুসলমান মুটে ঝাঁকা মাথায় অনেক মাল নিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় এক ঘোড়ার গাড়ি তার উপর এসে পড়ল। ঝাঁকা উলটে তাতে থাকা বিস্তর রুটি মাখন নষ্ট হল। তার উপর গাড়ীওয়ালা লোকটি বৃদ্ধ মুসলমানের উপর চাবুক কষিয়ে চলে গেল। "আল্লাহ" বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বৃদ্ধ নিজের কাজে যেতে চাইল।। গোরা ক্রোধে অধীর হয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না।
সে বৃদ্ধের নষ্ট হওয়া মাল কিনে নিয়ে তাকে অর্থসাহায্য করবে বলে বিনয়ের বাড়িতে ডেকে আনল। হঠাৎ চাবি না পাওয়ায় হাত দিয়েই দেরাজের তালা মুচড়ে ভেঙে সে টাকা বের করে মুসলিম মালবাহককে দিল। শিক্ষিত হয়ে ভারতের দরিদ্র অসহায় নাগরিকের দিনযাপনের কষ্ট সম্বন্ধে যারা ওয়াকিবহাল নয়, তারা কি মানুষের পর্যায়ে পড়ে?
গোরা যখন দেখেছিল যে দরিদ্র মুসলমান মালবাহক আল্লাহের কাছে নিজের কষ্ট নিবেদন করেই ক্ষান্ত থাকল, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল না, তার সেই ভীরু ধর্মাচ্ছন্ন মতিকেও গোরা সমালোচনা করেছিল। গোরা বলেছিল অত্যাচার হজম করাটা, আল্লাহের উপর প্রতিকারের দায়ভার ছেড়ে দেওয়াটা উচিত নয়।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন