![]() |
``সুপর্ণার জন্য পঙক্তিমালা'' : সুবীর সরকার |
কত রকমের কবিতা। কত কিসিমের কবিতা। দাউদাউ এক ঘোর নিয়ে আমি ঝুঁকে পড়ি অগণন বাংলা কবিতার দিকে। কবিতা জাপটে ধরে। আমাকে জীবনের দিকে বারবার তাড়িত করে আমাদের কবিতা। আবহমান এক চিরকালীনতা নিয়ে বাংলা ভাষায় বহুস্বরিক বর্ণময় সব কবিতা লেখা হচ্ছে। এটাও দ্বিধাহীন সত্যি যে, আমাদের বাংলা কবিতা বিশ্বমানের এক স্তরে পৌঁছে গেছে। এটাই তো অর্জন। প্রাপ্তি।
সম্প্রতি নিবিড় পাঠের সুযোগ হল কবি রুদ্রসাগর কুন্ডুর ‘সুপর্ণার জন্য পঙক্তিমালা’ সিরিজের ১০ টি কবিতা। বারবার পড়বার পরেও একটা আবেশ জড়িয়ে রেখেছে এখনো। একটা ম্যাজিক ভাষা রুদ্রর। পরতে পরতে সে খুলে খুলে আবার বিছিয়ে দিচ্ছে অদ্ভূত এক জায়মানতা। রুদ্র ১ নং কবিতায় বলছেন_
‘যে-সব ইশারায় পৃথিবীর বার্ষিক গতি জানে মানুষেরা
তাতে প্রতিয়মান হয়,মানুষ জানে,বদলের ইতিহাস’
কবি এখানে দেশকালের উর্দ্ধে গিয়ে এক প্রাসঙ্গিক কালখন্ডকে তুলে এনেছেন।
আবার ২ নং কবিতায় রুদ্রকে দেখি প্রখর এক আকুতি ছড়িয়ে দিতে। এই আকুতি কি প্রেম! না কি প্রেমের বিপরীতে গিয়ে তীব্র এক সমর্পন।কবি বলছেন,
‘তেপান্তরের মাঠে আমাদের সমর্পণ
একান্ত প্রশস্তি-প্রহরা ভেঙে বুকের ভিতরে ছায়াপথ
ফুল ছোঁয়ালেও কংকাল ভেঙে চুরমার যেন’
কবি স্নিগ্ধতা ভাঙেন না। বরং বিনোদন প্রণালীর প্রস্তুতি সেরে ফেলতে ফেলতে তার জীবনে প্রতিবার হেসে ওঠে অতীব শোকাবহ দিনগুলি।
সিরিজের তৃতীয় কবিতায় কবিকে গ্রাস করে তুমুল এক ঘোর। হয়তো জ্বরের মতো এক মেদুরতা। কবি উচ্চারণ ছড়িয়ে দিয়ে বলেন,
‘এইভাবে,অবাধ্য হিম ছোঁয়,পাখির খুলে রাখা মনের দুয়ার
আর আমার অবসন্ন দিনলিপি খুলে উড়ে যাচ্ছিল
অক্ষরগুলো’
ভাবুন তো মাননীয় পাঠক,কবি বললেন পাখির খুলে রাখা মনের দুয়ারের কথা! এই পাখি তো জন্ম ও মরণ জড়ানো আমরাই! প্রবল এক ঝাঁকুনিতে বিহ্বল হয়ে যেতে হয় এই সব লাইনে এসে।
রুদ্রসাগরের কবিতার সবচেয়ে বড় শক্তি তার দর্শন। তার বোধ। তার দেখবার ক্যাটার্যাক্টমুক্ত দুই চোখ। তিনি দেখেন আর দেখা সমগ্রকে পাঠকের পরিসরে বেশ করেই বিছিয়ে দিতে জানেন।
৪ নং কবিতায় রুদ্রসাগর বলছেন,
‘হেমন্তের বিহ্বল দুপুর,নমিত পাহাড় বনানী,পুরুষ-
মননশীলতা
নিরত্তেজ শব্দের বিমুগ্ধতা
উৎসবের তরঙ্গ;সব জানো,সবকিছু জানো নারী’
না,ট্রাডিশনাল প্রেম নিবেদনের প্রগলভতা নেই; কিন্তু প্রেমের এক বিস্ফোর রয়েছে। শব্দ ব্যাবহারের নুতন এক প্রণালী প্রয়োগ করেছেন কবি। সাদামাটা শব্দকে মহামহিম করে তোলেন রুদ্র তার কবিতায়। যেমন উদাহরণ হিসেবে ৫ নং এবং ৭ নং কবিতায় চলে যেতে পারি আমরা ...
৫ নং-এ কবি লিখছেন,
‘সাম্রাজ্য চাওনি তুমি,ভূমি উৎস থেকে সূর্যরঙ
চাঁদ থেকে গৃহস্থ সামিয়ানা’
৭ নং-এ রুদ্র বিড়বিড় করে বলে চলেছেন,
‘তুমি জানো না মেয়ে ,বিরাজিত মেঘের ভিতর,বর্ষা
লুকিয়ে ঘুমায়, পুরুষের ঘুম পরাস্ত সূর্য, যৌন বিরতির
মত শুনশান,উপেক্ষিত আলেয়াহ্রদের দিনলিপি’
ভাবা যায়! সূর্য,যৌন বিরতির মত শুনশান, উপেক্ষিত আলেয়াহ্রদের দিনলিপি-- এইভাবে লেখা যায়! এখানেই কবি স্বতন্ত্র। কবি সাহসী। বাঁকে বাঁকে উড়ে বেড়ানো কয়েনেজগুলিকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে সযত্নে আহ্লাদিত কোলাজের অনন্ত কোরাস লিখে যাচ্ছেন কবি।
যাপনের গল্পের পাশে পাশে দেশ-কাল-ইতিহাস হেঁটে যায় রুদ্রর কবিতায়। যাপনের আলো ও অন্ধকার দিয়ে রুদ্র ছড়াতে থাকে কি অসামান্য এক জীবনমায়া!
৮ নং কবিতায় আমরা শুনি অলীক এক-কালের গান বুঝি
‘তোমার ক্লান্তিকর শরীরের খাদে নেমেছি একা একা
তোমার উষ্ণতায় পুড়েছি নিভৃতে
জারণরেখার মত আয়ুধ ও কৌশলে
এই আমি প্রতিদিন লজ্জার বাহুতে ডুবে মরি’
কি দুরন্ত ও সৎ এই কনফেসন!
এই সব কনফেস দিয়েই তো কবি তার যাপনের দিকে আর্তি ছুঁড়ে দিয়ে লিখতে পারেন (৯ নং কবিতা)
‘কবির মুখে জেগেছিল মৃত্যুর ঘুমন্ত পথ
নগরের সব কবি একদা এইসব যত্নে রেখেছে তুলে
স্মৃতিকথনের জ্যোৎস্নায় আবিল মন্থর ঘাস,অনায়াসে
পূরবীর কোলে মাথা রেখে শোয়।এই নশ্বরতায়’
মজা ও ম্যাজিক দিয়ে, ব্যাথা ও বেদনা দিয়ে নির্মিত রুদ্রসাগরের কবিতার করিডোর। ভারী জীবন্ত ভারী তীব্র হয়ে বিদ্ধ করে পাঠককে।
সিরিজের শেষ কবিতায় কবি লিখছেন,
‘পালকে পালকে লেখা রক্তের ইতিহাস ধুয়ে গেছে...
এক দুপুর নির্জনতার ভিতর প্রাচীনতম দুঃস্বপ্নের!
অসম্ভব ভিন্ন ঘরানার কবি রুদ্রসাগর কুন্ডু। তার মেধা ও মননের পায়ে ঘুঙ্ঘুর বেঁধে দেয় সচেতনতা। এই কবি আমাদের প্রাপ্তি। বাংলা কবিতার বাঁকবদলের পরিসরে কবি তার কবিতার ভুবনজোতে বিছিয়ে দিয়েছেন কুয়াশাচ্ছন্ন এক দীর্ঘ টানেল। আর ইশারার পাশে চুপ করে রেখে আসা পেইনকিলার।
হ্যাটস অফ,প্রিয় রুদ্রসাগর...
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন