মিষ্টি কথা : মৃদুল শ্রীমানী

 মৃদুল শ্রীমানী
মিষ্টি কথা

চলুন, আপনাদের একটু মিষ্টি খাইয়ে আনি। ভয় নেই, এই মিষ্টিতে রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়বে না। ওই দেখুন মিষ্টির কথায় এল শর্করা কথাটা। হিন্দিতে শক্কর। ইংরেজি বচনে সুগার। কি রকম মিল আছে না? সাধারণ লোকে সুগার বেড়েছে বললে রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধিজনিত সমস্যা বোঝে। আমাদের কোশে তো খাদ্য হিসেবে সরল শর্করাটুকু কাজে লাগে। খাদ্য বলতে জ্বালানি। তো সেই শর্করাকে রক্তই কোশে বহে নিয়ে যায়। সেই প্রক্রিয়ায় যানজট হয়ে রক্তে শর্করার সমস্যা আসে। 

সমস্যার কথা থাক। আমরা মিষ্টির গল্প করি আসুন। শর্করাকে আমরা কি বলে চিনি? আমি চিনি গো চিনি তোমারে। চিনি তো ছিল না। ছিল মধু। মধু বাতা ঋতায়তে। মধু ক্ষরন্তি সিন্ধব। মধু বলতে মদও বোঝাতেন প্রাচীনেরা। গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় যাবৎ মধু পীবাম্যহম ... দেবী আসব পান করছিলেন ... যুদ্ধের আগে বীরাঙ্গনা অসুরকে বললেন, আমি যে টুকু সময় মদ খাচ্ছি, ওইটুকু সময় তুই একটু হল্লাগুল্লা করে নে ...
মধু মাছিরা মধুমাসে মধুচক্র রচনা করত। দুধ আর মধু ছিল সম্পন্নতার প্রতীক। দ্রাক্ষারসের মতোই মধু থেকেও আসব তৈরি হত। তাকে প্রাচীনেরা বলতেন মাধ্বী । মধু যদি না মিলত? মধু না পাওয়া গেলে গুড়ের ব্যবস্থা হত। মধ্বাভাবে গুড়ং দদ্যাৎ ।  আখের গুড় বা এখো গুড় হত আখের রস জ্বাল দিয়ে। খেজুর রস জ্বাল দিয়ে খেজুর গুড়। তালের রস থেকে তালগুড়। গুড় তৈরিতে তরিবৎ লাগত। আঁচের নানা কায়দা কানুন থাকত। দানা বাঁধানোর অনেক কৌশল থাকত। সেই ঘরানার তারতম্যের কারণে কারো তৈরি গুড়ের চাহিদা ছিল বিপুল। কারও গুড় পড়তে পেত না। আর কাউকে মাছি তাড়িয়ে মরতে হত। গুড়ের ব্যবসা যে সর্বদা জমত, তা নয়। লাভের গুড় কখনো পিঁপড়ে খেয়ে যেত। আশা ধ্বংস হলে লোকে বলত, সে গুড়ে বালি। গুড়ের নানা রকম হত। চিটে গুড়। ভেলি গুড়। গরিবের ছেলে এক টুকরো ভেলিগুড় পেলে তাই অনেকক্ষণ ধরে চাটত। চেটে চেটে গুড় শেষ হলে গুড়ের রস মাখা আঙুলটাই অনেকক্ষণ ধরে চাটত। বেশি গুড় খেলে ছোটোদের শরীর খারাপ হত। কেন না গুড়ের নাগরী খোলা পেলে তাতে মাছি থিক থিক করত। মাছি থেকে নানা অসুখ। কবিরাজের কাছে গেলে কবিরাজ নিজের ঘরের গুড়ের কলসী সরিয়ে তবে বালক রোগীকে গুড় না খাবার বা কম খাবার গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিতেন। গুড় আবার জ্বাল দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা ফেলে বাতাসা আর পাটালি বানানো হত। জল ও বাতাসা দিয়ে গৃহস্থ অতিথি সৎকার করতে জানত। সম্পন্ন গৃহস্থ পাটালির টুকরো দিতে জানত।

চিনি এল চীন দেশ থেকে। ফটফটে ফর্সা চিনি সাদা করতে না কি হাড়ের গুঁড়ো কাজে লাগানো হত। তাই পূজা আর্চায় চিনি নৈব নৈব চ। দানা ওয়ালা গুড় চট বা  কাপড়ের  ঝোলায় ঝুলিয়ে লাল চটচটে তরল যথা সম্ভব অপসৃত করে কাশীর চিনি মিলত। সেটি ছিল দেবভোগ্য। পূজায় এই সেদিন অবধিও কাশীর চিনিই দিতে হত। মিছরি কথাটা এল চীনের মতো আরেক প্রাচীন দেশ থেকে। সে দেশের নাম মিশর। মিশ্রী বানানেও সেই মিশর দেশের ছায়া। ক্রিস্টাল বা কেলাসের চেহারা নিত চিনি আর মিছরি দুটোই। মিছরির কেলাস বড় হত। সেই কেলাসের গঠন দেখে কি মিছরির ছুরি কথাটা এল? হবেও বা। 

চৈতন্য চরিতামৃতে "তপ্ত ইক্ষু চর্বণ" কথাটা দেখেছি। খেতে ইচ্ছে করে খুব, কিন্তু খাওয়া যায় না। তপ্ত ইক্ষু কি জ্বাল দিতে থাকা ইক্ষুরস?
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.