পরিণতি : সোনালী মুখার্জী

সোনালী মুখার্জী

পরিণতি

 বৌমা .... ও বৌমা....ডাকতে ডাকতে নিচে থেকে পরিমল বাবু দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলেন..সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আট বছরের রিনি দেখলো পাশের বাড়ির জেঠু তার মাকে ডাকছে..নিচে নেমে এলো ও..এসে ভয় ভয় দরজাটা খুলে বললো ,মা তো বাড়ি নেই জেঠু ??বাজারে গেছে..ওও তুমি স্কুলে যাও নি আজ??বলতে বলতে পরিমল বাবু রিনি কে কোলে তুলে নিলেন।আগেও জেঠু ওকে অনেক কোলে নিয়েছে ,আদরও করেছে..কিন্তু এখন যেন জেঠুর আদর টা কি রখম ,ওর একটুও ভালো লাগে না..ও অনেক ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলো নিজেকে..আর পরিমল বাবু ওর ছোট্ট শরীর টাকে নিজের হাতের মধ্যে নিষ্পেষিত করতে করতে বলতে লাগলেন ,অমন কেন করছো রিনি মা??তোমার ভালো লাগছে না??আমি তোমায় বিকালে একটা বড় ক্যাটবেরি খাওয়াবো।কিন্তু যদি বাড়িতে মাকে বা কাউকে বলো তবে কিন্তু ওরা তোমাকে ভীষণ মারবে বকবে..আর স্কুলেও যেতে পারবে না..বন্ধুরা কেউ তোমার সাথে কথা বলবে না..আর সত্যি রিনি ভয়ে তে কাউকে কিচ্ছু বলতে পারে না..সমস্ত যন্ত্রণা নিজে সহ্য করে চুপচাপ..ওর মনে ভয় আর অপরাধ বোধ কাজ করতে থাকে ।যে অপরাধের মানেই জানে না ও..তার সাথে কি হচ্ছে না বুঝেই ও মনে মনে নিজেকেই দোষী ভাবতে থাকে।

এই ভাবেই কেটে যায় কয়েক মাস।রিনির বাবা চাকরি সূত্রে বাইরে থাকেন,বাড়িতে শুধু রিনি আর ওর মা বিভা দেবী।রিনি বসুধা প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী..পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ।উচ্ছল প্রাণবন্ত সারাদিন হাসিখুশি থাকা মেয়েটা আস্তে আস্তে কেমন যেন পাল্টে যেতে লাগল।বিভাদেবী মেয়েকে অনেক জিজ্ঞাসা করলেন ,কিন্তু কিছুই বুঝতে না পেরে স্বামীর সাথে আলোচনা করে ওকে পাড়ায় এক ডাক্তার কাকু কে দেখালেন।তাতেও বিশেষ কিছুই হলো না..রিনি সেই একই রখম রয়ে গেল..সব সময় যেন একটা আতঙ্কিত ভাব।
আরো কিছুদিন বাদে ও এমনই হয়ে পড়ল যে ওর স্কুলের নিবেদিতা ম্যাডামের ও ব্যাপারটা চোখে পড়লো।উনি টিফিনের সময় রিনি কে কাছে ডাকলেন,বললেন,রিনি তোমার কি হয়েছে??
রিনি--কিছু হয়নি তো ম্যাম??
ম্যাম---সত্যি বলছো??
রিনি--হ্যাঁ ম্যাম..
ম্যাম--তবে তোমার বন্ধুরা সবাই অত খেলছে দৌড়াদৌড়ি করছে ,তুমি একা চুপ করে বসে আছো কেন??তোমার খেলতে ইচ্ছে করছে না??আগে তুমি তো কত ছুটোছুটি করতে??খেলতে??
উত্তরে রিনি বলে ফেললো ,আমার সারা শরীরে খুব ব্যাথা ম্যাম,আমি তো ভালো করে হাঁটতেই পারছি না,বলেই ও চোখ নামিয়ে নিল।আর নিবেদিতা ম্যাম ওর চোখে প্রথম কোনো কিছুর জন্য ভয়ের ছায়া দেখতে পেলেন।ওকে বললেন আচ্ছা যাও, তুমি ঘরে গিয়ে বসো।রিনি আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।নিবেদিতা ম্যাম দেখলেন সত্যি ওর হাঁটা টা একটু অদ্ভুত।

নিবেদিতা ম্যাম কিন্তু ব্যাপার টা ছেড়ে না দিয়ে পরের দিন রিনির মা বিভাদেবী কে স্কুলে ডেকে পাঠালেন..রিনির সম্পর্কে ওর মায়ের সাথে সমস্ত আলোচনা করে ঠিক করলেন ওর বন্ধু সাইক্রিয়াটিস্ট ডঃ সোম বর্মন কে রিনির ব্যাপারে সমস্ত জানিয়ে তারপর এগোনো..
কথামতো তার পরেরদিন ই ওরা রিনি কে নিয়ে পৌঁছে গেল ডঃ সোমের ক্লিনিকে।অফ ডে থাকা সত্ত্বেও নিবেদিতার বন্ধুত্বের খাতিরে সোম রিনিকে দেখতে রাজি হয়ে গেল সেদিন..

ডঃ সোম রিনিকে নিয়ে ভিতরের ঘরে গেলেন । আলাদা ভাবে প্রায় দু ঘন্টা কাটিয়ে ফিরে এলেন,এবং আসল সমস্যা টা ধরে ফেললেন।তারপর বাইরে ওকে বসিয়ে একটা  ক্যাট বেরি হাতে দিয়ে বললেন তুমি এখানে একটু বসো??আমি তোমার মা আর ম্যামের সাথে কথা বলে আসছি।রিনি ভয়ে ভয়ে চকলেট টা হাতে নিল, কিন্তু খেতে পারলো না..ওর মনের ভিতর পরিমল জেঠুর ক্যাট বেরি দেবার কথাটা বার বার মনে পড়তে লাগলো।তাহলে এই ডঃ আঙ্কেল ও কি????

যাই হোক ডঃ সোম বিভাদেবী আর নিবেদিতা কে পরিমল বাবুর কথা বললেন..যা মনের অগোচরে রিনি তার কাছে প্রকাশ করেছে।শুনে বিভাদেবী অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গেলেন।উনি বিশ্বাস ই করতে পারছেন না যে লোকটা তাদের দীর্ঘদিনের শুভাকাংক্ষি রিনির বাবা না থাকা কালীন যে মানুষটা রিনিকে কখনো তার বাবার অভাব বুঝতে দেন নি,যে মানুষটা রিনির জন্ম থেকে তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করলেন,তার মনের ভিতরে এমন একটা আস্ত জানোয়ারের বাস??এমন একটা নরখাদক ভিতরে বাস করছে??যার ছেলের প্রতিষ্ঠিত চাকরী, মেয়ের বিয়ে সব হয়ে এখন অবসর নিয়েছেন,তার এমন পশুসুলভ আচরণ বিভাদেবী কিছুতেই যেন মানতে পারছেন না।নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না।
ফিরে এসে স্বামীকে সবকিছু ফোন করে জানালেন বিভাদেবী,আর এর পর তারা কি কি করবেন সেটাও বললেন,যা ওরা তিনজন বসে আলোচনা করে ঠিক করেছে।

পরের দিন নিজেদের ঠিক করা প্ল্যান অনুযায়ী বিভাদেবী যথারীতি বাজারে গেলেন রিনিকে একা বাড়িতে রেখে।এবং কিছুদূর গিয়ে আড়াল থেকে লক্ষ রাখতে লাগলেন নিজের বাড়ির ওপরে,আর নিবেদিতা আর ডঃ সোম ততক্ষণে পুলিশ স্টেশন এ গিয়েরিনির  বলা কথাগুলোর রেকর্ড শুনিয়ে FIR করে ওনাদের নিয়ে একটু দূরে উপস্থিত শুধু বিভাদেবীর ফোনের অপেক্ষায়।

বিভাদেবী দেখতে পেলেন দূর থেকে পরিমল বাবু এদিক ওদিক দেখে তার বাড়িতে ঢুকে পড়লেন।বিভাদেবী আর দেরি করলেন না।সঙ্গে সঙ্গে নিবেদিতা কে ফোন করলেন,আর পুলিশের ভ্যান সাথে নিয়ে ওরা এসে দাঁড়ালেন বিভাদেবীর বাড়ির বাইরে।এর পরের ঘটনা খুবই ছোট,পুলিশ সহ সকলে গিয়ে পরিমল বাবুকে হাতেনাতে ধরে ফেললেন এবং সকলের চোখের সামনে দিয়ে ওনাকে হাতে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ ভ্যানে তুললেন।

আর এতকিছু দেখে হতভম্ব রিনি দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলো।ডঃ সোম বিভাদেবী কে বললেন ,যাক আর কোনো চিন্তা নেই,আপনার মেয়ে একদম ফিট।।
এ তো গেল রিনির কথা।ওর স্কুলের নিবেদিতা ম্যাম,ডঃ সোম ওর মা সকলে মিলে রিনিকে তো বাঁচিয়ে নিল, কিন্তু আপনারা???পরিমল বাবুর মতো হাজার হাজার নরপশু আমাদের সমাজে বসবাস করছে।তাদের সামনে আনার চেষ্টাটাও কিন্তু আপনার আমার,আমাদের, আসুন না ,সবাই মিলে একটু সতর্ক হই??একটু ছেলেমেয়ের দিকে লক্ষ রাখি??তাহলেই আমার মনে হয় ৬০ শতাংশ কাজ হয়ে যাবে। নিজেরাই খুঁজে নিতে পারবো ভদ্রবেশী জানোয়ার গুলোকে.।।।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.