একটি সমর্থ পুরুষ আর একটি রূপসী বিধবা, আর গসিপ : মৃদুল শ্রীমানী

মৃদুল শ্রীমানী

একটি সমর্থ পুরুষ আর একটি রূপসী বিধবা, আর গসিপ

সেই যে দামিনী মেয়েটি। লীলানন্দ বৃত্তের মানসিক অত্যাচার থেকে যে প্রতিদিন নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলতো। লীলানন্দ এই দামিনী মেয়েটির স্বামী শিবতোষের ফেলে যাওয়া বাড়ি ঘরদোর আসবাব সহ স্থাবর অস্থাবর সব কিছুই দখল করেছিলেন। শুধু পারছিলেন না দামিনীকে হজম করে ফেলতে। না, হিন্দু সাধুজী ও গুরু মহারাজদের নারীলিপ্সা কোনোকালেই খুব কম ছিল না। এমন কি শিশুদের উপরেও যৌন নির্যাতনে তাদের ক্লান্তি নেই। দামিনীর সঙ্গে তার স্বামীর গুরু লীলানন্দের বাঘবন্দী খেলা চলছিল। বাড়ির মধ্যে থেকেও তারস্বরে হতে থাকা সংকীর্তনে দামিনী যোগ দিত না। প্রয়াত স্বামীর গুরুকে উপেক্ষা করবে বলেই তার এই চেষ্টা। শচীশ ও শ্রীবিলাস এই দুই উচ্চশিক্ষিত যুবককে দেখে দামিনীর উপোসী নারীত্ব উচ্ছল হয়ে ওঠে। নারীহৃদয়ের কোন নিগূঢ় ইঙ্গিতে সে নানাতর খেলায় মেতে উঠে এই দুই যুবকের নৈকট্য পেতে চায়। দামিনী ভালো করে জানে, হিন্দু বিধবার পক্ষে পুরুষসঙ্গ অমার্জনীয় অপরাধ। কিন্তু দামিনীর অঙ্ক বলে যে শচীশ ও শ্রীবিলাসের সাথে মন দেওয়া নেওয়ার খেলায় মেতে উঠলে লীলানন্দ কিছু বলে উঠতে পারবেন না। শ্রীবিলাস বেশ সহজেই রসিকা রমণীর নানা শখ পূরণে এক পায়ে খাড়া। আর শচীশ এসে মাঝে মাঝে শুকনো মুখে দেখে যেতে চাইত - কি চলছে কাণ্ডটা !
শচীশকেই চেয়েছিল দামিনী। চেয়েছিল তার সমস্ত নারীসত্তা দিয়ে। পায় নি। দামিনী পাশে পেল শ্রীবিলাসকে। শ্রীবিলাস কি তার সাথে দাম্পত্যে বৃত হল?
এক নতুন ধরণের সম্পর্কের মাত্রা উন্মোচন করেন রবীন্দ্রনাথ। বাঁধাধরা সম্পর্কের চেয়ে অনেক অন্য ধরণের সম্পর্ক।
খবরের কাগজে ঢি ঢি পড়েছিল। এক ছাদের নিচে এক অন্নে একটি সমর্থ পুরুষ আর একটি রূপসী বিধবা, গসিপ ছাড়বে কেন থার্ড পেজ?
শচীশ ও মাঝে মাঝে আসতো। নোট বই লিখে সংসার চালানোর বন্দোবস্ত করেছিল শ্রীবিলাস - এক কালের প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলার। এক বিধবা কি করে জীবন খুঁজে পায় মরমিয়া ভাষায় সে গল্প করতে থাকেন রবীন্দ্র ঠাকুর  I

শিবতোষের মৃত্যুর পর দামিনী বিধবা। শিবতোষের সন্তান হয় নি। অন্যান্য জ্ঞাতি কুটুম্ব আত্মীয়ের সাথেও যোগাযোগ না থাকার মতো। এই অবস্থায় ঘর দুয়োর আসবাব সমেত সে নিজের তরুণী স্ত্রীকে উৎসর্গ করে যায় লীলানন্দ স্বামীর কাছে। লীলানন্দ স্বামী ধর্ম ব্যবসায়ী। ব্রিটিশ শাসনে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অনেক যুবক নিজের মনের ভেতর নানা প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে নানা পথে নিজের উচ্ছ্বাস কে অপচয় করেছে। এ দেশে ধর্মের নানা আড়ম্বর সর্বদাই গুরুত্ব পেয়েছে। যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমুখী চিন্তা চেতনা এদেশে শিকড় ছড়াতে পারে নি। পুরোনো ধাঁচের ধর্মীয় সংগঠন নবীন যৌবনকে আশ্রয় না দিতে পারলে, অতি সামান্য সময়ের জন্যে হয়তো বাঙালি যুবক যুক্তি ও জ্ঞান বিজ্ঞানের মুখোমুখি হতে চেয়েছে। কিন্তু সে সামান্য সময়। বেশিরভাগ যুবক ধর্মের চোলাইতে মেতে গিয়েছেন। শচীশ তেমন একজন। পড়াশোনায় দিগগজ হবার পরেও, জ্যাঠামশাই এর মতো যুক্তিবাদী মানুষের সঙ্গ পাবার পরেও লীলানন্দ কি করে শচীশকে নিজের দলে ভিড়িয়ে নিতে পারেন, সে এক আশ্চর্য প্রহেলিকা। শচীশের ছায়াসঙ্গী শ্রীবিলাস। পড়াশুনায় মজবুত হয়েও সে শচীশের টানে লীলানন্দ বৃত্তে। কিন্তু বৃত্তের পরিধিতে না থেকে দুই বন্ধুই ক্রমশঃ সে সংগঠনের কেন্দ্রে। তাদের উন্নত মেধা মগজ তাদের ওই ধর্মীয় সংগঠনের কেন্দ্রে এনে দেয়। দামিনী নামে তরুণী বিধবাটিও মেধাপূর্ণ যৌবনের দিকে তাকায় আগ্রহে। শচীশের প্রেমের পূর্ব ইতিহাস ছিল। তার দাদা পুরন্দর ননিবালা নামে এক বিধবার ধর্মনষ্ট করে। পুরন্দর এ কাজ করেও নিজের পিতা হরিমোহনের কাছে ভর্ৎসনা পায় নি। শচীশের যুক্তিবাদী মানবতাবাদী জ্যাঠামশাই ননিবালাকে কন্যাজ্ঞানে পিতৃস্নেহে আশ্রয় দিতে চেয়েছিলেন। শচীশ তার জ্যাঠামশাই এর প্রতি আনুগত্যে ননিবালার গর্ভস্থ সন্তানের পিতৃ পরিচয় এর দায়িত্ব নিতে চায়। কিন্তু ননিবালা আত্মহত্যা করে। এর পর জ্যাঠামশাই বেশিদিন বাঁচেন নি। সে যাই হোক শচীশ বুঝতে পারতো বিধবা দামিনী তাকে বিশেষ পছন্দ করে। কিন্তু সে সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি কি হবে সে নিয়ে শচীশ প্রবল দোলাচলে থাকতো। শচীশ আর দামিনীর ফাঁকের জায়গাটাতে দামিনী টেনে আনত শ্রীবিলাসকে। শ্রীবিলাসও পড়াশুনা করা সুদেহী পুরুষ। তরুণী দামিনীর প্রতি তারও এক রকম টান ছিলই। এই তিনটে মানুষের পরস্পরের টানের গল্প গড়ে উঠেছে দামিনীর চারপাশে।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.