 |
রবীন্দ্র গুহ |
গোবিন্দ ধর শুধু কবি নন, একাধারে স্রোত পুস্তক প্রকাশনা, সাময়িকী সম্পাদনা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন সহ বিচিত্রবিধ সাহিত্যবিষয়ক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত অতি জীবিত এক দ্রোহবীজ। যা তাঁর স্বখোদিত ভাস্কর্যের মতো প্রস্ফুটিত। তাঁর কবিতা পাঠের সাথে সাথে পাঠক স্বখননের সলিলে ডুবে যাবেন নিজেরই অজান্তে এ বিশ্বাস ইতিমধ্যেই তৈরী হয়েছে কবি যেন এক সুদক্ষ শৈল্যবিদের মতো নিজের জীবনকে নিজেই কাঁটাছেড়া করতে করতে বিশুদ্ধ উচ্চারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন জীবনবেদ।আর পাঠক সেই বেদবীজ থেকে খুঁজে পাচ্ছেন যেন নিজেরাই দ্রোহবীজ।কবি গোবিন্দ ধর আমার নিজট বর্গছকের বাইরের মানুষ। নিঃশর্ত কিছু,গুণাচরণ প্রত্যক্ষ করার জন্য কবির হৃদয় বনাম মেধামস্তকের সাথে কিছু বার্তালাপ করা যাক। বাইনেকুলারটা একটু কাত করুন-ধরুন কবিকে প্রশ্ন করা হলো---
রবীন্দ্র গুহ:
তোমার লেখায় এত অপর শব্দ কেন ব্যবহার করো?শব্দগুলো কোথা থেকে পাও?অনেক শব্দ-ই অবৈজ্ঞানিক আবলা অকুলান - এসব কি তুমি নির্মান করো?
গোবিন্দ ধর :
(১)অপর - [বিশেষণ পদ] অন্য, পর, ভিন্ন, বিপরীত, অন্য ...।সে অর্থে কোন শব্দেরই আভিধানিক অর্থ দেখে কবিতা আমি লেখি না হয়তো কেউ-ই লেখেন না।কোন কবি নয়-ই।কবিরা নিজস্ব শব্দ গঠন করতে বাধ্য হোন।তাদের চেনা শব্দকেও নতুন অর্থে প্রয়োগ করতে হয়।কিছুদিন আগে শহিদ স্মরণ করা প্রসঙ্গে আমার মনে হয়েছিল শহিদ স্মরণ উৎসব করা যায়।অথচ অভিধান সে বিধান দেয়নি।কোন অভিধানেই শহিদ স্মরনকে উৎসবের আকার দেওয়ার বিধান নেই।উৎসবকে আনন্দ প্রকাশ করতে ব্যবহার করতে দেখেছি। সবাই এরকমই ধাতস্থ। কিন্ত আমার মনে হয়েছে উৎসব শব্দের প্রায়োগিক দূর্বলতা আছে।আমি শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে উৎসব কেন করতে পারবো না আওয়াজ তুলি।এরকম অজস্র প্রয়োজনে শব্দের অর্থকে ব্যাপক অর্থে প্রয়োগ করতে হয় শব্দশ্রমিকদের।শব্দ নির্মান অনিবার্য হয়। শব্দ তো ব্রহ্ম। তার প্রয়োগে অর্থ সংকোচন প্রসারণ ঘটে।আবার অর্থের প্রয়োজনেও গঠন করতে হয় শব্দ।কবি লেখকদের নিজস্ব ভাষাকোড তৈরী করতেও শব্দ নির্মান করতে হয়।কবিরা তো শব্দনির্মানের কারিগর। আমি বলি শব্দশ্রমিক।আমার কবিতায় এরকম শব্দ নির্মাণের তাগিদেই এগুলো নির্মাণ করি।কবিতার প্রয়োজনে গঠন করি।আবার হাওয়ায় উড়তে থাকা শব্দকে বগল দাবা করেও কবিতায় প্রয়োগ করি।স্বভাবতই আমার শব্দের বৈজ্ঞানিক কোন শব্দশৃঙ্খল খুঁজে পাওয়া হয়তো যাবে না।আবলা অকুলান তাই আমার কবিতার ভাষা।অভিধানে এসব শব্দ নেই। আমিও অভিধান পাশে রাখি না।আমার আলমারিতে যদিও কয়েকখানা অভিধান জং পড়ছে।
রবীন্দ্র গুহ:
তুমি কি দোমুখিভাষায় বিশ্বাসী?অর্থাৎ,শব্দের সংকরায়ন?
গোবিন্দ ধর:
(২)দোমুখো মানে দুই—মুখ।কবিতার তো যা বলা হয় শুধু তা-ই বলার জন্য বলা হয় না।আরো কোন ভিন্ন অর্থ থাকেই।সহজ সরল কথার মাঝেও নানা অভিমুখ থাকে।যখন কবিতাই বললেন তখন তার মুখ অভিমুখ নানা অর্থ নানা রকম তার প্রয়োগ। কোন কোন শব্দ শুধু দুমুখো নয়।আরো বিভিন্ন মুখো তার উচ্চারণ থাকে।কোন কোন শব্দের এরকম রাত অথবা দিন কিন্ত সকাল কিংবা বিকেল এরকমও আমি প্রয়োগ করি।যেমন শুভ নববর্ষ ->নয় বছরের জন্যে শুভেচ্ছা। ।যেখানে কোন সত্যই চিরন্তন মনে হয় না।শব্দ কখনো কখনো তার অর্থও বদল করে আমাদের সময়কে বদলে বদলে নেয়।সুতরাং শব্দের এই সংকরায়ন আমার কবিতায়ও আছে।আমি বিশ্বাসও করি।টিনের ঘর বললে তো শুধু ঘরই নয়।আরো গভীর কোন অর্থও এতে আছে।
রবীন্দ্র গুহ:
শব্দ নির্মাণের একটা গণিত আছে।তোমার গণিতটা কি?
গোবিন্দ ধর :
(৩)শব্দ গঠনের বিজ্ঞান গণিত কিংবা ভাষাশৃঙ্খলের যে বিধান গ্রামারে লিপিবদ্ধ সে বিজ্ঞান কিংবা গণিতের সমস্ত নিয়ম কিংবা বিজ্ঞান আমি সচরাচর আভিধানিক ভাবে নীতিমালা গ্রহণ করে ভাষাকোড গঠন করিনি।আমার ভাষায় গণিত কতটুকু তা পাঠক বুঝবেন।তবুও বলি শব্দ গঠনের গণিত থাকবেই। না হয় কি করে চটির সাথে পিসি যোগ হয়ে চটিপিসি হয়।কিংবা মদের সাথে বিশ্বায়ন যুক্ত হয়ে মদায়ন হয়?
আমি ততটুকু গণিতের নিয়ম মেনে এগুলো করিনি।আমার কোন গণিত নেই। আমার শব্দ আসে পরিবেশ প্রতিবেশ থেকে।হৃদয় থেকে।আমার নিজস্ব ভাষাকোড তৈরীর নিয়ম থেকে।মাথার বোধের রসায়ন থেকে।হয়তো মাথার নিজস্ব কক্ষপথ পরিভ্রমণ করে আমাকে যে শব্দ বিশ্বাস করতে সক্ষম -আমার কবিতায় তার প্রয়োজন,আমিও সে শব্দ প্রয়োগ করি। এই হচ্ছে আমার নিজস্ব গণিত।দুই-য়ে দুই-য়ে =চার হয়তো আমার ভাষায় নাও মিলতে পারে।তবে শব্দ গঠনের গণিত তো আছেই।আমারও একদম নেই তা বলবো কি করে।গণিত যদি এসবের ভেতর থাকে তো নিশ্চয়ই এগুলো গণিতেরই নিয়মেই হয়েছে।
রবীন্দ্র গুহ:
তোমার কী ধরনের শব্দ মৃত্তিকা থেকে উঠে আসে?কবিতায় খেরুয়া শব্দ পাতি শব্দ ;ফুটপাতিয়া শব্দ, খণ্ড শব্দ প্রয়োজনে আরো আসুক-তুমি চাও কী?
গোবিন্দ ধর:
(৪) সকল শব্দই তো ভূমিজাত।কুলীন। অকুলান কিংব অবৈজ্ঞানিক শব্দ বলতে কোন শব্দকেই আমি মনে করি না।ব্যবহার সঠিক হলে সকল শব্দেরই প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়।মৃন্ময়ী মা চিন্ময়ী হয়ে উঠার মতোই। শব্দের কোন প্রকারবেদ আবার কেন।কবিতায় এসব খেরুয়া পাতি ফুটপাতি বটতলার শব্দ এরকম বিভাজন শ্রেণি বিভাজন হয় নাকি।শব্দের কোন শ্রেণি সংগ্রাম হয় নাকি? শব্দ সব সময়ই গঠন হয় প্রয়োজনে।সব রকম নীতিমালা তারপর তার উপর চাপিয়ে দিয়ে আমরা গবেষক হই।আমার কবিতায় অনেক তথাকথিত অচ্ছুৎ শব্দকেও নির্দিধায় নিয়েছি।বটতলা,পাতি,ফুটপাতি শব্দ বলে আমার নিজস্ব অভিধান নেই।আমার নিকট সকল শব্দেরই গ্রহণযোগ্য রূপ আছে।শব্দের রূপ অরূপ দর্শন করতে করতে সুর দিতে দিতে কবিতা আমার গান।কবিতা আমার মন্ত্র।কবিতা আমার নিজের শ্রম লাঘবের মাধ্যম।কবিতা আমার দীর্ঘ অসুখ থেকে আরগ্যালয়।জীবনের ভাতশিকারের পরিশ্রম থেকেও একটু জিরিয়ে নেওয়ার উপশম।কবিতায় তাই সকল শব্দকে আমি অধিকার দিই।যেকোন শব্দ যেখানে বসার মতো মনে করেছি সেখানেই ছাড়পত্র দিয়েছি।ঘুম ভাঙাতে চেয়েছি শব্দের ভেতরের ঘুমন্ত শব্দকে।শব্দ আমার নিকট কৃষকের ফসল তোলার আনন্দ। শ্রমিকের কাজের উৎসাহের প্রাণশক্তি। মজুরের জিরিয়ে নেওয়ার দুদন্ড আরাম।কিংবা নৌকো টানা মাঝির তীরে নৌকো ভিড়ানোর দিশা।শব্দ আমার পাখির নীড়ে ফেরার দিশা।প্রভাতে পাখির কিচিরমিচির। ধান ভানা ঢেঁকির আওয়াজ।আঁখ মাড়াই কলের রস নির্গমন।কিংবা আঁখের রসকে উনুনে জ্বাল দিতে দিতে গুড় করে দেওয়ার হাতিয়ার।শব্দকে কখনোই আমি অচ্ছুৎ ভাবি না।শব্দ আমার কাজের আনন্দ। আনন্দোৎসব।
রবীন্দ্র গুহ:
ভাষাবাস্তবতা বলতে কি ভাবো?তুমি কি আপস করে কবিতা লেখা? পোস্ট মর্কসিস্টরাও তো আজকাল অতিচেতনার কথা -জাদুবাস্তবতার কথা বলছে। তুমি কি বলো?
 |
গোবিন্দ ধর |
গোবিন্দ ধর :
(৫)
ভাষার তো বাস্তবতা থাকবেই।যেমন গৈরিকা এক থোপনা টেকরই পেড়ে কোঁচড় ভরে নিল। আকাশ কুসুম ভাবা যায়।আকাশ কুসুম ভাষা হয় নাকি আবার।সুতরাং ভাষা তো হতে চায় বাস্তবতার নিরিখে নিরিবিলি ধ্যানমগ্ন এক সাধনায় ভাষাকোড তৈরী হয়।কবিতায় কবি একজন ধ্যানমগ্ন সাধক।তিনি তার যাপন থেকে শব্দনির্মান শ্রমিক হয়ে উঠেন।
শব্দ যখন আপস করে লিখতে হয় তখন কবিতা আর হয়তো কবিতা থাকে না।তখনই প্রয়োজন হয় নিজস্ব মুদ্রায় কথা বলা।হয়তো সব ক্ষেত্রেই সাফল্য আসে তেমন নয়।তখনই কবিরা আপস করেন।হয়তো আমিও করি।হয়তো করি না।
যদিও আমরা জানি কিটস বলেছেন"Willing suspension of disbelief"মধ্যবিত্তদের দ্বারা কখনোই বিপ্লব সম্ভব নয়।চেতনায় বিপ্লব তে থাকা জরুরী।তাই মধ্যবিত্তের ভাষায় জাদুবাস্তবতার আমদানি ঘটেছে। এরকম স্বপ্ন নিয়ে বাঁচা।বেঁচে থাকো।হয়তো একদিন বিপ্লব হবে।এই স্বপ্ন বাস্তবতার নিরিখে হয়তো কোন মূল্য নেই।কিন্তু মানুষের চেতনায়ও যদি শোষণ নিপিড়নের বিষয়গুলো পরিস্কার না থাকে তাহলে তো চেতনালুপ্ত প্রাণি হয়ে যাবে মানুষ। আমি বলি হরলিকস খাওয়া জাতি।যে জাতি বুঝতে পারছে না কতটুকু মেধা বন্ধক দিয়ে চলতে হচ্ছে তাদের।নিজস্ব চিন্তায় যদি সু কু না ধরা পড়ে তো সে সময়কে ডিঙিয়ে গেলেও তো সামনে আরো বড় গর্তে পড়তে হবে।তখন কি আর কোন রূপ দ্রোহ আসবে মনের গভীরেও?আমার তো মনে সমাজের এই পচন ধরেছে অনেকদিন থেকে।
সুতরাং কবিতা অতি চেতনা চেতনা জাদুবাস্তবতার নিরিখে কবিতা এক নিরিবিলি সাধনাই।সাধনা ব্যতিরেখে আর কোন পথ তার নেই।স্বপ্ন না থাকলে মানুষ হয়ে যসবে জড়। জাদুবাস্তবতাও সাধনা।কবিতায় অতিচেতনাও কি থাকবে না।নিশ্চয়ই সকল শব্দকে বগল দাবা করা ততটা সহজ নয়।সুতরাং ইচ্ছে হোক আর না হোক কোন শব্দ তো আমার কথাকেই শুধু বলবে এমন নয়।আমি যেরকম ভেবে লিখি তা হয়তো শেষ অব্দি আর হয়ে উঠলো না।তখন গবেষকের কাজ হয় কোথায় অতিচেতনা কিংবা জাদুবাস্তবতা এলো।আমিও এসবের বাইরের গ্রহে নয়।আমিও সকল শব্দের ঈশ্বর নয়।আমিও আমার শব্দকে যখন বৃহত্তর পাঠকের নিকট পৌঁছে দিই সে সকল শব্দ তখন আমার কথা শুধু বলে না।তারা আরো নিজস্ব রূপ নেয়।যা হয়তো আমি ভাবিনি।শব্দ তখন অরূপ।আমার রূপ সে মানেনি।তার শরীর থেকে আরো ভিন্ন রকম মুক্তি খুঁজে।কেউ কেউ তার আরো নান রূপ আবিস্কার করেন।তখন কবির কথা শব্দ শুনে না।পাঠকের কথা শুনে শব্দ। শব্দ যখন পাঠকের হয় তখন তার নানা উড়াল। কবির আর হাত নেই সে সকল শব্দের নিকট।শব্দ তখন নিজস্ব আকাশ ভেদ করে পাঠকের অধিকারে চলে যায়।পাঠক ভিন্ন ভিন্ন হোন।শব্দও ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায় রূপ পায়।শব্দ এক মায়াআত্মা।
রবীন্দ্র গুহ:
হৃদয়ের সঙ্গে কবিতার কি সম্পর্ক? হৃদয়হীন মানুষ কি কবি হয়না?
গোবিন্দ ধর:
(৬)হৃদয় ও বোধ মিলেমিশে টুয়েন্টি টুয়েন্টি ক্রিকেট হলো কবিতা।কবিতায় শুধু বুদ্ধির চকমকিই শেষ কথা নয়।আবার হৃদয়ের ভাবই শুধু কবিতা নয়।কবিতা দুইয়ের মিলিত মেনিফেস্টো।আত্মার মেনিফেস্টোও কবিতা।কবিতা হলো নিজস্ব পতাকার উড়াল।এই উড়ালে শুধুই বুদ্ধি থাকবে তেমন নয়।আবার শুধু আত্মার ফেডারেশনই কবিতা নয়।মিলিত মেনিফেস্টোই কবিতা।সুতরাং কবিতা লেখতে শুধু হৃদয়বান হলেই ভালো কবি হয়ে উঠবেন তা যেমন ঠিক নয় তেমনি বুদ্ধিমান লোকেরাই কবি হবেন এমনও নয়।তাহলে কবি কে?কবি হলেন তিনি যে শব্দের প্রাণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাষার একটি অর্থগত বাক্য গঠন করে পাঠককে সাময়িক এমন কী দীর্ঘ সময়ের জন্যে জাগরিত করেন প্রেমে দ্রোহে।কিংবা অন্য রকম কোন জাদুবাস্তবতায় কবি ধরে রাখেন পাঠকের মনের উদিত দ্রোহ, প্রেম,সংকল্প কিংবা আনন্দও।
কবিতা লেখার ছাড়পত্র কখনোই কোন হৃদয়বানের দখলে ছিলো এমন নয়।দখল যদি এমন হতো তাহলে বিন্ লাদেন কি করে কবি হোন?কিংবা আরো আরো উদাহরণ দেওয়ার মতো হৃদয়হীনদের খাতায় কী করে কবিতা ধরা দিতো?কবিতা সকল হৃদয়বান থেকে হৃদয়হীনদেরও মেনিফেস্টো।কবিতা শুধু হৃদয়বানের আত্নার পতাকা নয়।কবিতা খলদেরও দ্রোহবীজ।আবার চারিত্রিক নানা দোষ গুণের অধিকারীরাও কবিতার জনক।আমি শুধু মানি যে কবিতা কবির অন্তর্গত জারণ বিজারণ।
১৫-০৪-২০১৯
This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন