ও মোর মাকনা হাতির মাহুত রে : সুবীর সরকার

সুবীর সরকার

ও মোর মাকনা হাতির মাহুত রে

১.
আমার একটা গঞ্জহাটের পৃথিবী আছে।আমার পৃথিবী জুড়ে অগণন সুপুরিগাছের সারি।আমার পৃথিবীতে ভরা নদীর ওপর ঝুঁকে পড়া মাযাবৃক্ষ।ভুমিলগ্ন আবহমানের সব চিরায়ত সোনার বরণ মানুষজন।আমার একটা নাচঘেরা বাজনাঘেরা অপরূপ লোকপুরাণের দেশ রয়েছে।সেখানে 'ভইসা গাড়ির' নীচে কালিমাখা লণ্ঠন দোলে।আর ধু ধু পাথারবাড়ির দিকে গান ছড়িয়ে পড়ে-
'ও হো রে,কুচবিহারত হামার বাড়ি
ঘাটাত দেখঙ ওরে ভইসা গাড়ি'
কিংবা-
'ও কি হায়রে হায়
আজি মনটায় মোর
পিঠা খাবার চায়'
মানুষ যেভাবে গল্পের পাকে পাকে জড়িয়ে যায়,জীবন যেভাবে গল্পের পাকে পাকে জড়িয়ে যায়,আমিও সেভাবে এই লোকমানুষের দিনদুনিয়ায় ডুবে গেছি।উত্তরের এই লোকজীবনের মায়া ও জাদু আমার চরম প্রাপ্তি।চরমতম শক্তি।
আমি যখনই অস্থির হয়ে পড়ি,আমি যখনই একা হয়ে যাই তখন এই লোকায়ত ভুবন,উত্তরের লোকগান আমাকে ফিরিয়ে আনে জীবনে।ফিরিয়ে আনে লড়াইয়ে।ফিরিয়ে আনে চূড়ান্ত স্বপ্নের ভেতর।
আমি আবার নুতন হয়ে উঠতে থাকি।আর গৌরীপুরের হাট থেকে মাধবডাঙ্গার গঞ্জ থেকে ঝাঁকুয়ার টারি থেকে দেখি ভেসে আসে হাতিমাহুতের অন্তহীন যত গান-
'ও মোর গণেশ হাতির মাহুত রে
ও মোর মাকনা হাতির মাহুত রে
মোক ছাড়িযা কেমনে যাইবেন
তোমরা হস্তীর শিকারে'...
জীবন দুলে ওঠে।জীবন উৎসবে পরিণত হয়।
আর আমি প্রনাম করি আমার উত্তরের মাটিকে।
উত্তরের মানুষকে।
35 বছর বাংলা কবিতার ভেতর ডুবে গিয়ে
সুপ্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।ভালো ও মন্দ সব মিলিয়েই।বারবার স্বপ্ন দেখি আমি।বারবার স্বপ্নভঙ্গ হয় আমার।এটাও একটা জার্নি।এই প্রান্তবেলায় এসেও আমি কিন্তু হাল ছাড়ছি না।বারবার স্বপ্নই দেখে যাবো আমি।
কারণ, আমি বিশ্বাস করি একজন কবির জীবন
আদতে অভিশাপের জীবন।সন্ন্যাসী ও সৈনিকের জীবন...


আমি ভোরের জঙ্গলে সার্চলাইট নিয়ে বসে থাকি
তীব্র ময়ূরের পাশে পড়ে থাকে সব অপমান
উপেক্ষার উপাখ্যান জুড়ে প্রাক শ্রাবনের বৃষ্টি
তোমরা সবাই দূরে চলে যাও
আমি একা একা বহন করবো সমস্ত
                                                 প্রলয়
মৃত্যু মানে তো আদিগন্ত রাতপোশাক
স্বপ্নের হাতবদলের আগে আমি দেখে আসি
                                            ঝুলন্ত উদ্যান
আমারও তো শোক আছে
আমারও তো শ্লোক আছে
পুরোনো পাখির নাম মনে পড়ে গেল
কাউবয় টুপি পড়ে কামব্যাকের আসরে আমি
                                            নাচতে যাই
এই শহর এক স্মৃতিবন্দর
আমার ঘুমের কাছে এগিয়ে আসে
                                          ঘাম
অপমানের পর অপমান টপকে
নিজেকে গুছিয়ে নিতে থাকি
                                        আমি

২.
একটা সুপুরিগাছে ভরা পৃথিবী।দশ নদী আর বিশ ফরেষ্টের পৃথিবী।জঙ্গলের পাশ দিয়ে মাছ ধরতে চলে যান ফুলমনি রাভা।দাঁতাল আর মাকনা হাতিরা ধান খেতে চলে আসে ভরা সব ফসলের খেতে।বাইসনের দুরন্ত ছুটে চলা দিক ও দিগরের দিকে।ময়ূরের ডাক শুনে চকিত হরিণ বুঝি আনমনা হয়!কিন্দুস কিনদে আর এক্কাস লাকড়ার সাথে গল্প জমে ওঠে হাড়িয়ার হাটে।আর জঙ্গলজীবনের হালহকিকত জেনে নিতে থাকি ময়কান্ত আর টয়কান্ত বর্মণের কাছেই।লোকদেবতার থানের পাশেই করাতকল।এই ভুবনের কোথাও কবরের নিচে ঘুমিয়ে আছেন সেই কবেকার ডানকান সাহেব।আর এখনও দু'চোখে স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে আছেন 'কুরমাই বস্তির' জার্মান রাভা।দূরে ভুট্টাবন,জলাশয়,হলখল বাতাসের ঢেউ।টংঘরের পাশেই গির্জার ঘন্টা বেজে ওঠে।এই হাট গঞ্জ আর নদী ফরেষ্টের ভুবনে এলেই খুব মনে পড়ে যায় আর আকুল হয়ে খুঁজতে থাকি বন্ধে ওরাও,তেভাগা সৈনিক ফুলকুমার আর অহিভূষণকে।বাল্যে শোনা দুরাগত বাঘের ডাক আর দিকদিগন্তের যত মোরগ লড়াইয়ের উপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে গানের পর গান-
'ও মোর মাকনা হাতির মাহুত রে
মোক ছাড়িয়া কেমনে যাইবেন হস্তীর শিকারে'
#
এভাবেই ভ্রমণগল্প পড়ে থাকে শ্লোকের মতো....

৩.
'হামার দ্যাশত বড় বাঘের ভয় রে সোনা রায়
বাঘে পালে হামলা দিবার চায় রে সোনা রায়
বাঘে ধইল্যে কি করঙ উপায় রে সোনা রায়'

নটবর মন্ডল।বয়স প্রায় সত্তর।পেশায় তামাকচাষী।বাড়ি ছিল বাংলাদেশের পাবনা জেলায়।বাড়ির কাছে যমুনা নদী।1969 এ দেশ ছেড়ে,জন্মমাটি ছেড়ে চলে আসেন কোচবিহারের মাঘপালায়।শুরু হয় জীবনসংগ্রাম।কোচবিহারে তখন আর রাজার শাসন নেই।কিন্তু শেষ মহারাজা জীবিত।রাজমহিমাও প্রখর।আশেপাশে কত কত জোতদার।ধনীর ঘর।শিক্ষা বিস্তারে,লোকসংস্কৃতির প্রসার ও সংরক্ষণে যে জোতদারদের অবদান উত্তরবাংলায় অনস্বীকার্য।নটবর মন্ডল আমাকে শোনাতে থাকেন আবহমানের গল্পকথা।উত্তরের শ্লোক।চান্দামারীর প্রাণনাথ জোতদার,বালাগ্রামের পদ্ম ধনী আর বাঘমারার বাবুরাম ধনীর গল্প।প্রাণনাথের হাতি,বাবুরামের বাঘশিকার আর পদ্ম ধনীর বিশাল দোনলা খুটার বন্দুক।আর দশ গ্রামের যত মানুষ জড়ো হত বৈষগুড়ির বিলে।সে এক এলাহী বাহ পরব।মাছ মারা।আর ফাঁকে ফোকরে গুঁজে দেওয়া পূর্ববাংলার ভাটিয়ালী গান।উত্তর জনপদের দোতরা পালা,কুশানের ছুকরি নাচ।আর জঙ্গলবাড়ির গুলা বাঘা,লাল টিয়া।দেশ ভোলেন নি নটবর।এখনো চোখ বন্ধ করলে জন্মমাটি ভেসে ওঠে।জলে ভেজে চোখ।আহ,জীবন....
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.