![]() |
শামিমা এহেসানা |
ভিন্ন জাতের প্রেম কথা
( একটি বাঘ ও একটি সিংহের গল্প আপাত ভাবে মনে হলেও, এটি মানব প্রেমের গল্প। দুই ভিন্ন জাতের প্রেমিক -প্রেমিকাকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আলাদা করে দেওয়ার গল্প। বাঘ-সিংহ এখানে রুপক মাত্র )
এক যে ছিলো বাঘ। জংগলে রাজত্ব ছিলো বাঘের। কথা ছিলো বাঘিনী খুঁজে বাঘকে পাত্রীস্থ করা হবে।
কিন্তু হঠাত একদিন অন্ধকার নামে বাঘের জীবনে। সেই অন্ধকার হাতড়ে আলোয় ফিরে আসতে বাঘের সময় লেগে যায় প্রায় এক দশক।
এক দশক পরে বাঘ আলো দেখে, আর আলোর সাথে দেখে তার ঝুলে পড়া গালের চামড়া। বাঘ বোঝে সে অন্ধকারে অনেকটা সময় পার করে ফেলেছে। এবার পালা মূল স্রোতে ফেরা। কিন্তু একাকী কতক্ষন। সংগী ছাড়া কিসের জীবন। বাঘের গুহার অন্যান্য বাঘ, বাঘিনী মিলে সিদ্ধান্ত নেয় এবার এই বাঘকে মূল স্রোতে ফেরাতে হবে তাকে তার সংগিনী এনে দিয়ে।
যদি বাঘিনী নাও মেলে তবু শেয়াল রানী, চিতা বা অন্য কোনো প্রজাতির সংগিনী আনা হবে।
সিদ্ধান্ত মতো গুহার অন্যান্য বাঘ বেরিয়ে পড়ে সংগিনী খুঁজতে। সাথে একটি লক্ষন রেখা টেনে দেয় বাঘের চারপাশে।
বারণ থাকে বাঘের ওই লক্ষন রেখা পার করতে।
তখন মাঝ রাত। গোটা জংগল ঘুমিয়ে। বাঘের গুহাও ফাঁকা। কিন্তু বাঘের ঘুম আসেনা। সে লক্ষন রেখার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সময় কাটায়। এতক্ষনে খেয়াল করে একটা ছোটো এলাকা জুড়ে লক্ষন রেখার চিহ্ন নেয়। সেই পথ দিয়ে জংগলে বেরিয়ে আকাশের চাঁদ, তারা, বিলের কাঁচের মত জলে চাঁদের ছটা, জোনাকির আলো দেখার লোভ হয় বাঘের। শুধু ভোর হবার আগে লক্ষন রেখার ভেতরে ফেরত আসতেই হবে একথা মাথায় রেখে বাঘ বেরিয়ে পড়ে। জংগলে ঘুরতে ঘুরতে হঠাত একটা ঝিল দেখা যায়। ঝিলের পাশে হাঁটার সময় কোথা থেকে বেশ কয়েক বিন্দু জল বাঘের গায়ে এসে পড়ে।
বাঘ রাগে ফোঁসে। কে এমন দুঃসাহস দেখালো জানতে বাঘ সামনের ঝোঁপের আড়াল সরায়।
আড়াল সরাতেই চোখে পড়ে এক সিংহী সদ্য স্নান সেরে এসে তার কেশর ঝাড়া দিচ্ছিলো। সেই জলই আসলে বাঘের গায়ে পড়ে।
বাঘ অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সিংহীর সামনে। কামড় বসাতে যাবে এমন সময় দেখে সিংহীর চোখ চকচকে। চামড়া মসৃন। কেশর উজ্বল।
না। এতো কিশোরী সিংহী মাত্র। এর সাথে শোধই বা কিসের।
বাঘ কামড় বসানোর ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে উল্টে সিংহীর চোখের চকচকে করুণ দৃষ্টি বাঘের মন কেড়ে নেয়।
একথা ওকাথা বলতে বলতে ভোর হয়ে আসে। বাঘ বলে তার যাবার সময় হয়ে এলো। সে লক্ষন রেখায় ফিরতে চাই। ফিরেও যাই। কিন্তু সিংহ কিশোরীর সাথে কাটানো সময় এর কথা কিছুতেই ভোলেনা। একই অবস্থা সিংহীরও হয়।
ভোর হবার আগেই লক্ষন রেখার ভিতর ঢুকে গা এলিয়ে দেয় বাঘ। ঘুম আসেনা তার। আকাশ পানে তাকিয়ে দেখতেই খেলা করে বেড়ানো, মিটমিট করে জলে ওঠা তারাদেরকে দেখে বাঘের শুধু সিংহীকেই মনে পড়ে।
ওদিকে সিংহীও একই যন্ত্রনায় কাতর।
এমন সময় হই হুল্লোড়ের আওয়াজ পেতেই চোখ খোলে বাঘের।
দেখে দলের বাঘেরা ফিরে এসেছে একটি বাঘিনী, চিতা,ছাগ, শেয়াল রানীর মত আরো কয়েকটি যুবতী পশু নিয়ে।
দলের বাঘেরা আদেশ দেয় বাঘকে। এদের ই কোনো এককে বেছে নিতে।
বাঘ শান্ত মনে দুঃখ ভরে এসে দাঁড়ায় যুবতী শেয়াল এর সামনে। সে তাকিয়ে দেখে সিংহীর মুখ। ঘোর কাটলে খেয়াল করে ওটা শেয়াল রানী। এভাবে প্রতিটি পশুর সামনে দাঁড়িয়ে বাঘ শুধু সিংহীকেই দেখে।
বাঘ জানিয়ে দেয় সে এদের কাওকেও সাথী হিসেবে গ্রহন করবেনা। কারন সে শুধু সিংহীকেই চাই। দলের অন্যান্যরা তীব্র বিরোধ করে। অস্বীকার করে তারা বাঘের দলে সিংহীর আসা।
ওদিকে জংগল তোলপাড় করে ফেলে সিংহী শুধু বাঘের খোঁজে।
কোথাও পায়না সে মন চুরি করা বাঘের খোঁজ। শেষ পর্যন্ত হদিশ মেলে বাঘের গুহার।
বাঘকে দেখেই সিংহী ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু লক্ষন রেখায় বিদ্যুতের ঝটকা খেয়ে সিংহী লুটিয়ে পড়ে মাটিতে রক্তাক্ত হয়ে।
দুপারের দুই সিংহী আর বাঘ এর মাঝে দেওয়াল হয় লক্ষন রেখা। একজন কে সে রেখা পার করে বাইরে আসতে দেওয়া হয়না। আর অন্যজনকে ভিতরে যেতে দেওয়া হয়না।
কাতরাতে কাতরাতে রক্তাক্ত সিংহীর মৃত্যু হয়। আর ওদিকে বাঘ এই সবের সাক্ষী রয়ে যায়। পারেনা সে লক্ষন রেখা পার করে বাইরে আসতে।
অনেক বছর কেটে যায়।
বাঘ আজও আকাশের মিটমিটে তারায় সিংহীকে দেকগে। শুধু ছুঁতে পারেনা।
এখন বাঘের বড় সংসার। ছাগরানী কে বিয়ে করে বাঘের প্রায় ১২ টি শাবক জন্মেছে। নাম দিয়েছে- ছাগবাঘ।
ছাগবাঘ দের দেখে বাঘের করুনা হয়। মায়া হয়। সে ছাগবাঘ দের সিংহীর গল্প শোনায় প্রতি সন্ধ্যায়।
একটি পূর্নিমার আলো মাখা রাতের বন্ধুতা আজ বাঘের কাছে উপন্যাস এর মত দেখায়।
প্রতিটা সেকেন্ড একটা অধ্যায় মনে হয়।
ছাগবাঘ দের দেখে বাঘ মনে মনে ভাবে..... এদের তেজ কোথায় বাঘ সন্তানের মতো। ইশ। সেদিন যদি এমন না হতো। তবে আজ হয়তো ছাগবাঘ দের গায়ের রং হতো সোনালী। বাঘের দাঁত আর সিংহের কেশর মিলিয়ে অদ্ভুদ তেজী বাঘ-সিংহ জন্মাতো।
আফশোস হয়। শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বাঘ আকাশ পানে তাকিয়ে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন