ফসলের জন্মগন্ধ : সোমা প্রধান

সোমা প্রধান
ফসলের জন্মগন্ধ


তখন ভাদ্রের দুপুর। নিম্নচাপের কারণে মাঝে মাঝে ঝুপ করে নেমে আসছে বৃষ্টি মুষলধারায়।জানলার পাল্লা নড়ে ওঠে হাওয়ায়।ফাঁকা অফিসঘরে   কাজ করছিলাম একা। হঠাৎ  খিলখিল হাসির শব্দে চমকে উঠি। ঘাড় ঘুরিয়ে  জানলার বাইরে তাকাতেই চোখ আটকে গেল এক অপূর্ব দৃশ্যে।বড় রাস্তা থেকে নেমে একটি সরু আলপথ চলে গেছে মাঠের বুক চিরে সবুজ ধানজমির পাশ দিয়ে, তার পাশে আরও সরু নালায় বর্ষার কাদাজল বয়ে যাচ্ছে। তিনটি দামাল  কিশোর চলেছে ফসলের মাঠ পেরিয়ে। তাদের পায়ে পায়ে খেলা করছে একটি ভাঙা প্লাস্টিকের বোতল, ঠিক ফুটবল খেলার মেজাজে একএকবার এক একজনের পায়ের কিকে ছিটকে পড়ছে বোতলটি কখনো সবুজমাঠে,কখনো কাশফুলের ঝাড়ে, কখনো নালায় আর দামাল কিশোরেরা কাদাজলে দুমদাম পড়ছে  হড়কে... খিলখিল আওয়াজে ছড়িয়ে পড়ছে খুশি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি বাতাসে।

মুহূর্তে ফিরে গেছি শৈশবে।

 ইট পাথরের ঢালাই রাস্তা নয়, হেঁটেযাওয়া নগ্ন পায়ের ছাপে বোনা সরু খালপাড়, তারপর নেমে আসা আলপথ বেয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলেছি আমাদের মাঠে। মাথায় ক্যান ভর্তি গরমভাত, ডাল, আলুমাখা, আর আমচুর।ভুরভুর  গন্ধে খিদে বাড়ে । হাঁটু ওবদি কাদাজল আমার ফ্রক ছুঁয়ে যায়। উগালে এসে রোদ মাথায় নিয়েই খেতে বসে চাষি, কলাপাতায় সাজিয়ে দিচ্ছি খাবার। শুকিয়ে যাওয়া আগ্নেয়গিরির মাথায় যতটা খাদ ঠিক তেমন করেই খুদভাতের মাথায়  ডালের পুকুর। পাশে লঙ্কাপেঁয়াজ সরষের তেলে মাখা আলুভাতে, আর দুটুকরো আমচুর। খেসারীর ডালে আমচুরের স্বাদ ঠিক অম্লমধুর জীবন। আমিও খেতে বসি ওদের সাথে। চাষীকাকার ছেলে  সেলিম আমাদের স্কুলেই পড়ে, আমার থ্রি ওর ফোর। ও আসে মাঠে, হাতে হাতে ব্যানধান এগিয়ে দেয়, আমারও ইচ্ছে হয় খুব তবু মাঠে নামতে দেয়না কাকা।ডাক্তার  মালিকের মেয়ে বলে কথা।  চাষীরা খাওয়ার পরে বিড়িধরায় বটগাছের আড়ালে, সেই সুযোগে আমিও নেমে পড়ি মাঠে। ধানের চারা জলের ভিতর কর্ষিত মাটির বুকে গেঁথে দিই আলগোছে। নরমদুটি হাতে লেগে থাকে ফসলের জন্মগন্ধ, দুধেস্বর শিশুর হাতবদলের গন্ধ, আর আমার আনন্দের গন্ধ।
আমি আর সেলিম মাঠে নেমে এমনই কাদাজল ছিটিয়ে খেলেছি আর অবাক বিস্ময়ে দেখেছি কিভাবে ছোট্ট ঔ ধান থেকে ব্যানতলা, তারপর তা  ধানগাছ হয়ে ওঠে।

শরতের পরাগ মেখে সন্তানসম্ভবা মাঠ একসময় হেমন্তের শিরশিরে হাওয়ায় সোনালী ফসলে ভরে ওঠে কেমন করে, সেই অপার জিজ্ঞাসা ফেরার পথে মাথায় করে বয়ে আনি ফাঁকা ক্যানের সাথে।

এখন শেষ অঘ্রাণের রোদ নুয়ে আছে মাঠের বুকে। পাকাধানের শিসে শিসে মৃদুল বাতাস বাজায় নিক্কণ। রাণীপিসি গোবরজলের ন্যাতা দিচ্ছে নিকানো উঠোনে। কাল ধানের গাদা বসবে। দুপুরে হবে মহাভোজ।প্রত্যুষ কাকা সদলবলে মাঠে ধান কাটছে তাই। গ্রামের মেয়ে বৌ রা কাটা ধানের বিড়া বেঁধে  মাথায় বজা নিয়ে চলেছে  দুলকি চালে। আলপথের ধারে ধারে শিস থেকে ঝরে পড়ে ধান... যেন মেয়ে চলেছে শশুরবাড়ি, বিদায়লগ্নে কনকাঞ্জলি পেতে মাটি, মা আমার, বুকে বেঁধে নেয় ঋণ শোধের ফসল। এদিকে ধানকুড়ানীর দল ধামায় ভরে জোগাড় করে নবান্নের রসদ। নাড়ার গোড়ায় গোড়ায় ভিজে মাটিতে লুকিয়ে থাকে চিতি কাঁকড়া। ওপাড়ার মাসুদ, সাওন, নমিতা বালতি ভর্তি করে ধরে আনে সে সব।রাতে মাঠে নাড়ার আগুনে হবে ফিস্টি। রাঙা আলু, মুড়ি পেঁয়াজ, শিম, চিতি কাঁকড়া আরও কত কি পোড়া হবে, সে ভারী মজা।

আজ ও ভেসেওঠে বিক্রামনগরের সেই খালপাড় ঘেসা আমাদের চাষের জমি যেখানে শুধুই ধানেরচারা রোয়া হত না, রোয়া হত চাষীদের পরিশ্রম, আমার শৈশবের আনন্দ আর মায়ের মালক্ষ্মী হয়ে ওঠার গল্প।


সোমা প্রধান
গ্রামঃ জরারনগর, পোষ্টঃ হেঁড়িয়া, থানাঃ খেজুরী
জেলাঃ পূর্বমেদিনীপুর, ডাকসূচক-৭২১৪৩০
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.