একজন কাল্পনিক মানুষের গল্প : রুদ্রসাগর কুন্ডু

রুদ্রসাগর কুন্ডু
 একজন কাল্পনিক মানুষের গল্প

মানুষের মনে না জানি কত কথা, কত ভাবনা, কত ইচ্ছে অনিচ্ছের পাহাড় জমে থাকে। কত নদী, মাঠঘাট, সবুজ বন, মাটির রাস্তা, গাছের ছায়া, সম্পর্ক, অভ্যাস, অনুরাগ আরো কত কি ! অবসর পেলে আজকাল এইসব নিয়ে ভাবতে বসে যায় অনিমেষ। অনিমেষের বাবা-মা নেই, ভাই-বোন নেই। কেউ নেই। না দূরের, না কাছের। একাকিত্বের যা কিছু উপসর্গ থাকে, তার সবটুকুই অনিমেষ যাপন করে। অসুস্থ শরীরে গায়ে খাটাবার জোর নেই। দুচারটে গ্রামের ছেলেপিলে এসে আড্ডা মারে অনিমেষের ডেরায়। তারাই কখনো চালডাল নিয়ে আসে।

বিনিময়ে অনিমেষের কাছে ওরা দেশ বিদেশের জানা অজানা গল্প শোনে। অনিমেষ বলেছে পৃথিবীর বয়স গোনা যায়। এমিবা থেকে মানুষের জন্ম। এমিবা এঁকে দেখিয়েছে। মহাকাশের সীমা পরিসীমা নিয়ে কথা হয়। বিজ্ঞানের আবিষ্কার নিয়ে কথা হয়। সক্রেটিস নামক একজন বিশেষ ব্যক্তির কথা বলতে বলতে অনিমেষ আনন্দে হেসে ওঠে। চোখে বিদ্যুত ঝলকে ওঠে। অনিমেষের মুখ থেকে ওরা এথেন্সের গল্প শোনে। রোম নগরীর কথা শোনে। ছেলেগুলো এলে অনিমেষের একাকিত্ব কেটে যায়। আনন্দ করে গান করে, সকলে মিলে কোরাস গায়। বেশিরভাগ সময়ই অনিমেষ লালনের গান করে।

অনিমেষ ছাত্র বয়সে বাম রাজনীতি করতো। তখনকার সময়ের একজন বিপ্লবীর একটি ফটো দেয়ালে যত্ন করে টাঙানো। চে গুয়েভারার। বলিভিয়ার জঙ্গলে কষ্টে কাটানো দিনগুলির গল্প করতে করতে অনিমেষ কেঁদে ফেলে। ছেলেগুলো আশেপাশের পাড়া থেকে আসে। মদ খায়, গাঁজা খায়। সারাদিন দার্শনিক চিন্তা করে। রাজনীতি, শোষণ, শিক্ষানীতির কথা বলে। ওদের মধ্যে নয়ন নামের ছেলেটি বেশ মেধাবী। পড়াশোনায় ভালো। ডাক্তারিতে চান্স পেয়েছে এ বছর। নিয়মিত আসে। অনিমেষের খাবারের জোগাড় করে। জল, ওষুধ, দেশলাই, সাবান শ্যাম্পু কিনে দিয়ে যায়। হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করে রেখে যায়। নয়নকে দেখলে অনিমেষের কেন জানি স্বামী বিবেকানন্দের কথা মনে পড়ে যায়। ঠিক তেমন দুটি চোখ, নাক, কান আর গায়ের রং।

আরেকজন প্রিয় মানুষ রয়েছে অনিমেষের। পাশের বাড়ির একটা ৩ বছরের ছেলে। রঘুনাথ। সে সহসা অনিমেষের বাড়ি আসে না। দেওয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে হাঁক দিয়ে অনিমেষকে আনিমুচ বলে ডাকে। আর অনিমেষ তখন এপাশে দাঁড়িয়ে খানিক্ষন গল্প করে নেয়। রঘুনাথের বাবা মা অনিমেষের জন্য মাঝেসাঝে ওটা ওটা দিয়ে পাঠায় ছেলেগুলোর হাতে করে।

রঘুনাথের বাবা মুসলিম, মা হিন্দু। মায়ের ইচ্ছে ছেলে হিন্দুমতে বড়ো হবে। রঘুনাথের বাবা আলম সাহেব সরকারি চাকুরে। ৭ বছর আগে এই পরিত্যক্ত বাড়িটি কিনে বসবাসের উপযুক্ত তৈরী করে আছে। সেইসময় থেকেই অনিমেষের অনুগামী হয়ে পড়েন আলম সাহেব। অনিমেষের থেকে আলমসাহেব প্রায় ১০ বছরের ছোট হবে। অনিমেষ অবশ্য আলম সাহেব বলেই সম্বোধন করেন। রঘুনাথকে অনিমেষ ছোটবেলা থেকেই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। রঘুনাথের মা, অনিমেষকে দাদা বলে সম্বোধন করেন।

মানুষের বিচিত্র জীবন নিয়ে ছেলেগুলো আজ আলোচনা তুলেছে। সকাল এগারোটার এই আলোচনা সন্ধ্যে পর্যন্ত চলবে। এরই ফাঁকে খাওয়াদাওয়া। আজ মুরগির ডিম আর আলুর ঝোল রান্না করবে মতিন। জগদীশ রান্না করবে মুসোর ডাল। অনিমেষের বাড়ির গন্ডি একবিঘে জমি নিয়ে। চারিদিকে বর্ষার জঙ্গল হয়ে আছে। মাঝখানে ৪ কামরার পুরোনো বাড়ি অনিমেষের মামার দেয়া। দানে পাওয়া। এদিক ওদিকে সাপের আনাগোনা। গাছে গাছে পাখির বাসা। বড়োই রোমাঞ্চকর বসবাসের জায়গা।

অনিমেষের ছাত্র বয়সের বন্ধুরাও আসে মাঝে-মাঝে সময় কাটাতে। তখন ছেলেগুলোর খুব আনন্দ হয়। শহুরে মানুষের টাকায় মদ মাংস চলে হরদম।  কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, গল্প নিয়ে আলোচনা। সঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী, সুবোধ সরকার, নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজ, তসলিমা নাসরিন আরো কত কত লেখকের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে সারারাত আলোচনা আড্ডা চলে। রাতের টহলে বেরোনো পুলিশের গাড়ি এসে থমকে দাঁড়ায় অনিমেষের বাড়ির গেটের গাছে। বড়োবাবু বিনয়ী হাসি নিয়ে উঠোনে এসে সম্মানের সঙ্গে ডাকেন, অনিমেষবাবু, আড্ডা মারবো। আসব নাকি?

সারারাত আড্ডা মেরে সকালের আলো ফুটে ওঠে। এককাপ গরম চা খেয়ে বড়োবাবু বিদায় নিলে, এবার সবাই ১০ টা ১১ টা পর্যন্ত ঘুমায়। এতকিছুর মধ্যে অনিমেষ শুধু একটা বিষয় গোপন করে যায় সকলের কাছে। আর তা হচ্ছে অসুস্থ শরীরের যন্ত্রনা। ক্রমশ শরীর ভাঙছে অনিমেষের।

আজকাল প্রায় সময়েই প্রস্রাবে রক্ত পরে অনিমেষের। কিডনি খারাপ হয়ে গেছে। ভালো চিকিতসার জন্য প্রয়োজন অনেক টাকার। কাউকে অসুখের কথা বলতে ভালোও লাগে না। নয়ন অবশ্য খানিকটা বুঝতে পারে। তাদের গুরুদেব সুস্থ নেই। নিজেদের মধ্যে আলোচনা হয়ে গেছে। ছেলেরা আলম সাহেবের সঙ্গেও আলোচনা করেছে। টাকার জোগাড় প্রায় হয়ে গেছে। এবার দিনক্ষণ দেখে ভেল্লোরে যাবে সবাই মিলে।  অনিমেষকে হারানো চলবে না।

অনিমেষের খুব ইচ্ছে ছিল আমেরিকা ঘুরতে যাওয়ার। কিছু টাকা জমিয়েও রাখা আছে। শরীরের জন্য আর হয়ে উঠবে না। অনিমেষ একদিন ছেলেদের অগোচরে ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলে আনে। তারপর প্রায় প্রতিদিনই ভালোমন্দ খাবারের আয়োজন করতে থাকে। ছেলেগুলো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অনিমের বুদ্ধিদৃপ্ত সরল ও প্রতিভাময় মুখের দিকে। কি অবিচল, মুখে কি দারুন নির্মল হাসি।

সকল অসুখ যেন হার মেনে গেছে। অনুপম বেঙ্গালোরে পড়াশোনা করে। অনিমেষের অস্বাভাবিক আচরণের কথা শুনে গতকাল ফিরেছে বাড়িতে। দিব্যেন্দু, আলোক, মতিন সকলেই খুব চিন্তিত। কিন্তু মুখ ফুটে কেউ জিগ্যেস করতে সাহস করে না। পরশু ভেল্লোরে নিয়ে যাওয়া হবে অনিমেষকে। অনিমেষ তা জানে না। টিকিট, হোটেল বুকিং, ডাক্তার এপয়েনমেন্ট সব করে রেখেছে ছেলেরা। আলম সাহেবের পরিবার এবং ছেলেরা মোট ১১ জনের টিম।

আজ সকাল যেন অনিমেষের কাছে বিশেষ দিন। আজ সকলের অগোচরে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে অনিমেষ। মানব শরীরের বেঁচে থাকার দিনক্ষণ শেষ হয়ে এলেও মানুষ বাঁচার জন্য চেষ্টা করে। অনিমেষের বাঁচার ইচ্ছে নেই। কি হবে বেঁচে থেকে ? জীবন তো একদিন থমকে যাবেই। তা নিয়ে বিচলিত হওয়া ঠিক নয়।আজ অনিমেষ পরিপাটি। সেভ করেছে। স্নান করে সুগন্ধি মেখেছে।

কার্লমাক্সের জীবনী গ্রন্থটি প্রায় দশ মিনিট বুকে জড়িয়ে ধরে সুগন্ধ নিয়েছে। চে গুয়েভারার ছবিতে হাত বুলিয়ে সরিয়ে দিয়েছে ধুলোর আস্তরণ। মলাটের কাগজ খুলে গেছে লালনগীতি বইয়ের। বইটি শেষবারের মতো হাতে তুলে দেখে নিলেন একপলক। তারপর ঝড়ের বেগে পা চালিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পৃথিবীর পথে। রাস্তায় কারও সঙ্গে কথা বললেন না। কারো কথার প্রত্যুত্তর করলেন না। স্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেনটিতে উঠে পড়লেন উদ্ভ্রান্ত অনিমেষ।

এদিকে রীতিমতো হৈচৈ লেগে গেছে। ছেলেরা এসে দেখছে দরজা খোলা। ভেতরে অনিমেষদা নেই। বাইরেও কোথাও নেই। আলম সাহেব ছেলেদের নিয়ে সারাদিনমান ঘুরাঘুরি করে কোনো হদিস পেলেন না। না খেয়ে, সারাদিন ঘুরে ফিরে ক্লান্ত ছেলেরা অনিমেষের বাড়ি ফিরে এলো। না, অনিমেষ নেই। এখনো ফেরেনি সে। বড়োবাবু সব শুনে বিচলিত হলেন। খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র। এমেলে এলেন, এমপি এলেন। মুখ্যমন্ত্রী উদ্বিগ্নতা জানালেন। গঙ্গাজল ঘাঁটি থেকে বাল্যবন্ধু পরিমল এলো।

সংবাদপত্রে নিখোঁজ খবর ছাপা হলো। বাকি থাকলো সিআইডি আর সিবিআই। নিরুদ্দেশ অনিমেষকে সাতদিন, একমাস, বছর কেটে গেলেও কেউ আর খুঁজে পেলো না। ছেলেগুলো মাঝে মাঝে অনিমেষের ঘর খুলে চুপচাপ বসে থাকে। কেউ কোনো কথা বলে না। মাঝে মাঝে ৩ বছরের রঘুনাথ আনিমুচ বলে ডাকে। অনেক্ষন সারা না পেয়ে মায়ের কাছে ফিরে যায়। রঘুনাথের মা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদে। আলম সাহেব বাড়ি ফেরে।  হাতমুখ ধোয়। আর দীর্ঘ্যক্ষন অনিমেষের বাড়ির দিকে মুখ করে নীরবে বসে থাকে। 
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.

4 Comments:

Bidisha Sarkar বলেছেন...

ভালো লাগলো

Bidisha Sarkar বলেছেন...

ভালো লাগলো

নামহীন বলেছেন...

Khub sundor

সুকৃতি সিকদার বলেছেন...

রুদ্রদা, ভালো লাগলো লেখাটা।অন‍্য একটা আমেজ আছে।