আজ বিশ্ব ডাক দিবস : মৃদুল শ্রীমানী


আজ বিশ্ব ডাক দিবস 

 

মৃদুল শ্রীমানী


১.
স্মরণ করছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক ডাকঘর নিয়ে আমার অনুভূতি

ছোট শিশু যেন কেমন করে বিশ্বের দুঃখবাণী গুলি জেনে ফেলেছে। জেনে ফেলেছে যে এ সাধের পৃথিবী ছেড়ে বড়ো অসময়ে তাকে চলে যেতে হবে। কেন যে যেতেই হবে, কেন এ অমোঘ ডাক, সেই নিয়ে কোনো অভিযোগটুকুও নেই বালকের। কিন্তু তা বলে পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ হতে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চায় না সে। জানতে চায়। জানতে পেলে খুশি হয় অমল। কল্পনার মায়া কাজল মাখানো অমলের চোখ দুটি। নিজের বাপ মা নেই। গ্রাম সম্পর্কে পিসির কাছে মানুষ। রোগা ছেলেটিকে পিসেমশাই মাধব দত্ত ভারি ভালবাসে। আর অমল যে পৃথিবীতে বেশিদিন টিঁকবে না সেটা মাধব দত্ত জানেন। ছোটো ছেলেটির সামনে কাঁদতেও পারেন না। কেবল ওর চলে যাওয়াটুকু একটু সুসহ হলে যেন বেঁচে যান মাধব।
 
তাকে জীবনীশক্তিতে বঞ্চিত করলেও ভালবাসা আকর্ষণের শক্তির কোনো খামতি দেন নি প্রকৃতি। জানালার ধারটিতে বসে সে আপনমনে চলমান জনজীবনের স্পন্দন দেখে চলে। বিশ্ব সংসারের নাচের তাল এসে ঘুরে ফিরে যায় ওর শয্যাপার্শ্বের জানালার ওপার দিয়ে। যা কিছু জীবন্ত, যা কিছু প্রাণময়, তার প্রতিই অমলের অমোঘ কৌতূহল। সবাইকে ডাক দেয় অমল। কাজের মানুষ অনেকে রাগ করে। রাগ করে, কেন না তাদের খেটে খেতে হয়। তারপর অমলের মিনতি মাখা চোখদুটো দেখে তাদেরও হৃদয় পাত্র উপচে আবেগ আসে।
 
গোটা "ডাকঘর" নাটকে ঘরের মানুষের একটা ডাক, আর ঘরের বাইরের মানুষের আর একটা ডাকের মধ্য দিয়ে যাত্রাপথের আনন্দ গান শুনেছে অমল। ঘরের মানুষ যাঁতায় ডাল ভেঙে গেলে ঘরের বাইরের কাঠ বিড়ালীরা এসে খাবার নিয়ে গিয়েছে। ঘরের মানুষ বাইরের বাতাসকে ভয় পেয়েছে। জানালা বন্ধ করে দুর্ভাগ্যকে দূরে ঠেলতে চেয়েছে। আর রাজার ডাকঘরের সম্ভাবনা আর দূরের ঘন্টা আর নাম না জানা গ্রাম, সেখানকার পাহাড় নদী দুধ দোয়ানো বালিকা অমলের কল্পনায় রঙ্গিন হয়ে তাকে উসুখুশু করে দিয়েছে। অমল পাড়াগেঁয়ে পেশি পলিটিক্সটাও দেখে নিয়েছে। চিনেছে মোড়লীর কাঠখোট্টা ভাষা। ভাষা সন্ত্রাস। আর ঠাকুর দাদা। যে ঠাকুরদা অমলকে গল্প শোনায়, সে একদিন নিজেই অমলের কাছে বলে ফেলে - বাবা, তোমার ওই নবীন চোখ পাবো কোথায়! ঘরের মানুষের চোখে জল এনে দিয়ে একদিন অমল মিলিয়ে যায় বহুদূরের তারার আলোটির সাথে। চির ঘুমন্ত অমলের জন্যে ফুলওয়ালি মেয়ে স্বচ্ছ ভালবাসাটুকু জানিয়ে গেল। সমস্ত আগল খুলে সাদামাটা পৃথিবীর ওই ভালবাসাটুকুই সম্বল করে শূন্যলোকে পাড়ি দেয় অমল, যেখানে আর কোনোদিন ঘরের ডাক পৌঁছবে না।

২.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "পোস্টমাস্টার" কে কেন্দ্র করে আমার একটুখানি

রতনকে মনে পড়ে আমার। বালিকাটি পোস্ট মাস্টারের ঘরের কাজকর্ম দেখে দিত। বাপ মা হারা দুঃখী মেয়ে রতন। খাওয়া পরার সাংঘাতিক অভাব। না, ছোটো মেয়েটি রাঁধতে সেভাবে পারত না। পোস্ট মাস্টার কোনোমতে নিজেই রেঁধে নিতেন। রতন জল তুলত, বাসন মেজে আনত , আর কাপড় কাচত। সকালবেলার তরকারি রাখা থাকত। রাতে রতন কোনোমতে খানকতক রুটি গড়ত। তাই দিয়ে রাতেও দুজনের খাওয়া চলত। পোস্ট মাস্টারের ঘরে কাজ করে দেবার বিনিময়ে দুবেলা খেতে পেত রতন। পোস্ট মাস্টার ফাঁকা সময় পেলে রতনকে পড়ানোর চেষ্টাও করতেন। কখনো কখনো গল্পও বলতেন। সে সব কথা ছোটবেলায় কে না রবি ঠাকুরের কলমে পড়েছি ?
 
কলকাতার ছেলে পোস্ট মাস্টার। পাড়াগেঁয়ে এলাকায় পচা ডোবার ধারে তার পোস্ট অফিস। গ্রাম দেশে কি কেবলই ফাঁকা মাঠ? তা তো নয়, যেখানে মানুষের বসতি, সেখানে এঁদো পচা পুতিগন্ধময়। বর্ষাকালে পচা গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে থাকে। গ্রাম্য মানুষের মধ্যেও মন খুলে গল্প করার লোক বিশেষ পান না পোস্ট মাস্টার। রতন ছিল ওঁর গল্পের সঙ্গী। গল্পে গল্পে পোস্ট মাস্টারের বাবা, রতনের মুখে বাবা। তাঁর মা, রতনের মা। পোস্ট মাস্টারের পরিবারে তাঁর সাথে যাঁর যে সম্পর্ক,গল্প করতে করতে রতনের জন্যও তাঁরা তাই।  এমন কি কখনো কখনো মনের অগোচরে পোস্ট মাস্টারও ভাবতেন এমন একটি স্নেহ পুত্তলি তাঁর নিজের হোক। 
 
পাড়াগেঁয়ে পরিবেশে বিষণ্ন দিন কাটাতে কাটাতে কলকাতার ছেলেটি ম্যালেরিয়ায় পড়লেন। রতন তার আপনজনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। সেবায় যত্নে সেরে উঠলেন পোস্টমাস্টার। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন এই পচা ডোবার পাশে আর নয়। চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে যাবেন তিনি।  রতন জানে, সেও কলকাতায় যাবে তার আপনজনের সাথে। কেননা ওঁর বাপ মা কে সেও বাপ মা মনে করে। দাদা দিদি বৌদিদের নিজের আপন জানে মনে মনে।  কিন্তু কলকাতার ছেলেটি জানিয়ে দিলেন যে রতনের তাঁর সাথে যাওয়া হবে না। এটা রতনের ভারি বাজল। ফেলে রেখে যাবেন, এমন কথাও তিনি ভাবতে পারলেন? টাকা নয়, সুপারিশ নয়, কোনো কিছুই আজ তার যন্ত্রণা কমাতে পারবে না। আপনজন তাকে ছেড়ে চিরতরে চলে যাচ্ছেন, এই বেদনা রতনকে গ্রাস করল। 
 
সে সব দিনে তো রতনের বয়সেই লোকে মেয়ের বিয়ে দিত। পিতা মাতা হীন অনাথ মেয়েটি পোস্ট মাস্টারকেই জীবনের ধ্রুবতারা জেনেছিল। তাঁর পরিবারকে নিজের পরিবার জেনেছিল। তাঁর আত্মীয় দের নিজের আত্মীয় জেনেছিল। তাঁকে শুধু অন্নদাতা হিসাবে নয়, শিক্ষাদাতা ও আশ্রয়দাতা হিসাবে ও জেনেছিল।
কেন কলকাতার লোকটি এতখানি স্নেহ দিয়েছিলেন? কেন কাছে ডেকে বাড়ির গল্প বলতেন, লেখাপড়া শেখাতেন? 

পোস্টমাস্টারের এক অদ্ভুত স্বার্থপর হৃদয়হীন চেহারা ধরা পড়ে রতনের চোখের সামনে। সেই মানুষটা, যে বর্ষার দিনে কাছে ডেকে পড়তে বসাতো, বাড়ির সবার গল্প করতো, আজ সে এভাবেই ফেলে যাবে? তাহলে কি দরকার ছিল এতদিন এই স্নেহ দেবার? কলকাতার লোকটির স্বার্থপর চেহারাটা আমাদের কাছে বেআব্রু করে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.