দেবাশীষ রায়
'
মায়ের পদতলে জান্নাত ', এই কথাটা আমার কাছে ভোগাস মনে হয়। এ কথা পাপবোধ ও
মানসিক নিপীড়নের একটি বড় উৎস। চিন্তার কারণ নাই; আমি জান্নাত জাহান্নাম
নিয়ে কথা বলতে আসি নাই। উপরের এই কথাটার যে ব্যাখ্যা কমবেশি সবাই দেয়, সেটা
হচ্ছে— মায়ের অবাধ্য হওয়া যাবে না। মা একটা আদেশ দিলে সেটা পালন করাই
কর্তব্য। তার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা অধর্ম। কেউ কেউ
হয়তে এটাকে আরো নানান ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। কিন্তু মূলমন্ত্র মোটামুটি এরকম
যে, মায়ের কোনো আদেশ, সিদ্ধান্ত বা কথার বিরোধিতা করা উচিত না; আর অশ্রদ্ধা
করলে পাপ হবে। কারণ, মা তার সন্তানের ক্ষতি চায় না। যা করে ভালোর জন্যই
করে।
মানুষের যৌবনের একটা
বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এ সময় সে আবেগ তাড়িত হয়ে অনেক
স্বপ্ন দেখে যেগুলো অর্জন করতে পারা দুষ্কর। আর আবেগ তাড়িত মানুষেরা
শীঘ্রই নানান বিপদে পড়ে যায়; শিকার হয় ব্যর্থতার। তাই এসময়ে তার
দিকনির্দেশনা একান্ত জরুরী। সেসাথে তাদের প্রেরণা, সাহস দেয়া সকলের নৈতিক
দায়িত্ব । সমাজকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়," সেটা সে কোথা থেকে পাবে?" উত্তর
আসবে পিতা- মাতা, শিক্ষক, বড় ভাই, গুরুজন। এবং তারা যেহেতু অভিজ্ঞ তাদের
বাণী আমাদের সমৃদ্ধ করবে এবং বিচার বিবেচনায় সাহায্য করবে। সমাজ "পাকা
চুলওয়ালা মাথায় বেশি জ্ঞান, বেশি বুদ্ধি আছে", এরকম একটা নীতি বিশ্বাস
করে; থাক এ বিষয়ে কিছু বললাম না।
কিন্তু
এখানে একটা সমস্যা আছে। আমাদের গুরুজনেরা কতটুকু মেধা ও কালচার সম্পন্ন
মানুষ তা দেখতে হবে। মধ্যবিত্ত পরিবারের পিতা মাতাকে দিয়ে শুরু করা যাক।
আমার জানা মতে মানুষ সন্তান নেয় দুই কারণে। প্রথমটা সুখের জন্য। দ্বিতীয়টা,
কন্ট্রাসেপশন না করতে পেরে বা তার পদ্ধতি না জানা থাকার ফলে। কিন্তু
বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবার কি কারণে সন্তান নেয় সেটা এখনো আমার কাছে অজানা।
আমার তো মাঝে মাঝে এ বিষয়ে ভাবতে গেলে, মনে বলে, আমরা সবাই কনডম ফেটে
জন্মানো সন্তান( অসম্ভব না, কারণ বাঙালিরা কনডম ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি জানে
নাকি, তা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়) ; এজন্যই এত অনাদর ও শাসনের শিকার হই।
যাইহোক, লেখা শেষে এর উত্তর পান নাকি দেখেন।
একটা
শিশুকে জন্ম দিলেই পিতা মাতা হওয়া যায় না। সে শিশুর শারিরীক ও মানসিক
স্বাস্থ্যের সঠিক চর্চা করা তাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের
বাপ মা কি শিশু লালন পালনের সঠিক পদ্ধতি কোনো বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে
শিখেছিলো? উত্তর নিজেই ভেবে দেখেন। শিশুদের ত্বক খুবই কোমল। তাই তাদের জন্য
বিশেষ ক্রিম, শাবান, শ্যামপু তৈরি করা হয়। পিএইচ ভ্যালু সহ নানান কারণে
প্রাপ্তবয়স্কদের ক্রিম, শাবান, শ্যামপু তাদের ত্বকে দেয়া উচিত না।
শিশুদের সবসময় ডায়াপার পরিয়ে রাখলে তাদের কুঁচকিতে লাল দাগ দেখা দেয়।
তারপর, অনেক পরিবার তাদের আবাল বৃদ্ধদের কথা বিশ্বাস করে পুরো একবছর বুকের
দুধ খাওয়ায় না। শিশুরা কথা বলতে পারে না, তাই তাদের কোনোরকম অস্বস্তি দেখা
দিলে একজন বিশেষজ্ঞ দেখানো একান্ত জরুরী। এরকম আরো নানা বিষয় আছে যা শিশুর
শারীরিক সমস্যার জন্য দায়ি। একটু বড় হবার পরও, অনেক শিশু মোটামুটি ধনবান
পরিবারের জন্মগ্রহণ করেও অপুষ্টিতে ভুগে। এখন শিশু যত্ন ও লালন পালনের সঠিক
পদ্ধতির প্রচারের ফলে মানুষ বেশ সচেতন। কিন্তু এখনো আমাদের অনেকে পিতা
মাতার মধ্যে এ বিষয়ে অসচেতনা আছে। যা তাদের অজ্ঞতার পরিচায়ক...
একটা
শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে, তাকে তার দেহ ও মনের বিকাশে সাহায্য করতে হবে।
আপনার আমার বাপ মা সেক্স এডুকেশনের নাম শুনলে লজ্জায় লাল হয় যায়। মনে হয়,
এতটাই অপবিত্র একটা কথা উচ্চারিত হয়েছে যে, তারা দ্রুত মুখ লুকাতে পারলে
বেঁচে যায়। এটা তো আমার কাছে স্বভাবিক মনে হয়না। আপনার আমার পিতা মাতা কি
আমাদের মানসিক অত্যাচার করেনি? দেখা যাক করেছে নাকি না। এরকম কি আপনার সাথে
হয়েছে যে, স্কুল পরীক্ষা ফলাফল খারাপ করায় বাপ বা মা কয়েকদিন কথা বলে নাই?
অনেকের বাবা-মা তো খারাপ ফলাফলের কারণে ছেলেকে পিটুনিও দেয়। আমি একরকমও
দেখছি যে, নানান সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতায় প্রথম না হয়ে দ্বিতীয় হওয়ায় জন্য,
সে ছেলে বা মেয়ের বাবা-মা হতাশায় ভেসে গেছে। এগুলো আমার কাছে পৈশাচিক
আচরণ। ছোটখাটো ভুলভালের জন্য সপ্তাহ খানেক কথা না বলে মানসিক অত্যাচার
করবে। আবার কথার আগেই হতাশ হয়ে যাবে ও তার ইতিবৃত্ত প্রকাশ করে নিজের ছেলে
বা মেয়েকে বারবার ধিক্কার জানাবে। তাদের আরেকটা নীতি হচ্ছে, ত্রাস ও ভয়
দিয়ে শান্তি রক্ষা করার নীতি। ভয় সৃষ্টির আনুপাতিক হচ্ছে শান্তির রক্ষা!
এখানেই
শেষ না। আপনি এত শত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে যাওয়ার পর, আপনার বাবা- মা'ই
সিদ্ধান্ত নিবে যে আপনি কাকে বিয়ে করবেন। জীবন আপনার, বিবাহ আপনার, স্বামী /
স্ত্রী আপনার, সংসার আপনার কিন্তু সিদ্ধান্ত পিতা মাতার ! আমাদের কিন্তু
বুঝতে হবে বিবাহ জিনিসটা খুবই স্পর্শকাতর একটা বিষয়। মানুষ বিবাহ করে সুখী
হওয়ার জন্য, প্রিয় মানুষের সাথে জীবন কাটানোর জন্য। একসাথে একটা সন্তানকে
মানুষের মত মানুষ করে তোলার জন্য। এটায় যদি স্বামী স্ত্রীর মনে মিল না
থাকে, যদি সহমর্মিতা অভাব দেখা দেয়, তাহলে মোটামুটিভাবে বলা যায় একটা
মানুষের জীবনটাই অসুখী হয়ে যায়। আর এই অসুখী মনোভাবের থেকে পলায়ন শুরু হয়
পরকীয়ায়; শেষ হয় ডিভোর্সে। আর সেই বিবাহে যদি সন্তান থাকে তার মানসিক
বিকাশের পথে কি ডিভোর্স একটা বড় ধাক্কা নয়? আমি তো মনে করি প্রেম ছাড়া বিয়ে
করা শোচনীয় ভুল । সমাজ যদি লিভ টুগেদারের অনুকূলে থাকে তাহলে উচিত বছর ২-৩
প্রেম করে, বছর ২ এর মত সময় লিভ টুগেদারে করা। যদি মনের মিল অটুট থাকে,
তাহলে তাদের বিবাহ করে সন্তান নেয়া নিরাপদ মনে করি। আর সমাজ যদি প্রতিকূলে
থাকে তাহলে বছর ২-৩ প্রেম করে, বিবাহ করে, অন্তত বছর ৩-৪ প্রটেকশন ব্যবহার
করে সেক্স করে, বসবাস করে এরপর সন্তান নেয়া উচিত। সন্তান লালন পালনের
গুরুত্ব নিয়ে লেখতে গেলে তা শেষ হবে না...
কিন্তু
মজার বিষয়, ছেলেরা তাও তাদের পিতা মাতার অবাধ্য হয় না । মেয়েরা এ বিষয়ে
আরো বেশি অসহায়; সম্ভবত তাদের আর্থ পরাধীনতা তার কারণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে,
নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কেনো তারা পিতা মাতার
কাছে বশ্যতা শিকার করে? এর কারণ, তাদের উপর চলমান এত বছরের নীরব মানসিক
অত্যাচার, তাদের ভেতর থেকে আত্মবিশ্বাসহীন করে দিছে। আপনার ভেতরে সাহসীকতা
বলতে যা থাকার কথা ছিলো তা ভরে গেছে ভীরুতায়। আমরা পিতা মাতার এত কড়াকড়ি
বিধান আমাদের সিদ্ধান্তের ক্ষমতা কেড়ে নেয়। এগুলো আমার কথা না।
মনোবিজ্ঞানীদের কথা। মানসিক বিকারের বিষয়টা নীরবে ঘটে যায় বলে আমরা তা
বুঝতেও পারি না। তখন মানসিক অসুস্থতাই হয়ে দাঁড়ায় সুস্থতার প্রতীক। পরিবার
চায় তার ছেলে বা মেয়ে হবে কলের পুতুল; যা বলা হবে তাই মানবে। পিতা মাতার
একটা অসুখী বিবাহে যে সন্তানের কত অপরিসীম ক্ষতি হয়, তা বলা অসম্ভব।
ছোট
থাকতে, মানে বয়স ৫-১০ এর মধ্যে থাকতে, মা'রা তাদের মেয়েকে বাহিরে অনেক
ছেলে-পেলেদের খেলাধুলার সুযোগ দেয়। কিন্তু যেই একটু বড় হয়ে যায়, তাকে
বুঝানো হয় বাহিরের খেলাধুলা ছেলেদের জন্য। এটা স্বাভাবিক না যে, আপনি
বিকালে পুরো ঢাকায় ঘুরে হাতেগোনা কয়েকজন মেয়েকে বাহিরে খেলাধুলা করতে
দেখবেন। বিদেশে হুহু করে ছেলে ও মেয়েরা খেলাধুলা করে। শুধু তাই না, সেখানে
তারা সুইমিং পুলে নিয়মিত সাঁতার কাটে। মেয়েরা সাইকেল চালায়। অন্যদিকে,
ঢাকায় মেয়েরা সাইকেল বা মোটরবাইক চালালে ভীড় জমে যায়। বাঙালি মেয়েদের
দৌড়ঝাঁপ করতে ইচ্ছে হয় না, এটা আমার বিশ্বাস হয় না। যে মেয়েকে তার বাপ- মা
ছোটো থাকতেই ছেলেদের থেকে আলাদা করে রাখবে; বারবার বুঝাবে যে ছেলেদের নানান
বিষয়ে বেশি অধিকার আছে, সে দেশের মেয়েরা কখনই নিজেকে বড় রূপে প্রতিষ্ঠা
করতে পারে না। আমি বয়েজ স্কুল আর গার্লস স্কুলের তাৎপর্য এখনো ধরতে পারি
না। আলাদা স্কুলের ব্যবস্থা কেনো করছে? শিক্ষার মাধ্যম হবে সহশিক্ষা।
ছেলেদের ও মেয়েদের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হবে, তা শেখার জন্য এটা
আবশ্যক। নারী জাগরণের অন্তরায় সবচেয়ে বড় বাঁধা এসব প্রথাগত পারিবারিক
চিন্তাধারা।
দুঃখিত জনাব।
আমাদের পিতা মাতা কালচার্ড মানুষ নয়। তারা প্রথার ব্যাধিতে আচ্ছন্ন। তারা
অধিকাবৃত্তির নেশায় ডুবে আছে। তারা প্রথাগত। আপনার " আমিত্ব " কে তারা সহ্য
করতে পারে না। তারা চায় আপনি হবেন তাদের সম্পত্তি। আপনি এখন আমাকে প্রশ্ন
করবেন যে, " তাহলে কি পিতা মাতা আমাদের শাসন করবে না? " অবশ্যই করবে জনাব।
অবশ্যই করবে। কিন্তু সঠিক পদ্ধতিতে। আপনি কোনো বিশেষজ্ঞ, থেরাপিস্ট বা
মনোবিজ্ঞানীর লখা বা বক্তব্যে যদি আমাকে দেখাতে পারেন যে, শিশুদের শাসন
করার উচিত ব্যবস্থা তাদের পিটুনি দেয়া, ফলাফল খারাপ করলে কথা বলা বন্ধ করে
দেয়া, বারবার তাদের ব্যর্থতা কথা মনে করিয়ে দিয়ে তাকে হীনমন্যতার শিকার
করা, ভয় প্রদর্শন করা, তার সকল কথা ও আবদারকে অগ্রাহ্য করা ; আমি আপনার কথা
মেনে নিবো। আমি আপনার দাস হয়ে যেতে প্রস্তুত আছি।
সঠিক
ব্যবস্থা বা পদ্ধতি কিরকম, সেটা আলোচনা করতে গেলে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে।
তবে আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে কখনো, বাপ বা মায়ের থেকে এরকম কোনো প্রশ্ন
শুনি নাই যা প্রকাশ করে বিনয় বা অনুকম্পা। কখনো জিজ্ঞেস করে নাই যে, আমি
ভালো আছি নাকি। কোনোদিন শুভ সকাল, শুভ সন্ধ্যা জানায় নাই। চিন্তিত দেখেও
কখনো জিজ্ঞেস করে নাই যে কোনোকিছু নিয়ে সমস্যায় পড়ছি নাকি। কিন্তু আমার
ছোটখাটো ভুল নিয়ে দিনে ৫ বার বিচার নালিশ না বসলে কারো মনে শান্তি আসে না।
এখন যদিও পাত্তা দেয়া বন্ধ করে দিছি। জনাব, তারা এখনো বুঝলো না স্নেহ হচ্ছে
একজনকে নিজের মত বিকশিত হতে দেয়া। স্নেহ উদ্দেশ্য কাউকে নিজের ইচ্ছার
সীমানায় বদ্ধ করা নয়। সন্তানদের বিকাশকে ভালোবাসার মধ্যেই নিহিত সকল
শুভ্রতা।
" Your
children are not your children. They are the sons and daughters of
Life's longing for itself. They come through you but not from you, and
though they are with you yet they belong not to you.” আমরা পিতা- মাতাদের
মধ্যমে এসেছি, তাদের থেকে নয়। তাদের সন্তান বলেই তাদের দেয়া আকৃতি দেয়ার
মতো সম্পত্তি — মানবসন্তানেরা নয়! বিপদ বিপদ বলে সকল অভিজ্ঞতা থেকে রুদ্ধ
করে রাখা বিকৃত স্নেহ, অধিকাবৃত্তি করার মনোভাব। মানুষের জন্ম হয়
স্বাধীনরূপে কিন্তু আটকালচার্ড পিতা মাতা তাকে করতে চায় নিজের ইচ্ছার মধ্যে
শৃঙ্খলিত।
আরেকটা ভাবার
বিষয় হচ্ছে, তাদের কথায় কথায় ভাত কাপরের খোঁটা দেয়া। মনে হয়, পারলে এখনি
বাসা থেকে কোনো একটা জড়বস্তুর মতো নিজের সন্তানকে নিক্ষেপ করে বের করে দিলে
রক্ষা পায়। আমি ঠিক বুঝি না, যদি পরিবারে ভাত কাপড়ের এতই অভাব থাকে, তাহলে
একটা সন্তানকে জন্ম দেয়ার মানে কি? ফুর্তি করার জন্য আরেক দুর্ভাগাকে
পৃথিবীর মুখ দেখানো? মানুষ বলে, গরীব ঘরে জন্মানো অপরাধ না, কিন্তু গরীব
হয়ে মৃত্যুবরণ করলে অপরাধ। কথায় খিচ নাই। তবে কথাটা অসম্পূর্ণ। সেটুকু
হচ্ছে, সন্তান লালন পালন করার মত অর্থ নাই, এমন গরীব হয়ে বাচ্চা জন্ম দেয়া
চরম পাপ। মধ্যবিত্ত পরিবারের এই সমস্যা নাই। তাও, তারা কথার আগে এগুলো বুলি
ছুড়ে দিবে। আসলে বিষয়টা হচ্ছে, তাদের হাতে আর কোনো শক্তি নেই। স্নেহের
শক্তি বলতে একটা বিষয় আছে, যা দিয়ে যেকাউকে ভালো মন্দ বোঝানো যায়। এরা তো এ
বিষয় জানে না। তাই কথার আগে ভাত মেরে দেয়ার হুমকি দিয়ে শান্তি রক্ষা করে।
আমাদের
সমাজের বেশির ভাগ পিতা মাতাই আটকালচার্ড। স্পষ্ট করে বললে, " সুশিক্ষায়
শিক্ষিত নয়।" এটার হাজার হাজার প্রমাণ আপনি আপনার চোখের সামনেই পেয়েছেন
কিন্তু ভেবে দেখেন নাই। আপনি যার সাথে বাসে ঝগড়া করে আসলেন, কর্মস্থলে যার
বিরুদ্ধে অভদ্রতার অভিযোগ দিলেন, রাস্তায় যাকে মাথামোটা বললেন, ফেসবুকে যার
সাথে খিচ লাগালেন ; তারাই একজন পিতা, একজন মাতা। তবে টেনশন নাই। আমাদের
বাবা- মা এত বড় বিড়ম্বনা নয়; তারা সুশিক্ষিত না, সত্য; তবে সমাজে ভাবমূর্তি
অটুট রাখার জন্য যথেষ্ট শিক্ষিত। আপনি মনে করার চেষ্টা করেন আপনার স্কুল
কলেজে কয়জন কড়া শিক্ষকের দেখা পেয়েছেন। কথার আগেই মুখের উপর অনেক কথা বলে
দেয়া শিক্ষকের দেখা অনেক পেয়েছেন। অনেক শিক্ষক চরম অপমানজনক কথাও বলে।
অকারণে উত্তেজিত হয়ে শাস্তি দেয়ার মত শিক্ষকের দেখা আপনারা সবাই কম বেশি
পেয়েছেন। এরা যে তাদের সন্তানের সাথে আলাদা আচরণ করে এটা ভাবা বোকামি।
এরকম
ঘটনা সচারাচর হয় যে, মেয়ে শাশুড়ীর বাড়িতে অত্যাচারের শিকার হয়। কিন্তু সেই
মেয়ে তার মায়ের কথা বিবেচনা করে মুখ ফুটে বাবার বাড়িতে কিছুই বলে না। এটা
কি ধরনের বাধ্যতা? আমার এরকম ঘটনাও জানা আছে যে গৃহবধূ বিবাহে অসুখী ও মা-
বাবাকে কষ্ট দেয়ার ভয়ে, কাউকে কিছু না জানিয়ে আত্মহত্যা করছে। অসংখ্য জীবন,
ছেলে মেয়ে উভয়ের, অসুখী হয়ে গেছে তাদের পিতা মাতার সিদ্ধান্ত চোখ বন্ধ করে
মেনে নিয়ে। আমারো এরকম অভিজ্ঞতা আছে। তাদের সিদ্ধান্ত আপনার জন্য বিপর্যয়
নিয়ে আসবে না এরকম কোনো কথা নাই। তবে কোনো বিপর্যয়ই শেষ বিপর্যয় না। সেখান
থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসা সম্ভব। ব্যর্থতাকে ভয় করা অমূলক, কারণ কোনো
ব্যর্থতাই সবকিছুর অন্তিম না। জনাব, জীবনটা আপনার। " Give me an educated
mother, I shall promise you the birth of a civilized, educated nation.”
এই উক্তির মধ্যে মাতার কোন ধরনের শিক্ষার কথা বলা হয়েছে এখন নিজেই ভেবে
দেখুন। নিশ্চয় মাতাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পাস করা
সার্টিফিকেটের শিক্ষা এখানে বলা হয়নি।
যৌবনে
আপনার অন্তত এটা বুঝতে পারা উচিত যে, আপনি সঠিক পথে আছেন কিনা। এবং এই
সময়ে সকল সিদ্ধান্তের পেছনে যৌক্তিকতা উদঘাটন করে, তার সুবিধা অসুবিধা
ভাবার শক্তি অর্জন করতে পারবেন — এটা আশা করা যেতেই পারে। এখন এটা জানার পর
কি আপনি আপনারা পিতা মাতাকে শ্রদ্ধা করবেন না? অবশ্যই শ্রদ্ধা করবেন,
জনাব। তাদের ছোটখাটো সিদ্ধান্ত যেগুলো আপনার জীবনে হস্তক্ষেপ করতেছে না,
সেগুলো অবশ্যই বিনয়ের সাথে পালন করবেন। আপনি কি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে
ভয় পাবেন? ভয়ের কোনো যৌক্তিকতা দেখি না। যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত লাগবে সে বিষয়ে
অভিজ্ঞ কারো সাথে পরামর্শ করে নিবেন। আমাদের এটা একটা বড় সমস্যা, সেটা
হচ্ছে আমরা সঠিক মানুষের কাছে পরামর্শ চাই না। আাই সব ভুলভাল অনভিজ্ঞ
মানুষের কাছে। কবিগুরুর " বঙ্গমাতা " কবিতাটা পড়েছেন?
" পূণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে।
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।
দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালোছেলে করে।
প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।
শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে।
সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি। "
এখানে
কবিগুরু বঙ্গমাতা আমাদের দাদা দাদির চিত্রেরই প্রতিফলন। দেশের প্রতি ৭
কোটি সন্তানের জননীর প্রতি ধিক্কার। দুঃখিত জনাব। আপনার আমার পিতা মাতা
আমাদের মানুষ হতে দিচ্ছে না। মানুষ সন্তান নেয় দুই কারণে। কিন্তু বাঙালি
সন্তান নেয় অপশনের বাইরে তৃতীয় একটি কারণে। সেটা হচ্ছে অধিকারবৃত্তি ও শাসন
চর্চা করা, আর ভবিষ্যতে বসে বসে খাওয়ার ফ্রি টিকেট পাওয়ার জন্য। তারা
নিজেরা বাজে শাসন ও নীতির প্রভাবে বড় হইছে; এখন সেই বিকৃত শাসনই আমাদের উপর
প্রয়োগ করতেছে। জানি জনাব নিজের পিতা মাতাকে নির্বোধ রূপে কল্পনা করা বেশ
কঠিন( কিছু ব্যতীক্রম আছে) । কিন্তু এটাই সত্য। তারা মনে পাপবোধ সৃষ্টির
করার প্রধান মাধ্যম। আমি জানি, তারা সপ্তাহ খানেক সময় কথা না বলে একজন
ছেলের মাথায় কতটা চাপ ও বিকারের সূচনা ঘটায়। অনেক পিতা মাতারা তার সন্তানকে
বডি শেমিং এর শিকার করে, তার মানসিক সুস্থতাকে ক্রমে ক্রমে নাশ করে দেয়।
আপনি
নিজে এখন বিবেচনা করে দেখেন। প্রথাগত " স্নেহময়ী বঙ্গমাতা " তাদের
কন্যাদের কত ক্ষতিসাধন করে। বঙ্গমাতারাই কন্যাদের গৃহলক্ষ্মী রূপ দেয়, আর্থ
স্বাধীনতার শিক্ষা দেয়ার চেয়ে রূপের চর্চার দিকে বেশি মনোযোগ দেয়।
মনোভাবটা এমন যে, মেয়ে শিক্ষিত না হোক, সমস্যা নাই; কিন্তু রূপের তন্ময়ে
যেনো ভালো কোনো জামাই জুটে। তাহলেই আমার মেয়ে সুখী হবে( আমরা জানি বিয়ে করে
সুখী হওয়া আধুনিক যুগে কঠিন)। স্নেহময়ী বঙ্গমাতা তার ছেলেকে কোনোদিন
যৌনশিক্ষা দিবে না। বরং এটার নাম শুনলেই লজ্জায় মরি মরি ভাব করবে। যেদিন
ছেলের পর্ন আসক্তির কথা জানতে পারবে, সে চুপিচুপি যেয়ে সেটা লাগিয়ে দিবে
ছেলের বাপের কানে। আর বঙ্গপিতা এরপর ছেলেরে উড়াধুরা গালিগালাজ ও চড়থাপ্পড়
দিয়ে যেকোনো রকম সমস্যার আলোচনার পথ চিরতরে বন্ধ করে দিবে। এরপর থেকে সেই
ছেলে তার বাপ মা থেকে সবকিছু গোপন করবে এবং মিথ্যা বলবে। বঙ্গমাতার এই
ধরনের আচরণ প্রশংসনীয় না। এগুলা ননসেন্স, নির্বুদ্ধিতা, অজ্ঞতা। আধুনিক
বঙ্গমাতারা যে, এখন তাদের মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করতে চায়; এর কারণ এই যে এখন
উচ্চশিক্ষিত ছেলেরা নিরক্ষর মেয়েদের নিকা করতে চায় না। এই বিষয়ে আমি
বিস্তর ভেবেই এই কথা বলতেছি। বঙ্গমাতারা তাদের এই ক্ষুদ্রতাকে এখনো অতিক্রম
করে যেতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ...
আমাদের
দরকার সাহস, দরকার করুণা। A good world needs knowledge, kindliness, and
courage; it does not need a regretful hankering after the past or a
fettering of the free intelligence by the words uttered long ago by
ignorant men. একবার ব্যর্থ হলেও সমস্যা কি? ভয় কিসে? The only source of
knowledge is experience. আপনার আমার অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। পিতা মাতা যা
সিদ্ধান্ত দেয়, সেটা তারা তাদের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে দেয়। যুগ
প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। তাদের এত প্রথাগত ধ্যান ধারণা এখন সম্পূর্ণভাবে
বর্জনীয়। সন্ধ্যার আগে বাসায় ফেরার ভয় দেখিয়ে, সবসময় চোখে চোখে রেখে যে
মাতা তার কন্যার সাহস ও শক্তি কেড়ে নিচ্ছে, সে মাতা কি অপরাধ করছে না? সাহস
কেড়ে নেয়া একজিনিস, বোঝানো আরেক জিনিস। স্নেহময়ী বঙ্গমাতার পদতলে স্বর্গের
কথা একটু ভুলে যেয়ে সমাজে স্বর্গ প্রতিষ্ঠার কথা ভেবে দেখুন। একজন
সুশিক্ষিত পুত্রের জনক বা জননী হয়ে গর্ব করুন, আদর্শ স্থাপন করুন। আর কতদিন
প্রথাগত ও বাঁধাধরা নিয়মে চলবেন, অজ্ঞ মাতার পদতলের ভ্রান্ত স্বর্গের
হাবুডুবু খাবেন? বিবেচনা করুন, পরিবর্তন আনুন।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন