স্বাধীনতার গান
মৃদুল শ্রীমানী
আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বন্দে মাতরম্ এবং জাতীয় গাথা হল জনগণমনঅধিনায়ক গান দুটি। আমরা এই জনগণমনঅধিনায়ক গানের প্রথম স্তবক জাতীয় দিবসে গেয়ে থাকি। এইটুকু অংশই জাতীয় গাথা হিসেবে মান্য।
জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ
তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিষ মাগে,
গাহে তব জয়গাথা।
জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে॥
১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই জনগণমনঅধিনায়ক গানটি রচনা করেন। ভারতভাগ্যবিধাতা নামে পাঁচটি স্তবকের পূর্ণাঙ্গ গানটি আদি ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯১১ সালের ২৭ ডিসেম্বর তারিখে কলকাতা শহরে আয়োজিত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভায় জনগণমনঅধিনায়ক পরিবেশিত হয়।
১৯১২ সালের জানুয়ারি মাসে আদি ব্রাহ্ম সমাজের সভায় এই গানটি গীত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগিনেয়ী সরলা দেবী চৌধুরাণী শিশুদের নিয়ে গানটি পরিবেশন করেছিলেন। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতৃত্বগণ উপস্থিত ছিলেন।
অ্যানি বেসান্ত ছিলেন বিশিষ্ট ভারততত্ত্ববিৎ ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। দক্ষিণ ভারতে অন্ধ্রপ্রদেশের মদনাপল্লীতে বেসান্ত থিওসফিক্যাল কলেজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ সালে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গিয়েছিলেন এবং আঠাশ ফেব্রুয়ারি তারিখে জনগণমনঅধিনায়ক গানটি তিনি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে পরিবেশন করেন। ইংরেজি ভাষায় গানটির রবীন্দ্রপ্রদত্ত নাম ছিল মর্ণিং সঙ অফ ইণ্ডিয়া। আজও ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভাতী সঙ্গীত হিসেবে রবীন্দ্রসৃষ্ট গানটি গেয়ে থাকেন।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ইংরেজ অপশাসনের অবসান ঘটাতে রাশিয়া হয়ে জার্মানি যান। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর জাতীয় সঙ্গীত স্থির করতে একটি কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটি ১৯৪১ সালের ২ নভেম্বর তারিখে জনগণমনঅধিনায়ক গানটি বাহিনীর জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে চূড়ান্ত করে। পরে ১৯৪২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে জার্মানির হামবুর্গ শহরে জার্মান ইণ্ডিয়া সোসাইটির সভায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু স্বয়ং জনগণমনঅধিনায়ক গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে পরিচিত করান।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির পূর্ব মুহূর্তে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে কনসটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির বৈঠক বসেছিল। তার অন্ত্যপর্বে বৈঠক সমাপনী অনুষ্ঠানে সদস্যরা সম্মিলিত কণ্ঠে জনগণমনঅধিনায়ক গেয়েছিলেন। পরে ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি তারিখে স্বাধীন ভারত এই গানটি জাতীয় গাথা হিসেবে গ্রহণ করে।
এর আগেই এই গানটি হিন্দি সিনেমায় গৃহীত হয়। ১৯৪৪ জ্যোতির্ময় রায়ের গল্প আশ্রয় করে নিউ থিয়েটার্সের বিমল রায় পরিচালনা করেছিলেন উদয়ের পথে। রবীন্দ্রপ্রেমীরা এই শব্দদুটি শুনলে একটি নির্দিষ্ট কবিতা স্মরণ করবেন। উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই, হে রুদ্র তব সঙ্গীত আমি ... ইত্যাদি । সুপ্রভাত নামে রবীন্দ্র কবিতাটি। ১৯৪৫ সালে উদয়ের পথের হিন্দি রিমেক করলেন বিমল রায় নিজেই। নাম দিলেন হামরাহি। হিন্দি ছবির উপযোগী করে ডায়লগ বা বাক্যবিন্যাস করে দিলেন মোহনলাল বাজপেয়ী। সুর করেছিলেন বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়াল। ১২১ মিনিটের ফিল্মে বেশিরভাগ গান গেয়েছেন বিনতা বোস। হেমন্ত কুমারও ছিলেন। আর এই ফিল্মে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনগণমনঅধিনায়ক গানটি সম্মেলক গান হিসেবে গাওয়া হয়েছিল। খুবই সুখ্যাতি পেয়েছিল এই হামরাহি ফিল্মটি।
গানটি ১৯১১ সালে কংগ্রেসের সভায় পেশ হওয়া সূত্রে কয়েকটি ইংরেজি দৈনিক কাগজের অল্পশিক্ষিত ও অদূরদর্শী সাংবাদিক কলমচি গানটিকে ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের প্রতি প্রশস্তি হিসেবে উল্লেখ করে রিপোর্ট লিখে প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ধরনের ক্ষীণদৃষ্টি রিপোর্টের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। বাংলা ভাষায় যাঁদের কিঞ্চিৎ ব্যুৎপত্তি আছে, তাঁরা নিচের স্তবক দুটি পড়ে দেখলে বুঝতে পারবেন সাংবাদিক নামের আড়ালে কতদূর নীচ মানসিক গঠনের পরিচয় রেখে গিয়েছেন তথাকথিত ইংরেজি দৈনিক কাগজের কলমচিরা।
পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী।
হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।
দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে
সঙ্কটদুঃখত্রাতা।
জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে॥
ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে
জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে।
দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে
স্নেহময়ী তুমি মাতা।
জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে॥
এই গানটি যে কোনোভাবেই কোনো রক্ত মাংসের শাসকের উদ্দেশে রচিত হতে পারেনা, তা বুঝতে গেলে স্বাভাবিক বোধটুকুই যথেষ্ট।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন