নাস্তিকের শ্রীরামকৃষ্ণ : মৃদুল শ্রীমানী

নাস্তিকের শ্রীরামকৃষ্ণ : মৃদুল শ্রীমানী
 

নাস্তিকের শ্রীরামকৃষ্ণ

 

 মৃদুল শ্রীমানী

(প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি)


একজন বস্তুবাদী ও নাস্তিকের পক্ষে কোনো ধর্মীয় ব‍্যক্তিত্বকে লোকপ্রিয় করে দেখানো কঠিন। কেননা, নাস্তিক মানুষ জানেন ধর্ম জিনিসটা ভুলিয়ে রাখে। আফিমের সাথে ধর্মের তুলনা করেছেন মনীষীরা। কেউ তুলনা করেছেন বিষকন‍্যার সাথে। তাই আদ‍্যন্ত ধর্মপ্রাণ ও ঈশ্বরানুগত গদাধর চট্টোপাধ্যায় ওরফে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস মহাশয়কে লোকসাধারণ যেভাবে দেখে থাকেন, বা বিশেষ একটি ধর্মব‍্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের তরফে যেভাবে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রোপাগান্ডা করা হয়, তার সাথে তাল মেলানো নাস্তিকের পক্ষে অসম্ভব।

 অথচ, বাংলাভূমির রেনেসাঁ নিয়ে কথা বলতে গেলে গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের কথা ওঠে। গভীরভাবে লক্ষ্য করি যে, যথেষ্ট প্রোপাগান্ডা সত্ত্বেও শ্রীরামকৃষ্ণ যে নিছকই একজন মর্ত‍্য মানব, এই ধারণাটা অস্বীকার করা যায় না। কেননা অতি সাধারণ মানুষের মতোই তিনি অন্নসংস্থানের বাস্তব প্রয়োজন সম্পর্কে বুঝতেন, সাধারণ মানুষের লাচারির কথা জানতেন, শিক্ষা বিস্তার করার সহজিয়া ও লোকায়ত, যা কিনা সরকারি অনুপ্রেরণা কর্মসূচির বাইরে, তার মর্ম বুঝতেন। আর বিভিন্ন ব‍্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে মতবিনিময় করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতেন।

কলকাতার উত্তর শহরতলীতে জানবাজারের রানি রাসমণির একটি বাগান বাড়ি ছিল। সেখানে তিনি একটি কালিমন্দির করেছিলেন। কিন্তু বড় জমিদার, কাঞ্চন কৌলীন‍্যে প্রতিষ্ঠিত ও প্রখর ব‍্যক্তিত্বের অধিকারিণী হলেও রাসমণির সামাজিক কৌলীন‍্যের দারুণ ঘাটতি ছিল। রাণি রাসমণি তীব্র ব‍্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন বলে গঙ্গার দখলদারি নিয়ে ইংরেজ প্রশাসনের সঙ্গে টক্কর দিলেও মন্দিরের পূজারী ব্রাহ্মণ পেতে তাঁর সমস‍্যা হচ্ছিল। বড় জমিদার হলেও কৈবর্তঘরণীর দেবতাকে অর্ঘ্য দিতে বামুনেরা তখনো অরাজি ছিল। এই পরিস্থিতিতে গ্রামবাংলার দারিদ্র্য প্রপীড়িত এলাকা কামারপুকুর থেকে ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের ছেলেরা রাণির নবগঠিত মন্দিরে আর্থিক কারণেই  নিত‍্যপূজার দায়ভার গ্রহণ করলেন।
ইংরেজের কলকাতায় কাজের সুযোগ থাকলেও গ্রামবাংলার অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুণ। এবং ঘরে বসে পূজার্চনা করে অন্নসংস্থানের উপায় গ্রাম‍্য স্বল্পশিক্ষিত বামুনদের ছিল না।
সেই বাস্তবতা স্বীকার করেই ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের ছেলেরা কৈবর্ত মহিলার কর্মচারী হতে স্বীকৃত হন।
বড় দাদার সহকারী পরিচয় নিয়ে কলকাতায় এসে গদাধর যে নানাবিধ তপস্যা করেছিলেন বলে লোকশ্রুতি, তা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কেননা, আমি ওইধরনের তপস্যা করে কিছু হয় বলেই মনে করি না।
গদাধর ছিলেন স্বল্পশিক্ষিত। অক্ষরজ্ঞান তাঁর ছিল। তিনি লিখতে পারতেন। কিন্তু ওই পারতেন অবধি। গদাধরের হস্তলিপি দেখলে বোঝা যায়, দীর্ঘদিনের পাঠাভ‍্যাস ও মনন লিপিবিন‍্যাসে যে একধরনের শৈলী ও স্বচ্ছলতা দেয়, তা তাঁর ছিল না।

অথচ, তাঁর এক অদ্ভুত আলোকমুখীনতা ছিল। এই আলোকমুখীনতার কারণেই তিনি কলকাতার বুধমণ্ডলীর নক্ষত্রগণের কাছে গিয়ে আলাপসালাপ করা অন‍্যতম কৃত‍্য বলে মনে করতেন। গদাধর চট্টোপাধ্যায় কলকাতায় যাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলেন, ও খানিকটা কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন, সেই তালিকাটি রীতিমতো সম্ভ্রম জাগায়। ডেপুটি ম‍্যাজিস্ট্রেট ও বিখ‍্যাত ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সংস্কৃত কলেজের অধ‍্যক্ষ ও বিখ্যাত সামাজিক আন্দোলনকারী তথা পাঠ‍্যপুস্তক রচয়িতা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগর, নট ও নাট‍্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ, বিখ্যাত ইংরেজিনবীশ অসাধারণ বাগ্মী ব্রাহ্ম ধর্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন ইত‍্যাদি।

গদাধর অন্ততঃ এঁদের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে অবগত হতে পরিশ্রম করেছেন এবং কথায় বার্তায় তাঁদের কাছে কিছুটা সময় হলেও বসতে পেরেছেন। বিশেষতঃ বিদ‍্যাসাগর মশায়, যিনি তাঁর থেকে অন্তত ষোলো বছরের বড়, তাঁর সামাজিক সদর্থক ও গঠনমূলক অবদান সম্পর্কে কিছুটা ধারণা অবশ‍্যই গদাধরের ছিল। গদাধরের তরফে বিদ‍্যাসাগরকে ক্ষীরের সাগর বলাটা প্রায় প্রবাদ হয়ে গিয়েছে। একজন ঈশ্বরানুগত ব‍্যক্তির পক্ষে একজন অজ্ঞেয়বাদী সংশয়ী ও প্রশ্নশীল মানুষকে ক্ষীরের সাগর বলে শুধু মনে মনে চেনা নয়, সহজ উচ্চারণে বলতে পারাকে আমি শ্রদ্ধা করি।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গদাধরের থেকে দুই বছরের ছোট ছিলেন। বঙ্কিম যে অনন্য সাধারণ রসিকপুরুষ ছিলেন, তা বোধ করি গদাধর জানতেন না। আজকের দিনেও যাঁরা বঙ্কিম সাহিত্যের যত্নশীল পাঠক নন, তাঁরা বঙ্কিমের সরস ব‍্যক্তিত্বের খবর রাখেন কি? গদাধর যে বঙ্কিমের উপন‍্যাসের সাথে পরিচয় করে নিয়ে তারপর বঙ্কিম সন্দর্শনে গিয়েছিলেন, তা না হওয়াই সম্ভব।

ওই যে গদাধর বঙ্কিমের কাছে জানতে চাইলেন, তুমি কি কর, আর সাহিত‍্যসম্রাট রহস্য করে বলছেন, আহার নিদ্রা আর মৈথুন,  এই রহস্যভেদ  নিশ্চিতরূপে গদাধরের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সাহিত্য সম্রাটের  রহস‍্যালাপকে গদাধর লৌকিক বুদ্ধিতে বুঝতে চেয়ে এক রকম ভুলই বুঝেছিলেন। বন্দে মাতরম্ সঙ্গীতটির সাথে ভাল রকম পরিচয় থাকলে কালিভক্ত মাতৃঅনুগত গদাধর বঙ্কিমকে রীতিমতো সংবর্ধনা জানাতেন।

গদাধরের সঙ্গে রাসমণির সম্পর্কটি লক্ষ্য করা প্রয়োজন। রাসমণি মহিলা হলেও বড় জমিদার। অগাধ প্রতিপত্তি। হাঁকডাকওয়ালা মানুষ। গদাধর বাস্তবে তাঁর কৃপাপুষ্ট, আশ্রিত। তবু আর্থ সামাজিক প্রশ্নে দুর্বল গদাধর একদিন রাণিকে নাকি চড় মেরে বসেন। নিজের পয়সায় তৈরি মন্দিরে নিজের আয়োজনে প্রতিষ্ঠিত দেবীমূর্তির সামনে বসে একজন অর্থবান মহিলা মনে মনে কি ভাবছেন, তা লক্ষ্য করা বা অনুধাবন করা অনুগৃহীত ব‍্যক্তির সাজে না। লোকাচারে তা গৃহীত নয়। তবুও গদাধর তা করলেন, এবং রাণির গালে চড় মারলেন।

স্রেফ একজন ভণ্ড প্রতারক অর্থলোভী সুযোগসন্ধানী ধর্মব‍্যবসায়ীর পক্ষে এমন আচরণ অভাবনীয়। গদাধর চট্টোপাধ্যায় বেশ ফন্দি করে কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন, এ অসম্ভব। কেননা কাছেই রাণির ব‍্যক্তিগত দেহরক্ষীরা ছিল। সামান‍্য পূজারী ব্রাহ্মণ হয়ে রাণিকে গালে চড় মারার মতো ঘটনা কখনোই তারা নীরবে হজম করত না। বাস্তবে করেও নি। হিসেব করে এই রিস্ক নেওয়া সম্ভব ছিল না। নিছক একজন ফন্দিবাজ প্রবঞ্চক এর পরবর্তী ঘটনাক্রম অনুমান করে কিছুতেই চড় মারার ঝুঁকি নিতে পারত না। রক্ষীরা ফুঁসে উঠেছিল। রাণি তাদেরকে নিবৃত্ত করেন। দূরদর্শী রাণি কি গদাধরের অসামান্য সরলতা কিছুটা আন্দাজ করতে না পারলে, বিষয়টিকে এভাবে হালকা করে দিতেন? ক্ষমতাবান কি তাই করে?

গদাধরের সব চাইতে বড় আবিষ্কার নরেন্দ্র দত্ত। নরেন্দ্র জন্মেছিলেন ১৮৬৩ তে। অর্থাৎ গদাধর বয়সে সাতাশ বছরের বড়। নরেন্দ্র বিএ পরীক্ষায় তেমন দেখনসই রকমের ভাল রেজাল্ট না করলেও মানুষ হিসেবে যে অত‍্যন্ত মেধাবী ও বিচক্ষণ ছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অজস্র বাধা বিপত্তি টপকে আমেরিকা যেতে পারা, আর যাবার জন্য দুর্দম প্রচেষ্টা ব‍্যক্তি নরেন্দ্র দত্তের গোত্রটি চিনিয়ে দেয়। নরেন্দ্র দত্তের আস্থা অর্জন করাকে গদাধর পাখির চোখ করেছিলেন। বলেছেন আমাকে বেশ করে বাজিয়ে নাও।

এই যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত থাকা, তা বলতে পারা, বড় সোজা জিনিস নয়। পুত্রতুল‍্য নরেন সমাধিস্থ হয়ে নিজের মুক্তি চেয়েছিলেন। ভাববাদীদের এ এক বিকার। নিজের মুক্তি বলে যে কিছু হয় না, আর ধ‍্যান করারও যে কোনো অর্থ নেই, সে আজ অনেকেই জানেন‌। নরেন্দ্র দত্তের এই আকুতিকে গদাধর ঘুরিয়ে দেন জনহিতকর ব্রতের প্রতি। বিবেকানন্দ স্বামী হয়ে পড়ে জনহিতকর ব্রত বলতে নরেন্দ্র বাস্তবে কি বুঝতেন জানি না, তবে বাংলাভূমির বিপ্লবীদের মধ‍্যে বিবেকানন্দের বিরাট প্রভাব ছিল। ব‍্যক্তিকেন্দ্রিক মুক্তি আকাঙ্ক্ষা , মুমুক্ষুত্ব প্রার্থনার বদলে দেশ ও দশের আশ্রয়স্থল হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে গদাধর নিজেকে অনেক ধরা ছোঁয়ার মধ‍্যে এনে দেন।

গদাধরকে তাঁর স্ত্রী নিশ্চয়ই নররূপী ভগবান মনে করতেন না। যদি সারদা দেবী তাই করতেন, তাহলে অসুস্থ স্বামীর সুস্থতা প্রার্থনায় আর পাঁচটা গরিব বাড়ির বৌয়ের মতো তারকেশ্বরে হত‍্যা দিতে যেতে পারতেন না। আর পাঁচটা বাঙালি যেভাবে আর কাউকে না পারলে নিজের বৌয়ের কাছে নিজেকে বিরাট ব‍্যক্তি হিসেবে জাহির করে, গদাধর অন্ততঃ তা করতেন না। সারদা দেবীর সামনে  গদাধর নিশ্চিতভাবেই নিজেকে অবতার বরিষ্ঠায় বলে প্রতিপন্ন করেন নি। করলে কি সারদা দেবী তারকেশ্বর ছুটতেন?

নাস্তিক মানুষ হিসেবে আমি দৈবী ক্ষমতায় বিশ্বাস করি না। অলৌকিক বলে কিছু হয় বলে মানি না। যারা অলৌকিকতার গপ্প ফাঁদে, তাদেরকে প্রতিক্রিয়াশীল মনে করি। কিন্তু সাধারণ মানুষ ধর্মীয় ব‍্যক্তিত্বের কাছে কিছু অলৌকিক ক্ষমতা আশা করে। ভক্তরা তাদের গুরুর অলৌকিক ক্ষমতার গালগল্প প্রচার করে পয়সা পিটতে পছন্দ করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ভারতীয় এই গুরুটি সিদ্ধাই বা অলৌকিক ক্ষমতা বিষয়টিকে রীতিমতো ঘৃণা করতেন। এবং সেটা প্রকাশ‍্যে।

হাল আমলের ভারতীয় গুরুদের প্রতিভাই আলাদা রকমের। প্রচুর পরিমাণে অর্থ ও ভূ সম্পত্তি সংগ্রহে তাঁদের পটুত্ব প্রশ্নাতীত। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ নিঃস্ব অবস্থায় মরেছেন। কর্কট রোগের জ্বালায় দারুণ কষ্ট পেতে পেতে মরেছেন। খেতে পারতেন না। অথচ ভীষণভাবে বাঁচতে চাইতেন। এই তীব্র জীবনাকাঙক্ষা জিনিসটা তাঁকে আমার কাছে নবজাগরণের স্মরণীয় মানুষ করে দিয়েছে। ম‍্যাজিক করে আকাশ থেকে বিভূতি আনেননি তিনি। বড় সড় আশ্রম করে যেতে পারেননি। প্রাণতুল‍্য শিষ‍্যদের থাকার জায়গা দেয় নি কেউ। পরনের কাপড় পর্যন্ত জুটত না। কৌপীনবন্ত হয়ে থাকতে হত। ডাক্তারবাবু শেষ দেখা দেখে গেলেন।  ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার। দশটা টাকা দান করে গেলেন। এই মনীষীর একটা ছবি তুলে রাখবেন। মর্ত‍্য মানবের প্রতি আরেকজন মরণশীল মানুষের সহমর্মিতা।


Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.