আমার শৈশবের বর্ষা
পিনাকী চৌধুরী
শৈশবের সারল্য কখনও ভোলা যায় না! আর আমার শৈশবের সেইসব সাদা কালো দিনগুলোতে ভবিষ্যতের কোনো চিন্তা ছিল না, বর্তমানের আনন্দেই মাতোয়ারা প্রাণ ! বিশেষ করে ফেলে আসা অতীতের সেইসব দিনে বর্ষা হাজির হতেই যেন আমার মধ্যে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটতো ! খিদিরপুরের সেই আটপৌরে অনিশ্চয়তার একান্নবর্তী পরিবারে তখন অর্থের আতিশয্য হয়তো ছিল না, কিন্তু দেখতাম বেশ একটা আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করতো। পরিবারের প্রবীণ ব্যক্তিরা সংসার আলো করে থাকতেন! বাড়ির সামনে জল জমলেই কাগজের নৌকা তৈরি করে ভাসিয়ে দিতাম ! খিদিরপুরের অনতিদূরেই রেসকোর্স ময়দানে মাঝেমধ্যেই তখন বৃষ্টিস্নাত বিকেলে গিয়ে হাজির হতাম পিন্টু দা'র সঙ্গে ! বর্ষার জলে সিক্ত মাটির সোঁদা গন্ধটা যেন আজও আমাকে উদ্বেলিত করে ! গত শতাব্দীর '৭০ 'এর শেষ কিম্বা '৮০-র দশকের কলকাতা কিন্তু এখনকার মতো ছিল না !
রাস্তাঘাটে যানবাহনের সংখ্যাও ছিল তুলনায় কম ! আমার কল্পনাবিলাসী মনটা যেন সেই বৃষ্টিস্নাত সবুজের সমারোহ দেখে যারপরনাই বিস্মিত হত ! পড়াশোনাটা তেমন একটা পছন্দ করতাম না ! বর্ষায় সারাদিন কাকভেজা হয়ে ভিজে মণিলাল ব্যানার্জি রোডের রাস্তায় দাপিয়ে ফুটবল খেলতাম ! আমাদের বাড়ির উল্টোদিকেই ছিল একটি মেস ! কোনো এক বর্ষার বিকেলে আমি তারস্বরে রেডিও চালিয়ে দিয়ে মোহনবাগান এবং সোনালী শিবিরের খেলার ধারাবিবরণী শুনছি , এমনসময়ে মেস থেকে একজন চিৎকার করে আমাকে বললেন " মোহনবাগান ক'গোল দিয়েছে রে?" আমাদের বাড়ির কিছুটা পাশেই খিদিরপুর ৭৪ পল্লীর বিখ্যাত সেই পুজো ! সেইসময় আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহেই বৃষ্টিভেজা দিনেই দেখতাম খুঁটি পোঁতা হচ্ছে ! তখন কিন্তু সর্বপ্রথম বাঁশ নয় , খুঁটি পুঁতে , তারপর ধীরে ধীরে প্যান্ডেল নির্মাণ করা হত! আর সেই মন্ডপ নির্মাণ দেখতে প্রায় প্রতিদিনই আমি সেখানে গিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম ! মনে মনে ভাবতাম, পুজো তো প্রায় এসেই গেছে ! মনে আছে , একবার রথযাত্রার সময় সন্ধ্যা বেলায় বাড়ির বড়রা বলেছিলেন " রথ আজ হয়ে গেল, তার মানে হাতে রইলো আর তিন মাস !" তদানীন্তন সময়ে শ্রাবণ মাস অতিক্রান্ত হলেই যেন চারিদিকেই একটা পুজো পুজো ভাব দেখা দিতো ! যদিও ভাদ্র মাসেও বৃষ্টি হয় , কিন্তু তবুও মাঝেমধ্যেই শরৎ কালের নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত সাদা মেঘের ভেলা দেখে আমার মনটা আনন্দে নেচে উঠতো ! বাড়ির সামনে একটি শিউলি গাছ ছিল, রোজ সকালে দেখতাম অনাদরে অবহেলায় পড়ে রয়েছে শিউলি ফুল ! আর সেই শিউলি ফুলের অনন্যসাধারণ সুবাস যেন আমার মনকে নাড়া দিতো ! আমাদের পরিবারে ভাদ্র মাসের শেষে অরন্ধন পালিত হত! মানে পান্তা ভাত আর ইলিশ মাছ খাওয়ায় দিন ! পরিবারের সবাই মিলে বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতাম সেইসব বাশি রান্না !
শৈশবের সেই আটপৌরে বাড়ির ছাদ দিয়ে চুঁইয়ে জল পড়তো বর্ষাকালে! আমার কিন্তু কোনোরকম হেলদোল ছিল না তখন ! মাঝেমধ্যেই ড্রয়িং খাতাটি খুলে ' একটি গ্রামের দৃশ্য' অথবা ' বর্ষার জলছবি' তখন আঁকতে বসে যেতাম ! বর্ষার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কটা যেন সম্পৃক্ত ! বয়ঃসন্ধিকালে এক বর্ষার দিনেই পাড়ার একটি মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিলাম ! যদিও পরবর্তীসময়ে বুঝেছিলাম যে , সেটা ছিল ইনফ্যাচুয়েশন ! প্রেম করতে গিয়ে বারে বারে অপ্রেমের দ্বারস্থ হয়েছি ! তবে বদবুদ্ধির অভাব ছিল না আমার ! শৈশবে আমি কচুরি খেতে খুবই ভালোবাসতাম ! মনে আছে , একবার বাড়ি থেকে পাঁঠার মাংস কিনে আনতে টাকা দিয়েছিলেন পরিবারের এক বয়ঃজেষ্ঠ ! আর আমি ৬০০ গ্রামের জায়গায় ৫০০ গ্রাম পাঁঠার মাংস কিনে বাকি টাকা দিয়ে কচুরি কিনে লুকিয়ে গোগ্রাসে খেয়েছিলাম ! আজও বর্ষা এলে আমার মন চায় শৈশবের সেই সোনালী দিনগুলোতে ফিরে যেতে ! কিন্তু হারিয়ে গেছে আমার সেই ড্রয়িং খাতা!
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন